দলবদলের বাজারে গোলরক্ষকরা কখনোই সবচেয়ে দামী নন। সবচেয়ে বেশী দাম উঠবে আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের। এটাই চিরাচরিত নিয়ম। সে নিয়মের খুব ব্যতিক্রম হয়েছে, তা নয়। তবে এই দুই মৌসুম জুড়ে গোলরক্ষকদের নিয়ে বেশ টানাটানি যাচ্ছে। বারবার ভাঙছে গোলরক্ষকদের সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড। সর্বশেষ এই রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন কেপা।
আমরা চোখ বুলিয়ে নেবো এখন বিশ্বের সবচেয়ে দামী ১০ গোলরক্ষকের ওপর।
১০. ফ্যান্সেস্কো টোলডো – ১৭ মিলিয়ন পাউন্ড
তার প্রজন্মের সেরা গোলরক্ষকদের একজন মনে করা হয় টোলডোকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, ইতালির ফুটবলে গোলরক্ষকদের স্বর্ণযুগে জন্মেছিলেন। বিশেষ করে জিয়ানলুইজি বুফনের মতো সর্বকালের সেরা গোলরক্ষকের সাথে লড়তে হয়েছে তাকে জাতীয় দলে পোস্টের নিচে দাঁড়ানোর জন্য।
বুফনের ইনজুরিতে ২০০০ সালের ইউরোতে প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক হিসেবে খেলেছিলেন। জাতীয় দলের এই সমস্যা তার ক্লাবে ছিলো না। মূলত ফিওরেন্টিনার হয়ে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন। এই দলে এক সোনালী প্রজন্মের সাথে খেলেছেন, রুই কস্তা, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতারা ছিলেন তখন দলে। ২০০১ সালে হয়ে গেলেন সে সময়ের অন্যতম দামী গোলরক্ষক। ১৭ মিলিয়ন পাাউন্ড খরচ করে তাকে দলে ভেড়ালো ইন্টার মিলান। মিলানের হয়ে অত্যন্ত কাজের খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। টানা ৫টি লিগ শিরোপা জয়ে অন্যতম অবদান রেখেছেন।
৯. ডেভিড ডে গিয়া – ১৮.৯ মিলিয়ন পাউন্ড
মাদ্রিদেই জন্ম নিয়ে এই শহরেই বেড়ে উঠেছেন ডে গিয়া। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের যুব দলে ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। এরপর তাদের ‘বি’ দল হয়ে মূল দলে এসেছেন। সেখানে নিজেকে প্রমাণ করেছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক হিসেবে। ইকার ক্যাসিয়াসের প্রবল ব্যক্তিত্ব তাকে এক নম্বর হয়ে উঠতে দিচ্ছিলো না। সেই সুযোগও এসে যায় দ্রুত; ক্যাসিয়াস অবসর নিলে। ২০১১ সালে তাকে বিশাল অংক ব্যায় করে দলে ভেড়ায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। কিন্তু শুরুতে মনে হয়েছিলো, ইউনাইটেড একটা ভুল বাজি খেলে ফেলেছে। কারণ, বেশ কিছু ছেলেমানুষী ভুল করছিলেন শুরুর দিকে। পরে অবশ্য দ্রুত নিজেকে ইংলিশ ফুটবলে মানিয়ে নিয়েছেন।
৮. বার্নড লেনো – ১৯.২ মিলিয়ন পাউন্ড
গোলরক্ষকদের আরেক স্বর্গ জার্মানি। এখানে গোলরক্ষকদের প্রতিভা উঠে আসার কোনো শেষ নেই। লেনোকে অনেকেই এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ একজন গোলরক্ষক মনে করেন। কিন্তু জার্মানির বিশ্বকাপ দলে ২৩ সদস্যের মধ্যে জায়গা করে নিতে পারেননি। আর ওখানে এক নম্বর জার্সিটা তো অধিনায়ক ম্যানুয়েল নয়্যারের দখলে। তবে ক্লাবে তার পারফর্মেন্স প্রশ্নাতীত। বায়ার্ন লেভারকুসেনের হয়ে গত আট মৌসুম দারুণ পারফর্ম করছেন। তারই পুরষ্কার হিসেবে আর্সেনালের নতুন কোচ উনাই এমরি ডেকে নিয়েছেন নিজের নতুন দলে। এই দলবদলের মৌসুমেই বড় অংকের টাকা দিয়ে লেনোকে ইংল্যান্ডে নিয়ে এসেছে আর্সেনাল।
৭. ম্যানুয়েল নয়্যার – ২১ মিলিয়ন পাউন্ড
যদিও এবারের বিশ্বকাপটা ভুলে যেতে চাইবেন নয়্যার। কিন্তু আধুনিক গোলরক্ষকদের জন্য তিনি এক পথিকৃত। নয়্যারকে শুধু গোলরক্ষক না বলে বলা হয় ‘সুইপার কিপার’। তিনি দলের হয়ে বল পায়ে আক্রমণের সূচনা করেন বক্সের বাইরে বের হয়ে এসে। এই কাজের ঝুঁকিও যে আছে, তা এবার টেরও পেয়েছেন। তাতে নয়্যারের অতীত ম্লান হয়ে যায় না। জার্মান এই গোলরক্ষক নিজেকে প্রথম চেনান শালকে-জিরো ফোরের হয়ে। পাঁচ মৌসুম অত্যন্ত সাফল্যের সাথে শালকেতে খেলার পর নজরে পড়েন তিনি বায়ার্ন মিউনিখের। বায়ার্ন তখনকার দিনে, ২০১১ সালে অবিশ্বাস্য ২১ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে এই গোলরক্ষকের পেছনে। এই জার্মান মহীরূহ দলের হয়ে গত সাত বছরে ছয়বার ট্রফি ছুঁয়েছেন; নিজেকে প্রমাণ করেছেন দামী হিসেবেই।
৬. জর্ডান পিকফোর্ড – ২৫ মিলিয়ন পাউন্ড
এবার বিশ্বকাপে হঠাৎ করেই তারকা হয়ে গেছেন পিকফোর্ড। জো হার্টের মতো তারকা গোলরক্ষককে দলের বাইরে রেখে ইংল্যান্ড দল সাজিয়েছিলেন সাউথগেট। মনে হয়েছিলো, পিকফোর্ড এই আস্থার প্রতিদান দিতে পারবেন না। কিন্তু ইংল্যান্ডের প্রথম গোলরক্ষক হিসেবে বিশ্বকাপে পেনাল্টি শুটআউটে দলকে ম্যাচ জিতিয়েছেন। রাতারাতি খ্যাতির চূড়ায় উঠে গেছেন। এর আগেই অবশ্য সবচেয়ে দামী ইংলিশ গোলরক্ষক হয়ে গেছেন আগের মৌসুমে। সান্দারল্যান্ডে থাকা অবস্থায় সেভাবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি। ভিন্ন ভিন্ন সাতটি ক্লাবে ধারে খেলেছেন। এরপর তাকে সান্দারল্যান্ড থেকে ২৫ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করে দলে নিয়ে আসে এভারটন।
৫. থিবো কোর্তোয়া – ৩১ মিলিয়ন পাউন্ড
চেলসি তার বদলে যাকে কিনেছে, তাতে বিশ্বরেকর্ড হয়েছে। কিন্তু কোর্তোয়াকে বিক্রি করেও কম আয় হয়নি। এই ‘সোয়াপ ডিলে’ কোর্তোয়ার মূল্য ধরা হয়েছে ৩১ মিলিয়ন পাউন্ড। ফলে বুফনের চেয়ে সামান্য পিছিয়ে তিনি বিশ্বের পঞ্চম সর্বোচ্চ স্থানে আছেন দামের দিক থেকে। কোর্তোয়া এই দল বদলের আগে থেকেই বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় গোলরক্ষক। বেলজিয়াম জাতীয় দলের ভরসা এবং এবার বিশ্বকাপের সেরা এই গোলরক্ষক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন বেলজিয়ামের জেনক ক্লাব থেকে। সেখান থেকে আসেন চেলসিতে। চেলসি অবশ্য শুরুর কয়েকটা বছর তাকে ধারে দিয়ে রেখেছিলো অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কাছে। সে সময়ই কোর্তোয়া মাদ্রিদে সংসার পেতে ফেলেন। ফলে এবার মাদ্রিদ যখন তাকে নিতে চাইলো, সেটা তার জন্য ঘরে ফেরার মতো একটা ব্যাপার হয়েছে।
৪. জিয়ানলুইজি বুফন – ৩২.৬ মিলিয়ন পাউন্ড
অনেকের মতেই সর্বকালের সেরা গোলরক্ষকদের একজন এই ‘জিজি’। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে সাফল্য, ট্রাজেডি সবকিছুই দেখেছেন। প্রাপ্তির ঝুলিতে যেমন আছে অনেক কিছু; নেই একটা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ট্রফি। যেমন জুভেন্টাসের হয়ে জিতেছেন সবকিছু; তেমনই দেখেছেন জুভেন্টাসের পাতানো ম্যাচ কেলেঙ্কারিতে ভয়ানক পতন। এই ক্যারিয়ারে কম দেখেননি। ইতালির হয়ে কিংবন্তীতে পরিণত হয়েছেন। তবে এই সবকিছুর শুরু পারমা থেকে জুভেন্টাসে আসার ভেতর দিয়ে। সেই আমলে একজন তরুণ গোলরক্ষকের জন্য ৩২.৬ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করেছিলো জুভেন্টাস। অবশ্যই সেটা ছিলো বিশ্বরেকর্ড। পরের ১৭ বছরে বুফন জুভেন্টাসকে যা যা এনে দিয়েছেন, তাতে কখনোই তার দামটা বেশি বলে সংশয় তৈরি হয়নি। এই বছরই জুভেন্টাসের সাথে নাড়ির বাঁধনটা কেটে পিএসজিতে গেছেন।
৩. এডারসন – ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ড
অর্থের মূল্যমানের পরিবর্তনের কিছু জটিলতার কারণে এডারসন বুফনের ওপরে জায়গা পাচ্ছেন। কিন্তু প্রকৃতমূল্যে বুফনই এগিয়ে থাকার কথা। ২০১৭ সালে ক্লদিও ব্র্যাভোর বদলে ব্রাজিলের এই গোলরক্ষককে দলে ভেড়ায় ম্যানচেস্টার সিটি। তরুণ বয়সে সাও পাওলো যুব দলে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। এরপর ব্রাজিলে দুটো ক্লাবে খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছিলেন বেনফিকাতে। আর বেনফিকা থেকেই আসেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। ব্রাজিলের মূল দলে খুব একটা সুযোগ মেলার কথা নয়। কারণ, এলিসন বেকার এখন দারুন ফর্মে আছেন। ব্রাজিলের হয়ে মাত্র একটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন এডারসন।
২. এলিসন বেকার – ৬৫ মিলিয়ন পাউন্ড
শুধু চেহারার কথা ভাবলে এই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফুটবলারদের একজন এলিসন বেকার। তবে ব্যাপারটা শুধু চেহারায় সীমাবদ্ধ নেই। এ বছর তিনি কয়েকটা দিনের জন্য হলেও বিশ্বের সবচেয়ে দামী গোলরক্ষকে পরিণত হয়েছিলেন। রোমা থেকে ৬৫ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে তাকে নিয়ে এসেছে লিভারপুল। তখন তিনি বিশ্বরেকর্ড করে ফেলেছেন। যদিও দিন বিশেক পরেই সে রেকর্ড ভেঙে গেছে। রেকর্ড ভাঙা নিয়ে অনুতাপ করার সুযোগ নেই এলিসনের। কারণ এখন তিনি আসলেই পৃথিবীর সেরা গোলরক্ষকদের একজন। লিভারপুলে এবার ব্রাজিল তারকার নিজেকে সেই অর্থে প্রমাণ করার পালা।
১. কেপা আরিজাবালাগা – ৭২ মিলিয়ন পাউন্ড
অনেকে এটাকে বলছেন ‘প্যানিক বাই’। চেলসি থেকে থিবো কোর্তোয়া হঠাৎ করেই চলে গেছেন রিয়াল মাদ্রিদে। এই সময়ে তাদের গোলপোস্ট প্রায় ফাঁকা হয়ে পড়েছিলো। তাদের এক নম্বর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো ক্যাবায়ারোর। এরকম একটা সময়ে চেলসির আতঙ্কিত হওয়ারই কথা। বিশেষ করে প্রিমিয়ার লিগের দলবদলের শেষ দিন যখন এগিয়ে আসছে। তখনই তাড়াহুড়ো করে অ্যাথলেটিক বিলবাও থেকে রেকর্ড করে কিনে আনা হলো কেপাকে। এক মাসেরও কম সময়ে এবার গোলরক্ষকদের সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড দুবার ভাঙচুর হলো।