ফুটবল মানেই চোখ ধাঁধানো সব গোল, নজরকাড়া ড্রিবলিং, পাসিং সৌন্দর্য কিংবা ভয়ঙ্কর সব প্রতি আক্রমণ। তার মানে এই নয় যে ফুটবলের সব কিছুই সুন্দর। আমরা মাঝেমাঝে এর বিপরীত দিকটাও দেখতে পাই। বর্ণবাদী আচরণ, অন্য খেলোয়াড়ের প্রতি অসম্মান কিংবা মাঠের মধ্যেই একে অন্যের সাথে হাতাহাতিতে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা প্রায় নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। মাঠের আচরণে অনেক খেলোয়াড়ের নামেই জুটেছে ‘ব্যাডবয়’ তকমা।
এই তকমাধারীদের মধ্যে যেমন আছেন অনেক আনকোরা খেলোয়াড়, তেমনই আছেন অনেক নামী-দামী খেলোয়াড়ও। চলুন দেখে আসা যাক, ফুটবলের কিছু ব্যাডবয় খ্যাত খেলোয়াড়ের কার্যকলাপ।
লুইস সুয়ারেজ
নিঃসন্দেহে সময়ের অন্যতম এক সেরা স্ট্রাইকার এই উরুগুইয়ান ফরোয়ার্ড। প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে ত্রাস ছড়ানো এই বার্সা স্ট্রাইকার নিজের কর্মকান্ড দিয়েও মাঝখানে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিলেন। বেশ কয়েকবার বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য সমালোচিত হয়েছেন এবং সাজাও খেটেছেন। ২০১৪ বিশ্বকাপে ইতালির বিপক্ষে ম্যাচে ডিফেন্ডার জর্জিও কিয়েল্লিনিকে কামড় দিয়ে ফুটবল ইতিহাসের এক জঘন্যতম ঘটনার জন্ম দিয়েছেন সুয়ারেজ। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এর আগেও তিনি দুবার এই কামড় কান্ড ঘটিয়েছেন।
আয়াক্সের হয়ে খেলার সময় ২০১০ সালে পিএসভি আইন্দহোভেনের খেলোয়াড় ওটমান বাক্কালের কাঁধে কামড় বসিয়ে বিতর্কিত এক ঘটনার জন্ম দেন সুয়ারেজ। সেই ঘটনার জন্যে ৭ ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা পান তিনি। এর তিন বছর পর ২০১৩ সালে আবার একই কান্ড ঘটান তিনি। এবার তার শিকার চেলসির ব্রানিস্লাভ ইভানোভিচ। লিভারপুলের হয়ে খেলার সময় এই কাহিনীর জন্য আবারো ১০ ম্যাচের জন্য বহিষ্কৃত হন তিনি। সর্বশেষ কিয়েল্লিনিকে কামড়ে দেওয়ার জন্য সুয়ারেজ নিষেধাজ্ঞা পান ১৮ মাসের। পাশাপাশি জরিমানাও গুণতে হয় তাকে।
শুধু কামড়-কান্ড নয়, সুয়ারেজ বিতর্কিত তার বর্ণবাদী আচরণের জন্যও। ২০১১ সালে লিভারপুল বনাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একটি ম্যাচে প্যাট্রিস এভরাকে বর্ণবাদী মন্তব্য করেন তিনি, যার জন্য আবারো ৮ ম্যাচের জন্য বহিষ্কৃত হন তিনি। যদিও নিজের জীবনীতে বর্ণবাদী মন্তব্যের ব্যাপারটি অস্বীকার করেন তিনি। তবে সেই ঘটনার জের ধরে পরবর্তী লেগে ম্যাচ শুরুর আগে সুয়ারেজের সাথে হাত মেলাননি এভরা।
জোয়ি বার্টন
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি লাল কার্ড খাওয়া জোয়ি বার্টন অনেকের মতে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত ফুটবলার। খেলোয়াড় হিসেবে তিনি যতটা না সুপরিচিত, তার চেয়ে বেশি সমালোচিত মাঠ ও মাঠের বাইরের কর্মকান্ডের জন্য। সতীর্থের চোখে সিগারেট দেওয়া থেকে শুরু করে টিম হোটেলে মারামারি কিংবা ম্যাচ শেষে প্রতিপক্ষের দর্শকদের উদ্দেশ্যে পশ্চাৎদেশ দেখানো- সব কিছুই করেছেন বার্টন। টুইটারে স্বনামধন্য ফুটবলার গ্যারি লিনেকার এবং অ্যালান শিয়েরারকেও আক্রমণ করেছেন তিনি। ট্রেনিং গ্রাউন্ডে সতীর্থ ওসমান দাবুকে মেরে রক্তাক্ত করে জেল খেটেছেন। নাইট ক্লাবে হাতাহাতি বার্টনের জীবনে প্রায় নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপারই বলা চলে।
অথচ তিনি নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সেরা মিডফিল্ডার তিনি নিজেই। বিতর্কিত কান্ডের জন্য ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে প্রায় ১ বছরের মতো জেলই খেটেছেন। জরিমানার অঙ্কও ছাড়িয়ে গেছে কয়েক লাখ ডলারের উপর। সর্বশেষ, এখন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আছেন জোয়ি। ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার দায়ে ২০১৭ সালে ১৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা পান তিনি। প্রায় ৩৭ বছর হয়ে যাওয়া বার্টনের হয়তো ফুটবলে আর ফেরা হবে না। না ফেরা হলেই হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন বাকি সবাই।
সার্জিও রামোস
বর্তমানের সেরা কয়েকজন ডিফেন্ডারের মধ্যে সার্জিও রামোসের নাম আসাটা অনুমেয়ই। গত কয়েক বছর ধরে রিয়াল মাদ্রিদ ও স্পেনের আস্থার প্রতীক হয়ে আছেন সার্জিও রামোস। তার প্রতিভা নিয়ে কোনো সন্দেহ না থাকলেও মাঠের আচরণ ঠিক একজন ফুটবলারস্বরুপ নয়। যার দরুন ক্যারিয়ারে ২৭৪টি কার্ড দেখেছেন এই স্পেন অধিনায়ক, যা কি না ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ। লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার- প্রতিটি আলাদা আলাদা জায়গায় সবচেয়ে বেশি কার্ডধারী খেলোয়াড় হচ্ছেন সার্জিও রামোস। লা লিগায় প্রতি ২.৩ ম্যাচে একটি করে কার্ড দেখেছেন রামোস।
২৪টি লাল কার্ডের মধ্যে ১৯টিই দেখেছেন লা লিগায়। তাতে করে আগের সর্বোচ্চ ১৮টি কার্ডের রেকর্ড ভেঙে দিয়ে এক বিব্রতকর রেকর্ড নিজের করে নেন রামোস। এর আগে এল ক্লাসিকোতে স্পেন সতীর্থ পুয়োলকে মুখে ধাক্কা দিয়েও তুমুলভাবে সমালোচিত হন তিনি।
মারিও বালোতেল্লি
একসময়ের প্রতিভাবান এই স্ট্রাইকার এখন নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে না পারার দোষটা মূলত তারই। প্রায়ই মাঠের বাইরে বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য লাইমলাইটে আসতেন বালোতেল্লি। ম্যাচের আগে প্রায়ই নাইটক্লাবে গিয়ে মদ্যপ অবস্থায় পড়ে থাকতেন। এজন্য ২০১২ সালে ম্যানচেস্টার সিটিতে থাকাকালীন অবস্থায় তাকে ৪ লাখ ইউরো জরিমানাও করা হয়। লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন রাত দুটোয় তাকে নাইটক্লাবে পাওয়া যাওয়ায় ক্লাব কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ জরিমানা করে এই ইতালিয়ান ফুটবলারকে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে ম্যাচের আগে আতশবাজি নিয়ে খেলা করতে গিয়ে নিজ বাসার বাথরুম আগুনে পুড়িয়ে ফেলেও হাসির পাত্র হন বালোতেল্লি।
একবার রাতে নিজ গাড়িতে তাকে ২৫ হাজার ডলারসহ পুলিশ পাকড়াও। একসাথে এত ডলার থাকার কারণ জিজ্ঞেস করাতে বালোতেল্লির উত্তর ছিলো, “কারণ আমি ধনী।”
নিজ সতীর্থের দিকে ডার্ট ছুড়ে মারার জন্যও জরিমানা গুনতে হয় তাকে। কোচ মানচিনির সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি মাঠে সব বিরক্তিকর কর্মকান্ডের জন্য সমালোচিত এই ফুটবলার।
জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ
৩৬ বছর বয়সেও দারুণ ক্ষীপ্রতায় গোল করে বেড়ানো সুইডিশ খেলোয়াড় জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ তার ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্য বেশ সমালোচিত। মাঠের মধ্যেও প্রায়ই জ্লাতানের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখা যায়। নিজেকে সেরা ফুটবলার হিসেবে ঘোষণা করা জ্লাতান বেশ কয়েকবার নিজের সতীর্থদের সাথেও হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
বার্সেলোনাতে থাকাকালীন অবস্থায় বিবাদে জড়ান তৎকালীন বার্সা কোচ পেপ গার্দিওলার সাথে। পরবর্তীতে গার্দিওলাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করতেও ছাড় দেননি ইব্রাহিমোভিচ। মেসিকে বেটে আর রোনালদোকে অপদার্থ বলেও মুন্ডুপাত করেন তিনি। তবে কিছুদিন আগে সিএনএন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজেকে ‘ব্যাডবয়’ হিসেবে মেনে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন ইব্রা।
মারলন কিং
গোলের সামনে মোটামুটি ভালোমানের স্কোরার হলেও বাস্তব জীবনে মোটেও ভালো মানুষ নন এই বার্মিংহাম ফরোয়ার্ড। নাইটক্লাবে গিয়ে এক নারীকে ঘুষি মেরে নাক ভেঙে দেওয়ার কারণে জেল খাটতে হয় সাবেক এই উইগান ফরোয়ার্ডের।
এই ঘটনার কিছুদিন পর মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে মার্সিসাইড পুলিশের হাতে পাকড়াও হন তিনি। ড্রাইভিং লাইসেন্স হারানোর পাশাপাশি জরিমানাও গুনতে হয় তাকে। নারীদের উক্তত্য করা ছিলো কিংয়ের প্রায় প্রতিদিনের কাজকারবার। এছাড়া নিজের সতীর্থকে মাথা দিয়ে ঠুস দিয়ে ক্লাব কর্তৃপক্ষকে জরিমানা দিতে হয় মারলনের। তবে সবচেয়ে নিন্দনীয় কাজটি করেন একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কিছু পণ্য চুরি করে। নিজের এহেন সব কাজের জন্য কোনো ক্লাবেই বেশিদিন ধরে স্থায়ী হতে পারেননি। ফর্ম পড়তির পাশাপাশি যাযাবরের মতো এ ক্লাব থেকে ও’ ক্লাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন, কিন্তু চরিত্র শোধরাননি এখনো।