১
একইসাথে সমালোচনা ও সফলতার বিশ্বকাপ হিসেবে অতি পরিচিত বিশ্বকাপটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৪ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে। ব্রাজিলের জন্য সফলতার একটি বিশ্বকাপ গেলেও বিভিন্ন দিক থেকে এ বিশ্বকাপটিতে কলঙ্ক লেগে আছে। ডোপ টেস্টের কবলে পড়ে শুধু বিশ্বকাপ নয়, ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিলো আর্জেন্টাইন কিংবদন্তী দিয়েগো ম্যারাডোনার। কলম্বিয়ান ডিফেন্ডার এসকোবারকে গুলি করে হত্যা করা হয় বিশ্বকাপের একটি ঘটনার রেশ ধরে।
উজ্জ্বল পথে চলছিলো ইতালি দল। সেই পথের রাস্তা দেখাচ্ছিলেন রবার্তো ব্যাজিও। অথচ ব্রাজিলের সাথে ট্রাইবেকারের ইতালিকে হারানোর খলনায়ক ছিলেন তিনিই। রোমারিওকে দলে নিতেই চাননি তৎকালীন ব্রাজিল কোচ। কিন্ত সেবার সেই রোমারিও হয়েছিলেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়। এছাড়াও, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে টাইব্রেকারেরর দেখা পেয়েছিলো পৃথিবী। এতসব ঘটনার ঘনঘটার কারণেই ১৯৯৪ বিশ্বকাপ একইসাথে সমালোচনার ও সফলতার।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপের আগে ১৯৯০ বিশ্বকাপে ভঙ্গুর দল নিয়েও ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ফাইনালে। ফাইনালে রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে জার্মানিকে প্রায় রুখে দিয়েছিলো আর্জেন্টিনা। কিন্তু খেলার একদম শেষের দিকে রেফারি পেনাল্টি দেন জার্মানিকে। ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান বল নিয়ে আর্জেন্টিনার বক্সে ঢুকে পড়লে তিনি বাধার শিকার হয়েছিলেন কি না, তা আজও রহস্য। ক্লিন্সম্যানের ফাউল নিয়ে এত বছর পরেও বিতর্ক চলে।
১৯৯৪ সালে আর্জেন্টিনা দলও তেমন সুবিধাজনক পর্যায়ের ছিলো না। কিন্ত ম্যারাডোনা তো ছিলেন! আর্জেন্টাইনরা তাই ভরসা রেখেছিলো তার উপর। কিন্ত সেবার শুধু মারাডোনার নয়, পুরো আর্জেন্টিনা শিবিরে যেন বিপর্যয় নেমে এলো। ১৯৯১ সালে ড্রাগ টেস্টে কোকেইন সেবনের সত্যতা পাওয়া গেলে ১৫ মাসের জন্য ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন ম্যারাডোনা। ১৫ মাস এবং তার পরবর্তী সময়ে ফুটবলের সাথে ম্যারাডোনার সেই মধুর সম্পর্ক আর ছিলো না। তাই ৩৩ বছর বয়সী ম্যারাডোনার জন্য ১৯৯৪ বিশ্বকাপ ছিলো প্রত্যাবর্তনের। গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে গ্রিসের বিপক্ষে তার ফিরে আসাটাও দারুণ ছিলো। পরের ম্যাচে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনাকে তিনিই জিতিয়েছিলেন। প্রশ্ন তৈরি হয় ঠিক তখনই!
ফিফার সব টুর্নামেন্টেই ডোপ টেস্ট একটি নৈমিত্তিক প্রক্রিয়া। সেখানে যে কাউকেই তারা এই পরীক্ষার জন্য বেছে নিতে পারে। নাইজেরিয়া বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচে আর্জেন্টিনা থেকে বেছে নেওয়া হলো খোদ ম্যারাডোনাকে। মূত্র পরীক্ষায় ম্যারাডোনার শরীরে নিষিদ্ধ নমুনা পদার্থ শনাক্ত করা গেল। রবার্তো পেইদ্রো নামক একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন ১৯৯৪ বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা দলের মেডিকেল টিমের প্রথমসারির কোনো পদে। অথচ পেইদ্রো মারাডোনাকে এমন কোনো নিষিদ্ধ ড্রাগ কখনোই দেননি, তাই ঘটনা একদমই অবাস্তব মনে হতে লাগলো তার কাছে।
পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, ম্যারাডোনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক তাকে ওজন কমানোর জন্য একটি ওষুধ দিয়েছিলেন যার একটা উপাদান ছিল নিষিদ্ধ এফিড্রিন। পেইদ্রো এবং দলের সঙ্গে যুক্ত অন্য সকল সদস্য জোর গলায় বলেছিলেন, তারা এই ওষুধের বিষয় কিছুই জানতেন না। আসলে ম্যারাডোনা নিজেও জানতেন না ওই ওষুধে নিষিদ্ধ এফিড্রিন রয়েছে। শরীরে এফিড্রিনের নমুনা পাবার কারণে বিশ্বকাপ থেকে নিষিদ্ধ হতে হয় তাকে। ম্যারাডোনাহীন আর্জেন্টিনা পরের ম্যাচে হারে বুলগেরিয়ার কাছে। শেষ ষোলোতে রোমানিয়ার কাছে হেরে সেবার বিশ্বকাপ পর্ব শেষ হয় আর্জেন্টিনার। বিশ্বকাপ স্বপ্নভঙ্গের পাশাপাশি সমাপ্ত হয় আর্জেন্টিনার হয়ে ম্যারাডোনা অধ্যায়েরও।
২
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপের এক ম্যাচ। স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে খেলছে কলম্বিয়া। কলম্বিয়াসহ দারুণ খেলছিলেন দলের অধিনায়ক আন্দ্রেস এসকোবার। কিন্ত নির্দিষ্ট সময় পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ২-১ গোলে হেরে যায় কলম্বিয়া। ৩৫ মিনিটে আন্দ্রেস এসকোবারের করা আত্মঘাতী গোলই মূলত হারিয়ে দিয়েছিলো কলম্বিয়াকে। দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া এসকোবার কখনো চাননি খলনায়ক হতে, কখনো ভাবেননি এই আত্মঘাতী গোলের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে তার প্রাণের বিনিময়ে। বিশ্বকাপ থেকে বাদ পরার পর কলম্বিয়ার একটি নৈশক্লাব থেকে বের হয়ে গাড়িতে ওঠার মুহূর্তে আক্রমণের শিকার হন এসকোবার। পরপর ছয়টি গুলি করা হয় তার শরীরে। হাসপাতালে নেবার পর তার মৃত্যু ঘটে। যে তাকে গুলি করেছিলো, প্রত্যেকবার গুলি করার সময় গো-ও-ল, গো-ও-ল বলে ধারাভাষ্যকরের মতো চিৎকার করছিলো। তাই এটা নিশ্চিত, বিশ্বকাপে ৩৫ মিনিটে করা আত্মঘাতী গোলই এসকোবারের মৃত্যু ডেকে এনেছিলো।
৩
সর্বকালের সেরা প্লে-মেকারদের একজন? ইতালির ফুটবলের সেরা আক্রমণভাগের খেলোয়াড়? এসব বিশেষণই রবার্তো ব্যাজিওর সাথে যায়। ‘৯৪ বিশ্বকাপের আগের বছর ব্যালন ডি অর জিতেছিলেন ব্যাজিও। স্বাভাবিকভাবেই দলের ভরসায় পরিণত হয়েছিলেন তিনি। কিন্ত বিশ্বকাপে প্রথম এসে তিন ম্যাচ থাকলেন গোলহীন। দ্বিতীয় পর্বে ইতালি মুখোমুখি হয় সেই বিশ্বকাপের চমক জাগানো দল নাইজেরিয়ার। ম্যাচে ইতালির যখন হতবিহ্বল অবস্থা, তখন গোল পায় নাইজেরিয়া। ইতালির হতাশার সেই ম্যাচে নিজেকে ফিরে পেলেন ব্যাজিও। ৮৮ মিনিট ও ১০২ মিনিটে জোড়া গোল করে ইতালিকে ফেরালেন বিশ্বকাপের স্বপ্নে। এরপর শুধু ব্যাজিওর মুগ্ধতা। স্পেনের সাথে ১-১ গোলে সমতার পর ৮৮ মিনিটে তার জয়সূচক গোল। বুলগেরিয়ার বিপক্ষে জোড়া গোল তাকে সেবার নিয়ে গিয়েছিলো ভিন্ন এক মঞ্চে।
এরপর এলো সেই কাঙ্খিত ফাইনাল, যেখানে ব্যাজিও দলে না থাকলে কখনোই আসতে পারতো না ইতালি। ফাইনালে কোনো দলই নির্ধারিত সময়ে গোল করতে পারেনি। পারেনি অতিরিক্ত সময়েও। তাই ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। উভয়দলের হয়ে পেনাল্টি শট মিস করেন সান্তোস ও বারোসি। পরে ব্রাজিল টানা তিন গোল করার পর পেনাল্টি শট নিতে আসেন ব্যাজিও। তিনি গোল করতে ব্যর্থ হলেই বিশ্বকাপ চলে যায় সেলেসাওদের হাতে। অন্যদিকে, ইতালিকে একাই ফাইনালে টেনে তোলা রবার্তো ব্যাজিও হয়ে উঠলেন খলনায়ক। তবে রোসবোল স্টেডিয়ামে ঐ ভুলের জন্য ইতালি সমর্থকেরা ব্যাজিওকে দোষারোপ করেন না। ব্যাজিও তাদের মনের সম্মান ও ভালোবাসার অংশেই বসবাস করছেন।
৪
১৯৩০ সালে ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হবার পর নানা অদ্ভুত ও রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটলেও ঘটেনি ফাইনালে টাইব্রেকারের ঘটনা। বিশ্বকাপের ১৫ তম আসরে বিশ্বকাপ প্রথমবার দেখে পেনাল্টি শুটআউট। ফাইনালে ইতালি ও ব্রাজিল নির্ধারিত সময় এবং অতিরিক্ত সময়ে গোল করতে না পারায় ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। বিশ্বকাপের ফাইনালে টাইব্রেকারের প্রথম শট আকাশে উড়িয়ে মারেন ইতালির বারোসি। ব্রাজিলের হয়েও গোল করতে ব্যর্থ হন সান্তোস। এরপর ইটালির হয়ে আলবার্তোলিনি ও ইভানি গোল করেন এবং ব্রাজিলের হয়ে একইভাবে গোল করতে সক্ষম হন রোমারিও ও ব্রাঙ্কো।
ইতালির হয়ে চতুর্থ শট মিস করে বসেন মাসসারাও। কিন্ত ওদিকে ঠিকই গোল করতে সক্ষম হন দুঙ্গা। ইতালির হয়ে পঞ্চম শট মিস করে সমর্থকদের হতাশার সাগরে ভাসান ব্যাজিও। ব্যাজিওর মিসে আর কোনো পেনাল্টি শট প্রয়োজন হয়নি বিজয়ীকে নির্ধারিত করতে। ৩-২ গোলে বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম টাইব্রেকারে শিরোপা জিতে নেয় ব্রাজিল।
৫
১৯৭০ সালে সর্বশেষ বিশ্বকাপ জিতেছে ব্রাজিল। মাঝখানে কেটে গেছে ২৪ বছর। টাফারেল, ব্রাঙ্কো, মাজিনহো, কাফু, বেবেতো, রোমারিও, রোনালদোর, দুঙ্গার মতো খেলোয়াড়দের নিয়ে ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দল ছিলো সবথেকে ফেবারিট। সেবার তাদের বড় সুযোগ ছিলো যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ৪র্থ শিরোপা জয় করার। কিন্ত বিশ্বকাপের আগে তারকাপূর্ণ দলে রোমারিওকে নিতে চাননি কোচ কার্লোস পেরেইরা। অনেক অনুরোধের পরে রোমারিওকে দলে নিতে বাধ্য হন পেরেইরা।
পেরেইরা হয়ত পরে বুঝতে পেরেছিলেন, রোমারিওকে সুযোগ না দিলে কত মারাত্মক ভুল তিনি করতেন! ব্রাজিল তাদের সৌন্দর্যের ফুটবল ভুলে গিয়ে রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলেছিলো ঠিকই, কিন্ত ৭ ম্যাচে ৫ গোলে বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ছিলেন রোমারিও। ফাইনালে টাইব্রেকারে পেনাল্টি শটও ঠিকমতো জালে জড়িয়েছিলেন, যেখানে ব্যাজিওর মতো খেলোয়াড় ছিলেন ব্যর্থ। বেবেতো ও ব্যাজিওকে হারিয়ে সেবার বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হয়েছিলেন রোমারিও।