কোচ সালাউদ্দিন তখন গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের উঠতি ক্রিকেটারদের নিয়ে ব্যস্ত। শ্যামলী মাঠের একপাশে তার দল ‘প্রীতি ম্যাচ’ খেলছে আশেপাশেরই কোনো অখ্যাত ক্লাবের সঙ্গে। আলোচনা সেটা নয়। যেখানে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের প্লেয়াররা অস্থায়ী ডাগআউট বানিয়েছে ছেলেরা। চলছে হাসি-ঠাট্টা, পাশের নেটে কিশোর ক্রিকেটারদের ঘাম ঝরানো অনুশীলন। এসব এড়িয়ে চোখ চলে যায় ঠিক ডাগআউটের মতো করে বেঞ্চ পেতে রাখা জায়গাটার ঠিক সামনে। ঘাসের অল্প আঙ্গিনায় এক নারী সমানে বোলিং অনুশীলন করে যাচ্ছেন। যদিও ততদিনে তারকাখ্যাতি পেয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু নিজের অনুশীলন সেসব তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে না একটুও।
যার কথা বলা হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের পেসার জাহানারা আলম। নিজের বোলিং ডেলিভারিতে বোধ হয় সমস্যা হচ্ছিলো। সেটাই ঠিক করতে শরণাপন্ন হয়েছেন ‘সালাউদ্দিন স্যার’ এর কাছে। কিন্তু স্যারকে চাইলেই তো পাওয়া যায় না। সেই বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিস্থান (বিকেএসপি) থেকে ঢাকায় আসবেন ঘন্টা দুয়েকের জন্য ছাত্রদের অনুশীলন করাতে, তার মধ্যেই অনানুষ্ঠানিক অনুশীলনটা সেই ভোরে সেরে নেন জাহানারা।
নারী ক্রিকেট দলের যেখানে ঠিকমতো ম্যাচই হয় না, সেখানে নিয়মিত অনুশীলনের সুযোগ পাওয়ার কথা ভাবা বাতুলতা। তার মধ্যেই এভাবে মেয়েগুলো নিজেদের ব্যক্তিগত চেষ্টায় অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছে। অগোচরে, অবহেলায় নিজেদেরকেই প্রতি মুহূর্তে ছাড়িয়ে যাওয়ার অন্তত ইচ্ছাটুকু তাদের মধ্যে আছে। তারপরও, সঠিক সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার পর যখন সমালোচনা হয়, তা মাথা পেতে নেন মুখ বুজে। একই সময়ে আবার নিজেদের সাফল্যের আলোর আভায় আলোকিত করেন সবাইকে। সেই সাফল্যকে বুকে জড়িয়ে নেয় দেশের কোটি সমর্থক। হুল্লোড় হয় তখন এসব জাহানারা-রুমানা-সালমাদের নিয়ে।
এ যেন অনেকটা উভয় সঙ্কটের মতো। যে উভয় সঙ্কটের পিঠে রয়েছে স্বপ্নের রঙ্গিন প্রজাপতির ডানা।
১.
দেশের নারী ক্রিকেট নিয়ে মাথাব্যথার শুরুটা ৬০০ টাকার ম্যাচ ফি কেলেঙ্কারি থেকে। কেলেঙ্কারিই বলা চলে। কারণ এই বিপর্যস্ত অবস্থাটা চলে আসছিল তারও আগে থেকে। ৬০০ টাকার ব্যাপারটা অজানা থাকলে হয়তো এখনও পর্যন্ত রুমানাদের আর্থিক সঙ্গতি-অসঙ্গতি নিয়ে মাথা ঘামাতো না কেউই।
গণমাধ্যমের চাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সেই ম্যাচ ফি নিয়ে যায় ১,০০০ টাকা পর্যন্ত। যদিও এই অর্থ ঘরোয়া লিগে ম্যাচ খেলে পেতো মেয়েরা। তারপরও এহেন অনাহুত তথ্য ক্রিকেট বিশ্বে সাড়া ফেলেছিল।
একে তো অর্থ নিয়ে টানাটানি, তার উপর আন্তর্জাতিক ম্যাচের বালাই নেই। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মেয়েরা যখন চারদিনের ম্যাচ খেলে সময় বের করতে পারছে না, সেখানে বাংলাদেশের ঝুলিতে ওই ‘একক অনুশীলন’ আর দর্শকহীন মাঠে ঘরোয়া লিগ খেলা, সেটাও হাতেগোনা।
জাতীয় দলের নারী ক্রিকেটাররাও টের পান তাদের আর্থিক ব্যাপারে অসুবিধার কথা। কিন্তু জানতে দিতে চান না কাউকে। এর মূল কারণ ভবিষ্যৎ নারী দল। একবার দলের সাবেক এক অধিনায়ক মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘গণমাধ্যম সবসময়ই আমাদের পাশে দাঁড়ায়। এর জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু ম্যাচ ফি’র ব্যাপারটা এত বেশি প্রচার করা হলে আমরা দু’ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবো। প্রথমত, আমরা ব্যক্তিগত জীবনে। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে যেসব মেয়েরা জাতীয় দলে খেলতে চাইবে তারা আগ্রহ হারাবে এই অর্থের অঙ্ক শুনলে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি একদিন অবস্থা বদলাবে।’’
কেবল সফল হলেই যেন বোর্ড মুখ ফিরে তাকায় নারী-পুরুষ দলগুলোর দিকে। এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তাদের বেতন বাড়ছে, এমনটাও শোনা যাচ্ছে কর্মকর্তাদের মুখে। সর্বোচ্চ ৩০ হাজার মাসিক বেতন পাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের ক্রিকেটাররা। সেটা বদলে গিয়ে ৫০ হাজারে ঠেকতে যাচ্ছে।
যদিও এই এশিয়া কাপের আগে যখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে সবগুলো ম্যাচ হেরে এলো, তখন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন অন্য কণ্ঠে কথা বলেছিলেন। অবশ্যই আর্থিক দিক থেকে পাশের দেশ ভারত নারী-পুরুষ ক্রিকেট দলের জন্য উদাহরণ। সেখানে মেয়েরা বছরে ৫০ লাখ রুপি বেতন পায়। সেখানে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত সর্বসাকুল্যে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
এশিয়া কাপে যখন পাকিস্তান-ভারতকে হারালেন সালমা-শুকতারারা, তখন পাপন বলেছিলেন, ”পাকিস্তানকে হারিয়েছে শুনে ভাল লাগছে। ভারতকে হারানোয় আরও ভালো লাগছে। কারণ আমাদের নারী দলটা আমাদের নতুন কোচ নিয়েছি। মহিলা ফিজিও নিয়েছি। এদের ভালো সুযোগ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সমস্যা ছিল ব্যাটিং। তা না হলে দল খারাপ না। আজ দেখলাম ভাল ব্যাট করেছে। অত্যন্ত শক্তিশালী দল ভারত। আমি মনে করি এটা ভালো দিক। আমাদের আসলে অনেক দূর যেতে হবে ছেলেদের ক্রিকেটেও, মেয়েদের ক্রিকেটেও। নতুন কিছু প্লেয়ার দরকার।”
কিন্তু ম্যাচ ফি’র কথা তুলতেই প্রশংসার বাণী ঘুরে গেল অন্য মোড়ে, ‘‘আমার তো মনে হয় সৌম্য, ইমরুলরা যা পায় অলমোস্ট কাছাকাছি। ওরা হয়তো পায় ৩০-৪০-৫০ হাজার টাকা, তারা পায় ৭০। এই তো? এখন যদি বলেন সাকিব কত পায়, মাশরাফি কত পায়, তামিম কত পায়… ঐটা বেশি হতে পারে। ম্যাচ ফি আলাদা হতে পারে। আগে তো ছিলই না কিছু। এ ক্যাটাগরির মেয়ে বছরে ৭-৮ লাখ হয়। এটা কম। কিন্ত অত কম না।’’
হ্যাঁ, বছরে ৭-৮ লাখ টাকা হয়। নারী ক্রিকেটাররা সেটা পায় আন্তর্জাতিক-ঘরোয়া সব খেলে তারপর।
২.
এশিয়া কাপে মাশরাফি-সাকিবরাও ফাইনালে গিয়েছেন। সেটাও আবার দুবার। কিন্তু শিরোপা একবারও মেলেনি। সেখানে নারী দল একবার জায়গা করে নিয়েই শিরোপা জিতেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে হোয়াইটওয়াশ হয়ে আসা একটি দল এভাবে ঘুরে দাঁড়াবে তা কেউ ভাবেনি হয়তো। কিন্তু দলের ক্রিকেটাররা নিজেদের প্রতি বিশ্বাসটা ফিরে পেয়েছিলেন মালয়েশিয়ায় প্রথম ম্যাচে জয় পাওয়ার পর।
আর নারীদের শিরোপা জয়ের পর তামিম-মাশরাফিদের উচ্ছ্বাস আলোড়িত করেছিল সবাইকে। এটাই বোধহয় ভ্রাতৃত্ববোধ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মাশরাফি মেয়েদের এই অর্জনকে আরও বড় করে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘৯৭ সালের শান্ত ভাই আর পাইলট ভাইয়ের দৌড়ের পর আমার মতো অনেকেই আজ দৌড়ায়। আর এই ২০১৮ এর সালমা আর জাহানারার দৌড় দেখে বাংলাদেশে ঘরে ঘরে অনেকেই দৌড়ানোর অপেক্ষায় আছে। যে দৌড় চলবে তো চলবে আর থামবে না ইনশাল্লাহ। আজ শুধু অভিনন্দন অনেক কম আপনাদের জন্য।’’
নারী ক্রিকেটারদের অভিযোগ, তারা নিয়মিত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগটা পাচ্ছে না। সে কারণেই দীর্ঘ সময়ের পর যখন খেলতে নামছেন, তখন হারটা যেন সহজাত হয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য। তারই প্রতিফলন ঘটেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। সেখানে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজের সবগুলোতেই হেরেছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। দেশ ছাড়ার আগেও তাদের মুখে জয় নয় বরং অভিজ্ঞতা অর্জনের কথা ফুটেছে। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকার ঐ সফরের আগে এই মেয়েরা তাদের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিল ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে! অর্থাৎ, দীর্ঘ ১৪ মাস পর আবারও দেশের জার্সি গায়ে পরার ‘সৌভাগ্য’ হয়েছে তাদের।
সব মিলিয়েই তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সফরের আগে ম্যাচ জয়ের কথা মুখ ফুটে বলতে পারেনি মেয়েরা। তারচেয়ে বরং অভিজ্ঞতার কথাটাকেই সম্মানজনক মনে হয়েছে তাদের কাছে। সেবার মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের একাডেমি মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে অধিনায়ক রুমানা আহমেদ বলেছিলেন, ‘‘২০১৩ সালে আমরা সাউথ আফ্রিকা গিয়েছিলাম। ২০১৭ সালে তারা আমাদের দেশে এসেছিল। ২০১২ সালেও খেলা হয়েছে। সব মিলিয়া ওদের সঙ্গে তিনটা সিরিজ কিন্তু খেলেছি অতীতে। বেশি হয়ত জয় ছিল না, হয়ত দুই তিনটা জয় ছিল। সব মিলিয়ে ওরা বিশ্বের চার নম্বর দল। আমরা নয় নম্বর। তার মানে এই না যে আমরা ভেঙে পড়ছি বা পারি না। আমাদের উদ্দেশ্য থাকবে যেহেতু দীর্ঘ এক বছর পর খেলছি। ভালো করব এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করব। আমাদের আত্মবিশ্বাস আছে।’’
৩.
অভিযোগ রয়েছে, দলের নির্বাচকরা মেয়েদের ম্যাচে মাঠে যান না, তাদের খেলা দেখেন না। শুধু তা-ই নয়, গণমাধ্যমও ঘরোয়া ক্রিকেটে নারীদের সেভাবে প্রচার করছে না। সবমিলিয়ে তাই ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স বিচার করাও যেন ক্রমশ দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। ছিল না কোচও। সেটাও কয়েক দফা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে শেষপর্যন্ত আনা হয়েছে। সবকিছু পেতেই সোনার ডিম পাড়া হাসের মতো প্রতিদান দিতে শুরু করেছে নারী দল।
দক্ষিণ আফ্রিকায় হেরে আসা সেই মেয়েরাই শক্তিশালী ভারতকে, পাকিস্তানকে হারিয়েছে, শিরোপা জিতেছে। এ যেন উভয় সঙ্কট। একদিকে প্রতিনিয়ত অবহেলা, ঝরে পড়ার সংশয়। দাঁত কামড়ে পড়ে থাকা সেসব মেয়েরাই এবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, এনে দিচ্ছে সম্মান। তারাই হচ্ছে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার, খেলতে যাচ্ছে বিগ ব্যাশ লিগে। সবমিলিয়ে সেই উভয় সঙ্কটের পিছনে রঙিন ডানা হয়ে নতুন সূর্যের দিন দেখাচ্ছে এসব মেয়েরাই।
আর অপেক্ষা করছে কিছু ভালোবাসার, মনে রাখার মতো স্মৃতির। এশিয়া কাপের ফাইনালের মতো সেই ম্যাচের সূত্র ধরেই বলা যায়। শেষ বলে যখন জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ২ রান নিতে সমর্থ হলেন জাহানারা আলম, পরে বলেছিলেন, ‘‘আমি ডাইভ দেব, সেটা ধরেই রেখেছিলাম। সালমা আপু বলেছিলেন, জাহান শুধু ব্যাটটা বলে লাগিও। আমি পেরেছি। এ অর্জন ভোলার নয়, এ দিন ভোলার নয়।’’
ফিচার ইমেজ- DNA India