লর্ডস থেকে মিরপুরে, রূপকথার অচিনপুরে

তামিম ইকবাল ব্যাপারটা প্রথম শুনেছিলেন বড় ভাই নাফীস ইকবালের কাছে। জাতীয় দলের সাবেক এই ওপেনার তামিমকে লর্ডসের ব্যাপারে বলেছিলেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান তামিম ইকবালের প্রশ্ন ছিল ক্রিকেটের মক্কাখ্যাত লর্ডসের অনার্স বোর্ড নিয়ে। কী করলে সেই অনার্স বোর্ডে নিজের নাম লেখা যাবে? উত্তরটা সহজ, স্রেফ একটা সেঞ্চুরি। তাতেই হয়ে যাবে এমন অর্জন।

পরের গল্পটা সবার জানা। ২০১০ সালে বলে কয়ে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন তামিম। আহ, সে কী উদযাপন! একরকম উড়ে গিয়ে জার্সির পিছনে নিজের নামটা ইশারা করে দেখাচ্ছিলেন লর্ডসের অনার্স বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ককে। যার কাছে আগের দিন সন্ধ্যে বেলাতেই ৫৫ রানে অপরাজিত তামিম জিজ্ঞেস করে এসেছিলেন, “৫০ পার করা ক্রিকেটারদের নাম লেখানোর একটা ব্যবস্থা করা যায় না?” লোকটি তামিমকে সুখবর দিতে পারেননি। তামিম তাই মুশফিককে সামনে রেখে বলে এসেছিলেন, “হান্ড্রেড এন্ড থ্রি”। তামিম সত্যিই ১০৩ রান করতে পেরেছিলেন।

লর্ডসে তামিমের সেই আইকনিক উদযাপন; Image Source: Gurdian

সেঞ্চুরির পর মাঝ উইকেটে তার সেই শূন্যে ভেসে থাকা উদযাপনের ছবি আমাদেরকে রোমাঞ্চিত করে। অনুপ্রাণিত করে নীরবে লুকিয়ে রাখা স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলতে।

অনার্স বোর্ডে তামিমের নাম; Image Source: MCC

মনে হতেই পারে, কেন লর্ডসের গল্প? বিষয়টা তো বিপিএল! বিষয় বিপিএল হলেও ফাইনালে তার শিরোপা জয়ের উদযাপনটা লর্ডসের সেই উদযাপনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে এবারের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ফাইনালে ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে ১৪১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলতে গিয়ে শিরোপা জিতলেন, টুর্নামেন্টের দ্রুততম সেঞ্চুরির কৃতিত্ব বাগিয়ে নিলেন। সব মিলিয়ে লর্ডসের সেই উদযাপনের পুনরাবৃত্তি না হয়ে উপায় কি! তামিম তো মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আরেক অনার্স বোর্ডেই নাম লেখালেন!

১.

চতুর্থ বিপিএলে শিরোপা জিতেছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। সেবার অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। তামিম ইকবাল ছিলেন চিটাগং ভাইকিন্সে। সেবারে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে তামিম এগিয়ে থাকলেও, দল হিসেবে ভাইকিংস ছিল এককথায়, ‘ডিজাস্টার’। পরেরবারই কুমিল্লা তামিমকে দলে নেয়। মাশরাফি তখন রংপুর রাইডার্সে। ভাইকিংসের মতো কুমিল্লাতেও অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তামিম। টুর্নামেন্ট জুড়ে তার নেতৃত্বে দারুণ লড়েছিল দলটি। কিন্তু ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে মাশরাফির রংপুরের সামনে গিয়ে পরাস্ত হতে হয়।

২০১৯, অর্থাৎ বিপিএলের ষষ্ঠ আসরে শুরু থেকেই শিরোপা ফেরানোর লড়াইয়ে নামে কুমিল্লা। সেভাবেই দল গড়েছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। বড় চমক ছিল বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগে এই মুহূর্তে জাতীয় দলের বাইরে থাকা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার স্টিভেন স্মিথ। তিনি অধিনায়কের দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরু হয় কুমিল্লার যাত্রা। কিন্তু স্মিথ পড়েন ইনজুরিতে। দ্রুত ফিরতে হয় দেশে। কথা ছিল, বড় কোনো সমস্যা না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আবারও বিপিএলে যোগ দেবেন স্মিথ। কার্যত তা হয়নি। অস্ত্রোপচার করতে হওয়ায় টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যান স্টিভেন স্মিথ।

একটি সেঞ্চুরি, একটি জয়, একটি শিরোপা; Image Source: BCB

সেই ফাঁড়া কাটিয়ে উঠতে গিয়ে অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। একাধিকবার অধিনায়ক বদল করে দলের ম্যানেজমেন্ট। শেষ পর্যন্ত নিয়ম করে টসের দায়িত্বটা সারতে থাকেন ইমরুল কায়েস। যদিও মাঠে নেতৃত্বের দিক থেকে দারুণভাবে সবাইকে প্রভাবিত করেছেন তামিম। সঙ্গে নিজের পারফরম্যান্সটাও ঠিক রাখতে হচ্ছিল তাকে। সব মিলিয়েই এবারের বিপিএলে তামিমকে ঠিক তার মতো করেই পেয়েছে সমর্থকরা। গেল আসরে তামিম ছিলেন চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। সেবার ১০ ম্যাচ খেলে দুটি হাফ সেঞ্চুরিসহ মোট ৩৩২ রান তুলেছিলেন। এবারেও ফাইনালের আগপর্যন্ত চতুর্থই ছিলেন। কিন্তু শেষ ম্যাচটিই তাকে নিয়ে গেছে দ্বিতীয় অবস্থানে। ১৪ ম্যাচে ৩৮.৯১ গড়ে ৪৬৭ রান। দুটি হাফ সেঞ্চুরি ও একটি সেঞ্চুরি।

২.

তামিম কেবল জিততে চেয়েছিলেন। প্রতিটা ম্যাচেই নেমেছিলেন জয়ের মন্ত্র নিয়ে। শিরোপা জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে অকপটে স্বীকার করে নিলেন, সেই মন্ত্র তিনি পেয়েছিলেন মাশরাফির কাছ থেকে।

সংবাদ সম্মেলনে তামিম বলেছিলেন,

সত্যি বলতে আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। মাশরাফি ভাইয়ের ট্যাকটিকস ব্যবহার করছিলাম। উনি সবসময় বলেন যে, আমি জিতব, আমি জিতব। ওনার মনে কী থাকে সেটা জানি না। পুরো বিপিএলে আমার এই একই ট্যাকটিকস ছিল। তার কাছ থেকেই কপি করা বলতে পারেন। প্রথমদিন থেকে ফাইনালের দিন পর্যন্ত আমি সবসময় বলে আসছি, আমরাই জিতব, আমরাই জিতব। আমার যেটা দরকার ছিল, দলের মধ্যে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা। আমরা মন তো ওরা দেখতে পারছে না। কিন্তু আমার ডাক তো শুনতে পারছে।

ফাইনাল ম্যাচে ঢাকা কুমিল্লা সবমিলিয়ে তিন উইকেটে ১৯৯ রান তোলে। যেখানে এক তামিমের ব্যাটেই এসেছিল ১৪১ রান। দ্বিতীয় হাফ সেঞ্চুরি তুলতে খরচ করেছিলেন মাত্র ১৯ বল। অথচ প্রথম হাফ সেঞ্চুরি তুলতে ৩১ বল খরচ করেন তিনি। বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টির যেকোনো পর্যায়ের ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ড। এর আগে ২০১৩ সালে বিসিবি একাদশের হয়ে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে এই তামিমেরই করা ১৩০ রানের ইনিংস ছিল সর্বোচ্চ। আর বিপিএলের পরিসংখ্যান বলছে, এই টুর্নামেন্টে এটিই তামিমের প্রথম সেঞ্চুরি ও বাংলাদেশি হিসেবে চতুর্থ। এর আগে শাহরিয়ার নাফীস, মোহাম্মদ আশরাফুল ও সাব্বির রহমান সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন।

লিয়াম ডওসনের সাথে স্টিভেন স্মিথ (ডানে), কুমিল্লার অনুশীলন ক্যাম্পে; Image Source: BCB

যদিও তামিম জানিয়েছেন, তিনি যে এমন একটা ইনিংস খেলে ফেলতে পারেন; সেটাও এমন একটা পরিস্থিতিতে যেখানে তার সতীর্থ এনামুল হক বিজয় (২৪), এভিন লুইস (৬), শামসুর রহমানরা (০) বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। শেষপর্যন্ত অবশ্য তামিমের সঙ্গে ইমরুল কায়েস ১৭ রানে অপরাজিত ছিলেন।

নিজের ইনিংস প্রসঙ্গে তামিম বলেন,

কোনোদিনও চিন্তাই করিনি এরকম ইনিংস খেলবো। ব্যাটিং নিয়ে একটা কথা বলতে চাই, আমি খুব ভালো করে পরিকল্পনা সাজিয়ে এমন ইনিংস খেলেছি। কারণ আমি বারবার একটা জিনিস বলেছি, সাকিব আর নারিনকে যেন উইকেট না দেই। যদি দেখেন, পুরো ইনিংসে নারিনকে একটা ছক্কা ছাড়া কোনো ঝুঁকি নেইনি। এ দুজন বোলার ওদের খুবই ভাইটাল। ওদের সাকসেসের পেছনে ওদের দুজনের অবদান ছিল। আমি পেসারদের জন্য অপেক্ষা করেছি। আনবিলিভেবল উইকেট। একটা সময় দুইশ রানও কম মনে হচ্ছিল। সত্যি কথা বলতে, যদি ওদের দুই-তিনটা উইকেট একসঙ্গে না পড়তো, তাহলে রান আসলেই কম পড়তো।

তিনি আরও বলেন,

সত্যি কথা বলতে আমি এখনও স্বপ্নের ঘোরে আছি যে আমি কীভাবে ব্যাটিং করেছি। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। রুমে যাবো, এরপর হাইলাইটস দেখব এবং তখন হয়তো বিশ্বাস হবে। একটা সময় আমি বিরক্ত হয়েছিলাম, যখন বিজয় আউট হয়েছিলো। ওখান থেকে আমাকে শান্ত হতে হয়েছে এবং আমাকে নতুন করে শুরু করতে হয়েছে। শিওর যে হাইলাইটস দেখলে ভালো করে আরও বলতে পারবো।

মিরপুর স্টেডিয়ামে কীর্তি গড়ার কোনো অনার্স বোর্ড থাকলে তাতে বোধ হয় সবচেয়ে বেশি তামিমেরই নাম লেখা থাকতো। লর্ডসে তামিম যে উদযাপন করেছিলেন, বিপিএলের শিরোপাজয়ের পর সেই উদযাপন তার ফিরে আসবে তা অনেকটাই স্বাভাবিক। অথবা হতে পারে, তার উদযাপনের ধরনটাই এমন! টুর্নামেন্টটা ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক হলেও, বিদেশি ক্রিকেটারদের ছড়াছড়ি হলেও দিন শেষে জাতীয় দলের কথা স্বরণ করেছেন তামিম। কারণ নিজের ও প্রতিপক্ষ দলের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসটা বাংলাদেশিরাই খেলেছেন তাতে খুশি তামিম।

জয়ের নায়ক তামিম; Image Source: Daily Star

বলেছেন,

আজকের পুরো ম্যাচটি বাংলাদেশের ছিল। এটা আমার জন্য সব থেকে বড় অ্যাচিভমেন্ট। আজকের দিনের জন্য, বাংলাদেশিরা পুরো ম্যাচ চেঞ্জ কেরছে। দেট ওয়াজ মোর ইম্পরট্যান্ট। এর থেকে বেশি কিছু হতে পারে না। কত রান করেছি বা কতো কিছু করেছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। আমার ইনিংস দেখে জুনিয়র যারা আমার সাথে খেলে তারা যদি টেক দিস অ্যাজ আ চ্যালেঞ্জ যে, তারা আমাকেও টপকে যেতে পারে। এটাই ভালো।

তামিমের অনুপ্রেরণা শুনছে তো ছোটরা? তাহলে হয়তো লর্ডসের অনার্সবোর্ডে আরও কিছু বাংলাদেশির নাম লেখা হবে, আরও কিছু শিরোপা জেতা হবে মিরপুর কিংবা আরও কোনো কল্পপুরে।

This is an article based on Tamim iqbal who got knocked 141 in the final of BPL 2019. Necessary link has been hyperlinked. 

Feature Photo:BCB

Related Articles

Exit mobile version