২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২। ইডেন পার্ক, অকল্যান্ড।
পঞ্চম বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি দুই প্রতিবেশী, যৌথ আয়োজক, স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। বিশ্বকাপ সমাপনী মঞ্চ, মানে ফাইনাল হবে অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহাসিক মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। যৌথ আয়োজনের সুবাদে সূচনা মঞ্চের সাজানোর ভার ন্যস্ত হলো নিউজিল্যান্ডের ঘাড়ে। অকল্যান্ডের সুবিখ্যাত ইডেন পার্কের সুযোগ হলো ইতিহাসের অংশ হওয়ার।
ইতিহাস খুঁড়ে সেদিনের টুকরো চিত্র তুলে আনতেই আজকের এই খনন প্রচেষ্টা।
১
ছবির মতো সুন্দর দেশ নিউজিল্যান্ড। চারপাশের প্রাকৃতিক সবুজ আর নৈসর্গিক পরিবেশে পুরো দেশটি পরিবেষ্টিত। তাসমান পাড়ের সবুজে ঘেরা দেশটির কিছু কিছু দ্বীপে দেখা মেলে একদল বিরল প্রজাতির পাখির, নাম কিউই। এরা দিনে বেরোয় না, বেরোয় সূর্যাস্তের পর। শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট দেশটির প্রতীক হিসেবেও এই পাখিগুলোকে চিত্রায়িত করা হয়। ওদের পাগুলো বেশ মোটা আর মজবুত। প্রয়োজন হলে খুব দ্রুত দৌঁড়াতেও পারে ওরা।
১৯৯২ বিশ্বকাপের নিউজিল্যান্ড দলের সঙ্গে অনেকাংশেই আপনি মিল খুঁজে বের করতে পারেন কিউই পাখির।
দলটাকে অনেকে অভিহিত করেন ‘১১টি চতুর পাখি’ নামে। আর সেই এগারোর সবচেয়ে চতুর পাখিটি নিঃসন্দেহে মার্টিন ক্রো। তাদের দলনায়ক, যিনি সামনে থেকে নেতৃত্বই দেননি শুধু, উদ্ভাবনী নেতৃত্বের অনুপম প্রদর্শনীতে পুরো ক্রিকেটবিশ্বকে মুগ্ধ করে ফেলেছিলেন সহজাত বৈশিষ্ট্যে। যে দলটিকে কেউ তেমন গোনাতেই ধরেনি, যে দলটিকে কেউ আলোচনার আসরে দেয়নি স্থান, সেই দলটিই যে সেই বিশ্বকাপের পুরোটা জুড়ে থাকবে- তা কে ভেবেছিল?
২
স্বাগতিক দর্শকদের মুখে চওড়া হাসি এনে টস জিতলেন মার্টিন ক্রো, নিলেন ব্যাটিং। কিন্তু হাসিটা ম্লান হতে সময় লাগেনি মোটেই। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। আগের আসরেই তারা এশিয়া থেকে শিরোপা জিতে এসেছে, এবার নিজেদের উঠোনে, চেনা-জানা পরিবেশে তাদের চেয়ে হট ফেভারিট আর কে?
টসে হারলেও ম্যাচের দখল নিতে তাই একটুও সময় নিল না তারা। প্রথম বৈধ ডেলিভারিতে ফিরলেন জন রাইট। সে বিশ্বকাপের আরেক সারপ্রাইজ, ক্রোর আরেক চমক মার্ক গ্রেটব্যাচ খেলেননি সেই ম্যাচ, যাকে পরের ম্যাচগুলোয় ব্যবহার করা হয়েছিল পিঞ্চ হিটার হিসেবে, ১৫ ওভারের ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতার ফায়দা তুলতে। রাইটের পর ফিরলেন অ্যাণ্ড্রু জোন্সও। স্কোর বোর্ডে তখন মাত্র ১৩, ক্রিজে এলেন অধিনায়ক মার্টিন ক্রো। খানিকবাদে ক্রোকে রেখে ফিরলেন রড লাথামও। স্কোর বোর্ডের ৫৩/৩ দেখে ক্রোর মনে কী ভাবনা চলছিল তখন কে জানে! ক্রোকে সঙ্গ দিতে এবার এলেন কেন রাদারফোর্ড।
চতুর্থ উইকেটে দুজনে মিলে যোগ করলেন ১১৮ রান, মোটামুটি এই জুটিতেই ম্যাচ থেকে অনেকটা ছিটকে গেল অস্ট্রেলিয়া। অধিনায়কের অপরাজিত ঠিক ১০০-তে ঠেস দিয়ে নিউজিল্যান্ড দাঁড় করালো ২৪৮ রানের ফাইটিং টোটাল। ১১টি চারে সাজানো ক্রোর ইনিংসটিকে আপনি এই ২৪৮ রানের ‘স্থপতি’ বলতে পারেন।
ক্রো আসলে ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা ক্রিকেটার। ক্রিকেট উদ্যানে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। তার ক্ষুরধার মস্তিষ্ক থেকে বেরোনো অভিনব সব সিদ্ধান্ত তখন তো তাক লাগিয়েছিলই, আজকের আধুনিক ক্রিকেটেও হতবাক হতে হয় তখনকার তার চাতুর্য আর চমৎকারিত্বে।
৩
দীপক প্যাটেল। জন্মেছিলেন কেনিয়ায়। টেস্ট খেলবেন বলে ওরচেস্টারশায়ার থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডে। খেলেছেন অকল্যান্ডের হয়েও। মিডল অর্ডারে খেলতেন, সেট হয়েও আউট হয়ে যেতেন ক্ষণিকের অমনোযোগীতায়। ৯৯ রানে আউট হয়ে একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরিটিও পাননি। সেই তাকে মার্টিন ক্রো ব্যবহার করলেন অদ্ভুত আর বিচিত্র উপায়ে।
প্রথম ১৫ ওভারের ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশনে তার অফস্পিনকে ব্যবহার করা হলো ব্যাটসম্যান আটকে রাখার অস্ত্র হিসেবে। এবং সফলও হয়ে গেলেন তিনি। প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়াকে চেপে ধরলেন একদম। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডারের উইকেটসহ সেই ম্যাচে ১০ ওভারে দিলেন মাত্র ৩৬ রান। শুরুর সফল অভিযাত্রার ফলস্বরুপ পরের ম্যাচগুলোতেও তার ‘রোল’ হয়ে গেল সেটাই।
একজন দ্রুতগতির বোলারের পরিবর্তে নতুন বল হাতে বোলিং করছেন একজন অফ স্পিনার- ক্রোর চমকের মাত্র শুরু ছিল সেটা। এরপর পুরো টিমকে রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য বানিয়ে তো মহা হুলস্থুলই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।
৪
স্যার রিচার্ড হ্যাডলির বিদায়ের পর ফাস্ট বোলার উঠে আসছিল না সেভাবে। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে তখন সত্যিকারের পেসারের বড্ড অভাব। অভাবের সেই দুর্দিনে পেসারের সেই আকালে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট হাঁটলো মজুদ অস্ত্রেই শক্তি মেনেই। যা নেই তা ভেবে আর কী হবে? বরং যা আছে তা নিয়েই সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেই হয়।
সেই সময়ের নিউজিল্যান্ডের উইকেট ছিল খানিকটা নীচু আর ধীরগতির। সুতরাং মাত্র দুজন জেনুইন পেসার- ক্রিস কেয়ার্নস আর ড্যানি মরিসনের সঙ্গে চার-চারজন মিডিয়াম পেসার নিয়ে বিশ্বমঞ্চের অভিযানে যাত্রী হলো তারা।
গ্যাভিন লারসেন, ক্রিস হ্যারিস, উইলি ওয়াটসন ও রড ল্যাথাম- চারজন স্লো-মিডিয়াম পেসার।
ডিবলি-ডবলি-ওবলি-উইবলি।
বলা হয়ে থাকে, এই চতুষ্টয়ের জেন্টল মিডিয়াম পেস বোলিং দেখে সেই বিশ্বকাপের কোনো এক ম্যাচে সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার আর ক্রিকেট-পরবর্তী সময়ে মাইক্রোফোনের জনপ্রিয় কন্ঠ বনে যাওয়া ডেভিড ‘বাম্বল’ লয়েড নাকি বলে উঠেছিলেন, ডিবলি-ডবলি-ওবলি-উইবলি।
কে কোনজন সেটা অবশ্য আর ভেঙে বলেননি ব্রিটিশ ভদ্রলোক। ওয়াটসনকে ভক্তরা উইবলি নামে জানতেন, ওবলি হতে পারেন ল্যাথাম। হ্যারিস আর লারসেনদের একজন ডিবলি আর অন্যজন ডবলি হবেন হয়তো।
ওয়াটসন-ল্যাথাম তখন প্রায় শেষের পথে। বিশ্বকাপের পর তাই ওবলি-উইবলির পাঠ চুকে গেলেও রয়ে যান ডিবলি-ডবলি, লারসেন আর হ্যারিস।
১০০-১২০ কিলোমিটারের আশেপাশে লাইন-লেংথ ঠিক রেখে ব্যাটসম্যানকে বেঁধে রাখার চেষ্টা। জেন্টল মিডিয়াম পেসের সাথে হালকা সুইং, মুভমেন্ট বা বাড়তি বাউন্স; নির্দিষ্ট পয়েন্টে ফিল্ডার রেখে সেই বরাবর বল করে যাওয়া, ব্যাটসম্যান ঝুঁকি নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না ঠিক, তবে খুব বেশি অপ্রস্তুতও হবেন না। ডিবলি-ডবলিদের মূল কাজই হচ্ছে ব্যাটসম্যানকে বড় শট খেলতে না দেয়া, সিঙ্গেল, ডট বা ডাবল পর্যন্ত ঠিক আছে; কিন্তু বড় শটে যেন যেতে না পারে কিছুতেই!
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচটাতে ডিবলি-ডবলি-ওবলি-উইবলি মিলে ৩৪.১ ওভারে ১৩৯ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। ইকোনমি রেট মাত্র ৪.০৭। উইকেট পেয়েছিলেন প্রত্যেকেই। লারসেন ৩টি, আর বাকি প্রত্যেকেই ১টি করে।
আজকাল আর তেমন দেখা মেলে না ওদের। ওবলি-উইবলি তো নেই-ই, তেমন একটা নেই ডিবলি-ডবলিও। কিউই পাখির মতো ওরাও বুঝি বিরল প্রজাতি!
৫
টিকটিক করে ঘড়ির সময় ফুরিয়ে আসে। দিন, রাত, সপ্তাহ, মাস, বছর ঘুরে বহু বছর হয়ে গেছে। চৌকস ক্রিকেটারদের কুশলী দলপতি মার্টিন ক্রো পৃথিবী ছেড়েছেন, একাদশের অনেকেই জীবন সায়াহ্নে এখন প্রহর গুণছেন শেষের। আরো অনেকটা সময় অতিবাহিত হলে, শেষ হয়ে গেলে বুদ্ধিমান একাদশটির সকলের প্রহর গোনা, তখনও হয়তো আলোচনায় থাকবেন তারা। স্মরণে, স্মৃতিতে অমলিন হয়ে ঠিক আলোচনার আসরে আসবেন তারা। দখল করে নেবেন ক্রিকেট আলোচনার আনন্দঘন কিছু সময়।
সীমিত সামর্থ্য, সাধারণ প্রতিভাও ব্যবহারের চাতুর্য্যে কেমন অসাধারণ আর ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে তার আদর্শ উপমা হতে পারে এই একাদশ। কুশলী নেতৃত্বের সঙ্গে সঙ্গীদের বুদ্ধিমত্তা, অটুট মনোবল, আর সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দেয়ার নিবেদন মিললে ঘাটতিগুলো ঢেকে দিয়ে কেমন অপ্রতিরোধ্য আর নমস্য হতে পারে কোনো দল- তার সার্থক উদাহারণ হিসেবেও নেয়া যায় দলটিকে।
কতটা নমস্য আর বরণীয় ছিল দলটা?
আর সব পরিসংখ্যান বাদ দিন। এই যে এতটা সময় পর এখনও তাদের নিয়ে লেখা হয়, বলা হয়, আলোচনা হয়, তাদের দাপট আর প্রতাপের এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে? হ্যাঁ, দলটির প্রতি অনেকের মোহান্ধতা, বিভ্রম বা ঘোর কিংবা মোহগ্রস্থতা থাকা বিচিত্র নয়। তবে তেমন বাড়াবাড়ি আকর্ষণ জাগাতেও তো শক্তপোক্ত আর আকর্ষণীয় হতে হয়।
এক্ষেত্রে বলা যায় যে, দলটির আকর্ষণীয় হওয়ার দারুণ ক্ষমতা ছিল। তাই একঝাঁক চৌকস ক্রিকেটারে সাজানো দলটির অনুরক্তিতে মুগ্ধতাই থাকে কেবল, আশ্চর্য নয়!