প্রায়ই যাদের মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আসা-যাওয়া আছে, তারা জানেন; মাঠে ক্রিকেট মৌসুম থাক বা না থাক, জাতীয় দলের সিরিজ থাক বা না থাক, মুশফিকুর রহিম ঠিক আছেন। তাকে বলা হয় জাতীয় দলের ডিসিপ্লিনের আইকন। বিশ্বকাপশেষে যখন সবাই একটু ছুটি কাটাতে ব্যস্ত, তখনও মুশফিক ব্যাট হাতে ঘাম ঝরাচ্ছেন ঢাকার মাঠে, শ্রীলঙ্কা সিরিজকে সামনে রেখে। যদিও এই মুহূর্তে মুশফিকসহ পুরো বাংলাদেশ দল অবস্থান করছে শ্রীলঙ্কাতেই।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানের পারফরম্যান্স দলের ‘দ্বিতীয় সেরা’, প্রথমে আছেন সাকিব আল হাসান। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মুশফিক ৮ ইনিংসে ৩৬৭ রান করেছেন, গড় ৫২.৪২। সর্বোচ্চ ১০২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছেন। পুরো টুর্নামেন্টে ওই একটি সেঞ্চুরির সাথে ছিল আরও দু’টি হাফসেঞ্চুরি। এই পারফরম্যান্সে মুশফিক পিছনে ফেলেছেন এবারের আসরের সব উইকেটরক্ষককে।
ব্যাটিংয়ে যেমন আত্মতুষ্টি, তেমন আছে সমালোচনাও। বিশেষ করে উইকেটের পিছনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে রানআউট মিস করাটা এখনও চোখে লেগে আছে সবার। সেই উইকেট পেলে বদলে যেতে পারত পুরো দৃশ্যপট।
সে কথা থাক। মুশফিক যেমন হারিয়েছেন, তেমন ফিরিয়েও দিয়েছেন মুঠোভরে। একজন মানুষের জীবনীশক্তি কতটা প্রবল হতে পারে, তা টের পাইয়ে দিচ্ছেন এই ক্রিকেটার। মাঠে ব্যাট-প্যাডের লড়াই, মাঠের বাইরে পরিবার, ভক্তদের সমালোচনা, প্রশংসার মধ্যেও পড়াশোনাটা ঠিক চালিয়ে গেছেন, যাচ্ছেনও। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী এই ক্রিকেটার সম্প্রতি জানিয়েছেন, তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ক্রিকেট নিয়ে পিএইচডি করবেন।
নিজের এই স্বপ্ন নিয়ে প্রথম মুখ খুললেন না মুশফিক, জানিয়েছেন আরও আগেই। বিকেএসপির সাবেক এই শিক্ষার্থী স্বপ্নের অনেকটা কাছে পৌঁছেছেন বলেই মনে করিয়ে দিলেন আবারও।
বিশ্বকাপ শেষে যখন দলের সতীর্থরা পরিবারকে সময় দিচ্ছেন, তখনও মুশফিক দিনে চার ঘন্টা পড়েছেন কেবল এম.ফিল.-এর জন্য, যেন পিএইচডির জন্য আবেদন করতে পারেন। স্নাতকোত্তর শেষে চার বছর কোনো পড়াশোনার মধ্যে না থাকার কারণে তার জন্য খানিকটা হলেও সবকিছু কঠিন হয়ে গেছে। তারপরও, জীবনে তার দু’টি ব্যাপার, ক্রিকেট ও পড়াশোনা।
মুশফিক বলেছেন,
‘ক্রিকেট এবং পড়াশোনা, দুটো একসাথে চালিয়ে যাওয়া অবশ্যই কঠিন। চার বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেছে, আমি মাস্টার্স শেষ করেছি। এখন বাবাও হয়েছি। তো এমন অনেক সময় হয় যে, আমি যখন পড়ছি, তখন আমার সন্তান আমার সাথে খেলতে চাইছে; সময় কাটাতে চাইছে।’
‘সবকিছুই আমাকে ম্যানেজ করে নিতে হচ্ছে। এটা বেশ চ্যালেঞ্জিং; অবশ্যই বলবো, ব্যতিক্রমী এক চ্যালেঞ্জ। জীবনের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় আপনার সামনে ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ আসবে, এটাই স্বাভাবিক। পাঁচ বছর আগে যে চ্যালেঞ্জগুলো সামলাতে হতো, এখন অবশ্যই নতুন কিছু যোগ হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমি একসাথে সব ম্যানেজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
বিশ্বকাপ শেষ করে এসেই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মুশফিক। মূল কারণ পরীক্ষা। পিএইচডি করতে হলে এম.ফিল. প্রয়োজন, সেই পরীক্ষা নিয়েই দেশের সাবেক এই অধিনায়কের ব্যস্ততা। এ প্রসঙ্গে মুশফিক বলেছেন,
‘সবকিছু এখন পর্যন্ত ঠিকঠাক আছে। জুলাইয়ের ১৮ তারিখে একটা পরীক্ষা ছিল। আগস্টের ৪ তারিখে আরেকটা পরীক্ষা আছে। আমার লক্ষ্য হলো, যত দ্রুত সম্ভব এমফিল শেষ করে পিএইচডি শুরু করতে চাই। দক্ষিণ এশিয়ার ক্রিকেটের ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে চাই, ক্রিকেটার হিসেবে একটা উদাহরণ তৈরি করতে চাই। অনেক ভেবেই ক্রিকেট নিয়ে কাজ করতে চেয়েছি। যেহেতু আমি ক্রিকেটার, কাজটা আমার জন্য সহজ হবে। সাধারণত দুই থেকে আড়াই বছর দরকার হয় পিএইচডি শেষ করতে। তারপর থিসিস জমা দিতে হয়।’
শত চাপ সহ্যের অভ্যেস রয়েছে বলেই কি না, এই পড়াশোনার বাড়তি চ্যালেঞ্জের মধ্যেও ক্রিকেটের উপর কোনো প্রভাব পড়তে দিতে চান না মুশফিক। ক্যারিয়ারকে যদি তিন ভাগে ভাগ করা যায়, মুশফিক তাহলে রয়েছেন তৃতীয় ভাগে। তাই আর যতদিন খেলবেন, ততদিনই নিজের ক্যারিয়ারকে আরও নতুন উচ্চতায় নিতে চাইবেন, আরও স্মরণীয় করতে চাইবেন, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। আর সেটা করতে হলে নিজের ব্যাটিং পজিশনকে আরও উপরে নিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন এই ক্রিকেটার।
মুশফিক বলেছেন,
‘আপনি যদি এই মুহূর্তে চার নম্বরের সেরা ব্যাটসম্যানের তালিকা দেখেন, আমি সেখানে দুই নম্বরে আছি। এটা অবশ্যই তৃপ্তিদায়ক। আবার একই সাথে আরও ভালো করার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়, আরও চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সাহস দেয়। আমি যা-ই করেছি, আমি তাতে খুশি। যা করতে চেয়েছি, তার পুরোটা করতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, কিছু ম্যাচে আমি দলকে জেতাতে অবদান রাখতে পেরেছি।’
মুশফিক বরাবরই আবেগী। অধিনায়ক হিসেবে, ক্রিকেটার হিসেবে, এমনকি বাবা হিসেবেও। যেকোনো পর্যায়ে সবসময়ই চেয়েছেন দলের জন্য কিছু করতে। সেটা কখনও পেরেছেন, কখনও ব্যর্থ হয়েছেন। পুরনো সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠেছেন, হয়েছেন আরও অভিজ্ঞ। সবকিছুই মুশফিককে স্বপ্ন দেখায় নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার।
বলেছেন,
‘সত্যি বলতে, আমি আমার ক্যারিয়ারের শেষ ভাগে এসেছি, এখানে বিশ্রাম নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ১০-১৫ বছর ক্রিকেট খেলার পর এখনই সময় নিজের খেলাকে পরের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। আমি এই পর্যায় বলতে বোঝাতে চাইছি ৫০-৬০ রানের ইনিংস নয়, দলকে জেতানো। আমি সেই বিশ্বাসটা নিজের মধ্যে অর্জন করতে পেরেছি। কারণ, আপনি যখন শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পারফর্ম করছেন, তখন আপনাকে যেকোনো কন্ডিশনেই পারফর্ম করতে হবে। আপনিও নিজের মধ্যে বিশ্বাসটা অর্জন করতে পারবেন।’
বাংলাদেশ ক্রিকেটে প্রায়ই মুশফিকুর রহিম ও তামিম ইকবালের মধ্যে তুলনা চলে। এই তুলনাটা বেশ ‘স্বাস্থ্যকর’। কে কার চেয়ে বেশি রান করবেন, ক্যারিয়ারে কে এগিয়ে থাকবেন, এ নিয়েই তর্ক। যদিও এই তর্কটা বেশ উপভোগ করেন মুশফিকুর রহিম।
তার মতে,
‘অবশ্যই আমাদের (তামিম ও মুশফিক) মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা আছে একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। তামিম এখন পর্যন্ত যত রান করেছে, আমিও যদি সমান করতে পারি, তাহলে অবশ্যই আমি মনে করবো বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য আমি কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পেরেছি। যদি করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের অনেক ম্যাচ জেতাতে পারবো। তাছাড়া বিশ্বকাপে সাকিব যেভাবে ব্যাট করেছে, যেভাবে ফর্মের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে, তা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় ব্যাপার ছিল।’
চার বছর পর আরও একটি বিশ্বকাপ আসবে। সেই বিশ্বকাপে নিজেকে আরও ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা এখন থেকেই। মুশফিক বলেছেন,
‘আমি এখন থেকেই পরিকল্পনা করছি। সিরিজ ধরে এগোতে চাই। এখন থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করতে চাই। আমার লক্ষ্য হল ২০২৩ বিশ্বকাপ খেলা।’