বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলতে গেলে সবার আগে মানসম্পন্ন পেসারের অভাব সামনে চলে আসে। ২০১৫-১৬ সালে যখন মাশরাফি, রুবেলের সাথে তাসকিন, মুস্তাফিজ কিংবা আবু হায়দার রনির মতো সম্ভাবনাময় পেসাররা উঠে আসছিল, তখন মনে হচ্ছিল এই আক্ষেপ বুঝি খুব দ্রুত মিটতে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি, এদের কেউই তাদের প্রতিভার ফুল পরিপূর্ণভাবে ফোটাতে পারেনি।
তবে পেসার নিয়ে এই আক্ষেপের পেছনে একটা বড় রকমের গলদ রয়েছে, আমাদের এই একপাক্ষিক আক্ষেপ দেখলে অনেকেরই মনে হবে আমাদের স্পিন বিভাগ বুঝি খুবই শক্তিশালী। সত্যি কি ব্যাপারটা এমন? পরিসংখ্যানের পাতায় যাওয়ার আগে খালি চোখেই একটু পরখ করে নেওয়া যাক, সাকিব আল হাসান বাদে দলে কি কোনো বিশ্বমানের স্পিনার আছে? ঘরের মাঠে স্পিনিং পিচ বাদ দিলে অন্য কোথাও কি তাদের ম্যাচজয়ী পারফরম্যান্স দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে?
মেহেদি হাসান মিরাজ, তাইজুল ইসলাম কিংবা নাইম হাসান– এখন পর্যন্ত কেউই নিজেদের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রমাণ করতে পারেননি। এদের মধ্যে নাইম বেশ নতুন। তিনি সেভাবে এখনও সুযোগ পাননি, তাই তাকে নাহয় বাদ দেওয়া গেলো। কিন্তু বাকি যারা আছেন, তারা ঐ ঘরের মাঠের স্পিনিং ট্র্যাক বাদে বাকি সবখানেই একপ্রকার ব্যর্থ। শুরুতেই মেহেদি হাসান মিরাজের কথায় আসি, যুব বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার পর থেকেই তাকে ঘিরে অনেক আশা তৈরি হয়েছিল। এরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্বপ্নীল এক অভিষেক হয়েছিল তার। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে মিরাজ একাই তুলে নিয়েছিলেন ১৯ উইকেট!
মূলত অমন দুর্দান্ত শুরুর কারণেই নিজের শক্তির জায়গা ব্যাটিং থেকে দূরে সরে বোলিংয়ে পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছিলেন তিনি। দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে মিরাজও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ। ঘরের মাঠে ১১ টেস্টে তিনি যেখানে নিয়েছেন ৬১টি উইকেট, সেখানে ঘরের বাইরে সমান সংখ্যক টেস্ট খেলে তার উইকেট সংখ্যা মাত্র ২৯টি! ঘরের মাঠে ২১.৪৪ এর বিপরীতে ঘরের বাইরে তার বোলিং গড় ৫৭.৬৮ অর্থাৎ প্রায় তিনগুণ!
এবার আসা যাক দলের আরেক প্রথমসারির স্পিনার তাইজুল ইসলামের প্রসঙ্গে, অভিষেকের পর থেকে ঘরের মাঠে ১৯ টেস্টে তিনি উইকেট নিয়েছেন ৯৩টি, উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ২৭.১ রান। ঘরের বাইরে ১১ টেস্টে তার উইকেট সংখ্যা ২৯টি, উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ৫৭.৬৮ রান। মিরাজ কিংবা তাইজুল– ঘরের বাইরে এই দুজনের চেয়ে বরং মোহাম্মদ রফিকের বোলিং গড় কিছুটা ভালো, তিনি উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ৫১.৫৮ রান। তখন বাংলাদেশ দলের শক্তি-সামর্থ্য খুবই কম ছিল, তাই সতীর্থদের থেকে তেমন সহায়তাও রফিক পাননি।
ঘরের বাইরে সবচেয়ে সফল সাকিব আল হাসান, ১৯ টেস্টে তিনি উইকেট নিয়েছেন ৬৮টি। উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ৩১.২২ রান, যা তাইজুল-মিরাজদের অ্যাওয়ে বোলিং গড়ের প্রায় অর্ধেক! সাকিবের মতো আরেকজন বোলার যদি আমাদের থাকতো, তাহলে অ্যাওয়ে টেস্টে আমাদের দলের এমন হতশ্রী দশা অন্তত দেখতে হতো না।
অবশ্য স্পিন বিভাগে এই সংকট আজ নতুন নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের একদম শুরু থেকেই এই সংকট চলে আসছে। এদেশে কোনো ভালো মানের লেগ স্পিনার নেই তা মিডিয়ার কল্যাণে আমরা মোটামুটি সবাই জেনে গেছি। লেগ স্পিনারের এই সংকট দূর করতে সর্বশেষ বিপিএলের প্রতিটি দলে একজন লেগ স্পিনার থাকা বাধ্যতামূলক বলে হুঙ্কার দিয়েছিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন (সেই হুঙ্কারে অবশ্য কোনো কাজ হয়নি)। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কি শুধু লেগ স্পিনারেরই সংকট? এদেশে বিশ্বমানের ডানহাতি অফ স্পিনার কি আছে?
পরিসংখ্যানের কয়েকটি ছোট উপাত্ত এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য যথেষ্ট। কয়েক বছর আগে অভিষেক ঘটা মেহেদি হাসান মিরাজ বাংলাদেশের ২০ বছরের টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ডান হাতি স্পিনার! অর্থাৎ মিরাজ আসার আগে আমরা এই দীর্ঘ সময়ে বিশ্বমান দূরে থাকুক, টেস্টে একজন ন্যূনতম মানের ডান হাতি স্পিনার তুলে আনতে পারিনি।
টেস্টে তো তা-ও মিরাজ রয়েছেন, ওয়ানডেতে ডান হাতি স্পিনারদের মাঝে সর্বোচ্চ উইকেট কার সেটা জানলে কিছুটা আঁতকে উঠতে পারেন। ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবে দলে খেলা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ওয়ানডেতে বাংলাদেশি ডান হাতি অফ স্পিনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন, ১৮৮ ম্যাচে তিনি উইকেট নিয়েছেন ৭৬টি! অর্থাৎ টেস্ট কিংবা ওয়ানডে– কোনোখানেই আমরা ভালো মানের ডানহাতি স্পিনার খুঁজে পাইনি। এখন তা-ও মিরাজ কিংবা নাইম হাসানদের দিয়ে কাজ চালানো যাচ্ছে, আগে কাজ চালাতে হতো রিয়াদ কিংবা নাইম ইসলামদের মতো পার্ট টাইমারদের মাধ্যমে!
পরিসংখ্যানের যা হালচাল তাতে শুধু লেগ স্পিনার নয়, ডানহাতি অফ স্পিনার খেলানোর ব্যাপারেও বাধ্যবাধকতা তৈরি করা দরকার। বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে যতটুকু সাফল্য এসেছে, তার প্রায় পুরোটা এসেছে বাঁহাতি স্পিনারদের হাত ধরে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এত এত বাঁহাতি স্পিনার আসতে পারলে ডানহাতি স্পিনাররা কেন উঠে আসতে পারছে না?
উত্তর জানতে হলে চলে যেতে হবে ঘরোয়া ক্রিকেটে। প্রথমশ্রেণীর ম্যাচে মোটাদাগে মূলত দুই শ্রেণীর উইকেটে খেলা হয়– একদম নিষ্প্রাণ ফ্ল্যাট উইকেট অথবা পুরোদস্তুর টার্নিং উইকেট। প্রথম ধরনের উইকেটে পুরোদমে চলে রানবন্যা, সেখানে বোলারদের লাইন-লেংথ ধরে বোলিং করা ছাড়া তেমন করার কিছু থাকে না। টার্নিং উইকেটে খেলা অবশ্য কিছুটা কম হয়, এই ধরনের উইকেটে লাইন-লেংথ ধরে বোলিং করলেই উইকেট চলে আসে। একদম সাদামাটা অ্যাকশনে একটানা বোলিং করে যাওয়ার ব্যাপারে বাঁহাতি স্পিনাররাই তুলনামূলকভাবে দক্ষ হয়, ফলে ঘরোয়া লিগের প্রায় প্রতিটি দলেই বাঁহাতি স্পিনারের আধিক্য দেখা যায়।
আর ঠিক এ জায়গাতেই বাংলাদেশ বারবার মার খেয়ে যাচ্ছে, ঘরোয়া লিগেই যেখানে ভালো মানের ডানহাতি অফ স্পিনার কিংবা লেগ স্পিনার পাওয়ার তাগিদ নেই, সেখানে জাতীয় দলে মানসম্পন্ন স্পিনার কি আকাশ থেকে পড়বে? দীর্ঘদিন ধরে এই এক দুষ্টচক্রে আবদ্ধ থেকে আজ এই স্পিনার সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। এমনকি যেসব বাঁহাতি স্পিনার উঠে আসছেন, তারাও অতি বেশি সাদামাটা। তাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখাও দুষ্কর।
এখন এই সংকট থেকে উত্তরণের উপাই কী? একদম স্বল্প মেয়াদে চিন্তা করলে পেসার হান্টের মতো একটি স্পিনার হান্ট করা যেতে পারে। ভালো মানের স্পিনার হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী বোলিং অ্যাকশন বেশ বড় ভূমিকা রাখে। আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অদ্ভুতুড়ে বোলিং অ্যাকশনের অনেক বোলারই পাওয়া যায়, তাদের খুঁজে এনে মূলধারার ক্রিকেটে যোগ করতে পারলে বিশ্বমানের অফ স্পিনার পাওয়া যেতেও পারে। তবে অধিকাংশ সময়ে এসব স্পিনারের বোলিং অ্যাকশন চাকিংয়ের বাধায় আটকে যায়, তাই স্পিনার হান্ট যদি করা হয় তবে অবশ্যই এই চাকিংয়ের ব্যাপারটা শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
তাছাড়া শুধুমাত্র একটি স্পিনার হান্ট করে দায়িত্ব খালাস ভেবে বসে থাকলে হবে না, যারা উঠে আসবেন তাদের পর্যাপ্ত পরিচর্যায় রাখতে হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে সুফল পেতে হলে সবার আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে একটি বড়সড় সংস্কার আনতে হবে। বিশেষ করে ঘরোয়া ক্রিকেটের পিচ যাতে যথেষ্ট স্পোর্টিং হয় সেজন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যাথায় যত দিন যাবে, এই স্পিনার সংকট আরো প্রকট হবে।