৩০ আগস্ট, ২০১৯। রোদের তাপ প্রচন্ড নয়। সূর্যও তখন অস্তাচলমুখী হয়ে পড়েছে। তারপরও মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে বসে ঘামছেন উপস্থিত সবাই। আবহাওয়া এমনই উষ্ণ ছিল। মাঠে তখন প্রস্তুতি ম্যাচ চলছে। আসলে ম্যাচের আবহে অনুশীলন বলাই ভালো। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে একমাত্র টেস্টের জন্য দুই দিনের প্রস্তুতি ম্যাচের প্রথম দিনের খেলা তখন প্রায় শেষ পর্যায়ে।
পড়ন্ত বিকেলের ওই সময়ে ড্রেসিংরুম থেকে বের হয়ে এসে বাউন্ডারি লাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের হেড কোচ রাসেল ডমিঙ্গো। শিষ্যদের খেলা দেখছেন। বোলার তখন তাসকিন আহমেদ, ব্যাটসম্যান আবু জায়েদ রাহী ও শফিউল ইসলাম।
গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে কোচের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের চেষ্টাটা বিফলে যায়নি। তার মিনিট বিশেক আগে অবশ্য আফগানদের বিরুদ্ধে টেস্টের জন্য বাংলাদেশ দল ঘোষণা করেছিল বিসিবি, তাও সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। এবং দল নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু।
নতুন কোচ, তাছাড়া বাংলাদেশের হয়ে এটাই তার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। সংবাদকর্মী হিসেবে কোচের সঙ্গে আলাপের চেষ্টাটা সফলতায় ভরে না উঠলেও বৃথা যায়নি। কথাচ্ছলেই কোচের কাছে প্রশ্ন ছিল টেস্ট দলটা কেমন হলো? রাসেল ডমিঙ্গো হেসে জানালেন, দল ভালো হয়েছে।
দলে একই ধরনের দুই জন অফস্পিনিং অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ ও নাঈম হাসান। এটা কীভাবে দেখছেন? কোচ বললেন, দল নিয়ে আমি কিছু বলবো না। এটা নির্বাচকদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন। দূরে দাঁড়ানো প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নুকেও দেখিয়ে দিলেন।
তারপর বাংলাদেশের মিডিয়া তথা সংবাদপত্র কতগুলো, সবকিছুর খোঁজ নিলেন রাসেল ডমিঙ্গো। কী পরিমাণ ইংরেজি দৈনিক আছে, বেশিরভাগ বাংলা ভাষার কি না, এমনও জানতে চেয়েছেন তিনি। সংবাদকর্মীরাও কোচের কৌতূহল মেটালেন। দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়ে কেমন লেগেছে, তাও জানতে চেয়েছেন কোচ। বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা যেতে ভিসার যে ঝক্কি, তা শুনে চমকে গেলেন তিনি। কারণ, ভিসা করাতে হয় কলম্বো থেকে।
বাংলাদেশেও ভালো সময় কাটছে বলে জানালেন রাসেল ডমিঙ্গো। খাবার কেমন? হাসিতে ফেটে পড়ে এই প্রোটিয়া কোচ বলেন, ‘খুব ভালো। দেখছো না এটা (পেট দেখিয়ে) আরও বাড়ছে। ট্রাফিক আছে রাস্তায়। কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট দিয়ে আসলে তাড়াতাড়ি আসা যায়। আমার ভালোই লাগছে।’
বাংলাদেশ দলের কোচিং স্টাফে এখন প্রোটিয়াদের আধিক্যের প্রসঙ্গ উঠতেই রাসেল ডমিঙ্গো বলেন,
‘দেখো, রায়ান কুকের সঙ্গে আমি আগে কাজ করিনি। অত পরিচিতি নেই। তবে ওর সম্পর্কে তোমরা জানো তো, ওর বাবা জেমি কুক বড় ক্রিকেটার ছিলেন। ভাই স্টিভেন কুকও খেলেছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আর নতুন ফিজিও জুলিয়ান ক্যালেফাতো, তাকে আমি চিনি না, দেখিওনি কখনো। বাকিরা আমরা পরস্পরকে জানি।’
ঢাকায় রাসেল ডমিঙ্গো ও চার্ল ল্যাঙ্গেভেল্ট একসঙ্গেই থাকছেন। একসঙ্গে থাকার প্রশ্ন করতেই রসিকতায় মাতলেন বাংলাদেশ কোচ। প্রশ্নকর্তাকে থামিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন,
‘দেখো, আমরা একই হোটেলে থাকি। কিন্তু একসঙ্গে একই রুমে থাকি না। তুমি যা বলছো, বিষয়টা ঠিক এমন নয়।’
রসিকতা ধরতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত সবাই হাসতে শুরু করেন।
দল নিয়ে কথা বলবেন না, শুরুতেই বলে দিয়েছেন। তবে মুস্তাফিজুর রহমানের প্রসঙ্গ আসতেই রাসেল ডমিঙ্গোর মুখ থেকে কয়েকটি বাক্য পাওয়া গেল।
লাল বলে কোচের বিবেচনাতে নেই মুস্তাফিজ
সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কোচের এই সংক্ষিপ্ত আলাপের সময় ঠিক কয়েক গজ দূরে ডাগআউটে সতীর্থদের সঙ্গে বসে ছিলেন মুস্তাফিজ। আফগানদের বিরুদ্ধে টেস্ট দলে রাখা হয়নি বাঁহাতি এই পেসারকে। নির্বাচকরা দিয়েছেন হালকা ইনজুরি ও বিশ্রামের তত্ত্ব। যদিও কোচের কথায় মিলল অন্য আভাস।
কোচ, মুস্তাফিজ কেমন আছে? ও কি ইনজুরড? ডমিঙ্গো বলেন, ‘ফিজ ভালোই আছে।’ কিন্তু টেস্ট দলে তো নেই। তখন এই প্রোটিয়া কোচ জানলেন,
‘ও হোয়াইট বল ক্রিকেটার। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টির খুব ভালো বোলার। আপনারা দেখেন, বিশ্বের সব বোলাররা সব ফরম্যাট খেলে না। দক্ষিণ আফ্রিকার ডেল স্টেইনকে দেখেন, ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রড-অ্যান্ডারসনকে দেখেন। ওরা সব ফরম্যাট খেলে না।’
এই প্রসঙ্গের হেতু ধরেই টেস্টের জন্য আলাদা পেস বোলিং গ্রুপ তৈরির কথা বলতেই কোচ বললেন,
‘অবশ্যই এটা করতে হবে। সবাই সব ফরম্যাট খেলবে না। টেস্টের জন্য আলাদা পেসার তৈরি করতেই হবে।’
পেস বোলার হিসেবে এবাদত হোসেন, তাসকিন আহমেদেরও প্রশংসা করেছেন রাসেল ডমিঙ্গো। এবাদতের ভলিবল খেলার দক্ষতা সম্পর্কে জানা হয়েছে হেড কোচের। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হয়ে পেশাদার ভলিবল খেলার বিষয়টি জেনেছেন তিনি। তাসকিন ও এবাদত ভালো বোলার বলেও রায় দিলেন তিনি।
এর মধ্যেই আবু জায়েদ রাহী তাসকিনের বলে উইকেটের পেছনে মুশফিকুর রহিমের হাতে ক্যাচ দিলেন। শেষ হলো বিসিবি লাল দলের ব্যাটিং। শেষ হলো দিনের খেলা। ক্রিকেটাররা ফিরছেন ড্রেসিংরুমের দিকে। রাসেল ডমিঙ্গোও ছুটলেন সেদিকে। যাওয়ার সময় বললেন, ভালো থেকো। কথা হবে আবার। আমি যাচ্ছি এখন।
মুস্তাফিজকে আবারও বিশ্রাম
৩০ আগস্ট দুপুরেই টেস্ট দল ঘোষণার জন্য বিসিবি সভাপতির অনুমোদন পেয়ে গিয়েছিলেন নির্বাচকরা। বিকেলে অবশ্য নির্বাচক হাবিবুল বাশার জানালেন, কোচের ইচ্ছা, আগে ক্রিকেটারদের সঙ্গে মিটিংয়ে দলটা বলা। তারপর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা হোক। কোচের অনুরোধ পালনে অপেক্ষাও করেছেন নির্বাচকরা। যদিও সেই সময়টা আসার আগেই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দল ঘোষণা করে দেয় বিসিবি।
ঘোষিত ১৫ সদস্যের টেস্ট দলে মুস্তাফিজের না থাকার বিষয়ে অবশ্য হালকা ইনজুরির কথা বলেছেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। তিনি বলেছেন,
‘কন্ডিশনিং ক্যাম্পের মধ্যে মুস্তাফিজের হালকা ইনজুরি পেয়েছি আমরা। গতকাল (বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট) এটি দেখা হয়েছে। সামনে অনেকগুলো টেস্ট ম্যাচ আছে। ভারত সফরও আছে। টি-টোয়েন্টি ত্রিদেশীয় সিরিজ আছে। এই কারণে তাকে বিশ্রাম দেয়া হয়েছে।’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে মুস্তাফিজ টেস্ট খেলেছেন মাত্র ১৩টি। উইকেট নিয়েছেন ২৮টি। টেস্টে তার এখনও পাঁচ উইকেট নেই। বছরের শুরুতেও নিউজিল্যান্ড সফরে একটি টেস্ট খেলানো হয়েছিল তাকে, সেটা বিশ্বকাপের জন্য তাকে সতেজ ও ইনজুরিমুক্ত রাখার জন্যই। নির্বাচকদের ভাষ্য অনুযায়ী, এবার ঘরের মাঠেও বিশ্রামে রাখা হলো তাকে ভবিষ্যতের সূচির কথা ভেবে।
কিন্তু নতুন হেড কোচের ভাবনাকে গুরুত্ব দিলে মুস্তাফিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেই যায়। অবশ্য এখন অব্দি সাদা পোশাকে এই তরুণের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সার্ভিস পায়নি বাংলাদেশ। অদূর ভবিষ্যতে মুস্তাফিজকে টেস্ট খেলতে না দেখলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
তাসকিনের ফেরা, ইমরুলের দুর্ভাগ্য
মুস্তাফিজ ছাড়াও টেস্ট দল থেকে ইনজুরির কারণে বাদ পড়েছেন খালেদ আহমেদ। এখন পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলছে ডানহাতি এই পেসারের। আর তামিম ইকবাল ছুটি নিয়েছেন এই সিরিজ থেকে। দলে ফিরেছেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান, তাসকিন আহমেদ ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। যার মধ্যে চলতি বছরের শুরুতে সাকিব-তাসকিন ছিলেন নিউজিল্যান্ড সফরের টেস্ট দলে। কিন্তু বিপিএলের শেষ দিকে ইনজুরিতে পড়ে দুজনই নিউজিল্যান্ড যেতে পারেননি। হোমে আফগানদের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে ফিরছেন তারা।
তামিম না থাকায় অভিজ্ঞতার কারণে ওপেনিংয়ে নির্বাচকদের বিবেচনায় ছিলেন ইমরুল কায়েস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলে রাখা হয়েছে সৌম্য সরকার, সাদমান ইসলাম অনিককে। সঙ্গে লিটন দাসও আছেন।
ইমরুলের এবার দুর্ভাগ্য বলাই ভালো। কন্ডিশনিং ক্যাম্পের শুরুতে ছিলেন, পরে ছেলের অসুস্থতার কারণে ক্যাম্প ছেড়ে যান। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ইমরুলের ছেলে। ক্যাম্পে না থাকায় এবং পরিস্থিতির কারণে পরে আর বাঁহাতি এই ওপেনারকে আর বিবেচনা করা হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচক।
মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেছেন,
‘ইমরুল কায়েসকে নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করেছিলাম। যেহেতু তামিম নেই, তাই আমাদের ব্যাকআপ খেলোয়াড় আছে। লিটন, সৌম্য, ওরা আছে। ইমরুলকে নিয়ে আমরা চিন্তা করেছিলাম। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওর ছেলে অসুস্থ হওয়াতে সে হাসপাতালে আছে, ডেঙ্গু হয়েছে। এই কারণে সে এখন ক্যাম্পেও নেই, অনুশীলনেও নেই। আমরা আশা করছি, দ্রুতই সে খেলায় ফিরে আসবে।’
ইনজুরির দুর্ভাগ্যের পাকচক্র পেরিয়ে আবারও জাতীয় দলে ফিরেছেন তাসকিন আহমেদ। সর্বশেষ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে টেস্ট খেলেছিলেন তিনি। মুস্তাফিজ না থাকায় দ্রুতগতির এই পেসারের ডাক পাওয়াটা ত্বরান্বিত হয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি লংগার ভার্সনে ভালোই করেছেন তিনি। ভারতের কর্নাটকে মিনি রঞ্জি ট্রফিতে ভালো করায় তার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়েছে। প্রস্তুতি ম্যাচের প্রথম দিনেও চার উইকেট নিয়েছেন তাসকিন।
এই ডানহাতি পেসারের ফেরা নিয়ে প্রধান নির্বাচক বলেছেন,
‘তাসকিন শেষ নিউজিল্যান্ড সফরে ছিল। এরপর বিপিএলে ইনজুরির কারণে বাদ পড়ে। এরপর এখন ইনজুরি থেকে ফিরেছে বিসিবি একাদশের হয়ে। লঙ্গার ভার্সনের ক্রিকেটের যথেষ্ট ভালো করেছে ব্যাঙ্গালুরুতে। তার ইনজুরিতে এখন আপাতত সমস্যা নেই। তাই ওকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
অতিরিক্ত ব্যাটসম্যানের কথা বিবেচনা করে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকেও সুযোগ দেয়া হয়েছে টেস্ট দলে। ব্যাটিংয়ের সঙ্গে স্পিনটাও করতে পারেন বলে নির্বাচকদের বিবেচনায় এগিয়ে ছিলেন এই তরুণ অলরাউন্ডার।
মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেছেন,
‘আমরা অতিরিক্ত একজন ব্যাটসম্যান অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভেবেছি বলে ওকে (মোসাদ্দেক) রেখেছি। আর হোম সাইডে আমরা সবসময় ১৪ জন রাখি। তবে এখন ঘরোয়া ক্রিকেটে যেহেতু খুব বেশি খেলা নেই, তাই একজন অতিরিক্ত খেলোয়াড় নিয়ে যাচ্ছি আমরা। যাকে দরকার হবে, যেহেতু আবহাওয়া এবং কন্ডিশন কঠিন, তাই যেকোনো খেলোয়াড় ইনজুরিতে পড়তে পারে। দলের সাথে এবং সিস্টেমের মধ্যে থাকলে সবসময় তাকে নেয়া যাবে।’
আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টের জন্য বাংলাদেশের দল:
সাকিব আল হাসান (অধিনায়ক), সৌম্য সরকার, সাদমান ইসলাম, মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম, লিটন কুমার দাস, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মোহাম্মদ মিঠুন, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাইজুল ইসলাম, নাঈম হাসান, আবু জায়েদ রাহী, তাসকিন আহমেদ ও এবাদত হোসেন।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে একাদশ:
সাকিব আল হাসান (অধিনায়ক), সৌম্য সরকার, সাদমান ইসলাম, মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম, লিটন কুমার দাস, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাইজুল ইসলাম, নাঈম হাসান।