বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ ফুটবলের ব্যাপারে কোনো কথা উঠলে মনের ভেতর থেকেই একটা দীর্ঘশ্বাস চলে আসে। ২০৬ টি দেশের মধ্যে ১৯৪ তম স্থানে যখন নিজের দেশ থাকে তখন দীর্ঘশ্বাস আসাটাই স্বাভাবিক। যে দেশের মানুষ ফুটবলে পাগল, বিশ্বকাপের সময়ে অন্য দেশের পতাকায় যে দেশের আকাশ সয়লাব হয়ে যায়, সেই দেশের এমন করুণ অবস্থা সত্যি মেনে নেওয়া কষ্টকর। অবস্থা এতটাই খারাপ দিকে চলে গিয়েছে যে শেষ তিন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে গ্রুপ পর্বের বাঁধাই পেরুতে পারেনি বাংলাদেশ! যে ভুটানকে আগে আগে গুণে গুণে গোল দিত বাংলাদেশ, সেই ভুটানের কাছে এশিয়া কাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ হেরে দুই বছরের জন্য আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে ছিটকে যেতে হয়েছে।
অবস্থাটা কিন্তু সবসময় এমন বিবর্ণ ছিল না। কাজী সালাহউদ্দিন, সালাম মুর্শেদী, বাদল রায়, সাব্বির, মোনেম মুন্নাদের যুগে এদেশের ফুটবলে অন্যরকম একটা আমেজ ছিল। সেই প্রজন্মের হাত ধরে ১৯৮০ সালে এশিয়া কাপের মূলপর্বে খেলেছিল বাংলাদেশ। সেই সোনালী দিনের পরেও আমাদের জাতীয় দলের পারফর্মেন্সের ছক বেশ উঁচুতেই ছিল।
এবং এর পরের প্রজন্মের হাত ধরেই, আজ থেকে ১৫ বছর আগে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সেই অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। আমাদের দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বর্ণীল সেই টুর্নামেন্টের গল্পই আজ জানব।
আসরের শুরুর গল্প
১৯৯৫ সাল থেকে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের যাত্রা শুরু হলেও বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজক হয় ২০০৩ সালে। এর আগে অনুষ্ঠেয় চার আসরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অর্জন ছিল রানার্স আপ হওয়া। তাই ঘরের মাঠে ভাল কিছু করার তাড়াটা সেবার বেশ ভালোমতোই ছিল। সেসময় দলে সেই আশির দশকের মতো অত তারকার ছড়াছড়ি ঠিক ছিল না। তবে যারা ছিল তাদের নিয়েই দল গুছিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন কোচ জর্জ কোটান। এই অস্ট্রিয়ান বাংলাদেশকে নিজের দ্বিতীয় বাড়ি মনে করতেন, তাই সেবার দলকে কিছু দেওয়ার জন্যে নিজের সবটুকু দিয়েই তিনি চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।
রক্ষণভাগ ঠিক থাকলে সাফল্য আসবে- এটাই ছিল জর্জ কোটানের বিশ্বাস। এ কারণেই সেই আসরে তিনি বাংলাদেশ দলকে ৫-৩-২ ফর্মেশনে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন। গোলবারের নিচে ছিলেন দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক আমিনুল হক। দলে তিন সেন্টারব্যাক হিসেবে নজরুল, সুজন এবং অধিনায়ক রজনী কান্ত বর্মনের মতো তিন বিশ্বস্ত সৈন্যের উপর ভরসা রেখেছিলেন তিনি।
দুই উইংব্যাক হিসেবে হাসান আল-মামুন ও পারভেজ বাবুর উপর দায়িত্ব ছিল কিছুটা বেশি। কারণ ৫-৩-২ এর বদলে বাংলাদেশ যখন ৩-৫-২ ফর্মেশনে খেলত তখন এই দুই উইংব্যাককে ওভারল্যাপ করে উপরে উঠে যেতে হতো। সেন্ট্রাল মিডের দায়িত্বে ছিলেন আরিফ খান জয় ও মতিউর মুন্না। আরমান মিয়া ছিলেন দলের প্লে-মেকার, আরমানের সৃজনশীল সব পাস বাংলাদেশের অধিকাংশ আক্রমণের উৎস ছিল। আর স্ট্রাইকার হিসেবে আলফাজের সঙ্গী ছিলেন কাঞ্চন।
সবমিলিয়ে বেশ ভারসাম্যপূর্ণ একটা দল দাঁড় করিয়েছিলেন জর্জ কোটান। এ কারণেই ঘরের মাঠে অনুষ্ঠেয় সেবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে সবার প্রত্যাশার পারদও বেশ উঁচুতে ছিল। সেই আসরে বাংলাদেশ ছিল গ্রুপ-বি তে। সেই গ্রুপে বাংলাদেশের সঙ্গী ছিল নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটান। ২০০৩ সালের ১১ জানুয়ারি টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচে নেপালের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। শক্তির বিচারে নেপালের চেয়ে এগিয়েই ছিল বাংলাদেশ তাই জয়টাই প্রত্যাশিত ছিল। সেই প্রত্যাশা পূরণের কাজটা সহজ করে দেন আলফাজ আহমেদ। ৩০ মিনিটে তার করা গোলে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। বাকিটা সময় নিজেদের রক্ষণ অক্ষুণ্ণ রাখলে ১-০ গোলের জয় দিয়ে শুভ সূচনা করে বাংলাদেশ।
নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে মালদ্বীপের মুখোমুখি। এ ম্যাচে বাংলাদেশ বেশ কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। নিজেদের প্রথম ম্যাচে ভুটানের বিপক্ষে ৬-০ গোলে জিতেছিল মালদ্বীপ। তাই গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে এ ম্যাচে বাংলাদেশের জয় ভিন্ন অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। সেজন্য শুরু থেকেই চড়াও হয়ে খেলতে থাকে বাংলাদেশ। কিন্তু কিছুতেই গোলের দেখা পাচ্ছিল না। অবস্থার পরিবর্তন আনতে খেলার ৬৯ মিনিটে আগের ম্যাচের গোলদাতা আলফাজের বদলে ফরহাদকে নামান জর্জ কোটান কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হচ্ছে না। ম্যাচের এই হাল দেখে সবাই যখন ম্যাচের ফলাফল গোলশূন্য ড্র ধরে নিয়েছিল তখনই ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হন আরিফ খান জয়। ৮৯ মিনিটে জয়ের করা গোলেই মালদ্বীপের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত হয়।
নিজেদের শেষ ম্যাচে ভুটানের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। আগের দুই ম্যাচ জিতে সেমিফাইনাল মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ায় এ ম্যাচে দলের বেশকিছু নিয়মিত খেলোয়াড়কে বিশ্রাম দিয়ে সাইডবেঞ্চের খেলোয়ারদের সুযোগ দেন কোচ। দূর্বল ভুটানের বিপক্ষে জয়ের জন্যে বাংলাদেশের সেই একাদশই অবশ্য যথেষ্ট ছিল। ফরহাদের জোড়া গোল ও কাঞ্চনের গোলে ভুটানকে ৩-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের রাউন্ড নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। টানা তিন ম্যাচ নিজেদের জাল অক্ষুণ্ণ রাখায় সেমিফাইনালের আগে বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাসের রসদটা বেশ পরিপূর্ণ ছিল।
মহাকাব্যিক সেই সেমিফাইনাল
গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া সত্ত্বেও সেমিফাইনালে ভারতের মতো কঠিন দলকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় এমনিতেই ভারতের শক্তিমত্তা তুলনামূলকভাবে বেশি। তাছাড়া সাফের আগের চার আসরের মধ্যে তিনবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। তাই গ্রুপ পর্বে অসাধারণ খেলা সত্ত্বেও এম্যাচে বাংলাদেশের জয়ের ব্যাপারে জোরগলায় বলতে পারার মতো লোক কিছুটা কমই ছিল। কিন্তু ঘরের মাঠে ভারতকে হারানোর এই মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল বাংলাদেশ দল। তাই ফাইনালের আগেই এ ম্যাচটি আরেক ফাইনালের আমেজ নিয়ে এসেছিল।
প্রথম দুই ম্যাচের একাদশ নিয়ে কোটানের প্রিয় ৫-৩-২ ফর্মেশনেই এ ম্যাচে খেলতে নামে বাংলাদেশ দল। খেলার শুরু থেকেই ভারতের রক্ষণসীমায় বারবার আক্রমণ চালাতে থাকে বাংলাদেশ। খেলা শুরুর পাঁচ মিনিটের মাঝেই এগিয়ে যেতে পারত বাংলাদেশ কিন্তু কাঞ্চনের হেড গোললাইন থেকে ফিরিয়ে দেন ভারতের লরেন্স। এমন সুবর্ণ সুযোগ নষ্টের পরেও আত্মবিশ্বাস না হারিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতের রক্ষণভাগের কারণে সেই আক্রমণগুলো সাফল্যের মুখ দেখছিল না, পাল্টা আক্রমণে ভারত কিছু সুযোগ পেয়েছিল কিন্তু আমিনুলের দৃঢ়তায় বাংলাদেশের গোলবার সুরক্ষিতই ছিল। শেষপর্যন্ত গোলশূন্য অবস্থাতেই শেষ হয় প্রথমার্ধ।
দ্বিতীয়ার্ধে খেলার গতিপথ দেখে কৌশলে পরিবর্তন আনলেন কোটান, লেফটব্যাক পারভেজ বাবুকে উঠিয়ে আগের ম্যাচে জোড়া গোল করা ফরোয়ার্ড ফরহাদকে নামান। এই পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের রক্ষণভাগ কিছুটা দূর্বল হয়ে যায় যার সুযোগ নিয়ে বেশ কয়েকবার ভারতের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা বাংলাদেশের রক্ষণভাগে ঢুকে পড়ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের তিন সেন্টারব্যাকের দৃঢ়তায় ভারতের সেই আক্রমণগুলো সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। বরং কোটানের নেওয়া ঝুঁকিটাই কাজে লেগে যায়, খেলার ৭৭ মিনিটে আরমানের নেওয়া কর্নারে হেডে গোল করে বাংলাদেশকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেন কাঞ্চন।
কাঞ্চনের এই গোলের পর মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ফাইনাল খেলাটা বুঝি শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু ৮১ মিনিটে ভারতের আলভিটো ডি সুজার আচমকা এক শটে করা গোলে খেলায় ১-১ এ সমতা চলে আসে। এই গোলের আগে টুর্নামেন্টে টানা ৩৫১ মিনিট নিজেদের গোলবার সুরক্ষিত রেখেছিল বাংলাদেশ। মাত্র চার মিনিটের মাঝে এভাবে নিজেদের প্রিয় দলের লিড চলে যাওয়ায় স্টেডিয়ামে নেমে আসে শ্মশানের শূন্যতা। এই গোলের পর ভয় হচ্ছিল আগের মতো এবারো ভারত বাঁধায় পা আটকে ভেঙ্গে যাবে বাংলাদেশের সাফ জয়ের স্বপ্ন। শেষপর্যন্ত ১-১ গোলেই নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা শেষ হয়। তখন ছিল গোল্ডেন গোলের নিয়ম। অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে যারা প্রথমে গোল করবে তারাই জয় লাভ করবে।
অতিরিক্ত সময়ে দর্শকদের উত্তেজনার পারদ অন্য মাত্রায় চলে যায়, কারণ একটিমাত্র গোল তখন সবকিছুর ব্যবধান গড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। অতিরিক্ত সময়ের শুরুতেই আলফাজের বদলে উজ্জ্বলকে নামান কোচ কোটান। এর পাঁচ মিনিট পর অভিজ্ঞ হাসান আল-মামুনের পরিবর্তে টিটুকে মাঠে নামানো হয়। দুই দলই নিজেদের রক্ষণ সামলে আক্রমণে উঠার চেষ্টায় ব্যস্ত। তবে সেই চেষ্টা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দেননি বাংলাদেশের মিডফিল্ডার মতিউর মুন্না। খেলার ৯৮ মিনিটে মাঝমাঠে প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়ের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে কিছুটা দৌড়ে এসে প্রায় ২০ গজ দূর থেকে দূরপাল্লার এক শট নেন মুন্না। তার অসাধারণ সেই শটে মহাকাঙ্ক্ষিত গোল্ডেন গোল পেয়ে যায় বাংলাদেশ! স্টেডিয়াম ভর্তি পুরো দর্শক এই গোলের পর আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যায়। বহু চেষ্টার পর অবেশেষে সাফ ফুটবলে ভারত বধ। ফাইনালে যাওয়ার আনন্দের সাথে এই ভারত বধের আনন্দ সবার মনে দ্বিগুণ খুশি নিয়ে আসে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোলের তালিকা করলে মতিউর মুন্নার এই গোল্ডেন গোল হয়তো সবার উপরে থাকবে।
সেই স্বপ্নের ফাইনাল
২০ জানুয়ারি, ২০০৩। ঘরের মাঠে শিরোপা জয়ের শেষ ধাপে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল মালদ্বীপ। এই মালদ্বীপকে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ১-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। তাই জয়ের ব্যাপারে বাংলাদেশ দল বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল। কিন্তু টুর্নামেন্টের দুই ম্যাচে হলুদ কার্ড পাওয়ায় অধিনায়ক রজনী কান্ত বর্মনের নিষেধাজ্ঞা দলের জন্য ধাক্কা হয়ে আসে। গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে যুক্ত হয় দেশসেরা গোলরক্ষক আমিনুল হকের ইনজুরি। সবাই ধরে নিয়েছিল আমিনুল বুঝি এ ম্যাচ খেলতেই পারবেন না। কিন্তু দেশের এই মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ কিছুতেই মিস করতে চাইছিলেন না আমিনুল। তাই ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে ফাইনাল খেলতে নামেন। এ ম্যাচে রজনীর অনুপস্থিতিতে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান অভিজ্ঞ রাইটব্যাক হাসান আল-মামুন। আর রজনীর বদলে সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলতে নামেন ফিরোজ মাহমুদ টিটু।
সাদা-নীল জার্সির বাংলাদেশকে সমর্থন জানাতে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সেদিন কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল। খেলার বারো মিনিটে স্বাগতিক দর্শকদের আনন্দে ভেসে যাওয়ার সুযোগ করে দেন বাংলাদেশের স্ট্রাইকার রোকনুজ্জামান কাঞ্চন। বাম প্রান্ত থেকে ডিবক্সে বাড়িয়ে দেওয়া বল ওয়ান টাচ শটে জালে জড়িয়ে বাংলাদেশকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেন কাঞ্চন। গোল পাওয়ার পর আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ মালদ্বীপের উপর আরো চড়াও হয়ে খেলতে থাকে কিন্তু প্রথমার্ধে আর কোনো গোল আদায় করতে পারেনি স্বাগতিক দল। দ্বিতীয়ার্ধে লিড ধরে রাখার লক্ষ্যে কিছুটা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলতে থাকে বাংলাদেশ আর এই সুযোগে আক্রমণের ধার বাড়ায় মালদ্বীপ।
আর সেটার ফলও খুব দ্রুত পেয়ে যায় মালদ্বীপ, ডান প্রান্ত থেকে ক্রস আচমকা আলি উমারের পায়ে ছুঁয়ে জালে জড়ালে খেলায় ১-১ গোলে সমতা ফিরে আসে। এই গোলের পর ৫-৩-২ এর বদলে ৩-৫-২ এ ফিরে গিয়ে আবারো আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে খেলতে থাকে বাংলাদেশ। কিন্তু গোলের দেখা আর কিছুতেই পাচ্ছিল না বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা ১-১ গোলেই শেষ হলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেমিফাইনালের মতো ফাইনালেও আরেকটু হলেই বাংলাদেশের হয়ে গোল্ডেন গোল করে ফেলেছিলেন মতিউর মুন্না কিন্তু এদফায় তার নেওয়া শট বারে লেগে ফিরে আসে। এর দুই মিনিট পর বাংলাদেশের শিরোপা নিশ্চিত করার আরেকটু সুযোগ পান মুন্না কিন্তু বদলি খেলোয়াড় ফরহাদের ক্রসে মাথা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন।
শেষ পর্যন্ত খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। বাংলাদেশের হয়ে প্রথম দুই শটে গোল করেন নজরুল ও ফরহাদ। মালদ্বীপের আহমেদের নেওয়া শট আমিনুল ঠেকাতে না পারলেও আশরাফ লুতফির নেওয়া শট ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অসাধারণ দক্ষতায় ফিরিয়ে দেন আমিনুল। আমিনুলের এই সেভের কারণে শিরোপা জয়ের খুব কাছাকাছি চলে যায় বাংলাদেশ। এরপর বাংলাদেশের হাসান আল-মামুন ও মাহমুদুল হাসান দলের হয়ে যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ পেনাল্টি শটে গোল করেন। অন্যদিকে মালদ্বীপও পরের দুই শটে গোল করায় খেলা গড়ায় পঞ্চম শটে। ভাগ্যনির্ধারণী সেই শটে বাংলাদেশ গোল করতে পারলেই কাঙ্ক্ষিত শিরোপা চলে আসবে বাংলাদেশের দখলে। পঞ্চম শট নিতে আসেন সুজন, পুরো স্টেডিয়ামে তখন পিনপতন নীরবতা।
অনেকে আবার একমনে প্রার্থনায় মগ্ন, সুজন কি পারবেন পেনাল্টি থেকে গোল করে পুরো দেশকে আনন্দে মাতাতে? সুজন শট নিলেন ডান দিকে কিন্তু গোলরক্ষক ঝাঁপ দিলেন উল্টো দিকে। বল জালে জড়ানোর সাথে সাথে বাঁধনহারা উল্লাসে মেতে উঠে পুরো স্টেডিয়াম। ওদিকে গোল করার সাথে সাথে জার্সি খুলে ভোঁ দৌড় দিয়েছেন সুজন। স্টেডিয়ামের ৪৬ হাজার দর্শক বাংলাদেশ বাংলাদেশ গর্জনে যেন পুরো দেশকেই কাঁপিয়ে দিচ্ছিলেন। বহু অপেক্ষার পর দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপখ্যাত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ অবশেষে বাংলাদেশের ঘরে। সেই অপেক্ষার অবসানে এরকম বাঁধভাঙ্গা উল্লাসই তো স্বাভাবিক। স্বপ্নপূরণের সেই স্বর্ণালী সন্ধ্যার কথা মনে পড়লে আজও এদেশের মানুষ ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
এরপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। সময়ের স্রোতে পথ হারিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশের ফুটবল। ২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের সেই রাতে দেশবাসী আশা করেছিল এরপর সাফের গণ্ডি টপকে এশিয়ার ফুটবলে পা রাখবে বাংলাদেশ। কিন্তু কীসের কী! দিন যত গিয়েছে ততই বিবর্ণ হয়েছে এদেশের ফুটবল। এশিয়ার মানদণ্ডে যাওয়া তো বহুদূর আজ সাফের তলানীতেই বাংলাদেশকে আবিষ্কার করতে হয়।
যে ভারতকে হারিয়ে ২০০৩ সাফের ফাইনাল খেলেছিল বাংলাদেশ আজ সেই ভারত এশিয়া কাপ খেলার অপেক্ষায় রয়েছে। মালদ্বীপ আর আফগানিস্তানের মতো দল হেসেখেলে বাংলাদেশকে হারিয়ে যায়। যে ভুটানের বিপক্ষে খেলার সময়ে বাংলাদেশ নিজেদের সেরা খেলোয়াড়দের বিশ্রামে পাঠাতো সেই ভুটানের কাছে হেরে দুই বছর ধরে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে নির্বাসনে এদেশের ফুটবল।
পেছনে হটতে হটতে সত্যিই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এখন ঘুরে না দাঁড়ালে হয়তো আর কোনোদিনই ফুটবলে সুদিন ফিরবে না। আর ঘুরে দাঁড়ানোর কথাই বা জোর গলায় কীভাবে বলি, যে দেশে একটা ফুটবল একাডেমিই টিকে থাকতে পারে না সে দেশে ফুটবল নিয়ে কীভাবে বড় স্বপ্ন দেখবে জনগণ? বাফুফের কর্মকর্তারা নিজেদের ভাগ বাটোয়ারাতেই ব্যস্ত, প্রতি বছর নতুন কোনো বিদেশি কোচ নিয়ে আসাতেই যেন বাফুফের দায়িত্ব খালাস!
এতসব প্রতিকূলতার মাঝেও আশাবাদী এই দেশ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে সবুজ, জাফর ইকবালদের মতো তরুণদের হাত ধরে এদেশের ফুটবল আবারো সাফল্যের কক্ষপথে ফিরবে। এ বছর সেপ্টেম্বরে আবারো বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। এবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ১৫ বছর আগের সেই সুখস্মৃতি ফিরিয়ে আনবে বাংলাদেশ দল, এদেশের মানুষ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বিভেদ ভুলে সবাই একসাথে আবারো বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বলে উল্লাস করবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ফিচার ইমেজ : Prothom Alo