সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখন

আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ শেষ হয়ে গেছে।ক্যামেরায় এক এক জন করে ক্যারিবীয় খেলোয়াড়ের মুখ ধরছে। বিবর্ণ, পাংশু মুখগুলো যেন লুকানোর জায়গা খুঁজছে। ক্যামেরায় ভেসে আসলো ক্রিস গেইলের মুখখানা। সদাহাস্য গেইলও যেন হাসির খোরাক সব হারিয়ে ফেলেছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো- সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখন এই অবস্থায়! প্রায় তিন দশক ধরে ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, প্রথম দুটি বিশ্বকাপ জেতা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, টানা তিনটি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিংবা ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডস, গ্যারি সোবার্সদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ কী হয়ে গেলো এখন?

ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানেই স্মৃতি কাতরতা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানেই বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন। সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখন স্মৃতি নিয়েই বাস করে। আর কোনো সম্বল যেন নেই তাদের। যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া বিশ্বকাপে ফেভারিট বলে কেউ ছিল না, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ আজ বিশ্বকাপ খেলার জন্য বাছাই পর্ব খেলছে। সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ আজ আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার ভয় পাচ্ছে!

ওয়েস্ট ইন্ডিজের পুরোনো গল্পটায় একটু চোখ বুলানো দরকার। ১৮৮০ সালে প্রথম ক্যারিবীয় অঞ্চলের কিছু স্বাধীন ও অঙ্গরাষ্ট্র মিলে ক্রিকেট খেলার জন্য একটি জোট তৈরি করে। জোটের নাম দেওয়া হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জোট থেকে তৈরী একটি দল প্রথম আমেরিকা ও কানাডা সফর করে। ১৯২৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড নামে এই জোট তখনকার ইম্পেরিয়াল ক্রিকেট কাউন্সিল বা আইসিসির সদস্য পদ পায়। ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তারা প্রথম টেস্ট খেলে।

লিয়েরি কনস্টানটাইন- কালোদের পক্ষে লড়াই করেছিলেন; Source: Wikimedia Commons

১৯৩০ সালেই জর্জ হ্যাডলি, লিয়েরি কনস্টেনটিনদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম টেস্ট জয় পেলেও ষাটের দশক অব্ধি তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ধারাবাহিকতা পাওয়ার জন্য। পঞ্চাশ সালের দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে উত্থান ঘটে বিখ্যাত স্পিন জুটি সনি রামাদিন ও আলফ ভ্যালেন্টাইনের। এই দুজনকে নিয়ে রীতিমতো গান-টানও তৈরী হয়েছিল। দুজনের হাত ধরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজও জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সিরিজে দুই স্পিনারের পাশাপাশি অসাধারণ খেলেছিলেন ফ্রাঙ্ক ওরেল, এভারটন উইকস, ক্লাইড ওয়ালকটরা।

রামাদিন ও ভ্যালেন্টাইন জুটি এরপর অস্ট্রেলিয়া ও ভারত সফরেও দুর্দান্ত পারফর্ম করেন। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বিশ্বসেরা হয়ে ওঠার জন্য একটি রাজনৈতিক মুভমেন্টের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। তখনকার অধিকাংশ সাবেক ও বর্তমান ব্রিটিশ কলোনির মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজেও ছিল সংখ্যালঘু সাদাদের দাপট। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলেও ছিল এই চিত্র। দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে সাদাদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। কিন্তু ক্রিকেটে ও ক্রিকেটের নেতৃত্বে ছিল সাদারাই। এ নিয়ে কালো খেলোয়াড়দের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করে।

সমাজবিজ্ঞানী সিএলআর জেমস দাবী তোলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ কালোদের দল; তাই এখানে কালো অধিনায়কই করা হোক। তার এই দাবীর পক্ষে শক্ত হয়ে কথা বলা শুরু করেন লিয়েরি কনস্টেনটিন। তাদের এই দাবী রীতিমতো রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। ১৯৬০ সালের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজে কোনো ঘোষিত কালো অধিনায়ক কখনো দায়িত্ব পালন করেননি। যদিও লিয়েরি কনস্টেনটিন নিজেই ১৯৩৭-৩৮ মৌসুমে জ্যাকি গ্র্যান্টের ইনজুরিতে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে জন গডার্ডের ইনজুরিতে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হয়েছিলেন জর্জ হ্যাডলি। তবে প্রথম কালো হিসেবে বোর্ড থেকে এ দায়িত্ব পান ফ্রাঙ্ক ওরেল। সব দিক থেকেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে নতুন এক যুগের শুরু হয়। কালোদের অধিনায়কত্বে বিশ্বজয়ের পথে এগিয়ে যেতে শুরু করে ক্যারিবীয়রা।

স্যার ফ্যাঙ্ক ওরেল- প্রথম কালো অধিনায়ক; Source: Indian Express

সে সময়টা ছিল অস্ট্রেলিয়ার। তারা তখন বিশ্বসেরা দল। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল উঠতি পরাশক্তি। দুই দলের সিরিজকে তখন মনে করা হচ্ছিল টেস্টের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। ১৯৬০-৬১ সালে ওরেলের নেতৃত্বে টেস্ট সফরে অস্ট্রেলিয়া যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ব্রিসবেনে প্রথম টেস্ট টাই হয়েছিলো। পরের দুই টেস্ট হলো ড্র। চতুর্থ টেস্ট অস্ট্রেলিয়া অনেক কষ্টে ড্র করার পর শেষ টেস্টে ২ উইকেটের জয় পায় অস্ট্রেলিয়া। একেবারে সুতোর ব্যবধানে এই সিরিজটা জিতে ফিরতে পারলো না ওরেলের দল। তবে সে সময় সারা দুনিয়া এই সিরিজ নিয়ে আগ্রহী হয়েছিল। এর প্রমাণ হলো সেই আমলে ৯০ হাজার ৮ শত দর্শক হয়েছিল এই সিরিজের কোনো একদিনের খেলায়।

পরের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই দল ভারতকে ৫-০ ব্যবধানে সিরিজ হারায়। ১৯৬৩ সালে তারা জয় লাভ করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। অত্যন্ত নাটকীয় এই সিরিজের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন ফ্রাঙ্ক ওরেল। নতুন অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান স্যার গারফিল্ড সোবার্স। ওরেলের প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে, তাকে ম্যানেজার বানিয়ে দেয়া হয়। সোবার্সের নেতৃত্বে দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অত্যন্ত তিক্ত ও বাজে ঘটনার জন্য স্মরণীয় এই সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জেতে ক্যারিবীয়রা। সোবার্সের দল সামলানোর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বিভিন্ন অঙ্গন থেকে। ষাটের দশক জুড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এই পারফরম্যান্সটা ধরে রাখে।

ঠিক সর্বজয়ী নয়, তবে সবচেয়ে দাপুটে দলগুলোর একটা ছিল তারা তখন। ওয়েস হল, গ্রিফিথ, ল্যান্স গিবস ও সোবার্স নিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই উঠতি শক্তির দলের বোলিং প্রাণ ছিলেন। সত্তরের শুরুর দিকে একটু বিপাকেই পড়েছিল এ দল। হণ ও গ্রিফিথ অবসর নেন। তাদের বিকল্প পাওয়া যাচ্ছিল না। সোবার্সের পর অধিনায়ক হিসেবে রোহান কানহাই ভালো কিছু করতে পারছিলেন না। ১৯৭৩-৭৪ মৌসুমে এসে কানহাই ও সোবার্সও অবসর নিয়ে নেন। একটা যুগের সমাপ্তি হয়। আরো ভালো করে বললে বলা যায়, শুরু হয় এক নতুন যুগ- ক্লাইভ লয়েডের যুগ।

১৯৬৬ সালে টেস্টে অভিষেক হওয়া ক্লাইভ লয়েড অধিনায়কত্ব পেয়ে প্রথম সফরে অনায়াসে ভারতকে হারান। লয়েডের টিম ধীরে ধীরে জমে উঠতে থাকে। গর্ডন গ্রিনিজ এই সিরিজে বড় রান পান। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ১৯২ রানের ইনিংস খেলেন ভিভিয়ান রিচার্ডস। লয়েড নিজে ডাবল সেঞ্চুরি করেন। আস্তে আস্তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বজয়ী দলের কাঠামোটা তৈরি হতে থাকে।

অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং, কলিন ক্রফট ও জোয়েল গার্নার- চার ভয়ানক ফাস্ট বোলার; Source: Adrian Murrell/Getty Images

১৯৭৫ সালে প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে অনেকটা চমকে দেয় লয়েডের দল। তাদের হারিয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জেতে ক্যারিবিয়রা। তখনও দলটা সর্বকালের সেরা রূপে আবির্ভূত হয়নি। অস্ট্রেলিয়া সফরে তারা পেয়ে যায় ফাস্ট বোলার মাইকেল হোল্ডিংকে। পরের বছর অভিষেক হয় কলিন ক্রফট ও জোয়েল গার্নারের। দুই বছর পর আসেন ম্যালকম মার্শাল। ক্লাইভ লয়েড এবার হয়ে ওঠেন নৃশংস এক অধিনায়ক। মাঠে একসাথে নামিয়ে দেন চার ভয়ানক ফাস্ট বোলারকে। এই চার ফাস্ট বোলারের সাথে ব্যাটিংয়ে গ্রিনিজ, হেইন্স, কালিচরণ, রয় ফ্রেডরিকস, ভিভ রিচার্ডস এবং লয়েড নিজে। একবার কল্পনা করুন কী ভয়ানক এক দল।

ক্লাইভ লয়েড ও ভিভ রিচার্ডস © AP

এরপরের ঘটনাগুলো স্রেফ রূপকথার মতো। একের পর এক টেস্ট সিরিজ জয়, ব্লাক ওয়াশ চলতেই থাকে। এর মধ্যে ক্যারি পেকার সিরিজ এসে একটু ধাক্কা দিয়েছিল বটে। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরাক্রম কিছুতেই কমার নয়। টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জেতে তারা। তৃতীয় বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের কাছে অঘটনের শিকার না হলে টানা তৃতীয় ট্রফিও জেতা হতো।

১৯৮৪-৮৫ সালে লয়েড অবসর নেন। এরপর ভিভও লয়েডের এই ধারা ধরে রাখেন। তবে এ দশকের শেষ দিক থেকেই শুরু হয় পতনের শব্দ। ১৯৮৭ সালে গার্নার ও হোল্ডিং অবসর নেন। নব্বইয়ের শুরুতে এসে ভিভ, গ্রিনিজ, ডুজন অবসর নেন। এদের জায়গা নিতে হিমশিম খাচ্ছিল রিচি রিচার্ডসনের দল। যদিও ব্রায়ান লারার মতো সর্বকালের সেরা প্রতিভাদের একজন এই সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে যোগ দেন। কিন্তু সোনালী দলের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেননি ওয়ালশ, অ্যাম্ব্রোস ও কার্ল হুপাররা। আরো বছর পাঁচেক লাগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পতনটা দৃশ্যমান হতে। তবে পতন ঘটেই। আর লারাদের প্রজন্মের বিদায়ের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরিণত হয় এক স্মৃতিচারণকারী দলে।

ব্রায়ান লারা- শেষ মহাতারকা; Source: AP File

হ্যাঁ, এর মধ্যে ক্রিস গেইলরা এসে কখনো কখনো বিশ্বকে বিনোদিত করেছেন। ড্যারেন স্যামির নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে। কিন্তু আগের সেই পরাক্রম আর দেখানো হয়নি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বোর্ডের দুর্নীতি, খেলোয়াড়দের সাথে বোর্ডের প্রবল মনোবিরোধ, খেলোয়াড়দের অবসর ও হঠাৎ হঠাৎ চলে যাওয়া। সবমিলিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখন এক ধ্বংসস্তুপ।

একসময় যে বিশ্বকাপ ছিল তাদের মালিকানায়; আজ সেই বিশ্বকাপে খেলতে বাছাইপর্বে লড়তে হচ্ছে ক্যারিবিয়দের। নিয়তি আর কাকে বলে!

Featured photo © AllSportUK

Related Articles

Exit mobile version