মহাবিশ্বে ঘটা সবকিছুর সমাপ্তি আছে। মেসি ও রোনালদোর দ্বৈরথ ভেঙে একসময় যে নতুন কেউ তাদের স্থান দখল করবে তা অনুমেয় ছিলো। কিন্তু তাদের থাকাকালীন সেরা সময়ে তাদেরই উপেক্ষা করে নতুন কেউ বিশ্বসেরা হয়ে যাবে, এমনটা কেউ কখনও ভাবেনি। আসলে কারও চিন্তায় আসেনি মেসি বা রোনালদোকে টপকে কেউ বিশ্বসেরা হতে পারে! তাদের অবসরের পর বিশ্বসেরার মুকুট নিজের করে নেবার মতো অনেকে ছিলেন। নেইমার, গ্রিজমান, এমবাপে, কেভিন ডি ব্রুইন তার অন্যতম উদাহরণ। কিন্তু মেসি-রোনালদোর প্রথা ভাঙলেন ক্রোয়েশিয়ার জাদারে জন্ম নেওয়া ৩৩ বছর বয়সী একজন সেন্টার মিডফিল্ডার। তিনি লুকা মদ্রিচ।
ডায়নামো জাগরেব থেকে টটেনহাম হটস্পার, স্পার্সের হয়ে নিজেকে প্রমাণ করার পর রিয়াল মাদ্রিদ। ৪টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জয়। ক্রোয়েশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করা থেকে বিশ্বকাপের ফাইনাল। এক বছরে সকল সেরার অর্জন। এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া কি সহজ ছিলো লুকা মদ্রিচের জন্য?
যাত্রার শুরু
মদ্রিচের জন্ম ক্রোয়েশিয়া নামক ছোট্ট একটি দেশের জাদার নামক শহরে। ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে পড়ার পর বলকান অঞ্চলে যে নির্মম গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, মদ্রিচ সেই সময় বেড়ে ওঠা একজন ক্রোয়েশিয়ান। সহিংসতা এবং ভয়ের মাঝে পরে বাকি সবার মতো তারও শিশুকাল ছিলো ভয়াবহ। জাদারের রাস্তায় ফুটবল নিয়ে খেলার সময় আর দশটা শিশুর মতো মদ্রিচকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হতো কখন সার্বিয়ান বিমান হামলা চালায়। বিমানের শব্দ পেলে জীবন হাতে দৌড়ে পালাতে হতো। সার্বিয়ান সৈন্যরা তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। তারা মদ্রিচের দাদাকেও হত্যা করেছিল। মদ্রিচের দাদাকে যখন সার্বিয়ান সৈন্যরা আটক করে, ছোট্ট মদ্রিচও সে সময় আটক হয়েছিলেন সৈন্যদের হাতে। মদ্রিচ ছাড়া পেলেও তার দাদাকে যুদ্ধ গ্রাস করে নেয়।
অন্য শিশুদের মতো তাকেও সবসময় সাবধান করা হতো আশ্রয়কেন্দ্র থেকে যেন সে দূরে না যায়। আর সবসময় বোমা বা মাইনের দিকে যেন নজর রাখে। আর মদ্রিচ? তিনি মাইনভর্তি মাঠে বল নিয়ে ড্রিবল করে যেতেন। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিই তাকে সারাজীবন শক্তি জুগিয়েছে। দেশের এই যুদ্ধ ও নিজের সম্পর্কে মদ্রিচ বলেছেন,”যুদ্ধ আমাকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু আমি সারাজীবন এ নিয়ে ভাবতে চাই না। কিন্তু আমি তা একবারে ভুলে যেতেও চাই না।”
এনকে জাদারের হয়ে বয়সভিত্তিক ফুটবল খেলতেন মদ্রিচ। এই ক্লাবের হয়ে খেলার সময় তার পরিচয় হয় তোমিস্লাভ বাসিচের সাথে। এই বাসিচ মদ্রিচের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেন। এনকে জাদারের পরে মদ্রিচ ক্রোয়েশিয়ার আরেক ক্লাব হাদজুক স্পিল্টের সাথে চুক্তি করতে চেয়েছিলো। কিন্তু বাসিচের পরামর্শে তিনি পরিকল্পনা পাল্টে ফেলেন। পরবর্তীতে বাসিচ ডায়নামো জাগরেবের সাথে মদ্রিচের চুক্তি করাতে সফল হন। তারা ১৫ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডারকে ১০ বছরের চুক্তিতে তাদের যুবদলে নেয়। তরুণ মদ্রিচ পরবর্তীতে এই ক্লাবের হয়ে যখন নিজেকে প্রমাণ করতে শুরু করেন, চোখে পড়ে যান টটেনহাম হটস্পার ক্লাবের। খুব তাড়াতাড়ি সুযোগ এসে পড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমানোর।
টটেনহাম হটস্পারে শুরুর দিনগুলো
ডায়নামো জাগরেবের হয়ে দারুণ একটি মৌসুম কাটানোর পর ২০০৮ সালে তিনি স্পার্সে যোগ দেন। রবি কিন লিভারপুল ও দিমিতার বেরবাতোভ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে পাড়ি জমালে তাদের শূন্যতা পূরণের জন্য তরুণ মদ্রিচকে দলে ভেড়ায় টটেনহাম।
মদ্রিচের স্পার্সে আসার বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের কথা। লিগে নতুন সুযোগ পাওয়া আনকোরা দলের কাছে তারা যখন তাদের টানা ৬ষ্ঠ ম্যাচ হেরে বসে, মদ্রিচের বয়স তখন ২৩। দলে সুযোগ পাওয়ার জন্য তিনি তখন একরকম যুদ্ধই করছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে উদিনেসের বিপক্ষে যখন কোচ জুয়ান্দ্রে রামোস তাকে আবারও একাদশে রাখলেন না, মদ্রিচ তখন পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন। উদিনেসের মাঠে গিয়ে টটেনহামও হারলো ২-০ গোলে। লিগে টানা ৬ ম্যাচ হার ও উদিনেসের মাঠে আবারও লজ্জাজনক হারের পর জুয়ান্দ্রে রামোস নিজের চাকরিটা ধরে রাখতে পারলেন না।
যদিও উদিনেসের বিপক্ষে হারের সে ম্যাচে জেমি ও’হারা লাল কার্ড পাবার পর রামোস মদ্রিচকে নামিয়েছিলেন মধ্যমাঠে প্রাণের সঞ্চার করতে, কিন্তু একা মদ্রিচ তেমন কিছুই করতে পারেননি। ম্যাচ শেষে এই সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন,“আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, কিন্তু মধ্যমাঠে আমি যেন একা ছিলাম।”
গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মদ্রিচ বলেছিলেন,” আমি এর থেকে বেশি কিছু করতেও পারতাম না। একাদশে না থেকে আমি সম্পূর্ণ ভেঙে পরেছিলাম। তবে সেটা দলের কোচের সিদ্ধান্তই ছিলো।”
হ্যারি রেডন্যাপের নতুন অধ্যায়
তরুণ মদ্রিচের সে সময় একজন যথাযথ কোচের প্রয়োজন ছিলো। এমন একজন কোচ, যিনি তার হতাশাজনক সময় কাঁধে হাত দিয়ে সান্তনা দেবে, পাশাপাশি দলের সাথে সম্পর্ক তৈরিতেও সহায়তা করবে।
হ্যারি রেডন্যাপ ছিলেন তেমন একজন কোচ, যিনি জুয়ান্দ্রো রামোসের পর কোচ হয়ে এসে মদ্রিচের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। তিনি সেই কোচ ছিলেন, যাকে মদ্রিচের সেই বিশেষ সময়ে প্রয়োজন ছিলো। রেডন্যাপ এসে টটেনহামে মদ্রিচের ভূমিকা বদলে দিলেন। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে মধ্যমাঠের একটু নিচে খেলতে ভালোবাসতেন মদ্রিচ, রেডন্যাপ সেই সুযোগটা উপহার দিলেন তাকে। এতে খুব দ্রুত মদ্রিচ ফিরতে লাগলেন তার হারিয়ে ফেলা ফর্মে। ২০০৮/০৯ মৌসুমে টটেনহাম হটস্পার প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জিতে নেয়। হ্যারি রেডন্যাপের গড়া সেই দলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন লুকা মদ্রিচ। সেই মৌসুমে স্পার্সের মধ্যমাঠ যেন নিজের রঙে রাঙিয়ে তুলেছিলেন।
নতুন কোচ আর দলের রোল পরিবর্তনের উপকারিতা সম্পর্কে মদ্রিচ বলেছেন,” ঐ পজিশন পরিবর্তন আমার ক্যারিয়ারকে সামনে অগ্রসর করতে সহায়তা করেছেন। আমি মাঠের আরও গভীরে খেলতে পছন্দ করতাম।” কিছু দিন আগে স্ট্যান্ডার্ড স্পোর্টসে সেই দিনগুলোর কথা স্বরণ করে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মদ্রিচ বলেন,” যখন আমি আরও নিচে খেলতে পারার সুযোগ পেলাম, ম্যাচ পড়তে পারার দক্ষতা আমার বেড়ে গেলো, আমি তখন আমার প্রতিভাও ব্যবহার করতে পেরেছি। রেডন্যাপই আমাকে বদলে দিয়েছিলেন।”
যদিও রেডন্যাপ মদ্রিচকে অন্য পজিশনেও ব্যবহার করেছেন। আশ্চর্যভাবে, মদ্রিচ তখন খুব একটা খারাপ খেলেননি।
সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর অধ্যায়
প্রায় ৩০ মিলিয়ন ইউরোতে ২০১২ সালে এই ক্রোয়াট মিডফিল্ডারকে কিনে নেয় স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ। সে সময়ে এই অর্থের বিনিময়ে দল-বদল বিশাল কিছু ছিলো। এই বিশাল অর্থের বিনিময়ে লুকা মদ্রিচ মাদ্রিদে এসে প্রথম মৌসুমের বেশ অনেকটা সময় খেললেন লস ব্লাঙ্কোসদের হয়ে। কিন্তু বছর শেষে মার্কার মতে, তিনি নির্বাচিত হলেন সেই বছরে লা লিগায় সবথেকে বাজে সাইনিং হিসেবে।
টটেনহামের মতোই নতুন দেশে, নতুন ক্লাবে, নতুন সতীর্থদের পাশে মানিয়ে নিতে মদ্রিচের সময় লেগেছিলো। মদ্রিচ প্রথম মৌসুমের পুরোটা সময় জুড়েই নিজেকে দলের সাথে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু সেই বছরই তিনি সফল হননি। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে দ্বিতীয় মৌসুমে তার বদল হতে থাকে। খুব দ্রুত তার পারফর্মেন্স খারাপ থেকে ভালো এবং ভালো থেকে অতুলনীয়ের দিকে ধাবিত হয়।
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে দ্বিতীয় মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে মদ্রিচ বেঞ্চ থেকে নেমে গোল করে দলকে জিতিয়ে শিরোপার আরও কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। মূলত এই ম্যাচের পারফর্মেন্সের পর থেকে মদ্রিচের উপর ভালোবাসা জন্মাতে শুরু করে মাদ্রিদ সমর্থকদের। সে বছরই মধ্যমাঠের কান্ডারীরুপে নিজেকে প্রমাণ করে মদ্রিচ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও কোপা দেল রে জয়ের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফলে তিনি হয়ে যান রিয়াল মাদ্রিদের মধ্যমাঠের সুপারস্টার।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কতৃত্ব
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার রেকর্ড গড়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। এই অবিশ্বাস্য রেকর্ড গড়তে কার অবদান সবথেকে বেশি? হয়তো সবাই প্রথমে জিনেদিন জিদানের নাম স্বরণ করবে। তিনি দায়িত্ব নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ দলটা যেন বদলে দিয়েছিলেন। এরপর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এমন একজন দলে থাকা মানে প্রতিপক্ষকে মানসিক শক্তিতে আগেই হারিয়ে দেবার সুবিধা। আর দলকে তিনি কী দিয়ে গেছেন তা উহ্য থাকুক। এরপর কোনো আলোচনা ছাড়া আসবে লুকা মদ্রিচের নাম, যার দায়িত্ব মধ্যমাঠকে নিয়ন্ত্রণ করা।
প্রচন্ড চাপের পরও মদ্রিচ যেভাবে মধ্যমাঠকে নিয়ন্ত্রণ করতেন, তা বর্তমান সময়ের ফুটবলারদের মধ্যে সচারচর দেখা যায় না। এই ৩৩ বছর বয়সে এসেও তার ক্ষিপ্রতা একবিন্দু কমেনি। টনি ক্রুসকে মাঝমাঠের একটু উপরে উঠিয়ে দিয়ে নিজে নিচে নেমে খেলেন। সেখান থেকে প্রতিপক্ষের আক্রমণ থামিয়ে দিয়ে আক্রমণ গড়ে দিতে একটুও কুন্ঠাবোধ করেন না। তার এই মানসিকতা সম্পূর্ণভাবে ফুটে উঠেছিলো গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। ঠান্ডা মাথায় মধ্যমাঠ নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে দু’দলের মাঝমাঠের যুদ্ধে একক বিজয়ী হয়েছিলেন তিনি।
রিয়াল মাদ্রিদে জিদানের অধীনের তিন মৌসুমে তিনি যেভাবে খেলেছেন, সেক্ষেত্রে তার সম্মাননা আরও বেশি প্রাপ্য। কিন্তু কেবলমাত্র মিডফিল্ডার হবার কারণে তাকে নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয় না।
স্বপ্নের রাশিয়া বিশ্বকাপ
ক্রোয়েশিয়ার জার্সি গায়ে মদ্রিচ খেলেছেন ১১৩টি ম্যাচ। সম্ভাবনাময় একটি দল নিয়ে মদ্রিচ রাশিয়া বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন ভালো কিছুর প্রত্যাশায়। প্রত্যাশার পারদ যদিও খুব বেশি ছিলো না, হয়তো তার মনে ছিলো বিশ্বকাপে ক্রোয়াটদের সর্বোচ্চ সাফল্যকে অতিক্রম করা। সেটা মদ্রিচের দল করল ঠিকই, সাথে পৌঁছে গেলো বিশ্বকাপ ফাইনালে। যদিও বিশ্বকাপ জেতেনি মদ্রিচের ক্রোয়েশিয়া। ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে, সেরা পারফর্মেন্সের পর বিশ্বকাপ না পেলেও মদ্রিচ বিশ্ব মাত করেছেন, হয়েছেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়। ফিফা ও উয়েফার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। আর পেয়েছেন ব্যালন ডি অর।
ক্যারিয়ারের অন্তিম সময়ে এসে হাজির হয়েছেন মদ্রিচ। এখন পেছনে ফিরে তাকালে তার অজস্র সাফল্যের নমুনা পাওয়া যাবে। একজন মিডফিল্ডার হবার কারণে আর ভুড়িভুড়ি গোল না পাবার কারণে সবসময় তাকে নিয়ে আলোচনা কম হতো, হয়তো অবসরের পরও তুলনামূলকভাবে কমই হবে। তবে মদ্রিচকে মনে রাখাবে ব্যালন ডি অরের সেই সোনালী ট্রফিটি। কারণ, মেসি-রোনালদোকে দর্শক করে এই ট্রফি তো তিনিই ছিনিয়ে নিয়েছেন।