কোপা আমেরিকার পূর্বে : উরুগুয়ে

লাতিন আমেরিকা ফুটবলের নাম শুনলেই প্রথমে উচ্চারিত হয় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের নাম। তবে লাতিন আমেরিকার দলগুলো কিন্তু ইউরোপ মহাদেশের তুলনায় পিছিয়ে। কারণ, সব দেশের লড়াইয়ে, মানে বিশ্বকাপে ২০০২ সালের পর থেকে কোনো লাতিন আমেরিকার দেশ এই ট্রফিটি জেতেনি। তবুও আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের এত পরিচিতির পেছনে কারণ, তাদের ইতিহাস। আর এই দুই দেশ থেকে প্রতিনিয়তই প্রতিভাবান সব খেলোয়াড় তৈরি হয়ে ইউরোপে পাড়ি দিচ্ছে। আবার এই লাতিন আমেরিকার ফুটবল শ্রেষ্টত্বের লড়াইয়েও সবার আগে উচ্চারিত হয় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার নাম। তবে কোপা আমেরিকার লড়াই হওয়া উচিত ছিল তিন ঘোড়ার। কিন্তু সামর্থ্য ও সাফল্য থাকার পরও উরুগুয়ে দেশটিকে নিয়ে অধিকাংশ সময়ে নিশ্চুপ থাকা হয়।

হয়তো উরুগুয়ে সবসময় ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু কিছু কিছু দিক থেকে তারা আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের তুলনায় ঢের এগিয়ে। কোপা আমেরিকার শিরোপা সর্বোচ্চবার ঘরে তুলেছে উরুগুয়ে, এবং বিশ্বকাপও জিতেছে আর্জেন্টিনার সমানসংখ্যক। তবু ধারাবাহিকতা এবং দেশে মেসি বা রোনালদোর মতো তারকা খেলোয়াড় না থাকার কারণে উরুগুয়েকে নিয়ে আলোচনা বাকি দেশগুলো অপেক্ষা কম হয়।

ফ্রান্সের হেরে বাদ পড়ার আগ পর্যন্ত বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলেছিল উরুগুয়ে ; Photo Source : FIFA

উরুগুয়ে নিয়ে ক্ষীণ আলোচনা শুরু হয় বিশ্বকাপ বা কোপা আমেরিকার সময়। গতবার বিশ্বকাপেও উরুগুয়ে আলোচনা তুলে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছালেও সুবিধা তেমন করতে পারেনি। কারণ, ফ্রান্সের মতো দলের সাথে টেক্কা দেবার মত শক্তিশালী নয় বর্তমান উরুগুয়ে। কিন্তু কথা যদি হয় কোপা আমেরিকার মতো প্রতিযোগিতা নিয়ে, তখন দৃশ্যপট ভিন্ন।

উরুগুয়ের কোচ অস্কার তাবারেজ এই দলটির হাল ধরে আছেন সেই ২০০৬ সাল থেকে। অনেক উত্থান-পতন দেখেছেন তিনি। ২০০৬ বিশ্বকাপে তো অংশগ্রহণই করতে পারেনি উরুগুয়ে। তারপর তাবারেজের হাত ধরে ২০১০ বিশ্বকাপে চতুর্থ ও গতবারের ব্রাজিল বিশ্বকাপে পঞ্চম। তবে এমন দীর্ঘমেয়াদে থেকে একদম খালি হাতে বসে নেই ৭২ বছর বয়সী এই কোচ। ২০১১ এর কোপা আমেরিকায় উরুগুয়ে বিজয়ী হয় তার হাত ধরেই। তিনিই যে এই দলটির ধারক-বাহক, এই দলের মূল চালিকাশক্তি, তার প্রমাণ হয়ে গেছে বিশ্বকাপ-পরবর্তী প্রীতি ম্যাচগুলোতে। অসুস্থ থাকার কারণে কোচিং থেকে দীর্ঘদিন দূরে ছিলেন তিনি। সেখানে ফাবিয়ান কইতো’র হাত ধরে ৫ ম্যাচ খেলেছে উরুগুয়ে, তার মধ্যে ৪টিতেই হেরেছে তারা। অস্কার তাবারেজ উজবেকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আবার উরুগুয়ের কোচের আসন নিলে দলটিও পরাজয়ের বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসে। তাই আসন্ন কোপা আমেরিকাতেও উরুগুয়েকে চালনা করবেন প্রবীণ এই কোচ।

উরুগুয়ের প্রবীণ কোচ, অস্কার তাবারেজ ;Photo Source : Sports Illustrated

কোপা আমেরিকাতে ‘ফেভারিট’ দল বলতে এবার ব্রাজিল। আর্জেন্টিনা শক্তিশালী একাদশ নিয়ে লড়বে ঠিকই, তবে বেশ কিছু কারণের উপর ভিত্তি করেই তারা ফেভারিটের তালিকায় আসছে না। টানা দুইবারের চ্যাম্পিয়ন চিলি আর সেই পুরনো চেহারায় নেই। কলম্বিয়া দলের বর্তমান পরিস্থিতিও সুবিধার নয়। তাই ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনাকে টক্কর দেওয়ার মত দেশ শুধুমাত্র উরুগুয়ে। তবে শুধু টক্কর নয়, শক্তিমত্তার বিচারে এই দলটি যেমন এবার আর্জেন্টিনা থেকে এগিয়ে, তেমনই শিরোপা জেতার জন্য উপযুক্ত।

উরুগুয়েকে সর্বশেষ দুই ম্যাচে ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলিয়েছেন তাবারেজ। তবে ৪-৩-১-২ ফর্মেশনে উরুগুয়ে সবথেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, যে ফর্মেশন তিনি ব্যবহার করেছিলেন রাশিয়া বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে। তবে তাবারেজের ট্যাকটিক্স নির্দিষ্ট ফর্মেশন বা ধরনের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। বিপক্ষ দল ও পরিস্থিতি বুঝে শুধু দলের একাদশ নয়, খেলোয়াড়ও পরিবর্তন করেন।

কোপা আমেরিকার দলে এবারও অস্কার তাবারেজ ডেকেছেন তাদের পুরনো সৈনিক ৩২ বছর বয়সী গোলরক্ষক ফার্নান্দো মুসলেরাকে। মুসলেরা কখনো ইউরোপের বড় ক্লাবে খেলেননি, গ্যালতাসারাইয়ের হয়ে তার ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় খেলেছেন বলে পরিচিতি কম। তবে গোলরক্ষক হিসেবে তিনি ইউরোপের সেরা ১০ গোলরক্ষকের তালিকাতেই হয়তো থাকবেন। অতিরিক্ত গোলরক্ষক হিসেবে থাকবেন মার্টিন কাম্পানা ও মার্টিন সিলভা। তবে মুসলেরাই যে বিগত ম্যাচগুলোর মতো উরুগুয়ের গোলবার সামলাবেন, তা নিশ্চিত।

উরুগুয়ের দীর্ঘদিনের রক্ষণপ্রহরী মুসলেরা ;Photo Source : SuperSport

অস্কার তাবারেজের বানানো একাদশ পরবর্তীতে যে রূপই ধারণ করুক না কেন, তার একাদশে চারজনের রক্ষণ ব্যবস্থা থাকবেই। তার দর্শন অনুযায়ী, রক্ষণ দৃঢ় রেখে আক্রমণে যাওয়াটাই সঠিক পরিকল্পনা। রাশিয়া বিশ্বকাপ দিয়ে তাবারেজের একাদশে নতুন লেফটব্যাক ডিয়েগো লাক্সাল্টের আবির্ভাব হয়েছিল, সেবার তিনি খেলেছিলেনও দুর্দান্ত। বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স দেখে এসি মিলান তাকে দলে ভেড়ায়। যদিও পরবর্তীতে সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি, তবু কোপাতে খুব সম্ভবত লেফটব্যাকে তাকেই বিবেচনা করবেন উরুগুয়ে কোচ। যদিও একই সাথে লেফট-মিডেও খেলতে পারেন লাক্সাল্ট। তাই ৪-৪-২ ফর্মেশন ব্যবহার করলে মধ্যমাঠের বাম পাশে তাকে দেখা পাবার সম্ভাবনা আছে। তবে একই ধরণের খেলোয়াড় লিপজিগের মার্সেলো সারাচ্চিকে দলে রেখেছেন তাবারেজ। তাই, তাকেও এ পজিশনে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে।

রাইটব্যাক পজিশনে কোনো ভরসাযোগ্য বা তারকা খেলোয়াড় নেই। মার্টিন কাসেরেস ও জিওভান্নি গঞ্জালেস থেকে একজনকেই বেছে নেবেন তাবারেজ, হয়তো দু’জনকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলাতে পারেন। তবে অভিজ্ঞতা ও ফর্ম বিবেচনা করলে ৩২ বছর বয়সী মার্টিন কাসেরেসের সুযোগ পাবার সম্ভবনা বেশি।

উরুগুয়ের রক্ষণভাগ শক্তিশালী হবার কারণ তাদের সেন্টারব্যাক জুটি। ডিয়েগো গডিন ও হোসে গিমেনেজ তাদের রক্ষণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বয়স ৩০ পার হলেও গডিন এখনও রক্ষণে সেরাদের একজন। আর হোসে গিমেনেজ ধীরে ধীরে উদীয়মান তারকা থেকে বিশ্বসেরা ডিফেন্ডারদের একজন হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও এদের বিকল্প হিসেবে থাকবেন সেবাস্টিয়ান কোয়েটস। সুতরাং, বিশ্বমানের রক্ষণ নিয়েই যে উরুগুয়ে কোপা আমেরিকাতে লড়তে যাবে, তা বলাই বাহুল্য।

গডিন ও গিমেনেজ জুটি ;Photo Source : Getty Image

৪ জন মিডফিল্ডারের একাদশে অস্কার তাবারেজ রদ্রিগো বেন্টানকুরকে ব্যবহার করেন অনেকটা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে, যিনি মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ গড়ে তোলেন ও স্ট্রাইকারদের বলে যোগান দেন। বিপরীতে প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দিতে সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ পজিশনে থাকেন লুকাস তোরেইরা, যাকে অনেকে ডাকেন ‘ক্ষুদে ডাইনামাইট’। লুকাস তোরেইরা অনেকটা ব্রাজিলিয়ান ক্যাসেমিরোর দ্বিতীয় সংস্করণ। তাবারেজের এ ফর্মেশনে লুকাস তোরেইরার দুই পাশে থাকেন দুইজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার। তারা যেমন আক্রমণ গড়ে তোলেন, তেমনি আক্রমণ নষ্টও করে ফেলতে পটু। এক কথায়, তারা পূর্ণাঙ্গ মাঝমাঠের খেলোয়াড়। বিশ্বকাপে উরুগুয়ে কোচ এই পজিশনে ব্যবহার করেছিলেন মাতিয়াস ভেসিনহো ও নাহিতান নানদেজকে। খুব সম্ভবত ৪-৩-১-২ ফর্মেশন ব্যবহার করে এভাবেই মধ্যমাঠ সাজাবেন অস্কার তাবারেজ।

তাই জুভেন্টাসের তারকা খেলোয়াড় রদ্রিগো বেন্টানকুর, লুকাস তোরেইরা ও মাতিয়াস ভেসিনহোর থাকা নিশ্চিত। তবে ফর্ম বিবেচনা করলে, নাহিতান নানদেজ ও নিকোলাস লদেইরো থেকে একজনকে বেছে নেবেন উরুগুইয়ান কোচ। রিয়াল মাদ্রিদের এ মৌসুমের উদীয়মান তারকা ফেদ্রিকো ভালভার্দেকেও দলে রেখেছেন তিনি। তবে তিনি লুকাস তোরেইরা’র বিকল্প খেলোয়াড় হিসেবে বেঞ্চেই থাকবেন।

উরুগুয়ের রক্ষণভরসা লুকাস তোরেইরা ;Photo Source : Getty Image

বার্সেলোনার স্ট্রাইকার লুইস সুয়ারেজ বর্তমানে ইনজুরিতে। এ মৌসুমে তার ফর্মও তেমন ভালো ছিল না। তবুও দলের সেরা খেলোয়াড় ছাড়া স্কোয়াড ঘোষনা করেননি উরুগুয়ে কোচ। ইনজুরিতে আক্রান্ত আরেক স্ট্রাইকার এডিনসন কাভানিও আছেন তার স্কোয়াডে। এই দুই পরীক্ষিত স্ট্রাইকার ইনজুরি কাটিয়ে কতটা ভালো পারফরম্যান্স দলকে দিতে পারবেন, তাতে কিছুটা সন্দেহ থেকেই যায়। তবে অভিজ্ঞ এ দুইজন ছাড়াও দলে আছেন ম্যাক্সি গোমেজ ও ক্রিশ্চিয়ান স্টুয়ানির মতো স্ট্রাইকার। এদের অভিজ্ঞতা বা গোল করার দক্ষতা, কোনোটাই মন্দ নয়। তাই বিশেষ কোনো সমস্যা না হলে কোপা আমেরিকায় আক্রমণভাগ তেমন ভোগাবে না উরুগুয়েকে।

তাবারেজের আক্রমণ ভরসা, কাভানি ও সুয়ারেজ ; Photo Source : The National

দেখতে শক্তিশালী এই দলের সবার একাগ্রতা ভালো থাকলেও স্কোয়াডে সবার বিকল্প রাখতে পারেননি তাবারেজ। বেন্টানকুরের সঠিক কোনো বিকল্প খেলোয়াড় নেই দলে। মিডফিল্ডের ডানপাশের খেলা লদেইরো বা নানদেজ কেউই তেমন রক্ষণাত্মক নয়। উপরন্তু, পরীক্ষিত কোনো রাইটব্যাক নেই দলে। তাই যেভাবেই একাদশ সাজানো হোক না কেন, দলের ডান অংশ বরাবরই দুর্বল থেকে যাবে। সেক্ষেত্রে, আক্রমণ এবং রক্ষণ উভয়ক্ষেত্রেই তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে যাবে এই দলটি।

খুঁটিনাঁটি সমস্যা প্রত্যেক দলেই থাকে। কিছু দল সেসব সমস্যা সমাধান করে এগিয়ে যেতে পারে, আবার অনেকে সেখানেই থমকে যায়। অস্কার তাবারেজের কাছে উরুগুয়ের এই দলটি নিজের হাতের তালুর মতোই পরিচিত। দলের উপর আসা অনেক ঝড় প্রতিবার তিনি একাই সামলেছেন। শেষবার কোপা আমেরিকা জেতা দলের পর বর্তমানের এই দলটিও অনেক প্রতিশ্রুতিময়। দেখা যাক, অস্কার তাবারেজের দীর্ঘ কোচিং ক্যারিয়ার আর উরুগুয়ের খেলোয়াড়দের বিজয়াকাঙ্ক্ষী মনোভাব কতটা কাজে দেয় এবারের কোপা আমেরিকার আসরে।

This article is in Bangla language which is about the national team of Uruguay in Copa America tournament 2019. References are hyperlinked inside the article.

Feature Image : AP Photo/Andre Penner

Feature Source:

1.https://www.google.com/amp/s/www.goal.com/en/amp/news/suarez-included-in-uruguays-final-copa-america-squad-despite/wqc2zvdj62xe1rlago7wu9px3

2.http://futebolcidade.com/outsiders-the-best-of-the-rest-at-this-years-2019-copa-america/

Related Articles

Exit mobile version