আমাদের শৈশবের সবচেয়ে আনন্দঘন স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন বোর্ড গেম। ঝড়-বৃষ্টিতে যখন বাইরে খেলতে যাওয়া মানা কিংবা সাঁঝের হারিকেন-কুপির আলোয় বারান্দায় বসে যখন বাড়ির ছেলে-বুড়ো সকলের খেলার নেশা চেপে বসে, তখন ‘কানা-ছক্কা’র লুডুর মতো বোর্ড গেমগুলো আমাদের সঙ্গ দেয়। প্রাচীনকালের রাজকীয় পাশা খেলা থেকে শুরু করে লুডু, দাবা, ডোমিনোস, স্ক্র্যাবল, সুডোকো, তাস এবং মনোপলির মতো বিভিন্ন বোর্ড গেইম আমাদের নির্মল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বোর্ডের চারকোনায় বন্দি হয়ে আছে আমাদের হাজারো স্মৃতি, মিশে আছে হাসি-ঠাট্টার হাজারো গল্প। তেমনি এই বোর্ড গেমগুলোরও আছে নিজস্ব একটি গল্প। প্রতিটি গেম তৈরির পেছনে লুকিয়ে আছে একটি অজানা ইতিহাস। আমাদের দেশে সহজলভ্য বোর্ড গেমের মধ্যে মনোপলি কিংবা ‘ধনী হবার মজার খেলা’ অত্যন্ত জনপ্রিয়। বোর্ডের উপর দুটো ছক্কা ছুঁড়ে দিয়ে যে কেউ যোগ দিতে পারে ধনী হবার এক শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিযোগিতায়। অন্যান্য খেলার ন্যায় এরও একটি ইতিহাস রয়েছে। আমাদের আজকের প্রবন্ধে জনপ্রিয় মনোপলি কিংবা ধনী হবার মজার খেলার অজানা ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত করা হবে।
মনোপলি কী?
Monopoly একটি ইংরেজি শব্দ যার অর্থ ‘একচেটিয়া অধিকার’। পুরো খেলার ধরন বোঝার জন্য এই শব্দটুকুই যথেষ্ট। দুটি ছক্কার সাহায্যে গুটি চালনার মাধ্যমে মনোপলি খেলা হয়ে থাকে। এখানে প্রতিটি ঘরে বিভিন্ন স্থানের নাম দেওয়া থাকে। খেলার উপকরণ হিসেবে বিভিন্ন হোটেলের মডেল এবং কাগজের তৈরি অর্থ ব্যবহৃত হয়। অর্থ সংরক্ষণের জন্য একটি কাল্পনিক ব্যাংকও রয়েছে। একজন খেলোয়াড় বিভিন্ন স্থানে হোটেল বসানোর মাধ্যমে সেই স্থানের উপর একচেটিয়া অধিকার লাভ করেন। অন্যান্য খেলোয়াড়দের সেই স্থানে অবস্থান করার জন্য হোটেল মালিককে ভাড়া হিসেবে অর্থ প্রদান করতে হয়। শুধু গুটি চালনা ছাড়াও বিভিন্ন কার্ডের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের ভাগ্য নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে। সম্প্রতি বিভিন্ন আকর্ষণীয় ছবি এবং ফিচার সংযোজনের ফলে খেলাটি আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। খেলোয়াড়ের ভাগ্য খারাপ হলে তাকে গুণতে হতে পারে বিশাল অর্থের জরিমানা। এমনকি ভাগ্যে হাজতবাস পর্যন্ত জুটতে পারে!
যেখান থেকে শুরু
মনোপলি বর্তমান যুগে বিনোদনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও মূলত খেলাধুলার উদ্দেশ্যে এটি তৈরি করা হয়নি। এলিজাবেথ ম্যাগি নামক এক আমেরিকান ভদ্রমহিলা একটি বোর্ড গেইমের সাহায্যে হেনরি জর্জ প্রণিত ‘একক কর তত্ত্ব‘ ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে মনোপলির উদ্ভাবন করেন। প্রাথমিকভাবে খেলার নাম দেয়া হয় Landlord’s Game কিংবা ‘জমিদারের খেলা’। কিন্তু কাঠখোট্টা নামের এই খেলাটি বাজারজাত করার পর সাফল্যের মুখ দেখলো না। হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ আগ্রহ নিয়ে কয়েক সেট কিনলো। কিন্তু কয়েক মাস পরে লোকসানের মুখে তা বিক্রি বন্ধ হয়ে গেলো। তবে ম্যাগির বোর্ড গেমটি শিক্ষাক্ষেত্রে সমাদৃত হতে থাকলো। বিশেষ করে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ক্লাসে এই বোর্ড গেম ব্যবহারের মাধ্যমে কর সম্পর্কিত বিভিন্ন জটিল তত্ত্ব বেশ সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলো। ম্যাগি চেয়েছিলেন, মানুষ এই খেলার মাধ্যমে সম্পদের প্রতি লোভের কুপ্রভাব সম্পর্কে সচেতন হবে। কিন্তু বিনোদনের মাঝে শর্ত থাকতে পারে না। তাই খুব দ্রুত ম্যাগির বোর্ড গেমটি বাজার থেকে উঠিয়ে নেওয়া হলো।
বর্তমান যুগের মনোপলির তুলনায় ম্যাগির খেলাটি অত্যন্ত জটিল ছিল। যদিও তা বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি, তবে তা অন্যান্য গেম ডিজাইনারের নজরে পড়ে। তারা যদিও খেলার জটিল নিয়মকানুন পছন্দ করেননি, কিন্তু অনেকেই গেমটির পরিবর্তিত সংস্করণ বের করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ডন লেম্যান নামক এক ডিজাইনার ‘ফিন্যান্স’ নামক একটি বোর্ড গেম বের করেন যা ম্যাগির গেমের অপেক্ষাকৃত সহজ সংস্করণ ছিল। এর কিছুদিন পরেই রুথ হাস্কিনস নামক আরেক ডিজাইনার আটলান্টা শহরের উপর ভিত্তি করে গেমটির নতুন সংস্করণ বের করেন। নতুন সংস্করণগুলো ব্যবসায়িকভাবে সফল হলো। বেশ কিছু অঞ্চলে খেলাটি কিশোর এবং তরুণদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করলো। কিন্তু তখনও খেলাটি আধুনিক মনোপলি পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
ফিলাডেলফিয়ার ভদ্রলোক
ফিলাডেলফিয়া শহরের চার্লস ডারো তার প্রিয় বন্ধু চার্লস টডের বাসায় আড্ডা দিচ্ছিলেন। কথাচ্ছলে টড তাকে বাজারে বিক্রি হওয়া নতুন বোর্ড গেম সম্পর্কে বলছিলেন। টডের মুখে গেমের কথা শুনে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন ডারো। মনে মনে চিন্তা করলেন, যেভাবেই হোক একবার খেলে দেখতে হবে এই নতুন খেলাটি। তিনি টডকে নিজের আগ্রহের কথা জানান। টড তার প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হয়ে যান। চার্লস ডারো বেশ কয়েকবার গেমটি খেলার পর অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি খুব দ্রুত গেমটির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। তবে সাদামাটা বোর্ডের উপর খেলতে ডারোর সামান্য বেমানান লাগছিলো। তাই ডারো সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি নিজে বোর্ডের নকশা করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। ডারো নিবিড় মনে কাজ করতে লাগলেন বোর্ডের উপর। বাদামী কাগজের উপর রঙিন ছবি সংযোজনের মাধ্যমে বোর্ডটি আরও আকর্ষণীয় করে তোলা হলো। হোটেল এবং বাসার জন্য ব্যবহৃত টোকেনের বদলে ছোট আকারের প্রতীকী বাসার প্রচলনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে সাজিয়ে তোলেন গেমটিকে। তিনি নতুন বোর্ডের নাম দেন ‘মনোপলি‘। ১৯৩৩ সালে সর্বপ্রথম মনোপলি বাজারজাত করা হয়।
শুরুতে তেমন সাড়া ফেলতে না পারলেও গেমটি পার্কার ব্রাদার্স কোম্পানির নজরে আসে। ১৯৩৫ সালে পার্কার ব্রাদার্স চার্লস ডারোর নিকট গেমটি ক্রয় করার আবেদন করে। প্রায় ৭ হাজার ডলার বিনিময়ে ডারো গেমটি বিক্রি করে দেন। পার্কার ব্রাদার্সের মোড়কে মনোপলি খুব দ্রুত বাজার দখল করতে সক্ষম হলো। গেমের সফলতায় সন্তুষ্ট হয়ে পার্কার ব্রাদার্স ডারোর নামে গেমটি প্যাটেন্ট করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্যাটেন্ট অফিসে বাঁধলো নতুন ঝামেলা। কারণ নাম বদলে ফেললেও এই গেমটির আসল আবিষ্কারক চার্লস ডারো নন। প্যাটেন্ট অফিস থেকে জানানো হলো, মনোপলি বের হবার পূর্বে এলিজাবেথ ম্যাগি এবং ডন লেম্যান কর্তৃক ‘ল্যান্ডলর্ড গেম’ এবং ‘ফিন্যান্স’-এর প্যাটেন্ট করা হয়েছে। তাই মনোপলির আসল সত্ত্বাধিকারী চার্লস ডারো নন। কিন্তু পার্কার ব্রাদার্সরা সহজে হাল ছাড়তে নারাজ। তারা দ্রুত ডন লেম্যান এবং এলিজাবেথ ম্যাগির সাথে যোগাযোগ করে এবং ১,৫০০ ডলারের বিনিময়ে গেমটির সত্ত্ব ক্রয় করে নেয়। পার্কার ব্রাদার্স কর্তৃক সত্ত্ব বাতিলের পরও ডারো কয়েক মিলিয়ন ডলার আয় করে ফেলেন।
নতুন সত্ত্ব পাওয়ার পরও পার্কার ব্রাদার্স এলিজাবেথ ম্যাগির পুরাতন সংস্করণে ফিরে যায়নি। কারণ ম্যাগির ল্যান্ডলর্ড গেমের শেষ পরিণতি ছিল দেউলিয়া হয়ে যাওয়া। এই সম্পর্কে গার্ডিয়ানের ভিডিও গেম সমালোচক ট্রিস্টান ডনোভান বলেন,
“একজন খেলোয়াড় মনোপলি বোর্ডের দিকে তাকিয়ে নিজেকে একজন সুখী ধনী হিসেবে দেখতে পায়। আর ধনী হবার মতো আনন্দের অনুভূতি আর কী হতে পারে? আপনি নিজেও চাইবেন না দেউলিয়া হতে, সেটা গেম হোক কিংবা বাস্তব! যদি সেটা প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে নিঃস্ব করে ধনী হতে হয় তাহলে ব্যাপারটা আমার কাছেও একদম মন্দ নয়।”
মনোপলির বিরুদ্ধে ‘অ্যান্টি-মনোপলি’
মনোপলি খেলায় একজন খেলোয়াড় একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে ধনী হতে পারেন। কিন্তু অনেকের নিকট এই খেলার ধরণ পছন্দ হলো না। অনেকেই আশঙ্কা করতেন, এই খেলার মাধ্যমে কিশোর এবং তরুণরা সম্পদের প্রতি আরো লোভী হয়ে উঠবে। কিন্তু আপনি অনৈতিকতার দোহাই দিয়ে জোর করে কাউকে মনোপলির মতো বিনোদনমূলক গেম থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন না। এই সমস্যার সমাধান নিয়ে হাজির হলেন এক সাধারণ কলেজ শিক্ষক। ১৯৭৩ সালে রালফ অ্যান্সপেক নামক সেই কলেজ শিক্ষক মনোপলির বিরুদ্ধে নতুন আরেকটি গেম প্রচার করা শুরু করেন। গেমের নাম রাখা হয় ‘অ্যান্টি-মনোপলি’।
মনোপলির মতো একচেটিয়া আধিপত্য না থাকলেও এর ভেতর বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। প্রতিটি খেলোয়াড় সমানভাবে খেলায় বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখতে পারে। এর ফলে অনেকের কাছে গেমটি মনোপলির চেয়েও বেশি প্রিয় হয়ে উঠে। এই ঘটনায় পার্কার ব্রাদার্সের কর্মকর্তারা ভীষণভাবে চটে যান। ১৯৭৬ সালে তারা মামলা করে বসেন রালফের বিরুদ্ধে। কিন্তু আদালতে পার্কার ব্রাদার্সের মামলা খারিজ হয়ে যায়। মনোপলির ন্যায় এই খেলাটিও দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৭ সালে এই খেলার নতুন সংস্করণ বের হয়। এখন পর্যন্ত অ্যান্টি-মনোপলির বেশ কয়েকটি সংস্করণ বাজারজাত করা হয়েছে।
দেশে-বিদেশে মনোপলি
১৯৩৬ সালে পার্কার ব্রাদার্সের সহায়তায় ইংল্যান্ডের লিডস কাউন্টিতে মনোপলি রপ্তানি করা হয়। সেখানে লণ্ডনের বিভিন্ন স্থানের নামের ব্যবহারের মাধ্যমে মনোপলির নতুন সংস্করণ বাজারজাত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় লিডসেও গেমটি ব্যবসাসফল হয়। শেষপর্যন্ত গেমটি পুরো ইংল্যাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। ইংল্যাণ্ডে সফলতার মুখ দেখে পার্কার ব্রাদার্স গেমটি ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, স্পেন, জার্মানী এবং ইতালিতে রপ্তানি করে। প্রতিটি দেশ নিজস্ব শহরের নামানুসারে গেমটির নতুন সংস্করণ বাজারজাত করতে থাকে।
১৯৮৮ সাল পর্যন্ত গেমটি রাশিয়ায় নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু গেমটির রুশ সংস্করণ বের করার পর সেটি মস্কোতে বাজারজাত করার অনুমতি প্রদান করা হয়। রুশ সংস্করণে টোকেন হিসেবে ব্রিটিশ মদের পরিবর্তে রুশ বিয়ার ব্যবহার করা হয়েছিলো। ১৯৯১ সালে হাসব্রো নামক এক প্রতিষ্ঠানের নিকট পার্কার ব্রাদার্সকে বিক্রি করে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে হাসব্রো মনোপলি খেলা বাজারজাতকরণের সম্পূর্ণ অধিকার লাভ করে। এর কিছুদিন পর মনোপলির ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন ঘটে।
ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্রে স্থানীয় নামে বিক্রি হতে থাকে মনোপলি গেম। আমাদের বাংলাদেশে মনোপলির নামকরণ করা হয় ‘ধনী হবার মজার খেলা’ হিসেবে। আমেরিকা-ইউরোপ জয় করে উপমহাদেশের মাটিতেও তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে মনোপলি। প্রতি দুই-তিন বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মনোপলি চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন করা হয়। স্পেনের জাফ্রা ফারনান্দেজ বর্তমান মনোপলি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তবে ২০০৪ সালে সর্বশেষ মনোপলি চ্যাম্পিয়নশিপের পর আর কোনো প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়নি।
নগরায়নের যুগে মানুষের বিনোদনের মাধ্যম বিভিন্ন পার্ক এবং মাঠের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ব্যস্ত জীবনে নির্মল পারিবারিক বিনোদনের আশায় মানুষ মনোপলির মতো বিভিন্ন বোর্ড গেমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। মানুষের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে মনোপলিরও বিভিন্ন সংস্করণ বাজারজাত করা হচ্ছে। বন্ধু-বান্ধব, পরিবারের সদস্যদের অংশগ্রহণে এই খেলার মাধ্যমে চমৎকার কিছু সময় কাটানো যায়। তাই দিন দিন এর জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ফিচার ইমেজ: The Spruce