ঠিক যেন রেসিপি মেনে জয়!

বাংলাদেশ ইংল্যান্ড তাহলে এখন সমান সমান?

পড়তে এসে শুরুতেই কি একটু ধন্দে পড়ে গেলেন? এক দল টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, অন্য দল দুশ্চিন্তায় ভুগছে দল দাঁড় করতেই – এই তথ্য জানা থাকার কারণে লেখকের ওপর ঈষৎ বিরক্তও?

অবশ্য লেখকেরই বা দোষ কী বলুন! প্রায় দেড় যুগের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি যাত্রায় বাংলাদেশ কেবল দ্বিতীয়বারের মতো মুখোমুখি হলো ইংল্যান্ডের। প্রথম ম্যাচটা ইংলিশরা জিতলেও চট্টগ্রামে দ্বিতীয় মোকাবেলায় জয়ী দল বাংলাদেশ, দু’দল এখন সমানই তো!

Image credit: Prothom Alo

যে ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ হয়ে গেল ইংল্যান্ডের বরাবর, ম্যাচটাও কী মনে রাখার মতো! ব্যাটিং-ইনিংসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনে হলো, ‘এখন বাংলাদেশকে হারাতে পারে কেবল বাংলাদেশই।’ নামে-ভারে বড় দলগুলোর বিপক্ষে এমন দোর্দণ্ড প্রতাপে বাংলাদেশ শেষ কবে জিতেছে, উত্তর করতে গেলে মাথা আপনাকে চুলকোতে হবেই।

রোর বাংলা খুঁজে দেখতে চেয়েছে, কী নীলনকশায় আঁকা হলো এই স্মরণীয় জয়ের ছবি:

ডেথ বোলিংয়ে বাজিমাত, অন্তত একদিন

চট্টগ্রামের উইকেট ধীরগতির, ইংলিশ ক্রিকেটারদের এমন উইকেটে খেলার অভিজ্ঞতাও কিছু কম বিবেচনায় নিয়েই কি না ম্যাচ শুরুর আগে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনাই বেশি দেখছিল ক্রিকইনফো। তবে, জস বাটলারের ক্যাচ মিস আর প্রথম ১০ ওভারে ইংল্যান্ড মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে ৮০ রান তোলার পরে ইংল্যান্ডের জয়ের সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল বেশি। পরে যখন ফিফটি তুলে বাটলারও উইকেটে জমে গেলেন, ইনিংসের ১৫তম ওভার হতে হতে ইংল্যান্ডের জয়ের সম্ভাবনা পৌঁছে গেছিল ৬৭ শতাংশতে।

হাসানের ডেথ বোলিংটা প্রশংসা করতেই হবে। Image credit: Prothom Alo

ইনিংসের শুরুতে উইকেট না নিতে পারাটা বাংলাদেশকে ভোগাচ্ছে লম্বা সময় ধরেই। পরপর হওয়া দুটো বিশ্বকাপের মাঝের সময়টায় যে ১৬ ইনিংসে বল করেছে বাংলাদেশ, সেখানে প্রথম ১৬ ওভারে তারা উইকেট তুলতে পেরেছিল গড়ে ৩.৫৬টি। আদতে এই উইকেট না তুলতে পারার ডমিনো ইফেক্টটাই টের পাওয়া যাচ্ছিল ইনিংসের শেষাংশে। ইনিংসের মাঝে কিংবা শেষে বাংলাদেশকে খুঁজে পেতে হতো তলানির দিকে।

তবে, গতকাল দেখা গেল ডেথ বোলিং দিয়ে ম্যাচে ফেরার বিরলদৃষ্ট উদাহরণ। শেষ চার ওভারে মাত্র ২১ রান হজম করলেন বাংলাদেশি পেসাররা। এর মাঝে হাসান মাহমুদের প্রশংসা করতে হবে আলাদা করে। ১৭ নম্বর ওভারের প্রথম বলেই বাটলারকে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে ম্যাচ জয়ের জন্য ফেভারিট করে তুললেন আরও একবার, পরের ১১ বলে হজম করলেন মাত্র ৫ রান।

পাওয়ারপ্লেতে যে শুরুটা দরকার

সাধারণ ধারণা বলে, ১৫৭ রানের লক্ষ্যটা মামুলিই। তবে বাংলাদেশের জন্য এমন রানগুলোও যে পাহাড়সমানই, তার প্রমাণ এই পরিসংখ্যান: ১৪০-১৫৯ লক্ষ্য নিয়ে এর আগে যে ১৭ ম্যাচে ব্যাট করতে নেমেছে বাংলাদেশ, এর ১০টিতে হারতে হয়েছে তাদের। বাংলাদেশের জন্য এই মধ্যম মানের রান তাড়া করার তরিকাটাও গোলকধাঁধাই এখনো।

১০ বলে ১২ রান। খুব বেশি হয়তো নয়, তবে এই দিনে যথেষ্ট। Image credit: Getty Images

এমন মাঝারি মানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ইনিংসের সূচনা হতে পারে দু’রকমের।

  1. পাওয়ারপ্লেটা দেখে কাটিয়ে দিয়ে একটা ভিত্তি গড়া। বাংলাদেশ যে কাজটা করতে চেষ্টা করত বেশির ভাগ দিন। উদাহরণ হতে পারে, ২০১০ সালের ব্রিজটাউন কিংবা ২০২১-এর আল আমিরাত। সমস্যা হচ্ছিল, শুরুর ধীর-স্থিরতা পুষিয়ে দিতে শেষে যে টর্নেডো তুলতে হতো, বাংলাদেশ মার খেয়ে যাচ্ছিল এখানে।
  2. ভিন্ন একটা রাস্তা হতে পারত ইনিংসের শুরু থেকেই আক্রমণে উঠে যাওয়া। যেন খেলা শেষের রোমাঞ্চে গড়ানোর আগেই মেরে ফেলা যায় উত্তেজনা। গতকাল বাংলাদেশ ঢুকে দেখতে চাইল ওই রাস্তাতেই। এবং, রত্নের সন্ধানও মিলল।

ইনিংসের প্রথম ওভারেই এলো ১০ রান। পরের দুই ওভারেও স্কোরিং রেট ছুঁলো দুই অঙ্ক। প্রায় আট বছর পর দলে ফেরা রনি তালুকদারের ব্যাটেই আত্মবিশ্বাসের ঝলক দেখা গেল বেশি। তিনি আউট হলেন ১৪ বলে ২১ করেই, ইনিংস বড় হলো না লিটন দাসেরও। তবে দু’জনে যে ২৪টা বল খেলে গেলেন, তাতে এলো ৩৩ রান। ক্রিকভিজের হিসাবে, অনুমিত রানের (এক্সপেক্টেড রান) চেয়ে ৭ রান বাড়তি।

দারুণ একটা শুরু এনে দিয়েছিলেন রনি। Image credit: Prothom Alo

১০-এর বেশি রান এলো ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারেও। কেবল পাওয়ারপ্লের স্কোরের তুলনা টানলেও বাংলাদেশ জিতে যেত ৩ রানে।

দ্য ট্র‍্যাঞ্জিশনাল ফেজ’-এ নিয়ন্ত্রণ

এমন নয় যে, পাওয়ারপ্লেতে ৫০-এর বেশি সংগ্রহ বাংলাদেশ এর আগে তোলেনি। এমনকি ‘বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাওয়ারপ্লে স্কোর’-এর তালিকায় একে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শীর্ষ ১৫-তেও। বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতল মূলতঃ মাঝের ওভারগুলোতে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ৭-১০ নম্বর ওভারে।

পাওয়ারপ্লে শেষ, পাঁচজন ফিল্ডার ছড়িয়ে পড়েছেন সীমানাদড়ি ঘেঁষে – ইনিংসের সপ্তম ওভারটা দেখে খেলার ট্রেন্ড মানে প্রায় পুরো দুনিয়াই। সাত নম্বর ওভারটাকে তাই তুলনা করা যেতে পারে ফুটবলের আক্রমণ থেকে রক্ষণ বা রক্ষণ থেকে আক্রমণে বদলানোর মুহূর্তের সঙ্গে, ইংরেজিতে যাকে বলা হচ্ছে ‘ট্রাঞ্জিশনাল ফেজ’। বাংলাদেশ এই সমস্যায় ফেঁসে যেত আরও বেশি। পাওয়ারপ্লের দুরন্ত সূচনা হুমড়ি খেয়ে পড়ত ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতা উঠে যাওয়ার পরে। ম্যাচটা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত ইনিংসের এ পর্যায়েই। আর পাওয়ারপ্লে শেষ হতে হতে ক্রিজে এসেছিলেন শান্ত, ইনিংসের মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলায় সমালোচনা ছিল তাকে ঘিরেও। 

নাজমুল হোসেন শান্ত, এবার আর কম স্ট্রাইক রেটের দায়ে দায়ী নন। Image credit: Prothom Alo

গতকালও ম্যাচের সপ্তম ওভারেই খেই হারাল একটা দল, তবে দলটার নাম বাংলাদেশ নয়। মার্ক উডের টানা চার বল সীমানাছাড়া করলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। স্মার্ট স্ট্যাটস অনুযায়ী, ম্যাচের ভাগ্যে সবচেয়ে বড় রদবদলটা ওই ওভারেই হয়েছিল। ছয় বলের মধ্যে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা বেড়েছিল ১৪.৫২ শতাংশ।

পরের তিন ওভারে তৌহিদ হৃদয় আর শান্ত মিলে তুলেছেন আরও ২৭ রান। সব মিলিয়ে, ৭-১০ নম্বর ওভারে বিনা উইকেটে বাংলাদেশ তুলেছে ৪৪ রান। এই ওভারগুলোতে বাংলাদেশের ইতিহাসেই এর চেয়ে বেশি রান তোলার তোলার উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে আর দু’টি।

প্রতিপক্ষসংগ্রহসাল
ওয়েস্ট ইন্ডিজ৫২/১২০১৮
নিউ জিল্যান্ড৪৫/০২০১৭
ইংল্যান্ড৪৪/০২০২৩
শ্রীলঙ্কা৪৩/১২০১৩
জিম্বাবুয়ে৪২/১২০১৩
৭-১০ ওভারে বাংংলাদেশের শীর্ষ ৫ সংগ্রহ

প্রথম ১০ ওভারে ৯৮ রান তোলার পরে ম্যাচ নিয়ে যাবতীয় অনিশ্চয়তার আসলে সেখানেই অবসান। পরপর ২ উইকেট পড়লেও বাকি পথটা নির্বিঘ্নেই পাড়ি দিয়েছেন আফিফের সঙ্গে মিলে সাকিব আল হাসান। ইংল্যান্ডের দেওয়া লক্ষ্য বাংলাদেশ টপকে গিয়েছিল ১২ বল বাকি থাকতেই।

২০ ওভারের ফরম্যাটটায় বাংলাদেশের অবস্থা এমনই সঙ্গীন যে, প্রতিটা সিরিজই শুরু হয় ‘নতুন কিছু হবে’র প্রত্যাশা জাগিয়ে। সিরিজ শুরুর আগে কোচদেরও শুনিয়ে যেতে হয় ‘প্রসেসটা ঠিক করতে চাই’ গান।

হাথুরুসিংহেও তাই শুনিয়েছিলেন। তবে, বাকি কোচদের সঙ্গে যা তফাৎ, তার দেখানো প্রসেসটা ঠিক হলে বাংলাদেশের চেহারা কী দাঁড়াবে, তার নমুনা প্রথম দিনেই দেখা গেল বোধ হয়।

এখন প্রভাতটা দিনের ঠিক ঠিক পূর্বাভাস দিলেই হয়।

This article is in Bangla language. This article is an ananalysis on Bangladesh's T-20 win vs England. Necessary hyperlinks and images are attached inside.

Related Articles

Exit mobile version