শুরুর আগে চলুন বছর পাঁচেক পেছনের ইতিহাসে ফেরা যাক। ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিলের ঘটনা। সেদিন বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশটি ছিল শ্রীলঙ্কা। দেশটির ক্রিকেট দল, তাদের সমর্থক, সবাই ফেটে পড়েছিলো বাঁধভাঙা উল্লাসে। কারণ, সেই দিনটি ছিল ক্রিকেট পরাক্রমশালী ভারতকে হারিয়ে আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জেতার দিন। যে জয়টা এনেছিলো শ্রীলঙ্কা জাতীয় ক্রিকেট দল।
কিন্তু সেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যদি এখনকার শ্রীলঙ্কার অবস্থার তুলনা করা যায়? মনে হবে সাজানো চিত্রনাট্য, মনে হবে সোনালী অতীতের দেয়ালে বাঁধানো একটি ছবিমাত্র। সুদিন হারিয়েছে ১৯৯৬ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা, হারিয়েছে দারুণ একটি দল; যা তাদের ক্রিকেটীয় সাফল্যের মধ্যগগণের সূর্যকে টেনে নামিয়েছে অস্তাচলে।
চলমান ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের অবস্থা এককথায় যাচ্ছেতাই। ভারতের বিপক্ষে নাকানিচুবানি খাওয়ার পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো এশিয়ার অন্যতম এই ক্রিকেট পরাশক্তি। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ব্যর্থতায় কাটা কলাগাছের মতো ভূপাতিত হলো পুরো দলসমেত। প্রথম টেস্টে অজিদের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কা হেরেছে ৩৬৬ রানের পাহাড়সমান ব্যবধানে। দ্বিতীয় টেস্টের অবস্থাও সঙ্গিন, ইনিংস ও ৪০ রানের ব্যবধানে হার।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গেল এক বছরে শ্রীলঙ্কার অবস্থা কেমন ছিল? একটু দেখে নেওয়া যাক। দলটি এই সময়ের মধ্যে টেস্ট ম্যাচ খেলেছে ১৩টি। জিতেছে চার ম্যাচে, হার ছয়টিতে, ড্র হয়েছে তিনটি টেস্ট ম্যাচ। জয়-পরাজয়ের হিসাব ০.৬৬৬; যা অস্ট্রেলিয়া (০.৫০০; ১১ ম্যাচের তিনটিতে জয়) ও পাকিস্তানের (০.৬৬৬; ১১ ম্যাচে চারটিতে জয়) চেয়ে ভালো। শতাংশ বাদ দিয়ে ম্যাচের হিসেবে তারপরও শ্রীলঙ্কা এই দৌড়ে পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে থাকবে। শ্রীলঙ্কার এমন হারের পেছনে দু’টি কারণ থাকতে পারে। ব্যাটসম্যানদের অস্থিরতা, অর্থাৎ দায়িত্ব নিয়ে খেলতে না পারা, এবং গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ‘দলবদ্ধভাবে’ হাল ছেড়ে দেওয়া।
ওয়ানডের অবস্থা আরও খারাপ। একই সময়ে শ্রীলঙ্কা জাতীয় ক্রিকেট দল ১৪টি ওডিআই ম্যাচ খেলেছে, যেখানে জয় এসেছে মাত্র তিন ম্যাচে। টেস্টখেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে একদিনের এই ফরম্যাটে শ্রীলঙ্কার চেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে কেবলমাত্র অস্ট্রেলিয়া। ওয়ানডেতে লঙ্কানদের জয়-পরাজয়ের অনুপাত ছিল ০.২৭২, সেখানে অজিদের ০.২২২। হিসেবের খাতা বলছে, আফগানিস্তানও গেল এক বছরে শ্রীলঙ্কার চেয়ে ওয়ানডেতে ভালো করেছে। লঙ্কানরা যেখানে প্রতি উইকেটে ২৮ রান পেয়েছে, সেখানে আফগানিস্তান পেয়েছে ৩২ রান।
অধিনায়ক নিয়ে ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ খেলা
শেষ এক বছরে শ্রীলঙ্কার টেস্ট অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন দু’জন, ওয়ানডের দায়িত্ব পেয়েছেন তিনজন এবং টি-টোয়েন্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন চারজন অধিনায়ক! অধিনায়ক নিয়ে এমন মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা দলের সদস্যদের মধ্যে অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে, নেতৃত্বহীনতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে, এবং সর্বোপরি একটি দল হিসেবে খেলার পথে বারবার বাঁধা হয়েছে। কারণ একজন নিয়মিত অধিনায়ক তার দলকে অনুপ্রাণিত করেন, মেধা মূল্যায়নের সুযোগ দেন। কিন্তু নেতৃত্ব নিয়েই যখন শঙ্কা তৈরি হয়, তখন খেলার ফলাফল নিয়ে বেশি ভাবতে হয় অধিনায়ককে। একটি ‘দল’ তৈরি হয় না।
নজর বেশি কোচের বেতনে
দলের সেরা ক্রিকেটাররা যখন একের পর এক ইনজুরিতে পড়ে মাঠ ছাড়ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে দলে নতুন অস্থিরতা হিসেবে আগমন কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহের।
শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের হয়ে ২৬ টেস্ট, ৩৫টি ওয়ানডে খেলা সাবেক এই ক্রিকেটার বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দারুণ সফল ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় তাকে শ্রীলঙ্কা দলের দায়িত্বে নেওয়া হয় চড়া বেতনে, যদিও সেই বেতনটা বাংলাদেশের চেয়ে ‘একটু’ কম। কিন্তু শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডের হিসেবে হাতুরুসিংহেকে যে অর্থ দিতে হচ্ছে, সেটাও এক কথায় ‘চোখ কপালে তোলা’র মতো।
কিন্তু এত অর্থ খরচ করে যাকে কোচের দায়িত্ব দেওয়া হলো, তিনি কি দলের সেই হারানো দিন ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন? উত্তরটা হলো, ‘না’। এমনকি বাংলাদেশে তিনি নির্বাচক প্যানেলের সদস্য ছিলেন। শ্রীলঙ্কা দলেও তাকে সেই সম্মান দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু তার ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে ক’দিন আগে সেই ক্ষমতা উঠিয়ে নিয়েছে লঙ্কান বোর্ড।
এক বিবৃতিতে বোর্ড বলেছে,
‘দল যখন বিদেশে সফর করবে, তখন একাদশ তৈরি হবে কেবলমাত্র টিম ম্যানেজার ও অধিনায়কের পরামর্শে বোর্ডের কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী।’
এত কিছুর মধ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, যে হাতুরুসিংহের সঙ্গে ৩৬ মাসের চুক্তি করেছিলো বোর্ড, তা হয়তো দুর্ভাগ্যবশত সময়ের আগেই শেষ হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ, চাকরি হারাচ্ছেন হাতুরুসিংহে।
রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি
কেবলই ক্রিকেটীয় পারফরম্যান্স কিংবা দলীয় বিভেদীকরণ নয়, শ্রীলঙ্কা দলের এমন বাজে অবস্থার পিছনে বোর্ডেরও দায় কম নয়। সাবেক ক্রিকেটার ও নির্বাচক প্রমোদা বিক্রমাসিংহের বিরুদ্ধে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ উঠেছে। তিনি যে সত্যিই দোষী সেই দাবি তুলে এক পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন ৪০ জন শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটার, যার মধ্যে জাতীয় দলের টেস্ট অধিনায়ক দীনেশ চান্দিমালও রয়েছেন। পুরো ব্যাপারটা আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিট (আকসু) কর্তৃক তদন্তাধীন রয়েছে।
অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে দেশটির কিংবদন্তি সাবেক ক্রিকেটার, অধিনায়ক ও নির্বাচক সনাৎ জয়সুরিয়ার বিপক্ষেও। গেল বছরের অক্টোবরে বিক্রমাসিংহের বিরুদ্ধে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগের তদন্তকালীন সময়ে জয়সুরিয়া আকসুকে সাহায্য করছেন না বলে অভিযোগ ওঠে।
এছাড়া সাবেক বোলার ও বোলিং কোচ নুয়ান জয়সার বিরুদ্ধে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ আসে। সাম্প্রতিক সময়ে দুবাইতে আইসিসির বৈঠকে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট কমিটিকে ‘করাপ্ট ফ্রম টপ টু বটম’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
বোর্ডের দুর্নীতি বের করে আনতে ক্রিকেটারদের সাহায্যও নিচ্ছে আইসিসি। তারা ১৫ দিনের একটি কার্যক্রম চালিয়েছে, যা শেষ হয়েছে গত ৩১ জানুয়ারি। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে বোর্ডের বিভিন্ন দুর্নীতির ব্যাপারে ক্রিকেটারদের জানাতে বলা হয়েছে।
অর্থাৎ, সবকিছু মিলিয়েই ১৯৯৬ বিশ্বকাপজয়ী দল পুরো ক্রিকেট দুনিয়ায় দুর্নাম কুড়াচ্ছে, যা সত্যিকার অর্থেই তাদের অতীতের সাফল্যের সুখস্মৃতিকে ম্লান করে দিচ্ছে।
এত কিছুর মধ্যে ক্রিকেটার ও দলের সাপোর্টিং স্টাফদের জন্য আসল কাজ, অর্থাৎ ক্রিকেট খেলাটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমান ধারাভাষ্যকার রাসেল আরনল্ড বলেছেন,
‘তারা সবাই মানুষ। এমনকি আমরা যারা দলের বাইরে আছি, তারাও সবকিছু শুনে খানিকটা স্নায়ু দুর্বলতায় ভুগছি। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট এখন খুব কঠিন সময় পার করছে। দলের সমর্থক, নীতিনির্ধারক ও ক্রিকেটার – সবাই। সবাইকে একসঙ্গে হয়েই এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দলের পাশে সমর্থকদের থাকতে হবে। নীতিনির্ধারক যারা আছেন, তাদেরকে তাদের কাজটা করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের দূরদর্শিতা প্রমাণ করাটা খুব জরুরি। এছাড়া ক্রিকেটার, কোচ সবাই মিলে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের সোনালী অতীত থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে।’