কবি সুনির্মল বসু লিখেছিলেন, ‘বিশ্বজুড়ে পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র।’
কবিতার এই পংক্তিগুলোর অনুকরণে ক্রিকেটার বেনি হাওয়েল অনায়াসেই বলতে পারেন, ‘বিশ্বজুড়ে বাসস্থান আমার, আমি বিশ্ব নাগরিক!’
না, ঠিক সব দেশ না হলেও বেনির জীবনের গল্পে জড়িয়ে আছে এই ব্রহ্মাণ্ডের কয়েকটি মহাদেশ। ৩০ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডারের জন্ম শিল্প-সংস্কৃতির দেশ ফ্রান্সে। বাবা ইংলিশ, মা অস্ট্রেলিয়ান। পড়াশুনা ও বসবাস ইংল্যান্ডে। তার রয়েছে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার পাসপোর্ট। তার স্ত্রী অর্ধেক আর্জেন্টাইন, অর্ধেক মার্কিন। সব মিলিয়ে রংপুর রাইডার্সের হয়ে বিপিএলের ষষ্ঠ আসরে বেনির সঙ্গে ‘সিটিজেন অফ ওয়ার্ল্ড’ তকমাটা বেশ মানিয়ে যায়।
পরিবারের সাথে সাথে বেনির ক্রিকেটার হওয়ার গল্পও বেশ চিত্তাকর্ষক। তার বোলিং নিয়ে তার মুন্সিয়ানা এবং দক্ষতা নজর কেড়েছে এবি ডি ভিলিয়ার্সের। সিলেটে নেটে তার বোলিং খেলেই ডি ভিলিয়ার্স বলেছিলেন, ‘ভেরি স্কিলফুল বোলার।’ এমনকি আইপিএলেও বেনির নাম প্রস্তাব করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এই অধিনায়ক।
বিপিএলে খেলার ফাঁকে একান্ত আলাপচারিতায় বেসবল থেকে ক্রিকেটে আসা, পরিবার, ক্রিকেটার হিসেবে নিজের স্বপ্নসহ অনেক কিছু নিয়ে কথা বলেছেন বেনি।
‘সিটিজেন অফ ওয়ার্ল্ড’ কথাটা আপনার সাথে বেশ মানিয়ে যায়। আপনার পরিবারের সম্পর্কে জানতে চাই।
আসলে আমার মা অস্ট্রেলিয়ান, বাবা ইংলিশ। আর যখন আমি জন্ম নিয়েছি, তখন তারা ফ্রান্সে ছিলেন। আমার স্ত্রী আসলে একজন আর্জেন্টাইন। মূলত অর্ধেক আর্জেন্টাইন, অর্ধেক আমেরিকান। তাই আমাদের যে বাচ্চা আছে, সে একইসাথে আর্জেন্টাইন, আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান ও ইংলিশ (হাসি)। বিষয়টা এমনই।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জানতে পারলাম, আপনি বিপিএলের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন আর্জেন্টিনায়…
হ্যাঁ, সেখান থেকেই আমার স্ত্রী এসেছে। আমরা ক্রিসমাসটা (বড়দিন) সেখানেই কাটিয়েছি। তারা ক্রিকেট বোঝে না, তারা ফুটবলপ্রিয় জাতি। সে কারণে আমাকে হকি কিংবা ফুটবলের মাঠ খুঁজতে হয়েছে বোলিং অনুশীলনের জন্য। সে কারণে বিষয়টি বেশ মজাদার দেখাতে পারে, কিন্তু এমনটাই আমাকে করতে হয়েছে।
ফুটবলের দেশে ক্রিকেটের অনুশীলন! আর্জেন্টিনায় অনেক ফুটবল কিংবদন্তি, তারকা ফুটবলার আছেন। কারো সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে কি?
নাহ, আমার কোনো ফুটবলারের সঙ্গেই দেখা হয়নি। নিজে থেকে শুধু অনুশীলন করে গেছি। বোলিং করেছি, বিভিন্ন ধরণের বোলিং নিয়ে কাজ করেছি, এবং ক্রিকেট উইকেটে নিজস্ব বিষয়গুলো বের করে এনেছি। সে কারণে কোনো ফুটবলারের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি সেখানে।
আপনি বেসবল খেলতেন। বেসবল থেকে ক্রিকেটে আসা কীভাবে?
যখন আমেরিকায় গেছি, তখন আমি বেসবল খেলায় গেছি। সেখানেই আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার দেখা। বেসবল ম্যাচে গিয়ে আমার স্প্লিট ফিঙ্গার, নাকল বল ও কার্ভ বলগুলো মাঠে দেখে দারুণ ভাল লেগে গেছে। সে কারণে আমি সেখানে খেলে এগুলো ক্রিকেটে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
বেসবলের মেজর লিগে খেলেছেন কি?
নাহ, আমি মেজর লিগ পর্যন্ত যেতে পারিনি। কিন্তু আমি ক্লাবে বেসবল খেলেছি। আমি কিছু মাইনর ও কিছু মেজর লিগের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় টিপস (পরামর্শ) নিতাম, এবং সেসবই ক্রিকেটে কাজে লাগিয়েছি।
‘দ্য ক্রিকেটার’ ম্যাগাজিনের কাছে নাকি দাবি করেছেন, আপনি ৫০ ধরনের স্লোয়ার করতে জানেন?
তারা এর কিছুটা অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করেছে। আমার বেশ কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্য আছে। এটা মাঠের ওপর এবং কোন ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করবো, তার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আমার কিছু রসদ আছে।
অস্ট্রেলিয়ার এক সাংবাদিক আপনাকে বিশ্বের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বোলার বলে অভিহিত করেছেন। মানে মিডিয়াম পেসের সঙ্গে স্পিন…
আমি চিরাচরিত পেস বোলার নই। আমার মনে হয়, স্পিনার ও মিডিয়াম পেসারের মাঝামাঝি কেউ একজন আমি। আমি প্রায় দ্রুতগতির এক রহস্যময় বোলার, যেমন দ্রুতগতির স্পিনার আরকি!
বিভিন্ন ডেলিভারির ওপর প্রতিনিয়ত কাজ করেন………
যখন আপনি কিছু উপভোগ করবেন, তখনই সেটা সহজ হয়ে যায়।
নাকল বল সম্পর্কে জানতে চাই………..
প্রচুর অনুশীলন দরকার। আপনার বেশ পুরু আঙুলের গাঁট থাকতে হবে। যখন ক্রিকেট খেলবেন না আপনাকে নিজের রুমে, হাঁটাহাঁটির সময় বলটা পুরোটা সময়ই ধরে রাখতে হবে। গাঁটের মধ্যে আপনি বলটা ধরে রাখতে থাকবেন, গ্রিপের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন। তারপর গ্রিপে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে তখন নেটে এটাকে প্রয়োগের চেষ্টা চালাতে পারেন। অনুশীলন, আর অনুশীলন। এবং থামানো যাবেনা অনুশীলনটা। আর তারপর এটার ভাল অনুশীলন করতে পারলে এক সময় এটা আপনি আয়ত্ত্বে আনতে পারবেন।
এসব প্রয়োগ করে আপনি ইংল্যান্ডে সফল হয়েছেন। আপনার মনে হয়, ওগুলো এখানে (বাংলাদেশে) কার্যকর হবে?
অবশ্যই! যদি এটাকে ঠিকভাবে আয়ত্ত্ব করেন, কোন কন্ডিশনে আপনি খেলছেন সেটি ব্যাপার নয়। বল যাতে না ঘোরে, এটাই চাইতে হবে আপনাকে। বল ঘুরবে না, মানে বাতাসের গতিই সেটিকে চালিয়ে নেবে এবং বাতাসেই সুইং করবে। তাই কোথায় আছেন, সেটা কোনো ব্যাপারই নয়। পুরো বিষয়টাই আসলে বাতাসে (বলের) নড়াচড়া। আর অবশ্যই আপনার সঠিক লেন্থে বল ফেলা আয়ত্ত্ব করতে হবে। তাহলেই আপনি দেখবেন, ব্যাটসম্যানরা সমস্যায় পড়ছে।
‘স্ক্রু বল’ বলটা কী?
‘স্ক্রু বল’ আসলে একটা লেগ কাটারের মতো। তাই বলটি আসলে উল্টোদিকে ঘুরবে, ফাইন লেগের দিক থেকে মিড অফে। এর ফলে বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে ভাসবে। এটা বেসবলের নাম, পিচাররা এটা ব্যবহার করে। আপনি যদি এর দিকে লক্ষ্য করেন, তারা এটাকে এভাবেই এক পার্শ্বে ছুঁড়ে দেয়। এর ফলে বলটি ঘুরে ভেতরের দিকে ঢুকে পড়ে।
আর কার্ভ বলটা কেমন?
আমার মনে হয়, ডোয়াইন ব্রাভো কার্ভ বলটা করে। ভিন্ন একটি অ্যাঙ্গেল দিয়ে বলটা অনেক ওপর থেকে করতে হয়, অনেকটা স্পিনারদের মতোই।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের কারণেই এই বৈচিত্র্যগুলো কি বেশি বেশি আসছে?
হ্যাঁ, অবশ্যই। বেসবলে সবসময় তারা চেষ্টা করে রান আনার। ক্রিকেটেও তারা প্রায় একইভাবে আপনাকে ছক্কা মারতে চাইবে। আপনি যদি এটার ব্যবহার করতে পারেন, এবং ক্রিকেটে আনতে পারেন, আমার মনে হয় আপনি খুবই সফল হবেন।
আপনার কি মনে হয়, আধুনিক ক্রিকেটে অনেক বোলারকেই এর প্রয়োগে সচেষ্ট হওয়া দরকার?
করা উচিত। এখন পর্যন্ত ব্যাটসম্যানরা যেভাবে বল পেটাচ্ছে, তাতে করে বোলারদের তো সেটা আটকাতে হবে। নাহলে তারা পেছনে পড়ে থাকবে। তাদের অবশ্যই উন্নতি করতে হবে এবং আরো ভালো হয়ে উঠতে হবে। কারণ, কোন ব্যাটসম্যান কীভাবে ব্যাটিং করে, সেই অনুসারেই তাদেরকে সেই ব্যাটসম্যানকে আটকাতে হবে।
বোলিংয়ের দক্ষতার উপর আপনার অনেক দখল। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই কোচের ভূমিকায় আসতে চাইবেন?
ভবিষ্যতে অবশ্যই। এখনও আমার লম্বা পথ যাওয়া বাকি। ক্রিকেট খেলে আমি আরও অনেক কিছুই অর্জন করতে চাই। কিন্তু অবশ্যই কোচিংয়ে গিয়ে আমার দক্ষতাগুলোর নিশ্চিত প্রয়োগ ঘটানোর সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এর আগে প্রথমত আমি ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার চেষ্টা করতে চাই, এবং যতগুলো সম্ভব ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে ও আইপিএলে যতটা পারি খেলতে চাই। তাই অবশ্যই আমি নিজেই এগুলোর যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়ে পারফর্ম করতে চাই।
অনেক বছর ধরে কাউন্টি ক্রিকেট খেলছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট খেলার স্বপ্নই হয়তো দেখেন…
ইংল্যান্ডের হয়ে আমি সীমিত ওভারের ফরম্যাটে খেলতে চাই। অবশ্যই আমি এটা করবো। আমার নিজের ব্যাটিং নিয়ে কাজ করার অনেক কিছুই আছে, যতটা পারি অলরাউন্ডার হয়ে ওঠার এবং বোলিংয়ে উন্নতি করার চেষ্টা করতে হবে।
এবি ডি ভিলিয়ার্স বলেছেন, আপনি খুবই দক্ষতাসম্পন্ন বোলার। এই স্বীকৃতি কেমন লাগে? বিশেষ করে তার মতো কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের কাছ থেকে…
তিনি বলেছেন, আমি যা কিছু করি, তিনি পছন্দ করেন। আগামী বছর তিনি আমার নাম আইপিএলে দেবেন। যা করছি, সেটা আমার করে যেতে হবে এবং ব্যাটে-বলে পারফর্ম করতে হবে। হ্যাঁ, তার সঙ্গে কথা বলতে পারাটা বেশ ভালো হয়েছে।
এবারসহ তৃতীয়বার বিপিএল খেলছেন (দুইবার খুলনা, এবার রংপুর)। অভিজ্ঞতা কেমন?
আমি এটা পছন্দ করি। রংপুর দারুণ, দুর্দান্ত সেটআপ। টম মুডি পুরো বিষয়টা দারুণভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন, এবং অনেকগুলো অবিশ্বাস্য ভালো খেলোয়াড় দলটিতে আছে। এবি, গেইল, হেলস, রাইলি এবং রবি, সবাই। এটা খুবই ভালো অভিজ্ঞতা।
বিপিএল আপনার ক্যারিয়ারে কতটা প্রভাব ফেলতে পারছে?
এটা খুবই অপরিহার্য। অবশ্যই এ কারণে যে, আমি প্রথমত খেলার সুযোগ পেয়েছি এবং তারপর পারফর্মও করেছি। বিপিএল প্রচুর বিশ্বমানের খেলোয়াড় আনে। সুতরাং আপনার অনেক বিশ্বমানের খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলার সুযোগ হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের কন্ডিশনের সঙ্গেও অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইংলিশ থেকে এশিয়ার কন্ডিশনগুলোয় অনেক ভিন্নতা। অনেক মূল্যবান এটা। আর অবশ্যই টম মুুডির মতো কোচদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া আমার ক্যারিয়ারকে আরও এগিয়ে নেবে, অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিদের তাগাদা দেবে আমাকে নিতে।
অধিনায়ক মাশরাফির অধীনে খেলা কতটা উপভোগ করছেন?
ম্যাশ বেশ দারুণ। সে খুবই মজার লোক। সে অবশ্যই বড় মাপের অধিনায়ক এবং বেশ সফল। ছেলেরা তাকে ভালবাসে, সে সত্যিকারের নেতা।
শেষ প্রশ্ন। যতটা জানি, আপনি ছোট বেলা থেকেই এডিএইচডি (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার) নামক ব্যাধিতে ভুগছেন। এই রোগটা কী? কীভাবে মানিয়ে চলেন?
আমার এডিএইচডি আছে, এটা নিয়েই আমি বেড়ে উঠেছি। এটা কিছুটা বিষাদগ্রস্ততা ও আবেগপ্রবণতার মাঝামাঝি একটা ব্যাপার। বেশ ভালোভাবেই আমি আরোগ্য লাভ করছি। সবকিছু বেশ ভালোই আছে। মস্তিষ্ককে পরিষ্কার রাখার জন্য আমি প্রচুর পরিমাণে ওষুধ সেবন করেছি, এবং অনেক মেডিটেশনও করি। ঠিকমতোই যাচ্ছে সব।