খুব সম্প্রতি শুরু হয়েছে নারীদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ। সেদিন ভারত-পাকিস্তানের লীগ পর্যায়ের খেলা দেখতে গিয়ে মনে হলো, দুই পরাশক্তির এই ম্যাচটি নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য নেই। আমাদের দেশে অবশ্য থাকার কথাও নয়। বাংলাদেশ যে টুর্নামেন্টে নেই, তার আবার কীসের খোঁজখবর? তার উপর ক্রিকেট যখন শক্তির খেলা, তখন নারীদের ক্রিকেটের প্রতি উন্নাসিকতা আর তাচ্ছিল্যের মনোভাব তো আছেই। তবে মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিয়ে যায়, কী করে শুরু হলো এই নারীদের ক্রিকেট? আজকের লেখায় রইল সেই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা।
ভাবতে অবাক লাগে, যখন দেখি মেয়েদের ক্রিকেট খেলার ইতিহাসও ছেলেদের ক্রিকেট খেলার মতোই অনেক পুরনো। মেয়েদের ক্রিকেটের সূচনালগ্ন আজ হতে প্রায় আড়াইশ বছরেরও অনেক আগে। ১৭৪৫ সালের ২৬ শে জুলাই ইংল্যান্ডের দুটি গ্রাম ব্রেমলে এবং হেমব্লেডনের মধ্যে একটি ক্রিকেট ম্যাচের মাধ্যমে এই খেলার জগতে নারীদের প্রথম পদার্পণ। সেই গ্রাম দুটির গৃহপরিচারিকাগণ নিজেদের মধ্যে ক্রিকেট খেলাটির আয়োজন করেন। উভয় দলেই ছিলেন এগার জন করে নারী খেলোয়াড় আর ছিলেন দু’জন আম্পায়ার। মেয়েদের ক্রিকেট হলে কী হবে? পুরুষদের ক্রিকেট খেলায় যা যা হয়ে থাকে তার সবকিছু নিয়েই পুরো ম্যাচটি সম্পূর্ণ হয়। এই ম্যাচটিকেই মেয়েদের ক্রিকেট খেলার যাত্রাপথের প্রথম ম্যাচ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
সেদিনকার সেই খেলা চারিদিকে এতোই সাড়া ফেলে দিয়েছিল যে, তখনকার দিনের জনপ্রিয় পত্রিকা ‘দি মার্কারি’তে এই খেলার উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনের কিছুটা অংশ হুবহু তুলে ধরা হল:
“The greatest cricket match that was played in this part of England was on Friday, the 26th of last month, on Gosden Common, near Guildford, between eleven maids of Bramley and eleven maids of Hambledon, all dressed in white. The Bramley maids had blue ribbons and the Hambledon maids red ribbons on their heads. The Bramley girls got 119 notches and the Hambledon girls 127. There was of bothe sexes the greatest number that ever was seen on such an occasion. The girls bowled, batted, ran and catches as well as most men could do in that game.”
১৭৪৭ সালের ১৩ই জুলাই ইংল্যান্ডে নারীদের আরো একটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় শার্লটন এবং চিলগ্রোভের সাসেক্সের সাথে। কিন্তু দর্শকদের মাঝে ঝামেলা হওয়ার কারণে সেই ম্যাচ আর শেষ হতে পারেনি। এরপর বেশ কিছুদিন মেয়েদের ক্রিকেট বড় আকারে আর মাঠে গড়ায়নি।
কিন্ত মেয়েদের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহের যে কোনো অংশে ভাটা পড়েছিল, তা কিন্তু নয়। পরবর্তী একশ বছরে এমন ছোটখাটো অনেক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে। ইংল্যান্ডের বাইরে তখনও তেমনভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি নারীদের ক্রিকেট। মেয়েদের ক্রিকেটকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার লক্ষ্যে ১৮৮৭ সালে প্রথম মেয়েদের ক্রিকেট ক্লাব প্রতিষ্ঠত হয়। ইয়র্কশায়ারে প্রতিষ্ঠিত ওই ক্লাবটির নাম ‘হোয়াইট হেদার ক্লাব’।
এর ঠিক তিন বছর পর ‘অরিজিনাল ইংলিশ লেডি ক্রিকেটার্স’ নামে আরেকটি ইংলিশ দল গঠিত হয়। মূলত এই দলের মাধ্যমেই ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে মেয়েদের ক্রিকেট খেলার জনপ্রিয়তা বাড়ে। তারা ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে সফরে গিয়ে প্রচুর দর্শকের উপস্থিতিতে ম্যাচ খেলে। ফলে প্রচুর মুনাফাও করে দলটি। তখন থেকে ক্রিকেটের প্রতি ইংল্যান্ডের মেয়েদের আগ্রহ বাড়তে থাকে।
এরপর মেয়েদের ক্রিকেট ইংল্যান্ডের বাইরেও অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ১৮৯৪ সালে অস্ট্রেলিয়াতে মেয়েদের ক্রিকেট লীগ অনুষ্ঠিত হয়। সেই একই বছর সাউথ আফ্রিকার পোর্ট এলিজাবেথে ‘দি পাইওনিয়ার্স ক্রিকেট টিম’ নামে মেয়েদের একটি ক্রিকেট টিম প্রতিষ্ঠিত হয়। কানাডার ভিক্টোরিয়াতেও এরূপ আরেকটি ক্রিকেট টিম বিকন হিল পার্কে খেলার নজির পাওয়া যায়।
মেয়েদের ক্রিকেট আরও বেশি জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে ১৯২৬ সালে ‘উইমেন্স ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠালাভ করে। ১৯৩৩ সালে ইংল্যান্ড নারী ক্রিকেট দল প্রথমবারের মতো লেইচেস্টারের বিপক্ষে খেলে। এর পরবর্তী বছর ইংল্যান্ড নারী দল প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কোনো সফরে অস্ট্রেলিয়ায় যায়।
সেখানে তারা অস্ট্রেলিয়া নারী ক্রিকেট দলের বিপক্ষে নারীদের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্ট খেলে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ দুটিতে জয় এবং একটিতে ড্র করে ইংল্যান্ডের মেয়েরা। এরপর সেখান থেকে ইংলিশ মেয়েরা নিউজিল্যান্ড সফরে যায়। এই সফরেই ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি নারী ক্রিকেটার ‘বেটি স্নোবল’ ১৮৯ রানের ঐতিহাসিক ইনিংস খেলেন।
ইংল্যান্ডের পর অস্ট্রেলিয়াতে নারী ক্রিকেটের জাগরণ শুরু হয়। অস্ট্রেলিয়ার নারী ক্রিকেটের প্রথম ধারক ও বাহক ছিলেন ক্রিকেট কিংবদন্তি ‘লিলি পলেট হ্যারিস’। ১৮৯৪ সালে তিনি অস্টার কোভ ক্রিকেট দলটির নেতৃত্বে আসেন। এই দলটিই ছিল অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশিক যুগের প্রথম কোনো নারী ক্রিকেট দল।
অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯০৫ সালে ‘ভিক্টোরিয়া উইমেন্স ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা পায়। এর আরও ২৬ বছর পর ‘অস্ট্রেলিয়ান উইমেন্স ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু নারীদের ক্রিকেট কেবল ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়াতেই সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এই খেলার বিকেন্দ্রীকরণের। এই লক্ষ্যে ১৯৫৮ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স ক্রিকেট কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রতিষ্ঠান নারীদের ক্রিকেট বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দ্রুত কাজ শুরু করে। বর্তমানে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড সহ প্রায় প্রত্যেকটি ক্রিকেট খেলুড়ে দেশে নিয়মিত মেয়েদের ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
নারী ক্রিকেটের টেস্ট খেলুড়ে দেশের তালিকায় রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এখনও পর্যন্ত অধিকাংশ টেস্টই খেলা হয়েছে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে। শুরুর দিকে এই সকল টেস্ট ছিল তিন দিনের। কিন্তু ১৯৮৫ সাল থেকে দিনের সংখ্যা বাড়ানো হয়। ২০০৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স ক্রিকেট কাউন্সিল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল বা আই সি সি’র সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হয়।
এবার আসা যাক মেয়েদের ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ প্রসঙ্গে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, ছেলেদের প্রথম ওয়ার্ল্ড কাপের দু’বছর আগে শুরু হয় মেয়েদের ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয় মেয়েদের প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপ। চলতি বছরের জুলাই মাসে ইংল্যান্ডের মাটিতে শুরু হয়েছে মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপের একাদশতম আসর। ছেলেদের ক্রিকেটের মতো মেয়েদের ক্রিকেটের বিশ্বকাপেও অস্ট্রেলিয়ার প্রাধান্যই বেশি। অস্ট্রেলিয়া নারী ক্রিকেট দল এই পর্যন্ত সাতবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয় করে। অপরদিকে পার্থক্য এই যে, ছেলেদের ক্রিকেটে ওয়ার্ল্ড কাপের দেখা না পাওয়া ইংল্যান্ড নারীদের ক্রিকেটে তিনবার ওয়ার্ল্ড কাপ জয় করে। ওয়ার্ল্ড কাপের আরেকটি আসর জেতে নিউজিল্যান্ড।
২০০৯ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আগামী বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজে বসবে এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ষষ্ঠ আসর।
ছেলেদের ক্রিকেটের পাশাপাশি বাংলাদেশের নারীদের ক্রিকেটও পিছিয়ে নেই। তবে এদেশের নারী ক্রিকেটের যাত্রা খুব বেশিদিনের নয়। ২০১১ সালের ২৪ নভম্বর বাংলাদেশ ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায়। ২০১৭ সালের চলমান ওয়ার্ল্ড কাপে অংশ নিতে পারলেও হয়তো খুব শীঘ্রই নারী ক্রিকেটাঙ্গনে জ্যোতি ছড়াবে রাঙ্কিয়ের নয় নম্বরে থাকা রুমানা আহমেদের নেতৃত্বাধীন এই দল। সাথে রয়েছেন সালমা খাতুন, আয়শা রহমান, ফারজানা হক আর সুলতানা ইয়াসমিনের মতো দারুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়রাও। আগামী দিনে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলও দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাক, এই আমাদের প্রত্যাশা।
ফিচার ছবিসূত্র: dhakatribune.com