টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হয়ে গিয়েছে। এরই মধ্যে অ্যাশেজে চমক দেখিয়েছে ইংল্যান্ড। মূলত এই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের উপর নির্ভর করবে র্যাংকিং থেকে শুরু করে বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া পর্যন্ত; সবকিছু। সেই ধারাবাহিকতায় পিছিয়ে নেয় বাংলাদেশও। অন্যান্যদের মতো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ এই ক্রিকেটশক্তিও বড় পরিকল্পনা নিয়েই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দিকে এগোচ্ছে। কয়েক বছর ধরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই মিশনে বাংলাদেশের প্রথম প্রতিপক্ষ হতে যাচ্ছে ভারত। নভেম্বরে সেই সফরের আগে নিজের ‘ঝালিয়ে’ নিতে কদিন পরই মুখোমুখি হতে যাচ্ছে আফগানিস্তানের বিপক্ষে, টেস্ট খেলতে।
দলের ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে সদস্যরা পর্যন্ত; প্রত্যেকেই বিশেষ গুরুত্বের সাথে নিজেদের টেস্ট নিয়ে পরিকল্পনা করছে। এর মূল কারণ হলো র্যাংকিংয়ের ৯ নম্বরে থাকা বাংলাদেশ সাদা পোশাকে খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় না। সে কারণে এই ফরম্যাটে নিজেদেরকে এখনও পুরোপুরি দাঁড়িয়ে উঠতে পারেনি। আর একই কারণে এই টুর্নামেন্টে তাদের ঝুঁকিও অনেক বেশি। বাংলাদেশ দলের ‘টেস্ট ব্যাটসম্যান’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ব্যাটসম্যান মুমিনুল হকও গুরুত্ব দিচ্ছেন টেস্টের নতুন এই নিয়মে। তবে দলের জন্য এই ব্যাপারটিকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবেই দেখছেন ৩৫ টেস্টে ৮ সেঞ্চুরি ও ১৫ হাফ সেঞ্চুরির সাথে ২৫৫৮ রান ও বল হাতে ৪ উইকেট নেওয়া বাঁহাতি এই ক্রিকেটার।
তার মতে, ২০০০ সাল থেকে টেস্ট ক্রিকেট শুরু করা বাংলাদেশ দল সাদা বলে রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে নিয়মিত ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়ে যেমন শক্তিশালী হতে পেরেছে, তেমনই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের কারণে বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। সেই ধারাবাহিকতায় নিজেদের আরও বেশি প্রমাণ করার সুযোগ থাকবে দলটির সামনে।
এরই মধ্যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্টকে সামনে রেখে অনুশীলন শুরু হয়েছে। মূলত টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপকে মাথায় রেখেই আফগানিস্তানের বিপক্ষেও জোর প্রস্তুতি চলছে। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সেই অনুশীলনের মাঝেই মুমিনুল বলেন,
আমি মনে করি, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ আমাদের সবার জন্য ভালো হয়েছে। আর ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে, আমি খুবই খুশি হয়েছি এই ধরনের উদ্যোগে, যেহেতু আমরা সাধারণত টেস্ট ক্রিকেটকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে পারি না।
মুমিনুলের ব্যক্তিগতভাবে খুশি হতে পারার আরও একটি কারণ হলো, যত বেশি টেস্ট ততবেশি তার মাঠে থাকার সুযোগ। দেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হলেও রঙিন পোশাকে একরকম অবহেলিত মুমিনুল। তবে টেস্টে তিনি নির্বাচকদের ‘অটোমেটিক চয়েস’। তাই টেস্ট ক্রিকেট হলেই কেবল আন্তর্জাতি ক্রিকেট খেলার সুযোগ বাড়ে তার। এর চেয়েও বড় কথা টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ হওয়ার কারণে বেশি টেস্ট খেলার সুযোগ হবে বাংলাদেশের। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৬টি টেস্ট খেলা হয়েছে বাংলাদেশের। যেখানে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে আগামী দেড় বছরেই ১৫টি টেস্ট খেলার সুযোগ পাচ্ছে সেই একই দলটি। এশিয়ার দল হিসেবে এটি অনেক বড় প্রাপ্তি বলেই মনে করা হচ্ছে।
টেস্টে বাংলাদেশ দলের ‘স্পেশালিষ্ট’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মুমিনুল বলেছেন,
আমরা যত বেশি টেস্ট খেলতে পারবো, ততই ভালো পারফর্ম করতে পারবো। যা একটা দল হিসেবে আমাদের র্যাংকিংকে আরও উপরে নিয়ে যাবে। বেশি টেস্ট খেলা আমার জন্য অনেক ইতিবাচক ব্যাপার। টেস্ট ম্যাচ খেলার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশ শক্ত থাকতে হয়। যেহেতু আমি শুধুই টেস্ট ক্রিকেট খেলছি, আমি নিজেকে সেভাবেই তৈরি করেছি। আশা করি এগুলো আমার জন্য তেমন কোনো সমস্যা হবে না।
নভেম্বরে ভারত সফরের মধ্যে দিয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু করবে বাংলাদেশ। সেখানে অনুষ্ঠিত হবে দুটি টেস্ট ম্যাচ। সেই সফরের আগে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠে একটি মাত্র টেস্ট সত্যিকার অর্থেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দেখতে চাইছেন মুমিনুল।
বলেছেন,
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার আগে আফগানিস্তানের বিপক্ষে এই টেস্ট খেলা আমাদের জন্য ভালো সুযোগ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলতে গিয়ে অনেক বেশি স্পিন সামলাতে হবে আমাদের যা ভারতের বিপক্ষে সুফল দেবে। সবকিছু ভেবেই এগোতে হচ্ছে, কারণ আমরা জানি উপমহাদেশের কন্ডিশনে ভারতীয় স্পিনাররা বেশ বিপদজনক।
খাতা-কলমে ঘরের মাঠে বাংলাদেশের টেস্ট পরিসংখ্যান খুব একটা খারাপ নয়। তবে বিদেশে পরিসংখ্যানটা একেবারেই নড়বড়ে। এখন পর্যন্ত গেল সাড়ে চার বছরে ১১ ম্যাচে কেবল একটি ম্যাচে সফরকারী দেশ হিসেবে টেস্ট জিতেছে বাংলাদেশ। এমন অবস্থায় র্যাংকিংয়ের উপরের দিকে থাকা শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে ভালো করাটা খুব সহজ কথা নয় বলেই মনে করছেন মুমিনুল হক।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘এ’ দলের হয়ে ভারত সফরের কথা উল্লেখ করে মুমিনুল বলেছেন,
‘কদিন আগেই ভারত থেকে ফিরেছি। সেখানে একাধিক তিনদিনের ও চারদিনের ম্যাচ খেলেছি আমরা। শুরুটা কঠিন হলেও, যখন আপনি নিয়মিত একটা নির্দিষ্ট ফরম্যাটে খেলবেন, তখন আপনার জন্য মানিয়ে নেওয়াটা সহজ হবে। আমার কাছে মনে হয় টেস্ট ক্রিকেট এমন একটি ফরম্যাট যেখানে আপনি যদি কঠিন মনে করেন, তাহলে কঠিন। সহজ মনে করলে সহজ। অর্থাৎ, সবকিছুই নির্ভর করে আপনি কীভাবে ফরম্যাটকে দেখছেন সেটার উপরে।’
টেস্ট ক্রিকেট বাদ দিলে, ২০১২ সালের পর থেকে মুমিনুল ক্রিকেটের ছোট ফরম্যাটে একরকম উপেক্ষিতই থেকেছেন। কখনও কোচ, কখনও বা ম্যানেজমেন্ট; মুমিনুলকে রঙিন পোশাকে তাদের তালিকায় রাখেননি। যদিও শুরুটা হয়েছিল সাবেক লঙ্কান কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহের হাত ধরেই। অথচ, এই মুমিনুলের শট খেলার ব্যকারণ মুগ্ধ করবে যে কাউকে। তবে সেসব নিয়ে ভাবতে চাননি মুমিনুল। যেটা খেলছেন, নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েই বোধ হয় এগিয়ে যাচ্ছেন সেই ফরম্যাটে।
কোচ প্রসঙ্গে মুমিনুল বলেছেন,
টেকনিক্যাল কোনো কিছু নিয়ে আমার সাথে কোচের কথা হয় নাই। আমরা কেবল পরিচিত হয়েছি। নতুন কোচ হিসেবে আনুষ্ঠানিকতা আর কী।
টেস্টের বাইরে জাতীয় দলে খুব বেশি উপস্থিত থাকার সুযোগ না হওয়ায় মুমিনুলের অনুশীলনটা হয়ে থাকে কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের কাছে। তার কাছ থেকে পাওয়া টোটকা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগিয়ে নিজেকে এখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভালো অবস্থানে রেখেছেন মুমিনুল।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
এমন নয় যে আমি তার (মোহাম্মদ সালাউদ্দিন) সবগুলো উপদেশই মেনে চলতে পারি। এমনটা নয়। তিনি আমাকে অনেক কিছু করতে বলেন, কিন্তু আমি সেটা করি যেটা আমার দরকার। আমার যদি পছন্দ হয়, আমি সেটা করি। ব্যাপারটা এমন। আশা করছি সবকিছু ভালোভাবেই হবে।
শেষবার ২০১৮ সালের শেষদিকে রঙিন পোশাকে মাঠে নেমেছিলেন মুমিনুল। কিন্তু নিজেকে সেভাবে প্রমাণ করতে পারেননি। ফলাফল হিসেবে, বিশ্বকাপে সুযোগ হয়নি তার। তো সেই ধারাবাহিকতায় লঙ্গার ভার্সনেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে চান মুমিনুল। তবে রঙিন পোশাকে আপাতত আসন্ন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) দিয়ে আবার ফেরার প্রত্যয় তার,
ঠিক বিপিএল নয়, ওটা আরও পরে। তবে হ্যাঁ, বিপিএলে ভালো কিছু করতে চাই। এই মুহূর্তে টেস্ট ক্রিকেটে মাঠে নামার জন্য মুখিয়ে আছি। নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে আপনাকে নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে। সে কারণেই আমি বাড়তি অনুশীলন করছি। আমি যদি টেস্টে ভালো গড় করতে পারি, যদি বিপিএলে ভালো করতে পারি তাহলেই কেবল আমি ভালো একটা সুযোগের (ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি) অপেক্ষায় থাকতে পারবো।
তবে শেষ পর্যন্ত কী হবে তা বলা কষ্টের। মুমিনুল বরাবরই সাদা পোশাকে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। পরিচিত পেয়েছেন দেশের ‘ব্র্যাডম্যান’ হিসেবেও। এক্ষেত্রে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে তিনিই হবেন বাংলাদেশ দলের তুরুপের তাস।