বিশ্বকাপে বিশ্ব কাঁপে।
বাক্যটি হয়তো বিশ্ব সংসারের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলের সঙ্গেই বেশি মানানসই। ক্রিকেট খেলার দিগন্ত এখনও হয়তো বিশ্বের সিংহভাগ ক্রীড়াপ্রেমীর হৃদয়ে ঠাঁই করে নিতে পারেনি। তবে ২২ গজে একদিবসী ক্রিকেটের এই মহাআয়োজন নিশ্চিতভাবে আন্দোলিত করে ক্রিকেট বিশ্বের অলিতে-গলিতে।
ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎসব বিশ্বকাপ। স্বপ্নাতুর চোখে, মোহাবিষ্ট হয়ে মহাযজ্ঞের এই মঞ্চে চোখ রাখেন কোটি কোটি ক্রিকেট রোমান্টিক। বিশ্বজয়ের উন্মাদনা-উত্তেজনা নিয়ে বিশ্বকাপ আসে। জন্ম দেয় নতুন সুপারস্টারের, যারা ব্যাট-বলের দ্যুতিতে রঙ ছড়ান টুর্নামেন্টে।
আসন্ন বিশ্বকাপকে ঘিরে অংশগ্রহণকারী ১০টি দেশই তাদের দল ঘোষণা করেছে। সেখানে যেমন চমক আছে, তেমনি বাদ পড়ার হতাশার গল্পও আছে। অনেক প্রতিষ্ঠিত পারফরমারই বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাননি, যাদের সামর্থ্য ছিল বিশ্বকাপে নিজেদের প্রতিভা মেলে ধরার। দুর্ভাগ্যের কোপানলে পড়ে এবার তাদের পা পড়বে না এই টুর্নামেন্টে।
সম্প্রতি খোদ আইসিসিই বিশ্বকাপের ‘দুর্ভাগা’দের দল তৈরি করেছে। সেখানে রাখা হয়নি বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটার, যদিও বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ইমরুল কায়েস ও ফাস্ট বোলার তাসকিন আহমেদের বাদ পড়া বড় আলোচনার বিষয়। আইসিসির এই দলেও নিশ্চিতভাবেই তারা ঠাঁই পেতে পারতেন।
আইসিসির দুর্ভাগাদের দলটা এমন: মোহাম্মদ রিজওয়ান (পাকিস্তান), নিরোশান ডিকওয়েলা (শ্রীলঙ্কা), ঋষভ পন্ত (ভারত), আম্বাতি রাইডু (ভারত), দীনেশ চান্দিমাল (শ্রীলঙ্কা), জোফরা আর্চার (ইংল্যান্ড), আসিফ আলী (পাকিস্তান), কিয়েরন পোলার্ড (ওয়েস্ট ইন্ডিজ), পিটার হ্যান্ডসকম্ব (অস্ট্রেলিয়া), আকিলা ধনঞ্জায়া (শ্রীলঙ্কা) ও মোহাম্মদ আমির (পাকিস্তান)।
তবে আইসিসির দলটাতে রাখা হয়েছে ১১ ক্রিকেটারকে। একাদশ চিন্তা করেই এটা করেছে বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রকসংস্থা। আমরা অবশ্য বাংলাদেশের ইমরুল-তাসকিনকে যুক্ত করেই দুর্ভাগাদের গল্পটা তুলে ধরছি।
ইমরুল কায়েস (বাংলাদেশ)
বাংলাদেশের ‘দুর্ভাগা’ ক্রিকেটার হিসেবেই তার পরিচিতি এখন বেশি। বিশ্বকাপকে পাখির চোখ করেই এগিয়েছেন ইমরুল কায়েস। কী দুর্দান্ত ব্যাটিংই না করেছেন গত বছর! জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ৩ ম্যাচে ৩৪৯ রান করেছেন, যেখানে দু’টি সেঞ্চুরি, অপরটি ৯০ রানের ইনিংস। এশিয়া কাপে হুট করে উড়ে গিয়ে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলেছেন এই অভিজ্ঞ ওপেনার। তারপরও বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে জায়গা হয়নি তার। মূলত হেড কোচ ও নির্বাচকদের ভাষায়, ওপেনিংয়ে ডানহাতি-বাঁহাতি কম্বিনেশন রাখতেই ইমরুলকে বিবেচনা করা হয়নি। তামিমের সঙ্গে লিটনকে এগিয়ে রেখেছেন তারা। তবে অভিজ্ঞতা, সাম্প্রতিক ফর্ম মিলে ইমরুল থাকতেই পারতেন বিশ্বকাপ দলে।
মোহাম্মদ রিজওয়ান (পাকিস্তান)
রিজওয়ানের বাদ পড়া অনেককেই অবাক করেছে। উইকেটকিপার হিসেবে সরফরাজের অনপুস্থিতিতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছেন তিনি। রিজওয়ান না থাকায় পাকিস্তানের বিশ্বকাপ দলেও থাকলো না কোনো বিকল্প উইকেটকিপার। ২৬ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার ৩২টি ওয়ানডেতে ৩৩.৫৭ গড়ে ৭০০ রান করেছেন। দুই বছরের বিরতি শেষে ২০১৭ সালে ফেরার পর রিজওয়ান দু’টি সেঞ্চুরি করেছেন, দু’টি সেঞ্চুরিই এই বছর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৫-০ ব্যবধানে হারা ওয়ানডে সিরিজে। উইকেটে তার সাবলীল ব্যাটিংই ছিল ওই সিরিজে স্বাগতিক পাকিস্তানের সবচেয়ে স্বস্তির জায়গা।
নিরোশান ডিকওয়েলা (শ্রীলঙ্কা)
ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজ হারের পর শ্রীলঙ্কার ওয়ানডে দলে অনেক বড় পরিবর্তন এসেছে, অনেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটারই যেখানে কাটা পড়েছেন। বিশেষ করে, নিরোশান ডিকওয়েলা। আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে অভ্যস্ত এই লঙ্কান উইকেটকিপার গত ১২ মাসে ১৫ ইনিংসে ৪৯৭ রান করেছিলেন।
ঋষভ পান্ত (ভারত)
ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সেঞ্চুরি করা প্রথম ভারতীয় উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান তিনি। টেস্টের এক ম্যাচে উইকেটের পেছনে সবচেয়ে বেশি ক্যাচ (১১) ধরার রেকর্ডেও নাম লিখিয়েছেন তিনি। সেই পান্ত বাদ পড়েছেন অনভিজ্ঞতার কারণে, যে জায়গায় ভারতের বিশ্বকাপ দলে নাম উঠেছে অভিজ্ঞ উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান দীনেশ কার্তিকের।
নির্বাচকরা ভেবেছেন, পান্ত মাত্র ২১ বছর বয়সী, অনেক সুযোগ তিনি পাবেন ভবিষ্যতে। যদিও তার বাদ পড়াটা অনেকেই অবাক করেছে।
পন্ত এখন পর্যন্ত পাঁচটি ওয়ানডে খেলেছেন। মারকাটারি ব্যাটিংয়ে সিদ্ধহস্ত এই তরুণ ২০১৬ সালে যুব বিশ্বকাপ খেলেছেন।
আম্বাতি রায়ুডু (ভারত)
সাত মাস আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজে ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলি চার নম্বর ব্যাটিং পজিশনে আম্বাতি রায়ুডুকেই সমর্থন দিয়েছিলেন, যদিও চলতি বছরের শুরুতে বিজয় শঙ্করের অভিষেক ভারতের বিশ্বকাপ পরিকল্পনায় বেশ পরিবর্তন এনে দিয়েছে। দুই বছর পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়ানডে দলে ফিরেছিলেন রায়ুডু। ফেরার পর দুর্দান্ত খেলেছেন তিনি; এই সময়ে একটি সেঞ্চুরি, চারটি হাফসেঞ্চুরি ও দু’টি চল্লিশোর্ধ্ব ইনিংস খেলেছেন। বিজয় শঙ্করকে নেয়া হলেও ভারতের ব্যাটিং অর্ডারে চার নম্বরের সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয়েছে, সেটা বলা যাবে না।
দীনেশ চান্দিমাল (শ্রীলঙ্কা)
২০১০ সালে অভিষেক হয়েছিল দিনেশ চান্দিমালের। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান ধরা হয় তাকে। ২০১৮ সালে তার ব্যাটিং গড় ছিল ৪২.৫৭, এবং দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। ভঙ্গুর অবস্থা থেকে ওই বছরের শুরুতে বাংলাদেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়ে লঙ্কানদের অধিনায়ক ছিলেন চান্দিমাল। ১৪৬ ওয়ানডে খেলেছেন তিনি, কিন্তু জায়গা হয়নি বিশ্বকাপ দলে। নিশ্চিতভাবেই শ্রীলঙ্কা মিস করবে চান্দিমালের মতো অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের সার্ভিস।
জোফরা আর্চার (ইংল্যান্ড)
ইংল্যান্ডের হয়ে এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেননি জোফরা আর্চার, যদিও ইংল্যান্ড দলের আশপাশে তার নাম ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকদিন ধরেই। সারা বিশ্বেই টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতে বেশ প্রথিতযশা বোলার তিনি। লক্ষ্যভেদী ইয়র্কার তার বোলিংকে বেশি ভয়ংকর করে তুলেছে। ২৪ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডারের জায়গা হয়নি শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ দলে, যদিও তার সুযোগ আছে নির্বাচকদের নজর কাড়ার। মে মাসে বিশ্বকাপের আগে পাকিস্তান ও আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজের ইংল্যান্ড দলে রাখা হয়েছে আর্চারকে।
আসিফ আলী (পাকিস্তান)
আক্রমণাত্মক ধাচের ব্যাটসম্যান আসিফ আলীর বাদ পড়াটা অপ্রত্যাশিত। কারণ, সম্প্রতি ব্যাটিং লাইনে পাওয়ার হিটারের অভাবের কথা সবসময় বলে আসছে পাকিস্তানের টিম ম্যানেজমেন্ট। এখন পর্যন্ত ১১ ওয়ানডে খেলেছেন, কিন্তু ২৭ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান হতে পারতেন স্লগ ওভারে পাকিস্তানের ট্রাম্পকার্ড। তাতে দলের ঘাটতিও পূরণ হয়ে যেত। তবে তাকেও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের আগে ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তান দলে রেখেছেন প্রধান নির্বাচক ইনজামাম-উল হক। তাই বিশ্বকাপের দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি আসিফ আলীর জন্য।
কাইরন পোলার্ড (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
যদিও পোলার্ড শেষবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ওয়ানডে খেলেছেন ২০১৬ সালে, তারপরও সম্প্রতি আইপিএলে বিস্ফোরক ব্যাটিংই তাকে আবার বিশ্বকাপ দলের আলোচনায় নিয়ে এসেছে। আইপিএলে ১০ ম্যাচে ২০০ রান করেছেন এই বিগ হিটার, যার মধ্যে ম্যাচজেতানো ইনিংসও ছিল। বল হাতেও তার সার্ভিস পেতে পারতো ক্যারিবিয়ানরা। বলার অপেক্ষা রাখে না বাউন্ডারি সীমানায় দুর্দান্ত এক ফিল্ডার তিনি।
বিশ্বকাপ খেলার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু নির্বাচকরা তার আগে বেছে নিয়েছেন আন্দ্রে রাসেলকে, বর্তমান সময়ে যিনি অসামান্য ফর্মে আছেন। ব্যাটিং- বোলিংয়ে রাসেল নিশ্চিতভাবেই পোলার্ডের চেয়ে ভালো ভূমিকা রাখতে পারবেন বলেই মনে করেছেন নির্বাচকরা।
পিটার হ্যান্ডসকম্ব (অস্ট্রেলিয়া)
স্টিভেন স্মিথের ফিরে আসাটাই দুর্ভাগ্য বয়ে আনল পিটার হ্যান্ডসকম্বের জন্য। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়েন এই তরুণ ব্যাটসম্যান। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান এক কথায় অসাধারণ ছন্দে। ২০১৯ সালে যে ১৩টি ম্যাচ তিনি খেলেছেন, সেখানে ৪৩.৫৪ গড়ে ৪৭৯ রান করেছেন, যেখানে একটি সেঞ্চুরি ও তিনটি হাফ সেঞ্চুরি ছিল। তিনি বাদ পড়ায় অস্ট্রেলিয়া দলেও বিকল্প উইকেটকিপারের জায়গাটা খালিই রয়ে গেল।
আকিলা দনঞ্জয়া (শ্রীলঙ্কা)
শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ দল থেকে যত নাম বাদ পড়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো আকিলা দনঞ্জয়া। গত বছর ২৩.০০ গড়ে ১৫ ইনিংসে ২৮ উইকেট নিয়েছিলেন এই স্পিনার। বলা বাহুল্য, শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী ছিলেন ওই বছর। তবে বোলিং অ্যাকশন শুধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার পর এই ‘রহস্য’ স্পিনারের কার্যকারিতা কমে গেছে কিছুটা, যার কারণেই হয়তো নির্বাচকরা বিশ্বকাপের সেরা ১৫ জনে রাখেননি আকিলা দনঞ্জয়াকে।
মোহাম্মদ আমির (পাকিস্তান)
ইংল্যান্ডে ২০১৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ে পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণের মূল অস্ত্র ছিলেন মোহাম্মদ আমির। কিন্তু তারপর থেকে ওয়ানডেতে বল হাতে ক্রমশই নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছেন এই বাঁহাতি পেসার। এপ্রিলের শুরুতে আমিরের ফর্ম নিয়ে চিন্তার কথা বলেছিলেন পাকিস্তানের বিশ্বকাপ দলের অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ। ২৭ বছর বয়সী এই পেসার শেষ ১৪ ম্যাচের নয়টিতেই উইকেটশূন্য ছিলেন, ফিটনেস ইস্যুও তার বিপক্ষে ছিল। আসিফ আলীর মতোই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৭ সদস্যের ওয়ানডে দলে আছেন আমির। আর এখানে ভালো করলে তারও বিশ্বকাপ দরজা খুলে যেতে পারে।
তাসকিন আহমেদ (বাংলাদেশ)
গত বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী (৮) ছিলেন তাসকিন আহমেদ। কিন্তু এবার বিশ্বকাপ দলে নেই এই ফাস্ট বোলার। চোটজর্জর ২০১৮ সালের পর বছরের শুরুতে বিপিএল দিয়ে দারুণ ছন্দে ফিরেছিলেন। ২২ উইকেট নিয়ে নিউজিল্যান্ড সফরের টেস্ট-ওয়ানডে দলে ডাক পেয়েছেন। কিন্তু বিপিএলের শেষ দিকে ইনজুরিতে পড়ে ছিটকে পড়েন দল থেকে। ইনজুরি কাটিয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ম্যাচ খেললেও জ্বলে উঠতে পারেননি। নির্বাচকরা মনে করেন, এখনও ফিট হতে পারেননি তাসকিন। তাই বিশ্বকাপ দলে জায়গা হয়নি এই দ্রুতগতির বোলারের। যদিও শেষ মুহূর্তে আয়ারল্যান্ড সফরে দলের সঙ্গী হচ্ছেন তিনিও। কে জানে, ভাগ্যে থাকলে হয়তো খেলেও ফেলতে পারেন বিশ্বকাপ!