অবিসংবাদিতভাবে জার্মান ফুটবলের সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় ক্লাব হচ্ছে বায়ার্ন মিউনিখ। শুধু জার্মানি নয়, ইউরোপেরই অন্যতম প্রভাবশালী ক্লাব এই বায়ার্ন। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্লাবটির সুবিশাল সমর্থক গোষ্ঠী। এমনকি খোদ বাংলাদেশেই আছে বায়ার্নের অফিসিয়াল ফ্যান গ্রুপ। চলুন জেনে আসা যাক বায়ার্ন মিউনিখ সম্পর্কে কিছু চমকপ্রদ তথ্য।
অতুলনীয় সাফল্য
বর্তমানে বায়ার্নের সাফল্য যেকোনো ক্লাবের জন্য ঈর্ষণীয় হলেও ক্লাবটির শুরুটা ছিল খুবই সাদামাটা। ক্লাবটির জন্ম ১৯০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, মিউনিখ সিটি সেন্টারের রেস্টুরেন্ট গিসেলাতে। মাত্র ১৭ জন ব্যক্তির দলিল স্বাক্ষরের মাধ্যমে জন্ম হয়েছিল এই জার্মান জায়ান্টের। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফ্রানৎস জন নামের এক জার্মান ফটোগ্রাফার, যিনি বায়ার্নের প্রথম ক্লাব প্রেসিডেন্ট।
বুন্দেসলিগার উদ্ভব হয় ১৯৬৩ সালে। মজার ব্যপার হচ্ছে, এই প্রথম বুন্দেসলিগাতে বায়ার্ন মিউনিখকে খেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কারণ তখন বায়ার্ন নয়, বরং মিউনিখের আরেকটি ক্লাব ‘১৮৬০ মিউনিখ’ ছিল শহরের সবচেয়ে প্রতাপশালী ক্লাব। মোট ১৬টি ক্লাব নিয়ে জন্ম নেওয়া বুন্দেসলিগার প্রথমে নিয়ম ছিল কোনো শহর থেকে একের বেশি ক্লাব অংশ নিতে পারবে না। আর তাই জার্মানির সবচেয়ে সাফল্যময় ক্লাবের স্থান হয়নি বুন্দেসলিগার প্রথম আসরে।
দুই মৌসুম পরে প্রমোশন পেয়ে বায়ার্ন যোগ দেয় বুন্দেসলিগাতে। ক্লাবটিকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। রেকর্ডসংখ্যক ২৭টি বুন্দেসলিগা শিরোপা ও ১৮টি ডিএফবি পোকাল কাপ নিয়ে বায়ার্ন অবিসংবাদিতভাবে জার্মান ফুটবলের সবচেয়ে সেরা ক্লাব। লিগ জয়ের দিক দিয়ে বায়ার্নের কাছে আছে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড ও বরুসিয়া মুনশেনগ্লাডবাখ, যারা প্রত্যেকে মাত্র পাঁচবার লিগ জিততে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে প্রধান ক্লাব শিরোপা ডিএফবি পোকালের দিক দিয়ে বায়ার্নের নিকটাত্মীয় এসভি ভের্ডার ব্রেমেন, যারা মাত্র ৬ বার এই শিরোপা জিতেছে।
বায়ার্নই জার্মানির একমাত্র ফুটবল ক্লাব যারা ট্রেবল জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছে। ২০১২-১৩ মৌসুমে তৎকালীন ম্যানেজার জাপ হেইঙ্কেসের নেতৃত্বে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বরুসিয়া ডর্টমুন্ডকে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে হারিয়ে তারা একই মৌসুমে প্রধান ৩ ক্লাব শিরোপা (বুন্দেসলিগা, ডিএফবি পোকাল ও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ) জয়ের গৌরব অর্জন করে। ক্লাবটি সর্বমোট ৫ বার জয় করেছে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। শুধুমাত্র রিয়াল মাদ্রিদ (১৩ বার) ও এসি মিলান (৭ বার) বায়ার্নের থেকে বেশি বার ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের এই লড়াই জিততে সক্ষম হয়েছে।
তরুণ প্রতিভার আঁতুড়ঘর
বর্তমানে বায়ার্নের অর্থনৈতিক কাঠামো যেকোনো ক্লাবের জন্য আদর্শ হলেও একসময় ক্লাবটির এমন সুসময় ছিল না। অর্থনৈতিক দৈন্যতায় জর্জরিত হয়ে ক্লাবটি একসময় সিদ্ধান্ত নেয় দামী তারকা কেনার বদলে তরুণ খেলোয়াড় গড়ে তোলার, যাদের হাতেই থাকবে বায়ার্নের ভবিষ্যৎ। আর এই প্রকল্প থেকেই বের হয়ে আসেন ক্লাবটির ‘সোনালি ত্রয়ী’ হিসেবে পরিচিত তিন বিশ্বমানের ফুটবলার জার্ড মুলার, সেপ মেইয়ার ও ফ্রানৎস বেকেনবাওয়ার।
বায়ার্ন এই মুহূর্তে বিশ্বের চতুর্থ ধনী ফুটবল ক্লাব। কিন্তু নিজেদের তরুণ ফুটবলার গড়ে তোলার প্রকল্প থেকে তারা এখনো সরে আসেনি। থমাস মুলার, ম্যাটস হামেলস, টনি ক্রুস, বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগার, ডেভিড আলাবা- বর্তমান এই তারকা ফুটবলারদের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে বায়ার্নের একাডেমি থেকে। বিশ্বকাপ জয়ী ডিফেন্ডার ফিলিপ লামের সারা জীবন কেটেছে বায়ার্ন মিউনিখেই। মাত্র ১১ বছর বয়সে ক্লাবে যোগ দেওয়া এই ফুটবলার যখন অবসর নেন, ততদিনে তিনি বায়ার্নের হয়ে খেলে ফেলেছেন মোট ৫১৭টি ম্যাচ!
ফ্রানৎস বেকেনবাওয়ার “দ্যার কাইজার”
জার্মান কিংবদন্তি বেকেনবাওয়ার ছিলেন নিজের সময়ের চেয়ে ঢের অগ্রগামী একজন ডিফেন্ডার। ‘সুইপার’ নামক নতুন এক ফুটবল পজিশনকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে তার ছিল অসামান্য অবদান। শুধু রক্ষণভাগ নয়, নিজের অসামান্য পাসিং দক্ষতা ও গোল করার অদম্য ক্ষুধার বদৌলতে তিনি ছিলেন প্রতিপক্ষের কাছে এক মূর্তিমান আতংক।
অথচ এই ফ্রানৎস বেকেনবাওয়ার তার শুরুর জীবনে ছিলেন বায়ার্নের প্রতিদ্বন্দ্বী ‘১৮৬০ মিউনিখ’-এর একনিষ্ঠ সমর্থক। ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ‘এসসি মিউনিখ ভন ১৯০৬’ নামের এক ক্লাবে, সেন্টার ফরওয়ার্ড হিসেবে। এই ক্লাব যখন দেউলিয়া হবার সম্মুখীন, তখন তিনি এবং তার সব ক্লাব সতীর্থ সিদ্ধান্ত নেন ১৮৬০ মিউনিখে যোগ দেবার।
কিন্তু নিউবিবার্গে এক অনূর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্ট তার এই সিদ্ধান্ত পাল্টে দেয়। এই টুর্নামেন্টের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল তার নিজ দল ‘এসসি মিউনিখ ভন ১৯০৬’ ও ‘১৮৬০ মিউনিখ’। ম্যাচে রীতিমতো রক্তারক্তি সংঘর্ষ হয় দুই ক্লাবের ফুটবলারদের মধ্যে। রাগে-ক্ষোভে বেকেনবাওয়ার তখন ১৮৬০ মিউনিখের বদলে যোগ দেন বায়ার্ন মিউনিখে।
বাকিটা ইতিহাস। বায়ার্নের হয়ে তিনি জিতেছেন চারটি বুন্দেসলিগা ও চারটি ডিএফবি পোকাল শিরোপা। শুধু তা-ই নয়, তার অধিনায়কত্বে বায়ার্ন ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে জিতে নেয় টানা তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমান উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ) শিরোপা। কাগজে কলমে একজন ডিফেন্ডার হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭২ সালে তিনি ব্যালন ডি’অর লাভ করেন, যা আজকের যুগে কল্পনাও করা যায় না।
তার নামের প্রথমাংশ ‘ফ্রানৎস’ মনে করিয়ে দেয় পুরনো অস্ট্রিয়ান সম্রাটদের কথা। আর তাই বায়ার্ন সমর্থকরা বেকেনবাওয়ারের ডাকনাম দিয়েছেন “দ্যার কাইজার” বা “দ্য এম্পেরর”।
সুবিশাল সমর্থক গোষ্ঠী
বায়ার্ন মিউনিখের সাথে তাদের সমর্থকদের সম্পর্ক ঠিক অন্য দশটা ক্লাবের মতো নয়। বায়ার্নের মতে, সমর্থকরাই তাদের ক্লাবের হৃদয়। সমর্থকরা বায়ার্নের কাছে ম্যাচের দ্বাদশ ফুটবলার। আর তাই এই সমর্থকদেরকে উদ্দেশ্য করেই বায়ার্ন তাদের ১২ নাম্বার জার্সি উৎসর্গ করেছে তাদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য।
বায়ার্নের রয়েছে প্রায় ২,৯০,০০০ অফিসিয়াল ক্লাব সমর্থক, যা ১০ বছরে বেড়েছে দ্বিগুণ। অফিসিয়াল সমর্থক সংখ্যার দিক দিয়ে কোনো ইউরোপিয়ান ক্লাব এই জার্মান জায়ান্টের ধারেকাছেও নেই। জার্মান ক্লাবগুলোর মধ্যে শালকে ও বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের রয়েছে ১৫০,০০০ অফিসিয়াল সমর্থক, যা বায়ার্নের প্রায় অর্ধেক। সোশাল মিডিয়া সাইট টুইটার, ফেইসবুক ও ইন্সটাগ্রামে বায়ার্নের রয়েছে ৬৫ মিলিয়নেরও বেশি ফলোয়ার। জার্মানির দ্বিতীয় জনপ্রিয় ক্লাব বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের সে তুলনায় আছে মাত্র ২৪ মিলিয়ন ফলোয়ার।
আর এই বিশাল সংখ্যক সমর্থক থাকার পিছনে এক বিশাল কারণ হচ্ছে টিকেটের মূল্য নির্ধারণে কর্তৃপক্ষের উদার মনোভাব। এত জনপ্রিয় একটি ক্লাব হওয়া সত্ত্বেও বায়ার্নের সিজন টিকেট পাওয়া যায় মাত্র ১৪০ ইউরোতে, যা দিয়ে আপনি প্রতি মৌসুমে অ্যালিয়েন্স এরিনাতে অনুষ্ঠিত ১৭টি হোম লিগ ম্যাচের সবগুলোই উপভোগ করতে পারবেন।
বিয়ার উৎসব, অক্টোবর ফেস্টিভ্যাল
মিউনিখ শহর বিখ্যাত তাদের ‘অক্টোবর বিয়ার ফেস্ট’ নামক এক উৎসবের জন্য। প্রতি বছর প্রায় ৭ মিলিয়ন লিটার বিয়ার পান করা হয় এই উৎসবে। মেলা ও বিয়ার উৎসব ছাড়াও থাকে নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, যেখানে বিশ্বের বড় বড় সেলিব্রিটিরা পারফর্ম করে থাকেন। সারা বিশ্ব থেকে প্রায় ৭ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকেন, যার ফলে এই ‘অক্টোবর ফেস্ট’ বিশ্বের সবচেয়ে বড় লোকউৎসব হিসেবে পরিচিত। আর বায়ার্নের ফুটবলাররাও এই উৎসবের সাথে একাত্মতা দেখিয়ে প্রতি বছরই অক্টোবর ফেস্টিভ্যালে সরাসরি অংশ নিয়ে থাকেন।
আপাতদৃষ্টিতে বায়ার্নের ফুটবলারদের এই ঠাসা সময়সূচীর মধ্যে বিয়ার ফেস্টিভ্যালে অংশ নেয়া অহেতুক মনে হতে পারে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোনো অদ্ভুত কারণে এত বিয়ার পান সত্ত্বেও বায়ার্ন মিউনিখের পারফরম্যান্সে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না। টানা ৮ মৌসুম জুড়ে অক্টোবর ফেস্টিভ্যালের সময়কার ম্যাচে বায়ার্ন মিউনিখ জিতে আসছে। এখন পর্যন্ত এই উৎসবের সময় অনুষ্ঠিত মোট ৯০টি ম্যাচের মধ্যে ৫৯টিতেই জিতেছে তারা। এমনকি বর্তমান সময়কার অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার রবার্ট লেভানডস্কি ভলফসবুর্গের বিপক্ষে একই ম্যাচে ৫ গোল করেছিলেন ২০১৫ সালের অক্টোবর ফেস্টিভ্যালের সময়েই। যেন বাভারিয়ান বিয়ারের ভরে বায়ার্নের ফুটবলাররা আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন।
বায়ার্ন মিউনিখের এই সাফল্য একদিনে আসেনি। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে আজকের এক বিশাল মহীরূহে পরিণত হবার পেছনে রয়েছে বায়ার্নের বহু ফুটবলার ও সমর্থকদের ত্যাগ-তিতিক্ষা। এর বদৌলতেই আজ মানুষ জার্মান ফুটবল বলতে বায়ার্ন মিউনিখকেই বুঝে থাকে।
Featured Image Credit: amazingpict.com