ক্রোয়েশিয়া বিশ্বকাপ ফাইনাল নিশ্চিত করার পর দেশটির ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাবেক তারকা ফুটবলার ডেভর সুকার বলেছেন,
‘আমরা যুদ্ধ করতে জানি। তাই আমরা জিততেও জানি।’
সংক্ষেপে ক্রোয়েশিয়া সম্পর্কে এর চেয়ে ভালো বর্ননা আর হয় না। লোকেরা কথায় কথায় যখন জীবন যুদ্ধের কথা বলে, ক্রোয়াটরা তখন সত্যিকারের যুদ্ধের ভেতর থেকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকেই কথা বলে। মাত্র আড়াই দশক আগেই এই দেশটিকে যেতে হয়েছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে। সেই যুদ্ধের ফল হিসেবেই পৃথিবীতে এসেছে নতুন দেশ ক্রোয়েশিয়া। স্বাধীনতার ২৭ বছরের মাথায় সেই ক্রোয়েশিয়া এখন বিশ্বকাপ ফাইনালের দল।
ক্রোয়েশিয়ার গল্পটা শুরু থেকেই চমকপ্রদ।
১৯৯৪ সালে ক্রোয়েশিয়া ফিফার ‘বেস্ট মুভার’ পুরষ্কার জিতেছিলো। এক বছরে যেকোনো দেশের তুলনায় র্যাংকিংয়ে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছিলো এই দলটি। সেটা ছিলো ফিফার সদস্য হিসেবে যাত্রা শুরু করার দুই বছর পরের ঘটনা। অনেকেই তখন এতে চমকে গিয়েছিলেন। তবে সেটা ছিলো শুরু মাত্র।
আর দুই বছর পর, ১৯৯৬ সালের ইউরোতে কোয়ার্টার ফাইনাল খেললো ক্রোয়েশিয়া। আরও দুই বছর পর সারা বিশ্ব চমকে গিয়ে দেখলো ফিফা বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে চলে এসেছে ক্রোয়েশিয়া; হলো তারা তৃতীয়। ডেভর সুকার হয়েছিলেন সেই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
এই উড়ন্ত সূচনাটা অবশ্য ধরে রাখতে পারেনি ক্রোয়াটরা। গত ২০ বছর আশানুরূপ উত্থান হয়নি আর দলটির। এর মধ্যে কেবল ২০০৮ সালের ইউরোতে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিলো এই দলটি। তবে ফলাফল না এলেও দলটির ফুটবল প্রতিভা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিলো না। রবিবারের ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার উপস্থিতি একটা চমক হলেও সেটা বিস্ময় কিছুতেই নয়। লুকা মদ্রিচ, ইভান পেরিসিচ, মারিও মানজুকিচ বা ইভান রাকিটিচের মতো ইউরোপের লিগগুলো কাঁপানো তারকারা বলে দেয়, তাদের এখানে আসাটা কোনো অঘটনের ফল নয়। এরা সবাই দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ এক ফুটবল সংস্কৃতির ফসল।
ক্রোয়েশিয়ায় সবসময়ই ফুটবল একটা বড় পরিচয়ের ব্যাপার ছিলো। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অংশ হিসেবে এখানে ফুটবলের একটা দীর্ঘ সংস্কৃতি ছিলো। কিন্তু এখানেই আবার ফুটবল নিয়ে অনেক রকম জটিল, রক্তক্ষয়ী ও অসহিষ্ণু ঘটনা ঘটেছে। ফুটবলের সাথে ক্রোয়াটদের এই জটিল সম্পর্কই কেবল পারে এত সাফল্যের পরও মদ্রিচদের সাথে দেশের মানুষের ভালোবাসা ও ঘৃণার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে।
এই দেশটির কয়েকটি অংশের একটা রক্তক্ষয়ী ইতিহাস আছে। যুগোস্লাভিয়া যখন সম্পর্কের এই টানাপোড়েনে অস্তিত্বের সংকটে পড়লো, তখনই জন্ম নিলো ক্রোয়েশিয়া। তিনটি ধর্ম ও তিনটি জাতিগোষ্ঠীর টানাপোড়েনে জন্ম এই রাষ্ট্রের। সার্ব, ক্রোয়াট ও বসনিয়ানদের মধ্যে রয়েছে শত বছরের হানাহানির ইতিহাস। এই ইতিহাসের পরিণতি হলো, স্নায়ুযুদ্ধের পরের পরিস্থিতিতে, ১৯৯১ সালে ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা। যুগোস্লাভিয়া ভেঙে তৈরি হওয়া নতুন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো ক্রোয়েশিয়া। যদিও এই দেশটির স্বাধীনতায় তাদের ইতিহাসের তুলনায় রক্তক্ষয় কম হয়েছে।
স্বাধীনতার পর নতুন এই দেশটির নতুন পরিচয় তুলে ধরার ক্ষেত্রে দেশটির নেতারা খেলাধুলাকেই বেছে নেন। দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি, এক অর্থে প্রতিষ্ঠাতা, ফ্রাঞ্জো টুজম্যান সচেতন ছিলেন খেলার এই ক্ষমতা নিয়ে। তিনি স্বাধীনতার পর বলেছিলেন, ‘যুদ্ধের পর খেলাধুলাই প্রথম জিনিস, যা দিয়ে আমরা আমাদের ভিন্নতা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে পারবো।’
ফলে ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড় নায়কেরা এখানে অনেক বড় ভূমিকা রাখলেন। দেশটির প্রথম এই নায়ক ছিলেন গোরান ইভানিসেভিচ। উইম্বলডনের ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে টুর্নামেন্ট জিতেছিলেন। ১৯৯১ সালের ইউএস ওপেনে অংশ নিতে গিয়ে প্রথম দুনিয়ার সামনে ক্রোয়েশিয়ার নাম তুলে ধরেছিলেন। সেই সময় তিনি বলেছিলেন,
‘আমার র্যাকেট, আমার বন্দুক।’
ওই ইউএস ওপেনের দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনি স্বদেশী গোরান পিরপিচকে হারান। পিরপিচ ওই সময় একই ধরনের একটা কথা বলেছিলেন,
‘যে কেউ যুদ্ধে যেতে পারে। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো অন্য কিছু করে বাইরের মানুষের সামনে ক্রোয়েশিয়া সম্পর্কে কথা বলতে হবে।’
সেটাই করছিলেন খেলোয়াড়রা।
তবে টেনিস তো ফুটবল নয়। ফুটবল সব অর্থেই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় খেলা। আর ফুটবলই এই যুগোস্লাভিয়া থেকে ক্রোয়েশিয়ায় বড় একটা ভূমিকা রাখলো। এই অঞ্চলের যুদ্ধের ও জাতিগত টানাটানির যে ইতিহাস, তার সাথে ফুটবলের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুগোস্লাভিয়াকে দখল ও ভাগাভাগি করে নিলো অক্ষশক্তি। ক্রোয়েশিয়ার বৃহত্তর অংশ চলে গেলো ইতালির অধীনে। ইতালিয়ানরা শুধু রাষ্ট্রটি দখল করে বসে থাকলো না। তারা বিভিন্ন ক্লাবের নাম বদলে দিলো এবং সেসব ক্লাবকে ইতালিয়ান লিগে খেলতে বাধ্য করলো। এই জায়গাটায় ক্রোয়াট জনগণের আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে উঠলো হাজদুক স্পিলিট ফুটবল ক্লাব। তারা ইতালিয়ানদের অধীনে নাম বদলে খেলার চেয়ে নিজেদের ক্লাব বিলুপ্ত করে দেওয়াই ভালো মনে করলো। এখনও ক্রোয়েশিয়ার জনগন হাজদুককে নিয়ে এই ঘটনার জন্য গর্ব করে।
১৯৯০ সালের বলকান যুদ্ধের সাথেও আছে ফুটবলের সম্পর্ক। বলা হয়, বলকান যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো ক্রোয়েশিয়ার ডায়নামো জারগেব ও সার্বিয়ার রেডস্টার বেলগ্রেড ম্যাচের ভেতর দিয়ে। দিনটা ছিলো ১৯৯০ সালের ১৩ মে। দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে, যারা আসলে দুটি জাতির প্রতিনিধি ছিলো, তাদের দাঙ্গার ফলে এই ম্যাচ বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো। সেদিন থেকে সারা দেশে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এখানেও হাজদুকের সমর্থকরা বড় ভূমিকা রাখে। ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে তারা পার্টিজান বেলগ্রেডের বিপক্ষে এক ম্যাচে গ্যালারি থেকে মাঠে ঢুকে পড়ে। তারপর যুগোস্লাভিয়ার পতাকা নামিয়ে আজকের সুপরিচিত ক্রোয়েশিয়ার পতাকা উড়িয়ে দেয়। বলা হয়, এই পতাকা উত্তোলনই বস্তুত ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা ছিলো।
মানে, ফুটবলই একটি দেশের যুদ্ধের ও স্বাধীনতার ইতিহাস!
ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা এলোও দেশটির ফুটবলের এক স্বর্ণযুগে। ১৯৮৭ সালে যুগোস্লাভিয়া ফিফা যুব চ্যাম্পিয়নশিপ (বর্তমান অনুর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ) জিতেছিলো। সেই দলে ছিলেন ডেভর সুকার, জোনিমির বোবান, রবার্ট জার্নি, রবার্ট প্রোসিনেস্কি, ইগর স্টিমাচ। এরা সবাই ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ দলের প্রাণভোমরা ছিলেন।
যুগোস্লাভিয়ার ফুটবল ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে নব্বই দশকের শুরুতে দারুণ শুরু করেছিলো ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু সেই শুরুটা পরে কেন ধরে রাখতে পারলো না, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন।
ক্রোয়েশিয়ায় এখন ফুটবল লিগে নানারকম দুর্নীতির খবর আসছে পত্রপত্রিকায়। মাত্র কয়েকজন মানুষ নিয়ন্ত্রণ করছিলো দেশটির ফুটবল। তার একজন ছিলেন জ্রাভকো মামিচ। ডায়নামো বেলগ্রেডের প্রধান ছিলেন। এই লোকটিই কিছুদিন আগে অবধি ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলের হর্তাকর্তা ছিলেন।
ক্রোয়েশিয়ার বর্তমান দলটির মাত্র ২ জন খেলোয়াড় দেশের লিগে খেলে। বাকিরা সব ইউরোপের বড় বড় লিগে খেলেন। আর এসব খেলোয়াড় সরবরাহের ক্ষেত্রে মামিচের ছিলো একচ্ছত্র ভূমিকা। তিনি নিজের ক্লাবকেই পাশ কাটিয়ে ইউরোপের ক্লাবগুলোর সাথে চুক্তি করতেন। এরকমই একটা চুক্তি ছিলো লুকা মদ্রিচকে নিয়ে টটেনহ্যাম হটস্পারের সাথে। যেখানে চুক্তির টাকা পাওয়ার কথা ছিলো ডায়নামোর, সেখানে টাকাটা গেলো মামিচের পকেটে। এই অপরাধ আদালতে প্রমাণ হওয়ায় তার জেলের রায় হয়েছে। মামিচ অবশ্য তার আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
এর ফাঁকে আরেকটা ঘটনা ঘটেছে। আদালতে স্বাক্ষী দিতে গিয়ে অপরাধীর পক্ষে অনিশ্চিত কিছু কথা বলেছেন মদ্রিচ নিজে। ফলে তার ওপরও ঝুলছে এখন শাস্তির হুমকি। সেই সাথে মদ্রিচ হয়ে উঠেছেন দেশের মানুষের কাছে ‘ভিলেন’।
এটাও যেন আরেকটা দুর্নীতির সাথে যুদ্ধ এবং সেখানেও জড়িত আছে ফুটবল। ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাস মানেই যেনো ফুটবলের ইতিহাস।
রবিবারের ফাইনালের আগে অনেকে বলছেন, ক্রোয়েশিয়া একটু পিছিয়ে আছে। কারণ, ফাইনালে আসার পথে তারা ফ্রান্সের চেয়ে ৯০ মিনিট ফুটবল বেশি খেলেছে। কিন্তু যুদ্ধি, অপরাধ, আদালত, দুর্নীতি, শাস্তি; এসব শব্দের চাপ নিয়েও যারা ফাইনালে আসতে পারে, নব্বই মিনিট তাদের কাছে আর বিশেষ কী!
ফিচার ইমেজ: AFP