চ্যাম্পিয়নস লিগের নতুন মৌসুমের গ্রুপপর্বের ড্র’র অনুষ্ঠানে ঘোষণা করা হয় উয়েফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের নাম। পাশাপাশি সেরা গোলরক্ষক, সেরা ডিফেন্ডার, সেরা মিডফিল্ডার ও সেরা ফরোয়ার্ডের পুরস্কার তো থাকেই। মেসি-রোনালদোর রাজত্ব গতবার ভেঙে ফেলেছিলেন ক্রোয়েশিয়ান মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচ। এবারও হল্যান্ডের ডিফেন্ডার ভার্জিল ভ্যান ডাইক উয়েফা বর্ষসেরা পুরষ্কার নিজের ঝুলিতে তুললেন মেসি ও রোনালদোকে পেছনে ফেলে।
তবে এ অনুষ্ঠানে কে বর্ষসেরা হচ্ছে, তা থেকেও অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু হচ্ছে, চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্বের ড্র। কারণ, নতুন মৌসুমে ৩২টি দলকে আটটি গ্রুপে ভাগ করেই শুরু হয় ক্লাব ফুটবলের সব থেকে জনপ্রিয় প্রতিযোগিতার আসর। এবারের ড্রয়ের পর দেখা গেল, গ্রুপপর্বেই মাঠে গড়াবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কিছু ম্যাচ। যেমন, বায়ার্ন লড়বে টটেনহ্যামের সাথে, রিয়াল মাদ্রিদ পেয়েছে ফরাসি জায়ান্ট পিএসজি, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ফের লড়বে জুভেন্টাসের বিপক্ষে। বার্সেলোনা গ্রুপ অফ ডেথে পেয়েছে ইন্টার ও বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে।
বিশেষ কোনো অঘটন না ঘটলে গ্রুপপর্ব কোন কোন দল পার করবে, তা অনুমান করতে দোষ নেই। তবে মুখ্য বিষয় হলো, এইসব নামজাদা ক্লাবগুলো চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা দৌঁড়ে কতটা পথ অতিক্রম করতে পারবে। এ লেখায় এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে ৩২ দল থেকে ১২টি বড় ক্লাবকে বাছাই করে তিনটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি বিভাগে হট ফেবারিট ক্লাবগুলো, অন্যটি ডার্ক হর্সদের, এবং অপরটি বড় ক্লাব হলেও যারা আশানুরূপ ফল নিয়ে দ্বিধা আছে, তাদের জন্য।
লিভারপুল
রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ফাইনাল হার, কিন্তু ঠিকই পরের বছর ফাইনাল জয়। লিভারপুলের গল্প অনেকটা এমনই। এ বছর লিভারপুল গ্রুপপর্ব খেলবে নাপোলি, গেন্ত ও সালসবার্গের বিপক্ষে। ক্লপের অধীনে তাদের বদলে যাওয়া ও বর্তমান ফর্ম অনুযায়ী গ্রুপপর্ব পার করা তাদের জন্য কঠিন কিছু না। তাই মূলত লিভারপুলের চ্যাম্পিয়নস লিগের মিশন শুরু হবে শেষ-১৬ থেকে।
গতবারের দল ও এবারের দলের মধ্যে তাদের কোনো তফাৎ নেই। যারা আছে, তারা সকলেই নিজের ক্যারিয়ারকে এক ধাপ উপরে নিয়ে গেছে। অ্যালিসন বা ভ্যান ডাইক এখন শুধু সেরা নন, বিশ্বসেরার কাতারে। আক্রমণ ও মাঝমাঠের অবস্থাও একই। ভাইনালদুমের মতো মিডফিল্ডার যখন গোল করে দলকে ফাইনালে তোলেন, বা সালাহ’র পরিবর্তে যখন অরিগি গোল করেন ফাইনালের মতো মঞ্চে, তখনই বোঝা যায়, আর সকল দল থেকে ক্লপের দলের মূল পার্থক্য।
লিভারপুলের শুধু সমস্যা অতিরিক্ত রকমের ম্যাচের প্রেশার ও মূল একাদশ বাদে ভরসাযোগ্য খেলোয়াড় না থাকা। তবে ঘরোয়া লিগের সাথে চ্যাম্পিয়নস লিগের সাথে তুলনা করলে চলে না। এই প্রতিযোগিতায় জিততে লাগে মাঠে সেরা ১১ জনের রসায়ন ও কোচের কার্যকরী ট্যাকটিক্স, যা লিভারপুলের খুব ভালোভাবেই আছে। তাই এবারও চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা ঘরে তোলার অন্যতম ফেভারিট দল লিভারপুল।
ম্যানচেস্টার সিটি
পেপ গার্দিওলা টানা দুইবার প্রিমিয়ার লিগ জিতলেন ম্যানসিটিকে নিয়ে। তবে সেরা এই দল নিয়েও চ্যাম্পিয়নস লিগে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। ঘরের মাঠে গোলবন্যায় ভাসালেও প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে ডুবে যাওয়ার স্বভাব থেকে এখনও বের হবার মন্ত্র আবিষ্কার করতে পারেননি গার্দিওলা।
গতবারের কথাই ধরা যাক। নিজের মাঠে ৩-১ গোলের ব্যবধানে জিতলেও টটেনহ্যামের মাঠে হেরে এসেছিল গার্দিওলা বাহিনী। শেষে অ্যাওয়ে ম্যাচে ঐ এক গোলই পার্থক্য গড়ে দিল। ২০১৭-১৮ মৌসুমে যদিও কোনো লেগেই তারা সুবিধা করতে পারেনি। আবার ২০১৬-১৭ মৌসুমের গল্প অনেকটা গত বছরের মতো। নিজের মাঠে মোনাকোকে ৫ গোল দিলেও অ্যাওয়ে ম্যাচে হেরে আসে তারা।
বিগত বছরের সাথে তুলনা করলে দলটি এবার আরও বেশি শক্তিশালী। স্টার্লিং, আগুয়েরো ও বার্নাডো সিলভার আগুন ফর্মের পাশাপাশি কেভিন ডি ব্রুইন ও ডেভিড সিলভার সাথে যুক্ত হয়েছে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার রদ্রি, যিনি ফার্নান্দিনহোর স্থানে যুক্ত হবেন। সাথে লাপোর্ত ও স্টোনসদের তৈরি রক্ষণদূর্গ এবং গোলবার ভরসা এডারসন তো আছেনই।
তাই চ্যাম্পিয়নস লিগ লড়াইয়ে হট ফেভারিটের তালিকায় ম্যানসিটি থাকলেও তাদের একমাত্র সমস্যা বিগত বছরের রেকর্ড। ম্যানচেস্টার সিটির সামর্থ্য নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু চাপের মুখে মুখ থুবড়ে পড়ার মতো দুর্বলতার জায়গাকে যতদিন না বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে পারেন, চ্যাম্পিয়নস লিগে সাফল্য ততদিন ধরা দেবে না। আর বড় দলের ছোট সমস্যা তো আছেই। তদুপরি, ইনজুরির খড়্গে পড়ে মৌসুমের শুরুতেই ছয় মাসের জন্য ম্যানসিটি হারিয়েছে উইঙ্গার লিরয় সানেকে, সম্প্রতি লাপোর্তও হাঁটুর কাটিলেজে ইনজুরিতে এ বছরের জন্য মাঠের বাইরে চলে গেছেন।
বার্সেলোনা
দলের আক্রমণভাগে লিওনেল মেসি, সুয়ারেজ ও দেমবেলের মতো তারকা খেলোয়াড়। অথচ, ২০১৫ সালের পর বার্সেলোনা চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনাল একবারও পার করতে পারেনি। হোম লেগে এগিয়ে থাকার পর রোমার মাঠে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও লিভারপুলের বিপক্ষে দুর্বল মানসিকতা বার্সেলোনার হারের প্রধান কারণ। যেদিন মেসি গোল করেন, সেদিন ঠিকই বার্সেলোনা সকল বাধা উতরে যায়। আর যখন মেসি ফ্লপ বা প্রতিপক্ষের ট্যাকটিক্সে খোলসবন্দী থাকেন, দলে আরও তারকা খেলোয়াড় থাকা সত্তেও তার স্থান কেউ নিতে পারে না।
তবে এবার বেশ পরিবর্তন এসেছে দলে। রাইটব্যাক পজিশনে পাকাপাকি স্থান হয়েছে নেলসন সেমেদোর, আর সার্জি রবার্তো খেলবেন মধ্যমাঠে। গতবার টানা খেলে জর্ডি আলবা হাঁপিয়ে গিয়েছিলেন কিছুটা, তার পজিশনে অতিরিক্ত খেলোয়াড়ও দলে টানা হয়েছে। মধ্যমাঠে আরও সংযোজন গত বছরের সেরা মিডফিল্ডার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং। আর মেসি ও সুয়ারেজের পাশে খেলবেন গ্রিজমান। তাই আশা করা যাচ্ছে, যেদিন মেসি গোল করতে পারবেন না, বা তাকে গোল করানো থেকে বঞ্চিত রাখা হবে, তখন পাশার দান উল্টে দিতে সক্ষম হবেন গ্রিজমানরা।
চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতার আসরে বার্সেলোনা এবার অন্যতম শক্তিশালী দল। কিন্তু এই শক্তিশালী দলকে গত দুই মৌসুমে যেমন ব্যবহার করতে পারেননি ভালভার্দে, তেমনই ভুল থেকে কোনো শিক্ষাও নেননি তিনি। তাই বাইরে যতই শক্তিশালী থাকুক বার্সা, ভালভার্দের ফুটবল দর্শনের কারণে কাতালানদের ভিতই যেন দুর্বল। তাই মেসি ও গ্রিজমানের মতো গোলমেশিন, যথাযথ মধ্যমাঠ ও রক্ষণ পাবার পরও ভালভার্দের অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক মনোভাবের পরিবর্তন না হয়, চ্যাম্পিয়নস লিগে হট ফেভারিট হলেও এবারের বার্সেলোনার দৌঁড় ঐ সেমিফাইনাল পর্যন্তই।
জুভেন্টাস
মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রি দীর্ঘদিন ‘তুরিনোর বুড়ি’দের দায়িত্বে ছিলেন। তার আমলে ‘সিরি-আ’ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে জুভেন্টাস ছাড়া কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগে বরাবরই পিছিয়ে থাকত তারা। ২০১৫ ও ২০১৭ তে দুইবার ফাইনাল পর্যন্ত গেলেও আলেগ্রির শিষ্যরা যথাক্রমে বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হেরে শেষ রক্ষা করতে পারেনি। এই দীর্ঘদিনের দায়িত্ব থেকে গত মৌসুমশেষে দল ছেড়ে গেছেন এই ইতালিয়ান কোচ। তার স্থানে নিয়োগ পেয়েছেন মরিসিও সারি। এতেই জুভেন্টাসের ফুটবলের রূপ বদলে গেছে চোখের পলকে।
মরিসিও সারি সাধারণত আক্রমণাত্মক ফুটবলে বিশ্বাসী। কিন্তু জুভেন্টাস এতদিন খেলে এসেছে তুলনামূলক রক্ষণাত্মক ভূমিকায়। সারির ট্যাকটিকসের সঙ্গে মানানসই মিডফিল্ডার জুভেন্টাস পেয়েছেও একদম ফ্রি-তে। অ্যারন রামসি ও আদ্রিয়েন রাবিও’র পর তারা দলে টেনেছে মাথিয়াস ডি লিটের মতো ডিফেন্ডার। এক বছর পিএসজিতে কাটানোর পর বুফনও ফিরেছেন তার পুরনো ক্লাবে। আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নিয়ে আর নতুন করে কিছুই বলার নেই। ট্রান্সফার মার্কেটে জুভেন্টাস বাধ্য হয়ে হারিয়েছে হোয়াও ক্যানসেলোকে। যদিও রাইটব্যাকে তার অনুপস্থিতিও বোঝা যাবে না, যদি দি শিলিও ভরসার যোগ্য প্রতিদান দেন।
গ্রুপ ডি’তে জুভেন্টাসের প্রতিপক্ষ অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, বেয়ার লেভারকুসেন ও লোকোমোটিভ মস্কোভা। লিগেও জুভেন্টাসের শুরু হয়েছে দুর্দান্ত। তাই সবকিছু ঠিক থাকলে জুভ সমর্থকেরা নতুন করে চ্যাম্পিয়নস লিগের স্বপ্ন দেখতেই পারেন।
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ
লা লিগায় বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের সাথে প্রতি মৌসুমে সেভাবে ফাইট দিয়ে টিকে থাকতে না পারলেও চ্যাম্পিয়নস লিগে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ সবসময়ই একটি চমকের নাম। হয় শক্তিশালী দল নিয়ে আকস্মিক হেরে গিয়ে তারা চমক সৃষ্টি করবে, নয়তো তুলনামূলক দুর্বল দল নিয়ে শিরোপাপ্রত্যাশী কোনো ক্লাবকে হারিয়ে চমক দেখাবে। তাই এই দলটির ভবিষ্যৎ ও সাফল্য নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা মুশকিল।
গত মৌসুমে তারা যেমন হোম লেগে এগিয়ে থেকেও জুভেন্টাসের মাঠে গিয়ে হেরে এসেছিল, তেমনই ২০১৭-১৮ মৌসুমে তারা গ্রুপপর্বই পার করতে পারেনি। আবার ২০১৫-১৬ এবং ২০১৩-১৪ মৌসুমে তারা দুর্দান্ত খেলে ফাইনালে উঠলেও শিরোপা ঘরে তুলতে পারেনি। তবে ডিয়েগো সিমিওনের উত্থানের পর থেকে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ একটি ত্রাসের নাম। বড় কোনো অঘটন না ঘটলে প্রতি মৌসুমেই তারা কোয়ার্টার ফাইনাল অথবা সেমিফাইনালে পৌঁছে যায়। গত মৌসুমে হারের পর এবং একে একে দলের সেরা খেলোয়াড়গুলো দল ছেড়ে যাবার পর অনেকেই ভেবেছিল, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সুদিন বুঝি শেষ।
তবে তারা দলকে নিভে যেতে দেয়নি। দলবদলের মৌসুমজুড়ে দুর্দান্ত সব খেলোয়াড় কিনেছে তারা। মারিও হারমোসো বা ট্রিপিয়েরের মতো পরীক্ষিত খেলোয়াড়ের পাশাপাশি রেনান লদি ও জোয়াও ফেলিক্সের মতো অপরীক্ষিত খেলোয়াড়ও দলে এসেই তাদের ঝলক দেখাচ্ছেন। ফলে সিমিওনের দল হয়ে উঠেছে নতুন সেনাদের শক্তিতে শক্তিশালী। তাই এবারও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়নস লিগে পাচ্ছে ‘ডার্ক হর্স’-এর তকমা।
বরুশিয়া ডর্টমুন্ড
গত বছর পরিবর্তনের আভাস দিয়েছিল সিগনাল ইদুনা পার্কের দলটি। এ বছরের নতুন দল, কোচের ট্যাকটিক্স ও খেলোয়াড়দের ফর্ম বিবেচনায় হয়তো চ্যাম্পিয়নস লিগ নতুন এক বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের দেখাই পেতে চলেছে।
গত মৌসুমে বুন্দেসলিগা শিরোপা প্রায় জিতেই গিয়েছিল দলটি। কয়েকটি দুর্বলতার কারণে শেষ পর্যন্ত শিরোপা জেতা সম্ভব হয়নি। তাই নতুন মৌসুমে নিকো শ্যুল্জ্, থ্রোগান হ্যাজার্ড, ইউলিয়ান ব্র্যান্ডট ও ম্যাট হামেলসকে দলে ভিড়িয়ে দলের শক্তিমত্তা বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাশাপাশি দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়রাও ক্লাবে রয়ে গেছেন।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে ডর্টমুন্ডের প্রধান সমস্যা গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলো। কারণ ইন্টার ও বার্সেলোনার মাঠ থেকে পয়েন্ট ছিনিয়ে আনা কষ্টসাধ্য। আবার নিজেদের মাঠেও যে অঘটন ঘটার সম্ভাবনা নেই, তাও নয়। তাই এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে তাদের প্রথম বাধা এই গ্রুপপর্বই। উতরে গেলে তাদের সামর্থ্য দেখানো সম্ভব হবে, আর তা না হলে ভালো একটি দল গঠনের পরও শুরুতে থমকে যাবে এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ যাত্রা।
ইন্টার মিলান
এবারের গ্রীষ্মকালীন দলবদলের মৌসুমে বেশ সরব ছিল ইতালির ক্লাব ইন্টার মিলান। দলে এসেছে আমূল পরিবর্তন। প্রথম পরিবর্তন হলো লুসিয়ানো স্পালেত্তিকে বদলে আন্তোনিও কন্তেকে আনা। কন্তের ফুটবল দর্শন ইতালিয়ান ফুটবলের সাথে দারুণ মানানসই। একইভাবে, উপযুক্ত খেলোয়াড় পেলে ইউরোপ শ্রেষ্টত্বের লড়াইয়ে তার ৩-৫-২ ফর্মেশনও দারুণ কার্যকর হতে পারে। তাই ইন্টারের দায়িত্ব পেয়ে তার প্রথম কাজ ছিল নিজের ফুটবল দর্শন মোতাবেক খেলোয়াড় দলে টানা। ইন্টারও কৃপণতা দেখায়নি, খেলোয়াড়ের পেছনে অর্থ ব্যয় করেছে উদারহস্তে।
মধ্যমাঠে ইতালির অন্যতম দুই সেরা ফুটবলার এখন ইন্টারের দখলে। বারেল্লা-সেনসি জুটি যেকোনো ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন। আর রোমেলু লুকাকু প্রিমিয়ার লিগে নিজেকে প্রমাণ করে এসেছেন। তবে কন্তের নতুন ইন্টারে ট্রাম্পকার্ড হতে পারেন লোনে আসা অ্যালেক্সিজ সানচেজে। কন্তের অধীনে বহু ফ্লপ খেলোয়াড়ের বদলে যাওয়ার রেকর্ড আছে। সানচেজের ক্ষেত্রে তাহলে ইন্টার ও সানচেজের ক্যারিয়ার উভয়েরই লাভ হবে।
তবে চ্যাম্পিয়নস লিগে গ্রুপপর্বই বাধা হয়ে যেতে পারে তাদের জন্য। কারণ গ্রুপপর্বে তারা খেলবে বার্সেলোনা ও বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের মতো দলের বিপক্ষে। তাই দারুণ বদলে যাওয়া সময়ের প্রথম মৌসুম রাঙিয়ে তুলতে গ্রুপপর্ব থেকেই ইন্টারের সেরাটুকু দিয়ে চেষ্টা চালাতে হবে।
পিএসজি
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ও ইন্টার মিলানের মতো পিএসজিও এবার দারুণ একটি দলবদলের মৌসুম পার করেছে। প্রায় পুরো দলটাকেই ভোজবাজির মতো পাল্টে ফেলেছে ফরাসি ক্লাবটি। প্রথমে গোলরক্ষক পজিশনে আসা যাক। বিগত বছরের কোনো গোলরক্ষকই নেই বর্তমান দলে। বুফন ফিরে গেছেন জুভেন্টাসে, আর আরিওলা লোনে পাড়ি জমিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদে, বিপরীতে পিএসজিতে এসেছেন কেইলর নাভাস ও লোনে সার্জিও রিকো। তাই গোলবার শক্ত করতে পিএসজির বর্তমানে অন্যতম ভরসা নাভাস।
রক্ষণে তেমন পরিবর্তন নেই। মধ্যমাঠে ফ্রিতে এসেছেন আন্দ্রে হেরেরা, পাশাপাশি ইদ্রিস গানা ও পাবলো সারাভিয়া। সব থেকে বড় বিষয় হলো, পিএসজি এবার তাদের গুরুত্বপূর্ণ কোনো খেলোয়াড় হারায়নি। নেইমার, কাভানি, এমবাপে ও ডি মারিয়ার পাশাপাশি লোন চুক্তিতে মাউরো ইকার্দি আসার ফলে আক্রমণভাগ আরও পোক্ত হয়েছে।
যদি নেইমার, এমবাপে ও ইকার্দিকে দিয়ে এবারের আক্রমণভাগ সাজান টুখেল, তবে চ্যাম্পিয়নস লিগে অন্যতম সেরা আক্রমণত্রয়ী হবে পিএসজির। রক্ষণে সামান্য ঘাটতি থাকলেও মধ্যমাঠ দারুণ শক্তিশালী তাদের। গত কয়েক বছরে ভালো দল থাকলেও এবারের দলের শক্তিমত্তাই সব থেকে বেশি। তবে পিএসজির বনের বাঘের ভয় থেকে মনের ভয় বেশি। মাঝেমাঝে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থেকে বড় ভুল, আবার কোনো সময় আত্মবিশ্বাসের অভাবে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বাদ পড়েছে তারা। তাই বর্তমান দলের শক্তিমত্তা বিবেচনায় পিএসজি অন্যতম পরাক্রমশালী দল হলেও তারা পাচ্ছে ‘ডার্ক হর্স’ তকমা। আর এ বছর যদি তারা বড় কোনো সাফল্য না পায়, তবে যতই শক্তিশালী রূপে আবির্ভূত হোক না কেন, ভবিষ্যতে পিএসজিকে নিয়ে আশা রাখাটা দুরূহ ব্যাপারই হবে বৈকি।
রিয়াল মাদ্রিদ
চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে কোনো ক্লাব টানা দুইবার শিরোপা ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু জিদানের রিয়াল মাদ্রিদ ধরে রেখেছিল হ্যাটট্রিক শিরোপা। কিন্তু এরপরই পতন; ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো পাড়ি জমালেন জুভেন্টাসে, জিদানও কোচের দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। রিয়াল মাদ্রিদ দুইবার কোচ বদল করেও আর সাফল্য তো দূরের কথা, টিকতেই পারেনি দৌঁড়ে।
কিন্তু জিদানের প্রত্যাবর্তনের পর তিনি ডাক দিয়েছিলেন পরিবর্তনের। প্রথম প্রয়োজন ছিল রোনালদোর রেখে যাওয়া শূন্যস্থানে একজন তারকা খেলোয়াড় আনা। সে স্থানে হ্যাজার্ড এসেছেন। এসেছেন মার্সেলোর বিকল্প ফারলান্ড মেন্ডি ও রামোস, এবং ভারানের বিকল্প হিসেবে এডার মিলিতাও, যিনি লেফটব্যাক হিসেবেও সমানতালে পারদর্শী।
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু খেলোয়াড় দলে ভেড়ানোর পরও মাদ্রিদের দিন ফেরেনি। লা লিগাতে ভালোভাবে শুরু করতে পারেননি জিদান। যদিও হ্যাজার্ড এখনও মাঠে নামেনি। কিন্তু চিরাচরিত ট্যাকটিক্স থেকে বদলে গিয়ে নতুন ফর্মেশনেও খাপ খাওয়াতে পারছে না দলটি। উপরন্তু, মধ্যমাঠে বুড়িয়ে যাওয়া খেলোয়াড়, সাথে ইসকো ও হামেসের মত আক্রমনাত্মক মনোভাবের খেলোয়াড়, যা জিদানের ট্যাকটিক্সের সাথেই যায় না।
তাই লিগের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদ কতটা পথ অতিক্রম করতে পারবে, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। যদি নতুন সাইনিং কাজে লেগেও যায়, তাও রাতারাতি সেটা হওয়া সহজ কথা নয়। কারণ, মেন্ডি বা ইয়োভিচরা দলের সাথে মানিয়ে নিতে সময় নেবেন। তাই দারুণ দল এবং জিদানকে কোচ হিসেবে পেয়েও চ্যাম্পিয়নস লিগে এবার তেমন ফেভারিট নয় রিয়াল মাদ্রিদ।
বায়ার্ন মিউনিখ
বিখ্যাত রিবেরি-রোবেন জুটির সমাপ্তি হয়েছে গত মৌসুমে। কিন্তু এরপরই সমর্থকদের মাথায় হাত দেবার মতো উপক্রম। দলে উইঙ্গার দুইজন, ক্যোমান ও ন্যাব্রি। তাও ক্যোমান প্রচন্ড ইনজুরিপ্রবণ। মাত্র দুইজন উইঙ্গার দিয়ে কীভাবে পুরো মৌসুম খেলবে বায়ার্ন মিউনিখ?
লেভানডস্কি ও মুলারের বয়স হয়েছে। মুলার নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন, বেশ কয়েক বছর হলো। তার মধ্যে উইঙ্গার সমস্যা, যা এখনও পুরোপুরি সমাধান করতে পারেনি দলটি। তাই লোনে নিয়ে এসেছে ইভান পেরিসিচ ও ফিলিপে কৌতিনহোকে। যদিও নিকো কোভাচের ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে কৌতিনহো খেলবেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে।
দলে ডিফেন্ডার এসেছে, নতুন লেফটব্যাকও কেনা হয়েছে। মধ্যমাঠে যেন তারার মেলা, তবুও চ্যাম্পিয়নস লিগে তারা বিবর্ণ। কারণ, এক মৌসুম পার করে ফেললেও বায়ার্ন মিউনিখ কোচ নিকো কোভাচ তেমন বৈচিত্র্য এনে দিতে পারেননি।
গত মৌসুমে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা লিভারপুলের সামনে দাঁড়াতে পারেনি দলটি। চলতি মৌসুমের শুরুতে লুসিয়ান ফাভ্রের ট্যাকটিক্সের কাছে শিরোপা হারিয়েছে তারা। লিগে পরিস্থিতি আয়ত্তে করে আনলেও হাই-প্রেসিং এবং এর সাথে পাসিং ফুটবলের সামনে খেই হারিয়ে ফেলছে বায়ার্ন। তাই তুলনামূলক সহজ গ্রুপে পড়লেও পরবর্তীতে চ্যাম্পিয়নস লিগে তাদের যাত্রা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়, এবং এর জন্য একমাত্র দায়ী নিকো কোভাচের ফুটবল-দর্শন।
টটেনহ্যাম হটস্পার
প্রায় অপরীক্ষিত একটি দল নিয়ে গতবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল স্পার্স। তাছাড়া গতবার দলে পর্যাপ্ত খেলোয়াড়ও ছিল না। তবে এবার টটেনহ্যাম হাত খুলে খেলোয়াড় কিনেছে। লেফটব্যাক, মিডফিল্ডার বা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, কোনো পজিশনেই ঘাটতি রাখতে চাননি পচেত্তিনো। তবুও কোথায় যেন সুর কেটে গেছে তাদের।
প্রিমিয়ার লিগে তাদের শুরুটা ভালো হয়নি। ফয়েথ ও ডেলে আলি মৌসুমের আগে থেকেই ইনজুরিতে ছিলেন। নতুন সাইনিং এনদম্বেলেও নিয়মিত হবার আগেই চোটে পড়েছেন। তবে গতবারের মতো দলের রসায়ন এবার আর চোখে পড়ছে না। আর নতুন মৌসুমেও দলগত কিছু সমস্যায় ভুগছে তারা।
ফিট থাকলেও টবি আল্ডারওয়ারেল্ডকে খেলাচ্ছেন না পচেত্তিনো। মধ্যমাঠে ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনও বর্ণহীন। যদিও টবি ও এরিকসেনের স্পার্স ছাড়ার কথা উঠেছিল, যদিও পরবর্তীতে তা হয়ে ওঠেনি। তাই ফুটবলবোদ্ধাদের অনুমান, এবার চ্যাম্পিয়নস লিগে গতবারের মতো চমক দেখানো হচ্ছে না স্পার্স বাহিনীর।
চেলসি
চ্যাম্পিয়নস লিগে ৩২ ক্লাবের মধ্যে সব থেকে নড়বড়ে অবস্থায় আছে চেলসি। বর্তমানে তাদের যে অবস্থা, বিগত মৌসুমে বর্তমানের মতো চললে চ্যাম্পিয়নস লিগ তো দূরের কথা, ইউরোপাও খেলার কথা না ব্লুজদের। দলবদলের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে এবার কোনো খেলোয়াড় কিনতে পারেনি চেলসি। লোনে থাকা কোভাসিচ ও আগেই কিনে রাখা ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিক তাদের নতুন খেলোয়াড়। আর নতুন কোচ আস্থা রাখছেন ক্লাবের অ্যাকাডেমিতে বেড়ে ওঠা ম্যাসন মাউন্ট ও ট্যামি আব্রাহামের উপর।
ব্লুজদের নতুন কোচ ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডও ইউরোপের মূলমঞ্চে নতুন। চেলসির কোচের আসনে বসে তিনিও পড়েছেন ঝামেলার ভেতর। একে তো চেলসি হ্যাজার্ড-লুইজদের মতো দলের প্রধান খেলোয়াড়দের ধরে রাখতে পারেনি, উপরন্তু দলবদলের নিষেধাজ্ঞা।
তবে চেলসির বর্তমান দল খুব খারাপ কিন্তু নয়। আক্রমণে পুলিসিক ও পেদ্রো, মধ্যমাঠে কোভাসিচ, কান্তে, জর্জিনহো ও বাকরেলির মতো খেলোয়াড়। তবে এদের দিয়ে এখন পর্যন্ত সেরাটা বের করে আসতে পারেননি ল্যাম্পার্ড। দলে ধারাবাহিকতার বালাই নেই, সাথে জেতার মানসিকতাও সবাই দ্রুত হারিয়ে ফেলে। তাই চেলসি এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে খুব বেশি সাফল্য পাবার কথা নয়। আয়াক্স, ভ্যালেন্সিয়া ও লিঁলকে হারিয়ে গ্রুপপর্ব পার করাই তাদের জন্য কষ্টসাপেক্ষ হয়ে উঠতে পারে।
আয়াক্স
এরিক টেন হ্যাগের ট্যাকটিক্স ও একঝাঁক তরুণ তুর্কি নিয়ে গতবারের আয়াক্সের চ্যাম্পিয়নস লিগ যাত্রা বেশ উপভোগ্য ছিল। তবে গতবার তাদের সাফল্যের যাত্রার চাবিকাঠি যারা ছিলেন, সেই ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং ও মাথিয়াস ডি লিট মৌসুমের শুরুতেই দল ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। মধ্যমাঠে খেলা লার্স শোরেও এবার থাকছেন না। তবে ভন দি বিক, ডেভিড নেরেস ও হাকিম জিয়েচদের ধরে রেখেছে ক্লাবটি। পাশাপাশি তাদের ক্লাব নীতি মেনে দলে ভিড়িয়েছে বেশ কিছু তরুণদের। আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার লিসান্দ্রো মার্টিনেজ, রোমানিয়ার মিডফিল্ডার রাযভান মারিন ও মেক্সিকান রাইটব্যাক এডসন আলভারেজ এমনই সংযোজন।
তবে ডি ইয়ং ও ডি লিট মধ্যমাঠ ও রক্ষণে যে ভূমিকা পালন করে গেছেন, এ মৌসুমের প্রতিটা ম্যাচে তার অভাববোধ করবে আয়াক্স। হয়তো নেরেস বা জিয়েচরা ঠিকই গোল এনে দেবেন। কিন্তু ডি ইয়ং যেভাবে মধ্যমাঠ নিয়ন্ত্রণ করতেন, ডি লিট যেভাবে আক্রমণ গুঁড়িয়ে দিতেন, তেমনটা তো আর হবে না। আর নতুনরা শুরুতে দুর্দান্ত খেলবে, এমনটাও প্রায় আকাশ-কুসুম প্রত্যাশা।
তাই, ঠিকঠাক একটি দল থাকলেও একাদশে বেশ কিছু ফাঁক নিয়েই এবার চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলতে যাবে তারা। কিন্ত এসব সমস্যা নিয়ে লিগে ঠিকঠাক খেললেও এই প্রতিযোগিতায় কতদূর যাওয়া সম্ভব, প্রশ্নসাপেক্ষ বটে। তাই গ্রুপপর্ব উতরে যাবার সম্ভাবনা থাকলেও বাকি প্রতিযোগিতায় তাদের পারফর্ম নিয়ে সংশয় থেকে যায়।
কিন্তু কথা যখন চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো প্রতিযোগিতা নিয়ে, সেখানে চমক না থাকলে কী হয়? এই ১২ দলের বাইরে আরও ক্লাব আছে, যারা হয়তো ঘটিয়ে ফেলতে পারে অঘটন। প্রথমবার খেলতে আসা আটালান্টা, বা জার্মান ক্লাব লিপজিগ, কিংবা ভ্যালেন্সিয়ার কথাই ধরুন না!
শুরু হয়ে গেছে চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই, ধীরে ধীরে উপরে উঠছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পারদ। শেষ হাসি কে হাসবে, কারা চমক দেখাবে, আর কারা ধাক্কা খাবে, সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে খুব দ্রুত। আর ততদিন অবধি চোখ রাখতেই হবে টিভির পর্দায়!