রাহুল দ্রাবিড়: দ্য আল্টিমেট ওয়াল

‘তাকে প্রথম পনেরো মিনিটের মধ্যে আউট করার চেষ্টা কর। সেটা যদি না পার, তাহলে বাকি উইকেটগুলো নেয়ার চেষ্টা কর।’ – স্টিভ ওয়াহ 

‘আপনি যদি তার সাথে মানিয়ে নিতে না পারেন, তার মানে আপনি জীবনের সাথে সংগ্রাম করছেন।’ – ব্রেট লি

১৩ই মার্চ, ২০০১। ইডেন গার্ডেন, কলকাতা। অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরের তিন ম্যাচ টেস্ট সিরিজের ২য় ম্যাচ। প্রথম ম্যাচে ভারতকে এক প্রকার উড়িয়ে দিয়ে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে সফরকারীরা। সেই সাথে টেস্টে টানা ১৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড। স্টিভ ওয়াহর নেতৃত্বে ব্যাটিংয়ে হেইডেন-ল্যাঙ্গারের সাথে পন্টিং-গিলক্রিস্ট, বোলিংয়ে ম্যাকগ্রা-গিলেস্পি-ওয়ার্নের অনবদ্য কম্বিনেশন, অস্ট্রেলিয়াকে করে তুলেছিল রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য। 

সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ৪৪৫ রানের জবাবে ১৭১ রানে অলআউট হয়ে ফলোঅনে পড়ে ভারত। ইনিংসে হার এড়াতে আরো প্রয়োজন ২৭৪ রান।

এরপরের গল্পটা সবার জানা। ভিভিএস লক্ষণের ২৮১ রানের অতিমানবীয় ইনিংসের উপর ভর করে শুধু দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৮৩ রানের লিড পায় ভারত। শেষদিনে অস্ট্রেলিয়াকে অলআউট করে ম্যাচও জিতে নেয় ভারত। সেদিন ভিভিএস লক্ষণের মাহাত্ম্যের নিচে চাপা পড়ে রাহুল দ্রাবিড়ের ১৮০ রানের ঝকঝকে ইনিংস। রানআউটে কাটা না পড়লে হয়তো ডাবল সেঞ্চুরিটাও পেয়ে যেতেন।

ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় শচীন টেন্ডুলকারের ছায়ায় থেকেও যিনি নিজেকে আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আজকের গল্পটা তাকে নিয়ে। রাহুল শরদ দ্রাবিড় – দ্য ওয়াল।  

Image Credit: Hamish Blair/Getty Images

ক্যারিয়ারের শুরু যেভাবে

রাহুল দ্রাবিড়ের জন্ম ১৯৭৩ সালের ১১ই জানুয়ারি, ভারতের মধ্যপ্রদেশে। বাবার চাকরির সুবাদে বেড়ে ওঠেন বেঙ্গালুরুতে। মূলত সেখানেই ক্রিকেটের হাতেখড়ি। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলেছেন কর্ণাটকের হয়ে। 

ক্রিকেটে যদি ধৈর্য্যশক্তির পরীক্ষা নেয়া হত, তবে অবধারিতভাবে একজন ফার্স্ট হতেন – তিনি রাহুল দ্রাবিড়। যার প্রমাণ, জাতীয় দলে অভিষিক্ত হওয়ার আগে ৫ বছর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যই ছিল এটা, হাল না ছাড়া।

অবশেষে, ভারতের ‘এ’ দলের হয়ে দারুণ পারফরম্যান্সের সুবাদে জাতীয় দলে ডাক পান দ্রাবিড়। ‘৯৬ সালের এপ্রিলে ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলংকার মধ্যকার অনুষ্ঠিত একদিনের তিনজাতি টুর্নামেন্টে শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে অভিষিক্ত হন তিনি। অভিষেক ম্যাচে ৩ রান করার পর পরের ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৪ রান করে আউট হয়ে আবারও ব্যর্থ হন দ্রাবিড়।

জাতীয় দলে অভিষেকের মুহূর্তটা সুখকর ছিল না দ্রাবিড়ের জন্য। তবে ব্যতিক্রম কেবল টেস্ট অভিষেক, ক্রিকেটের এই রাজকীয় ফরম্যাটেই রাজত্ব চালিয়েছেন তিনি। ওই একই বছরের জুনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে টেস্ট অভিষেক হয় দ্রাবিড়ের। সাত নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৯৫ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রাজত্ব করার অগ্রিম বার্তা দেন তিনি।

Image Credit: Shaun Botterill/Getty Images

১৯৯৯ এবং ২০০৩ এর বিশ্বকাপ

‘৯৯ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ততদিনে ‘টেস্ট স্পেশালিস্ট’ খেতাব পেয়ে গেলেও একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দ্রাবিড়ের অবস্থান ছিল নড়বড়ে। লো স্ট্রাইকরেট, শট খেলাতে সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি নানা কারণে ছিলেন সমালোচিত। এসব ঘুচানোর মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেলেন ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় ‘৯৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে। সেবার প্রায় ৮৫ স্ট্রাইকরেটে ৮ ম্যাচে ৪৬১ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানস্কোরার হন তিনি। শ্রীলংকার বিপক্ষে সৌরভ গাঙ্গুলিকে নিয়ে ২য় উইকেট জুটিতে করা ৩১৮ রানের পার্টনারশিপ ছিল তৎকালীন বিশ্বরেকর্ড। সে বিশ্বকাপে দল হিসেবে ভারত ব্যর্থ হলেও দ্রাবিড় ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। 

২০০৩ বিশ্বকাপেও ব্যাট হাতে ৩১৮ রান করে ভারতের ফাইনাল খেলার পথে দারুণ ভূমিকা রাখেন দ্রাবিড়।  সে বিশ্বকাপ তিনি খেলেছিলেন উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে। একজন এক্সট্রা স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান খেলানোর আইডিয়া থেকে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি হাতে গ্লাভস তুলে নেন দ্রাবিড়। ১৬ ডিসমিসাল করে হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা উইকেটকিপার।

এভাবেই কখনো বা ব্যাট হাতে, কখনো বা গ্লাভস হাতে – দলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন দ্রাবিড়।

২০০৩ বিশ্বকাপে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি হাতে গ্লাভস তুলে নেন দ্রাবিড়; Image Credit: Mike Hewitt/Getty Images

ক্যারিয়ারের স্বর্ণালী সময়

‘৯৯ বিশ্বকাপ থেকে ‘০৭ এর ওয়ানডে বিশ্বকাপ পর্যন্ত সময়টায় ক্যারিয়ারের স্বর্ণালী সময় কাটান দ্রাবিড়। ব্যতিক্রমী ডিফেন্সিভ টেকনিক, ধৈর্য্য ও কঠোর পরিশ্রমের এক অপূর্ব সম্মোহন রাহুল দ্রাবিড়কে অনন্য করে তুলেছিল। যার প্রমাণ, ২০০২ সালে ভারতের ইংল্যান্ড সফর। চার ম্যাচ টেস্ট সিরিজে প্রায় ১০০ ব্যাটিং গড়ে ৬০২ রান করে মাইকেল ভনের সাথে যৌথভাবে ‘ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট’ হন দ্রাবিড়। এর মধ্যে সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে লিডসের গ্রিন পিচে তার করা ১৪৮ রানকে ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ইনিংস বলা হয়। একই সিরিজে ক্যারিয়ারের ২য় ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নেন। 

টেস্ট ক্রিকেটে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন দ্রাবিড়। ১৬৪ ম্যাচে ২৮৬ ইনিংসে প্রায় ৫৩ গড়ে ১৩ হাজারের অধিক রান, ৩৬ সেঞ্চুরি (যার মধ্যে পাঁচটিই ডাবল সেঞ্চুরি), সে সময়ের সব টেস্টখেলুড়ে দেশের সাথে সেঞ্চুরি করার রেকর্ডগুলো সে সাক্ষ্যই দেয়। টেস্ট ক্রিকেট সর্বোচ্চ ৩১,২৫৮ বল ফেস করার বিরল রেকর্ডও তার।

প্রতিপক্ষের বোলার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিয়ে প্রচণ্ড মনস্তাত্ত্বিক চাপে ভোগাতেন দ্রাবিড়। যেকোনো পরিস্থিতিতে উইকেট কামড়ে পড়ে থাকা, প্রতিপক্ষের ছোড়া গোলা থেকে দলকে রক্ষা করা তাকে এনে দিয়েছিল ‘দ্য ওয়াল’ খেতাব। দ্রাবিড় ছিলেন ভারতের অন্যতম সেরা ‘অ্যাওয়ে’ ব্যাটার। উপমহাদেশ ও এর বাইরে সমানতালে খেলতে পারতেন। ‘০৩ এর ডিসেম্বরে অ্যাডিলেইড টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করা ২৩৩, এরপরের বছর পাকিস্তান সফরে রাওয়ালপিণ্ডি টেস্টে ২৭০ রানের অনবদ্য ইনিংস তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

আইসিসি হল অফ ফেমের স্বীকৃতি হাতে দ্রাবিড়; Image Credit: ICC Press Release

অধিনায়ক দ্রাবিড় এবং বিতর্ক কথন

রাহুল দ্রাবিড় অধিনায়ক হিসেবেও মোটামুটি সফল ছিলেন। তবে বিতর্কমুক্ত থাকতে পারেননি। প্রথমবার ২০০৪ সালে ভারতের পাকিস্তান সফরে নিয়মিত অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির অনুপস্থিতিতে তাকে অধিনায়ক করা হয়। মুলতানে সিরিজের প্রথম টেস্টে ১৯৪ রানে ব্যাট করছিলেন শচীন। হঠাৎ ইনিংস ঘোষণা করেন ক্যাপ্টেন দ্রাবিড়। হতবাক শচীন হতাশ হয়ে ড্রেসিংরুমে ফেরেন। ভারতের কোটি শচীনভক্ত ক্ষোভে ফেটে পড়েন।

২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপে রাহুল দ্রাবিড়ের নেতৃত্বে টিম ইন্ডিয়া চরমভাবে ব্যর্থ হয়। বিশ্বকাপের পরপরই অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন, পরে ‘০৯ সালে ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়েন।

ক্রিকেটকে বিদায়

২০১১ সালের জুলাইয়ে ভারতের ইংল্যান্ড সফরে ওয়ানডে দলে হঠাৎ ডাক পান দ্রাবিড়। ডাক পেয়ে ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে ৭৯ বলে ৬৯ রানের ইনিংস খেলে বিদায়ী ম্যাচকে স্মরণীয় করে রাখেন দ্রাবিড়। ৩৪৪ ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রায় ৪০ গড়ে করেছেন ১০,৮৮৮ রান।

সেবার টেস্ট সিরিজে ইংল্যান্ডের কাছে ৪-০তে ধবলধোলাই হয় ভারত। পুরো ব্যাটিং ইউনিট ব্যর্থ হলেও ব্যতিক্রম ছিলেন দ্রাবিড়৷ ‘১১ এর দ্রাবিড় যেন ‘০২ এর চিরসবুজ দ্রাবিড়ে ফিরে গিয়েছিলেন। চার ম্যাচ টেস্ট সিরিজে ৩ সেঞ্চুরিতে ভারতের পক্ষে সর্বোচ্চ ৪৬১ রান করেন দ্রাবিড়। এরপরের বছর জানুয়ারীতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেন। 

ক্রিকেট-পরবর্তী জীবন

 দ্রাবিড় ক্রিকেট-পরবর্তী জীবন কোচিং দিয়েই শুরু করেছেন; Image Credit: IDI/Getty Images

ক্রিকেটকেই ধ্যানজ্ঞান করা দ্রাবিড় ক্রিকেট-পরবর্তী জীবন কোচিং দিয়েই শুরু করেছেন। ভারতের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ আইপিএলের দল রাজস্থান রয়্যালস, ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ ও ‘এ’ দলকে কোচিং করিয়ে এনে দিয়েছেন সাফল্য। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি ইন্ডিয়ার হেড হিসেবে।

এভাবেই ব্যাটিংয়ে তিনি ‘মি. ডিপেন্ডেবল’ কিংবা ‘দ্য ওয়াল’ হয়ে উঠেছেন, দলের প্রয়োজনে উইকেটের পেছনেও দাঁড়াতে দ্বিধা করেননি। ছিলেন তার সময়ের অন্যতম সেরা ফিল্ডার। অধিনায়কত্ব করেছেন, সমালোচনাকে পাশ কাটিয়েছেন পারফরম্যান্স দিয়ে। দ্রাবিড় ছিলেন একজন সত্যিকারের জেন্টলম্যান।  

ক্রিকেট সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ

১) মাশরাফি
২) কাছের ক্রিকেট দূরের ক্রিকেট
৩) ক্রিকেট অভিধান

This article is in Bangla language. It is a biographical feature article on Rahul Dravid, a former Indian cricketer and captain of the Indian national team. He is the Director of Cricket Operations at National Cricket Academy, Bengaluru, India. He also monitors the progress of India A and India under-19 cricket teams. Necessary references are hyperlinked inside.

Featured Image: The Royal Challengers

Related Articles

Exit mobile version