প্রথম বল মাঠে গড়ানোর আগেই ২১ জন করোনা আক্রান্ত হবার খবর বেরোলেও সৌভাগ্যবশত সঠিক সময়েই শুরু হয় বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) অষ্টম আসর। আসরের একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত বিতর্ক বিপিএলের সঙ্গী হলেও মাঠের খেলায়ও উত্তাপ ছড়িয়েছে ফাইনাল পর্যন্ত। এমনকি মিরপুরের শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম দেখেছে বেশ কয়েকটি হাই-স্কোরিং ম্যাচ। কিন্তু বিপিএল আয়োজনের যে মূল লক্ষ্য, সেটা কতটা পূরণ হলো?
বিপিএল শুরুর কয়েকদিন আগে সাকিব আল হাসান জানিয়েছিলেন নিজের একটা প্রত্যাশার কথা, আসর শেষে যেন কমপক্ষে ২-৩ জন এমন ক্রিকেটার পাওয়া যায় যারা ভবিষ্যতে জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করবেন। সেই প্রত্যাশা পূরণে কতটা সফল হয়েছে এবারের বিপিএল, সেটা হয়তো ভবিষ্যৎই বলবে। তবে নিজেদের প্রথম আসরেই সামর্থ্যের জানান দিয়ে জাতীয় দলে ঢোকার দাবি জানিয়ে গেছেন অন্তত দুইজন।
প্লেয়ার্স ড্রাফটে দল না পেলেও আবাহনীর শিষ্য মুনিম শাহরিয়ারকে দলে নেন ফরচুন বরিশালের কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন। গত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ (ডিপিএল) টি২০তে আগ্রাসী ব্যাটিং করা মুনিম আসরের শুরুতে আক্রান্ত হন করোনাভাইরাসে। বরিশালও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল উদ্বোধনী জুটি নিয়ে। জেইক লিন্টট, ডোয়াইন ব্রাভোদের ইনিংস উদ্বোধন করতে পাঠানোর জুয়া কাজে লাগেনি।
শেষমেশ ক্রিস গেইল আর মুনিম শাহরিয়ারে একটা থিতু উদ্বোধনী জুটি পায় বরিশাল। বরিশাল মুনিমকে ব্যবহার করা শুরু করে ‘পাওয়ারপ্লে ম্যাক্সিমাইজার’ হিসেবে। প্রথম ছয় ওভারে ফিল্ড রেস্ট্রিকশনের সুবিধা নিয়ে যে কাজটা বাংলাদেশের বেশিরভাগ ওপেনার করতে পারেন না, আসরের শেষভাগে নিজের প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই সেই কাজটা করেছেন মুনিম শাহরিয়ার। ছয় ইনিংসে প্রায় তিরিশ গড়ে ১৭৮ রান করেছেন মুনিম, স্ট্রাইকরেটও ১৫২.১। সব বিপিএল মিলিয়ে পাওয়ারপ্লেতে কমপক্ষে ১০০ রান করা ব্যাটারদের মধ্যে বাংলাদেশের আর কেউ মুনিমের চেয়ে দ্রুত রান তুলতে পারেননি। প্রথম কোয়ালিফায়ারে দেশসেরা বোলার মোস্তাফিজুর রহমানকে শর্ট আর্ম জ্যাবে ছক্কা মারার মাধ্যমে মুনিম ভয়ডরহীন ক্রিকেটের স্বাক্ষরই রেখে গিয়েছেন। ফলাফলও পেয়ে গেছেন দ্রুতই, ডাক পেয়েছেন জাতীয় দলে; এমনকি আফগানিস্তানের বিপক্ষে অভিষেকের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
আলাদা করে বলতে হয় মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর কথাও। বিপিএল অভিষেকেই সিলেট সানরাইজার্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে দলকে জেতানো এই তরুণ বাঁহাতি পেসার মাত্র আট ম্যাচে ১৫ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর তালিকায় অবস্থান করছেন চার নম্বরে। ইকোনমি রেটটা খানিক বেশি (৯.১৪) হলেও স্লগ ওভারে বোলিংয়ে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। লিগ পর্বে মিনিস্টার ঢাকার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মাত্র আট রান ডিফেন্ড করে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সকে এনে দিয়েছেন জয়। সেই ওভারে দেশসেরা ওপেনার তামিম ইকবালকে করা ইয়র্কারটা তো আসরেরই সেরা ডেলিভারিগুলোর একটি।
এর বাইরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বাঁহাতি স্পিনার তানভীর ইসলাম আলো ছড়িয়েছেন। ১২ ম্যাচে ৭.৬৫ ইকোনমিতে তার ঝুলিতে উইকেট ১৬টি। ফাইনালে চার ওভারে ২৫ রানের বিনিময়ে দুই উইকেটের স্পেলটাও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাকিবের ফরচুন বরিশালের পেসার মেহেদী হাসান রানাও নজর কেড়েছেন। অধিকাংশ সময় ইনিংসের দ্বিতীয়ার্ধে জুটি ভাঙার জন্য তাকে ব্যবহার করেছেন সাকিব, তাতে সফল রানা। ৭ ইনিংসে ৮.২ ইকোনমিতে তার সংগ্রহ ১১ উইকেট।
দীর্ঘদিন জাতীয় দলের আশেপাশে থাকা ইয়াসির আলীরও ভালো সময় কেটেছে বিপিএলে। খুলনা টাইগার্সের হয়ে মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করে ৩১ গড়ে ২১৯ রান করেছেন ১৩৯ স্ট্রাইকরেটে। ধীর ও আক্রমণাত্মক – দু’ভাবেই খেলতে পারদর্শী ইয়াসির দুর্যোগ সামাল দেয়া বা শেষদিকে দ্রুত রান তোলা – দুটো কাজই করেছেন সমান দক্ষতায়।
শেষদিকে দ্রুত রান তোলার মতো ব্যাটারের অভাব বাংলাদেশে বহুদিনের। ক্রিজে এসেই বোলারদের উপর চড়াও হয়ে স্লগ ওভারের ফায়দা নিতে পারা ব্যাটার গত দশ বছরেও বিপিএল থেকে খুঁজে বের করতে পারেনি বাংলাদেশ। গত বছর জিম্বাবুয়ে সফরে আশার আলো দেখিয়েছিলেন শামীম হোসেন পাটোয়ারী, কিন্তু বিপিএলে তার পারফরম্যান্স যারপরনাই হতাশ করেছে। বিশেষ করে পেস বলে তার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছে প্রতিপক্ষরা। টানা ব্যর্থ হওয়ায় এক পর্যায়ে বাদও পড়েছিলেন। দলে ফিরে কিছুটা ভালো করলেও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি, ১০ ম্যাচে ১৬.৪ গড়ে ১৬৪ রান তারই প্রমাণ। স্ট্রাইকরেটটাও গড়পড়তা- ১১৭.১।
শামীমের চট্টগ্রামের সতীর্থ আফিফ হোসেনের টুর্নামেন্টটাও ভালো যায়নি। গত বছর অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ব্যাট হাতে ভালো পারফরম্যান্সের পর থেকে আর হাসেনি আফিফের ব্যাট। ১২ ম্যাচে মাত্র ১৯ গড়ে বিপিএলে আফিফের সংগ্রহ ২৩২ রান, স্ট্রাইকরেট ১১৭।
শুধু আফিফ-শামীমই নয়, গত টি২০ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে থাকা অধিকাংশ ক্রিকেটারই হতাশ করেছেন। এই তালিকায় আছেন সৌম্য সরকার, নুরুল হাসান সোহান, শরিফুল ইসলাম, নাঈম শেখের মতো ক্রিকেটাররা। নাঈম শেখের ব্যর্থতার দায় যতটা তার, ঠিক ততটাই অবশ্য মিনিস্টার ঢাকা ম্যানেজমেন্টের। জাতীয় দলে ওপেনিং করা নাঈমকে দেয়া হয়নি কোনো থিতু ব্যাটিং পজিশন, এমনকি নামাতে নামাতে নামিয়ে দেয়া হয়েছে সাত নম্বরেও। টি২০ অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ ও ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল দলে থাকার পরও নাঈমের এই অবস্থা একটা দিকেই ইঙ্গিত করে, আস্থা হারাচ্ছেন তিনি।
চরম ব্যর্থ হয়েছেন নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনাময় ব্যাটার মনে করা হয় যাকে, সেই নাজমুল হোসেন শান্ত। ফাইনালে চার ওভারে ২৭ রানের সহজ সমীকরণের পরও বরিশালের ম্যাচ হেরে যাবার পেছনে বড় দায় শান্তর, পুরো টুর্নামেন্টেও খেলতে পারেননি বলার মতো একটা ইনিংস। স্ট্রাইকরেটটাও দৃষ্টিকটু – ৯১.৭।
ব্যাট হাতে দারুণ সময় কাটানো তামিম ইকবাল টি২০ ফরম্যাট থেকে ছয় মাসের ছুটি নেয়ায় জাতীয় দলে ওপেনিং জুটির সমস্যা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গত সিরিজে বাদ পড়া লিটন দাসকে তাই আবার ফেরানো হতে পারে। প্রথম দুই ম্যাচ ছুটি নেয়া লিটন টুর্নামেন্টের শেষটায় খুব একটা ভালো না খেললেও ২৩ গড়ে, ১৩৬ স্ট্রাইকরেটে ২০৯ রান এই ফরম্যাটে খুব খারাপ নয়।
টি২০ বিশ্বকাপের দলে থাকা শেখ মেহেদী হাসানও ভালো করতে পারেননি। ওপেনিংয়ে এসে এক ইনিংসে ভালো করলেও তার প্রাথমিক ভূমিকা অর্থাৎ বোলিংয়ে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। ১১ ম্যাচে নিয়েছেন মাত্র পাঁচ উইকেট।
টি২০ অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ ছিলেন তামিমের পর মিনিস্টার ঢাকার সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। কিন্তু মিডল অর্ডারে ব্যাট করে মাত্র ১২০ স্ট্রাইকরেটটা কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলার মতো।
শর্টার ফরম্যাটে সারা বিশ্বে রিস্ট স্পিনাররা দাপট দেখালেও বাংলাদেশে এই ধরনের স্পিনারের অভাব সর্বজনবিদিত। যে দু’তিনজন আছেন, তারা সুযোগই পান না। বাংলাদেশের সবশেষ টি২০ সিরিজ খেলা লেগস্পিনার আমিনুল ইসলাম বিপ্লবকে কি না প্লেয়ার্স ড্রাফটে দলে নেয়নি কেউই, পরে মিনিস্টার ঢাকা দলে জায়গা পান তিনি। কিন্তু সেরা একাদশে জায়গা হয়নি এক ম্যাচেও। একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে ঢাকার আরেক লেগস্পিনার রিশাদ হোসেনকেও। আফগান লেগস্পিনার কায়েস আহমেদ নিয়মিত সুযোগ পেলেও দেশীয় দুই লেগস্পিনার ব্রাত্যই ছিলেন।
অন্যদিকে আরেক লেগস্পিনার জুবায়ের হোসেন লিখনকে দুই ম্যাচে সুযোগ দেয়া হলেও বলার মতো কিছু করতে পারেননি। তাই টুর্নামেন্টের মাঝেই নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন,
“দেশে মানসম্পন্ন লেগস্পিনার নেই, তাই তাদের দলে নেয়া হয় না।”
বিপিএল দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় দলে না থাকা ক্রিকেটারদের জন্যেও নিজেদের ফিরে পাওয়ার একটা প্ল্যাটফর্ম। সেটা ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন সিলেট সানরাইজার্সের এনামুল হক বিজয়। ৯ ইনিংসে ৩১ গড়ে ২৮০ রান করা বিজয় অন্তত দু’টো ম্যাচে দলকে প্রায় জয়ের বন্দরে নিয়ে গিয়েছিলেন, ব্যাটে ২৭ চারের পাশাপাশি ১২টা ছক্কা প্রমাণ করে পাওয়ার-হিটিং কোচ জুলিয়ান উডের সঙ্গে কাজ করে ভালোই ফল পেয়েছেন এই উইকেটরক্ষক।
অন্যদিকে হতাশ করেছেন সাব্বির রহমান৷ ৬ ম্যাচে ১১১ স্ট্রাইকরেটে মাত্র ১০৯ রান করা সাব্বির বাদ পড়েছেন মাঝপথেই, পারেননি আবার দলে ফেরার রাস্তা পাকা করতে।
এত অপ্রাপ্তির মাঝেও সম্ভবত এবারের বিপিএলের সেরা প্রাপ্তি ব্যাটার সাকিব আল হাসান। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার পর বিশেষ করে টি২০ ফরম্যাটে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন তিনি, আসরের প্রথমদিকেও যা ছিল অব্যাহত। কিন্তু সাকিব আসর শেষ করলেন ১১ ইনিংসে ২৮৪ রান নিয়ে, তিনবার পেরিয়েছেন অর্ধশতক। ছক্কা মেরেছেন ১৫টি, যা আসরের চতুর্থ সর্বোচ্চ। ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে টানা পাঁচ ম্যাচে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন আসরের সেরা খেলোয়াড়।
সাকিবের সেই ‘দু-তিনজন’ নতুন খেলোয়াড় পাবার প্রত্যাশা পূরণ হলেও ব্যর্থ হয়েছেন জাতীয় দলের অনেক প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার। এখনও সমাধান হয়নি ফিনিশার বা লেগস্পিনার সমস্যার। ওপেনিং সমস্যার সমাধান কতটুকু হয়েছে, সেটা হয়তো বোঝা যাবে আগামী কয়েক সিরিজে। মোস্তাফিজুর রহমান ছাড়া জাতীয় দলের কোনো পেসার নজর কাড়তে পারেননি। টুর্নামেন্টের সেরা পাঁচ ব্যাটারের চারজনই বিদেশি, সেরা স্ট্রাইকরেটধারী ব্যাটারের ক্ষেত্রেও তাই। তাই আপাতদৃষ্টিতে সফল একটা টুর্নামেন্ট আয়োজনের পরও টি২০ দলকে ঘিরে অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি এবারের বিপিএল।