কিয়েভ, ইউক্রেন। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল ম্যাচ শুরু হতে আর মাত্র ১ ঘন্টার মতো বাকি। টানা তৃতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলতে যাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ। ম্যাচ শুরু হবে ইতিহাস গড়ার প্রবল বাসনা নিয়ে। এর পূর্বে কোনো দল টানা দুইবার চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা ধরে রাখতে পারেনি। জিদানের রিয়াল মাদ্রিদ তাই করে দেখিয়েছে। কিয়েভে লিভারপুলও তাদের থামাতে পারেনি। অলরেডদের বিপক্ষে জিতে টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা দখলে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ।
টানা তিনবার ফাইনাল জেতার একাদশের ফর্মেশন ছিল ৪-৩-৩ অথবা ৪-৪-২, যেখানে সবসময় ৪ জনের রক্ষণভাগ ব্যবহার করেছেন জিনেদিন জিদান। বার্সেলোনার দুইবার ট্রেবল গার্দিওলা এবং ক্রুয়েফের আমলে। ২০০৬, ২০১০ বা ২০১৪ সালে বিশ্বকাপে ইতালি, স্পেন ও জার্মানি প্রত্যেক দল ব্যবহার করেছে ৪ জনের রক্ষণভাগ। বলতে গেলে, আধুনিক ফুটবলে অধিকাংশ কোচ ব্যবহার করে ৪ জন ডিফেন্ডারের রক্ষণ। ক্রুয়েফের টোটাল ফুটবল বা গার্দিওলার তিকিতাকা, ব্রাজিলের সাম্বা কিংবা ভিসেন্তে দেল বস্কের ‘ফলস নাইন’ – প্রত্যেক ট্যাকটিক্সের পেছনে লুকিয়ে আছে ৪ জন ডিফেন্ডারের রক্ষণভাগের সফলতা।
কেন বর্তমান ফুটবলে প্রায় প্রত্যেক কোচ ব্যবহার করেন এই পদ্ধতি? কোথা থেকে এই ট্যাকটিক্সের উৎপত্তি? তা জানতে হলে আমাদের উঁকি দিতে হবে ফুটবলের একদম গোড়ার দিকে। ডি স্টেফানো বা পুসকাসেরও আগের আমলে।
১৯২৪ সাল। প্রথম বিশ্বকাপ তখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। আবিষ্কার হয়নি ট্যাকটিক্সের জন্য নির্দিষ্ট ফর্মেশন ব্যবহারের। মানে, সংখ্যা দিয়ে যে ফর্মেশন বোঝানো সম্ভব, তখন তা কেউ জানতো না। সে সময়ে আর্সেনালের ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন হার্বার্ট চ্যাপম্যান। সে বছরই এই চ্যাপম্যানের হাত ধরে আবিষ্কার হয় W-M ফর্মেশন। যা খুব দ্রুত সে সময়ের ফুটবলের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আগেই বলেছি, সংখ্যার ফর্মেশন বলে তখন কিছু ছিল না। তাই ফর্মেশন মূলত প্রকাশ পেত খেলোয়াড়দের মাঝে থেকেই। চ্যাপম্যান তিনজন ডিফেন্ডার ব্যবহার করতেন। একজন লেফটব্যাক, একজন সেন্টারব্যাক ও অপরজন রাইটব্যাক। এরপর এই তিনজনের উপরে থাকতো দুইজন হাফব্যাক। এই হাফব্যাক পজিশনকে বর্তমানে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের সাথে তুলনা করা হয়। এই পাঁচজনকে একত্রে ভাবলে ভেসে ওঠে ইংরেজির “W” অক্ষরটি।
এদের বাদ দিয়ে মাঠে আর বাকি পাঁচজনই আক্রমণাত্মক ধাঁচের খেলোয়াড়। দুইজন ইনসাইড ফরোয়ার্ড, যাদের খেলার ধরণ বর্তমানে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের সাথে মেলে। আর বাকি থাকে বর্তমান ট্যাকটিক্সের মতোই দুইজন উইঙ্গার এবং একজন সেন্টার-ফরোয়ার্ড। এরাই থাকতো চ্যাপম্যানের একাদশে। এই পাঁচজন আক্রমণাত্মক ফুটবলারকে নিয়ে যে আকৃতি তৈরি হয়, তা ইংরেজি “M” অক্ষরের মত। এভাবেই চ্যাপম্যানের W-M ফর্মেশনের নামকরণের সার্থকতা।
কিন্তু এই ট্যাকটিক্সে তার দল আসলে কীভাবে খেলতো?
এই ট্যাকটিক্সে দলের মূলমন্ত্র ছিল একদম “ম্যান-টু-ম্যান” মার্কিং। যেমন: লেফটব্যাক মার্ক করতো লেফট উইঙ্গারকে, রাইটব্যাক রাইট উইঙ্গারকে, একমাত্র সেন্টারব্যাক মার্ক করতো প্রতিপক্ষের একমাত্র সেন্টার ফরোয়ার্ডকে। চ্যাপম্যান প্রথম এই ট্যাকটিক্স প্রয়োগ করেন আর্সেনালের উপর। খুব দ্রুতই তা ইংল্যান্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। ইংল্যান্ডের বাইরেও এই ফুটবল দর্শন ব্যবহার করে অনেকে সফলতার দেখা পান। তাই জনপ্রিয় এই ট্যাকটিক্সের মোকাবিলা করার ঔষধ বের করার জন্য মরিয়া হয়ে পড়ে অনেকে। বর্তমানের মতো প্রযুক্তি সে সময় ছিল না। তাই তখন খুব দ্রুত চ্যাপম্যানের দর্শনের খুঁত বের করা সম্ভব হয়নি।
১৯৫০ সাল। বিশ্বযুদ্ধের দামামার পর বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে ব্রাজিলে। মারাকানা স্টেডিয়ামে ফাইনালে মুখোমুখি উরুগুয়ে ও ব্রাজিল। উরুগুয়ে তখন চ্যাপম্যানের W-M ফর্মেশন ব্যবহার করে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। চ্যাপম্যান ১৯৩৪ সালে আকস্মিক মারা গেলেও তার মৃত্যুর ১৬ বছর পরও এই ফর্মেশনের আবেদন এক বিন্দুও কমেনি।
মারাকানায় ফাইনাল ম্যাচে ফেভারিট ছিল ব্রাজিলই, তার উপরে ঘরের মাঠ বলে কথা। কিন্তু W-M ফর্মেশন ও ট্যাকটিক্সের সামনে ব্রাজিল ২-১ গোলে হেরে অসহায় আত্মসমর্পণ করে বসে। ব্রাজিলের রক্ষণ নিয়ে পূর্বে কোনো সমালোচনা ছিল না। কিন্তু এই ফাইনালে হার সেলেসাওদের রক্ষণ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। সেই সাথে তারা হাঙ্গেরির সাথে যোগ দেয়, W-M ফর্মেশনের বিপক্ষে লড়াইয়ের কোনো এক কৌশল বের করতে!
এই ফর্মেশন ও ম্যান মার্কিং পদ্ধতি ব্যবহার করতে হলে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত, দলে গতিশীল খেলোয়াড় থাকা আবশ্যক। ১৯২৪ বা ১৯২৫ সালের দিকে আর্সেনালের প্রত্যেকটি খেলোয়াড়ই ছিল গতিশীল ঘরানার। তাই জনপ্রিয় হলেও সবাই কিন্তু সফলতা পায়নি গতিশীল ফুটবলারের অনুপস্থিতির কারণে। এই ব্যর্থ হওয়া একটি দল ব্রাজিল, যারা কখনও চ্যাপম্যানের দর্শনে প্রভাবিত হয়নি।
১৯৫০ সালে বিশ্বকাপের ফাইনাল হেরে আসার পর ব্রাজিলের কোচের দায়িত্বে আসেন ফ্লাভিও কস্তা, যিনি ৪ জন ডিফেন্ডারকে দিয়ে সাজানো একটি ফর্মেশনের ব্যাখ্যা দিয়ে ব্রাজিলের স্থানীয় একটি পত্রিকায় আর্টিকেল লেখেন। চ্যাপম্যানের W-M ফর্মেশন ছিল অনেকটা বর্তমানের ৩-৪-৩ অথবা ৩-২-৩-২ এর মতো। কিন্তু কস্তার প্রস্তাবিত ফর্মেশন ছিল ৪-২-৪। যদিও শুধু ব্রাজিলে ফ্লাভিও কস্তা নয়, চ্যাপম্যানের দর্শনে খুঁত বের করার চেষ্টা অনেক আগে থেকে করে আসছে হাঙ্গেরি।
১৯৫২-৫৩ সালের দিকে হাঙ্গেরির কোচ গুস্তাভ সেবেস, মার্তন বুকোভি ও বেলা গ্যুতমান একটা উপায়ও বের করে ফেলেন। সেই উপায় নিয়ে ব্রাজিলের সাথে তাদের আলোচনাও হয়। এরপর, সেবেস হাঙ্গেরির সাথে ইংল্যান্ডের এক প্রীতি ম্যাচে তার ভাবনার প্রয়োগও ঘটিয়ে ফেলেন। আসলে সে সময় ছিল হাঙ্গেরির ফুটবলের স্বর্ণযুগ। ৪-২-৪ ফর্মেশন হুট করেই ফুটবল দুনিয়ায় একটি পরিবর্তন নিয়ে আসে। হাঙ্গেরি হয়ে ওঠে তৎকালীন সময়ের সব থেকে শক্তিশালী ও বিপদজনক দলের একটি।
যাই হোক, প্রীতি ম্যাচে ইংল্যান্ড যথারীতি ২৫ বছর ধরে চলা চ্যাপম্যানের W-M ফর্মেশন ও ম্যান মার্কিং ট্যাকটিক্স নিয়ে হাজির। সেবেস তার দলকে নামান ৪-২-৪ ফর্মেশনে, চারজনকে ডিফেন্ডার হিসেবে। ইংল্যান্ড তখনও বুঝতে পারেনি, তাদের জন্য কী ভাগ্য অপেক্ষা করছে!
ম্যাচ শুরু হবার কিছুক্ষণ পর হুট করে ইংল্যান্ড আবিষ্কার করে, হাঙ্গেরির রক্ষণে ৪ জন ডিফেন্ডার সেজে খুঁটি গেঁড়ে বসে আছে, আর দুই পাশে ফুলব্যাক আক্রমণ ও রক্ষণ উভয়দিকেই সহায়তা করে যাচ্ছে। এরপরই তারা খুব অবাকভাবে লক্ষ্য করলো, হাঙ্গেরির সেন্টার ফরোয়ার্ড হিদেকুটি নিচে নেমে খেলা গড়ে দিচ্ছেন। এসব দেখে ইংল্যান্ডের রক্ষণ পুরো অনিশ্চয়তার সাগরে ভাসতে থাকে। তারা যথারীতি মার্কিং করে খেলার পরিকল্পনায় নেমেছে। এখন হিদেকুটি এমন আচারণ শুরু করলে তারা কীভাবে সামলাবে!
পুরো ম্যাচে তারা আসলে কিছুই করতে পারেনি। হিদেকুটিকে মার্ক করবে কি করবে না, সেটা ভাবতে ভাবতেই হিদেকুটি হ্যাটট্রিক করে বসেন। ইংলিশ রক্ষণকে রীতিমতো অপমান করে, ম্যান মার্কিং ট্যাকটিক্স পুরো ভেস্তে দিয়ে হাঙ্গেরি জেতে ৬-২ গোলের বড় ব্যবধানে। ইংলিশদের মাঠে প্রথম কোনো নন-ব্রিটিশ দলের এমন জয় পুরো ইংল্যান্ডকে নাড়িয়ে দেয়।
দক্ষিণ আমেরিকায় ফেরত আসি। কস্তার ৪-২-৪ ফর্মেশনের পর এবং হাঙ্গেরির উত্থান দেখে তারাও শুরু করে এই ফর্মেশনে ফুটবল খেলা। স্থানীয় ক্লাব পালমেইরাস ও সান্তোস এই ফর্মেশনে সফলও হয়। ফলে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ৪-২-৪ ফর্মেশন ব্যবহার করে তারা। চারজনের রক্ষণের জন্য ব্রাজিল এতই শক্তিশালীরূপে আবর্তিত হয় যে, বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল পর্যন্ত তারা গোল হজম করেনি। দুই ফুলব্যাক নিলটন সান্তোস ও জেলমা সান্তোস একইসাথে আক্রমণ ও রক্ষণ উভয় দিকে দুর্দান্ত ভূমিকা রাখেন। সেবার বিশ্বকাপও জিতে নেয় ব্রাজিল।
পরবর্তী ১৯৬২ বিশ্বকাপেও শিরোপা নেয় সেলেসাও’রা। একই ট্যাকটিক্সে, চারজন রক্ষণের সুবিধায়। দিদা, জাগালো বা দুর্দান্ত পেলে। আক্রমণে গারিঞ্চা, ভাভাদের পেছনে নিলটন ও জেলমা থাকলেও এই ৪-২-৪ ফর্মেশন বদলে দিয়েছিল ব্রাজিলের ফুটবল ও অর্জনকে। ঠিক যেভাবে ১৯২৪ সালে আর্সেনালকে বদলে দিয়েছিলেন চ্যাপম্যান।
হাঙ্গেরির মন্ত্রমুগ্ধকর খেলা, ব্রাজিলের এমন সাফল্য দেখে তখন অধিকাংশ দলই W-M ফর্মেশন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। খোদ ইংল্যান্ডই ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের খেলা দেখে পাল্টে ফেলে তাদের প্রাচীন ফর্মেশন। ১৯৬২ বিশ্বকাপের সময় দেখা যায়, চ্যাপম্যানের সেই ফর্মেশন আর ম্যান মার্কিং দর্শন প্রায় বিলুপ্ত। সবাই মজে গেছে ৪ জনের রক্ষণ পদ্ধতিতে। একসময় ব্রাজিল ৪-২-৪ বদলে তৈরি করে ৪-৪-২ ফর্মেশন। এরপর আসে ৪-৩-৩, যা তাদের মাঠে পজেশন ধরে আক্রমণে যেতে বেশ সুবিধা করে দেয়। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড শিরোপা জেতে ৪-৪-২ ফর্মেশন ব্যবহার করে। মধ্যমাঠে দখল আর উইঙ্গারদের উপর ভরসা রেখে। তখন প্রত্যেক দল নির্দিষ্ট ম্যান মার্কিং দর্শন ঝেড়ে ফেলেছে। পজেশন, পাসিং, মিডফিল্ডারদের শৈল্পিক ছোঁয়া, ফুলব্যাকদের ব্যবহার নিয়ে সবাই আগ্রহী।
১৯৭৪ সালে তো আবার ফুটবল দেখে আরেক ভয়ঙ্কর ফুটবল কৌশল। হল্যান্ড ও ক্রুয়েফের “টোটাল ফুটবল।” এরপর অনেক পরিবর্তন, অনেক স্বপ্নভঙ্গ আর কৌশলের গল্প। যদিও চারজন ডিফেন্ডার ব্যবহারের পদ্ধতির ভীড়ে এখনও কন্তে, ফাভরে বা বিয়েলসার মতো কোচ তিনজনের রক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। সিমিওনে ও মরিনহোর মতো কোচ বিশ্বাস করেন রক্ষণাত্মক ট্যাকটিক্সে। যদিও তার জন্ম এই আধুনিক ফুটবলেই।
একটি নির্মম পরিহাসের গল্প দিয়ে লেখার ইতি টানি। হার্বার্ট চ্যাপম্যানের কৌশল ভেঙে যায় প্রায় ৩০ বছর পর। এই কৌশলের খুঁত বের করে ৪ জনের রক্ষণ পদ্ধতি ও ৪-২-৪ ফর্মেশন ফুটবল বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলেছিল মূলত হাঙ্গেরিই। পরে তাদের বের করা কৌশল ব্যবহার করে অনেক দেশই সাফল্য পেয়েছে, ঘরে তুলেছে বিশ্বকাপ। কিন্তু সেই আবিষ্কারক হাঙ্গেরি, হারিয়ে যাবার পূর্বে বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফির স্পর্শ আর পাওয়া হয়নি।