ছোটবেলায় অধ্যবসায় রচনাটি আমরা কমবেশি সবাই পড়েছি। জীবনে সফল হতে গেলে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব ঠিক কতখানি তা আমরা মোটামুটি জানি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী জন ডাল্টন এ ব্যাপারে বলেছিলেন, “আমার সাফল্যের পেছনে প্রতিভার অবদান এক ভাগ আর বাকি নিরানব্বই ভাগ অবদান অধ্যবসায়ের।”
ক্রিকেটেও অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কিছুটা সীমিত প্রতিভা নিয়েও শুধুমাত্র অধ্যবসায় দিয়ে নিজেকে ঠিক কতটা উঁচু অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তী ক্রিকেটার কুমার সাঙ্গাকারা।
অসাধারণ এই ক্রিকেটার ১৯৭৭ সালের ২৭ অক্টোবর তার মাতুলালয় মাথালে জন্মগ্রহণ করেন, পুরো নাম কুমার চকশানাদা সাঙ্গাকারা। শৈশবের পুরোটা সময় কাটিয়েছেন ক্যান্ডিতে। সেখান থেকেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি ঘটে তার। বাঁহাতি এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে কিন্তু উইকেটরক্ষক ছিলেনই না! সেবার স্কুল লেভেল ক্রিকেটের জন্য অনুর্ধ্ব ১৩ দল বাছাই করা হচ্ছিলো, ব্যাটসম্যান হিসেবে সেই দলে জায়গা পেতে ব্যর্থ হন সাঙ্গাকারা! মন খারাপ করে যখন বাড়ি ফেরার পথ ধরছিলেন, তখন শুনলেন, কোনো উইকেটরক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না বলে দলে একটা জায়গা এখনো খালি রয়ে গেছে। ব্যস, আর কী চাই! কিশোর সাঙ্গাকারা দলে জায়গা পাওয়ার জন্য উইকেটরক্ষক হিসেবে নাম লেখালেন।
সেই যে শুরু এরপর থেকে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবেই নিজেকে তৈরি করেছেন। তবে খেলাধুলার পাশাপাশি পড়ালেখাতেও কিন্তু দারুণ ছিলেন সাঙ্গাকারা। আইনজীবী বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেও কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু ক্রিকেটে ব্যস্ততার কারণে সেটা আর শেষ করতে পারেননি (পরে অবশ্য ঠিকই ক্রিকেটের পাশাপাশি আইন নিয়ে পড়ালেখাটাও শেষ করেছিলেন)। যুব বিশ্বকাপে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে ভালো পারফর্ম করার সুবাদে শ্রীলঙ্কা-এ দলের হয়ে সুযোগ পেয়ে যান তিনি, সেখানে জিম্বাবুয়ে-এ দলের বিপক্ষে ১৫৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন সাঙ্গাকারা।
ওই ইনিংসের পরেই নির্বাচকদের নজরে পড়ে যান কুমার সাঙ্গাকারা, যার ফলে ২০০০ সালে অনুষ্ঠেয় সিঙ্গার ত্রিদেশীয় সিরিজে গলে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক ঘটে এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের। অভিষেক ওয়ানডেতে গ্লাভস হাতে একটি ক্যাচ ও ব্যাট হাতে ৩৫ রান করেন তিনি। পরের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৮৫ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলে দলকে ৯৭ রানের জয় এনে দেওয়ার পাশাপাশি ম্যাচসেরার পুরস্কারটিও পেয়ে যান সাঙ্গাকারা। ওই মাসেই গলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক ঘটে তার। অভিষেক ইনিংসে ২৩ রান করেই সাজঘরে ফিরে যান তিনি।
সাঙ্গাকারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান ২০০১ সালের আগস্টে। গল টেস্টে ভারতের বিপক্ষে তিন নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে ১০৫ রান করেন তিনি। এরপর টেস্টে উইকেটকিপিং করার পাশাপাশি নিয়মিত তিন নাম্বারে ব্যাট করতে থাকেন এই ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাটসম্যান। পরের বছর লাহোরে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২৩০ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলে ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পান সাঙ্গাকারা। তার সেঞ্চুরিতে ভর করেই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা।
টেস্টে এমন ধারাবাহিক সাফল্য পেতে থাকলেও ওয়ানডেতে সাঙ্গাকারা তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না। তবুও ২০০৩ বিশ্বকাপে উইকেটরক্ষক হিসেবে তাকেই বেছে নেওয়া হয়। ব্যাট হাতে সেই বিশ্বকাপে বলার মতো তেমন কিছু করতে পারেননি তিনি। উল্টো সেমিফাইনালে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের স্ট্যাম্পিং মিস করে বেশ সমালোচনার শিকার হন তিনি। এদিকে জাতীয় দলে তার কাছের বন্ধু মাহেলা জয়াবর্ধনেও সেই বিশ্বকাপে বেশ খারাপ পারফর্ম করেছিলেন। বিশ্বকাপের আগে এই দুজনকেই লঙ্কান ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ভাবা হচ্ছিলো, কিন্তু এমন হতশ্রী পারফর্মেন্সে সেই ভাবনায় বড়সড় একটা ধাক্কা লাগে।
তবে বিশ্বকাপের পরপরই ওয়ানডে ক্রিকেটে নিজের সেরাটা দিতে শুরু করেন সাঙ্গাকারা। শারজাহ কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার পরের ম্যাচে কেনিয়ার বিপক্ষেও সেঞ্চুরি করেন তিনি। এসময়ে ব্যাটসম্যান হিসেবে সাঙ্গাকারার কাছ থেকে সেরাটা পাওয়ার জন্য তাকে উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন নির্বাচকরা। তবে উইকেটকিপিংয়ের দায়িত্ব পুরোপুরি ছেড়ে দিতে কিছুতেই সম্মত ছিলেন না তিনি। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় যে, ওয়ানডেতে তিনিই উইকেটরক্ষক থাকবেন। তবে টেস্টে উইকেটরক্ষক হিসেবে অন্য কাউকে নেওয়া হবে।
এই সিদ্ধান্তটা সাঙ্গাকারার ক্যারিয়ারে সুফল বয়ে আনে। উইকেটকিপিং ছাড়ার পর তার টেস্ট ক্যারিয়ারের গড় আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। ২০০৪ সালে টেস্ট ফরম্যাটে দারুণ সফল ছিলেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে দুটি ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে ৫৫.৭০ গড়ে ১,১১৪ রান করেন তিনি। সেই বছর ওয়ানডেতে কোনো সেঞ্চুরির দেখা না পেলেও দশ ফিফটিতে তার গড় ছিল ৫৩.১৬! তবে ২০০৫ সালে টেস্ট ও ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই কিছুটা ম্রিয়মাণ ছিলেন তিনি।
২০০৬ সালে সাঙ্গাকারার সবচেয়ে কাছের বন্ধু মাহেলা জয়াবর্ধনে লঙ্কান দলপতির দায়িত্ব পান, আর সাঙ্গাকারা নিজে তার ডেপুটি হিসেবে দায়িত্ব পান। নেতৃত্বের ব্যাটন হাতে পেয়ে পেয়ে দুজনে লঙ্কান ক্রিকেটকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে শুরু করেন। তাদের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৫-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে শ্রীলঙ্কা। সেবছরেই এই জুটি গড়ে অনন্য এক ইতিহাস। সেবার জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে আসে দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথম টেস্টে কলম্বোর এসএসসিতে মুখোমুখি হয় দুই দল। প্রথম ইনিংসে প্রোটিয়ারা অল আউট মাত্র ১৬৯ রানে!
তবে ডেল স্টেইনের জোড়া আঘাতে মাত্র ১৪ রানে শ্রীলঙ্কার দুই ওপেনার সাজঘরে ফিরলে মনে হচ্ছিলো, এই অল্প পুঁজিতেই বুঝি ম্যাচ জমিয়ে তুলবে প্রোটিয়ারা! তবে এরপর যা হলো, সেটা শুধু প্রোটিয়ারা কেন, লঙ্কানরাও তাদের স্বপ্নে ভাবতে পেরেছিল কি না সন্দেহ! ১৫৭ ওভার ব্যাটিং করে ৬২৪ রানের পাহাড়সম এক জুটি দাঁড় করান কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনে! এই ৬২৪ রানের জুটি শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক টেস্টেই নয়, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট হিসেব করলেও যেকোনো জুটিতে সর্বোচ্চ! ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ১৩ রানে দূরে থেকে ব্যক্তিগত ২৮৭ রানে সাঙ্গাকারা আউট হলে ভাঙে সেই মহাকাব্যিক জুটি।
২০০৭ সালে নিজের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেলতে দলের সাথে উইন্ডিজে যান সাঙ্গাকারা। সেই আসরে কোনো সেঞ্চুরি না পেলেও তিন ফিফটি ও অসাধারণ উইকেটকিপিং করে দলকে ফাইনালে তুলতে ভূমিকা রাখেন তিনি। ফাইনালে অজিদের ছুঁড়ে দেওয়া ৩৮ ওভারে ২৮২ রানের কঠিন টার্গেট তাড়ার সময়ে ৫২ বলে ৫৪ রান করে লঙ্কানদের লড়াইয়ে টিকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু সাঙ্গাকারা আউট হওয়ার পর কেউ আর সুবিধা করতে না পারলে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় শ্রীলঙ্কাকে।
সেই বছর ঘরের মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষে টানা দুই টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করেন সাঙ্গাকারা। হোবার্ট টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ছুঁড়ে দেওয়া ৫০৭ রানের অসম্ভব এক টার্গেট তাড়া করতে নেমে ১৯২ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন তিনি। তবে শেষপর্যন্ত ৯৬ রানে ম্যাচটি হেরে যায় শ্রীলঙ্কা। ২০০৭ সালে টেস্টে তার গড় ছিল ১৩৮.২৯! ২০০৮ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে চারটি সেঞ্চুরির দেখা পান সাঙ্গাকারা, তবে টেস্টে এ বছর তেমন ভালো করতে পারেননি তিনি।
২০০৯ সালে হুট করে অধিনায়কের পদ থেকে সরে যান মাহেলা জয়াবর্ধনে। দীর্ঘ তিন বছর ডেপুটির দায়িত্ব পালন করার পর এবার দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান সাঙ্গাকারা। যদিও অনেকের মতে দায়িত্ব ছাড়ার পরেও খেলার মূল নাটাইটা মাহেলার হাতেই ছিল, তবুও অধিনায়ক হিসেবে সাঙ্গাকারার রেকর্ডটা কিন্তু ভীষণ বর্ণিল ছিল। দলনেতা হিসেবে তার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল ২০০৯ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে ৫৫ রানে অপরাজিত থেকে দলকে সুপার এইটে নিয়ে যান সাঙ্গাকারা। তার নেতৃত্বে সেই আসরে ফাইনালে চলে যায় লঙ্কানরা। সেখানে সবাই ব্যর্থ হলেও ৬৪ রানের ইনিংস খেলে দলকে ১৩৮ রানের লড়াকু সংগ্রহ এনে দেন তিনি। তবে এই ফাইনালেও শ্রীলঙ্কা হেরে যায়।
২০১০ সালে কলম্বো টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের সপ্তম ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পান সাঙ্গাকারা। এ বছর ওয়ানডে ফরম্যাটে তার নেতৃত্বে দুর্দান্ত পারফর্ম করে শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় ত্রিদেশীয় সিরিজে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জেতে লঙ্কানরা। এছাড়া ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ড ও ভারতকে নিয়ে অনুষ্ঠেয় ত্রিদেশীয় সিরিজের শিরোপাও ঘরে তোলে দলটি। সেই বছরের নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়া সফরে যায় শ্রীলঙ্কা। সাঙ্গাকারার নেতৃত্বে সেই সফরে টি-টুয়েন্টি ও ওয়ানডে সিরিজ জিতে নেয় লঙ্কানরা। অজিদের মাটিতে এটি ছিল লঙ্কানদের প্রথম সিরিজ জয়।
২০১১ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে কানাডার বিপক্ষে ৯২ রান করে শুরুটা বেশ ভালো করেন সাঙ্গাকারা। সেই আসরের গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১১১ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলে বিশ্বকাপে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নেন তিনি। সেমিফাইনালেও মুখোমুখি হয় এই দু’দল। সেখানে ৫৪ রানের পাশাপাশি দুর্দান্ত অধিনায়কত্বের কারণে ম্যাচসেরার পুরস্কার পান সাঙ্গাকারা। ফাইনালের মহারণে মুম্বাইয়ে স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে ৪৮ রান করেন তিনি, সাথে মাহেলা জয়াবর্ধনের ৮৮ বলে ১০৩ রানের ইনিংসে ভর করে ২৭৪ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করায় শ্রীলঙ্কা।
জবাব দিতে নেমে মালিঙ্গার বোলিং তোপে ৩২ রানেই যখন ভারতের ২ উইকেট চলে গেলো, তখন মনে হচ্ছিলো শ্রীলঙ্কার ফাইনালের গেঁরো এবার বুঝি কাটবেই। কিন্তু গৌতম গম্ভীর ও ধোনীর দুর্দান্ত দুটি ইনিংসে এবারো হার মানতে হয় লঙ্কানদের। এদিকে ফাইনালের একাদশে পাঁচ পরিবর্তন আনায় সমালোচকদের তোপের মুখে পড়েন সাঙ্গাকারা। শেষপর্যন্ত টানা পাঁচ বছর লঙ্কানদের নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার পর এবার সেখান থেকে সরে যান দুই বন্ধু সাঙ্গাকারা ও মাহেলা। অবশ্য ২০১১ সালে ওয়ানডেতে দুরন্ত পারফর্ম করায় আইসিসি ওয়ানডে প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার জিতে নেন তিনি।
নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেও রান করার দায়িত্বে আরো ধারালো হয়ে ওঠেন সাঙ্গাকারা। সেই বছর ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। আসল জাদুটা দেখান আবুধাবি টেস্টে। এ ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ৩১৪ রানে পিছিয়ে থাকা লঙ্কানদের হারই যখন একমাত্র ফলাফল হিসেবে মনে হচ্ছিলো, তখনই দেয়াল হিসেবে দাঁড়িয়ে যান এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। ৪৩১ বলে ২১১ রানের ম্যারাথন এক ইনিংস খেলে ম্যাচটি ড্র করার ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখেন তিনি। টেস্ট ইতিহাসে এটি অন্যতম সেরা ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস। সেই বছর দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম টেস্ট জয়ের দেখা পায় শ্রীলঙ্কা, আর এ ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৮ রান করে দলের জয়ের ভিত গড়ে দেন সাঙ্গাকারা।
২০১২ সালটাও দারুণভাবে শুরু করেন সাঙ্গাকারা। প্রোটিয়াদের ছুঁড়ে দেওয়া ৩১৩ রানের পাহাড়সম টার্গেট তাড়া করতে নেমে ৯৭ বলে ১০২ রান করেন তিনি। তার এই ইনিংসে ভর করেই ম্যাচটি ২ উইকেটে জিতে নেয় লঙ্কানরা। পরের মাসে অজিদের মাঠে ত্রিদেশীয় সিরিজে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন তিনি। সেই বছরের জুনে ঘরের মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে আক্ষরিক অর্থেই রানের ফোয়ারা বইয়ে দেন সাঙ্গাকারা। গল টেস্টে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৯ রানে অপরাজিত থাকার পর কলম্বো টেস্টেও মাত্র আট রানের জন্য ডাবল সেঞ্চুরি মিস করেন তিনি। তার এই দুর্দান্ত ফর্মে ভর করেই মুরালির অবসরের পর প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের দেখা পায় শ্রীলঙ্কা।
তবে সেই বছর ঘরের মাঠে অনুষ্ঠেয় টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উইন্ডিজের কাছে হেরে যাওয়ায় বিশাল একটা ধাক্কা খান সাঙ্গাকারা। এই হার নিয়ে টানা চারটি বিশ্বকাপের ফাইনালে হারে শ্রীলঙ্কা, আর সবগুলো আসরেই নেতৃত্বেই ছিলেন দুই বন্ধু সাঙ্গাকারা ও মাহেলা। লঙ্কানদের হয়ে ক্যারিয়ারে কোনো বিশ্বকাপ তারা আর আদৌ জিততে পারবেন কি না সেটা নিয়েও সন্দেহ দেখা দেয়। তবে ২০১২ সালে অনবদ্য পারফর্ম করায় আইসিসি প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ারের পুরস্কার জিতে নেন তিনি।
২০১৩ সালের শুরুতেই ঘরের মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে টানা তিন ইনিংসে সেঞ্চুরি করেন সাঙ্গাকারা। সেই বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২৯৪ রান তাড়া করতে নেমে ১৩৫ বলে ১৩৪ রান করে দলকে জয় এনে দেন তিনি। কলম্বোয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডেতে ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ১৬৯ রানের ইনিংস খেলেন সাঙ্গাকারা। ওয়ানডেতে এমন দারুণ পারফর্ম করার কারণে ২০১৩ সালের আইসিসি ওয়ানডে প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ারও জিতে নেন তিনি।
২০১৪ সালের শুরুটাও দারুণভাবে করেন সাঙ্গাকারা। চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি। সেই বছরের এশিয়া কাপে ভারতের দেওয়া ২৬৪ রান তাড়া করতে নেমে ১৬৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে যখন হারের শঙ্কায় শ্রীলঙ্কা, তখনই ত্রাতা হয়ে আসেন সাঙ্গাকারা। মাত্র ৮৪ বলে ১০৩ রানের অসাধারণ এক কাউন্টার অ্যাটাকিং ইনিংসে দলকে গুরুত্বপূর্ণ এক জয় এনে দেন তিনি। পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিক চাপের বিচারে এটা তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ওয়ানডে ইনিংস, আর শুধু রানচেজের ইনিংসগুলো বিচার করলে এটাকেই সবার চেয়ে ওপরে রাখতে হবে।
তবে বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় ২০১৪ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে কিছুতেই সুবিধা করতে পারছিলেন না সাঙ্গাকারা। দল ফাইনালে উঠলেও ব্যাট হাতে তার এই অফফর্মে সমালোচকরা অনেক কথা বলতে শুরু করেন। সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার জন্য বেছে নেন ফাইনাল ম্যাচকেই। এর আগের চার ফাইনাল হারায় এ ম্যাচের আগে বেশ চাপে ছিল শ্রীলঙ্কা। ভারতের দেওয়া ১৩১ রানের সহজ টার্গেট তাড়া করতে নেমে ৭৮ রানে ৪ উইকেট হারালে সেই চাপ আরো বেড়ে যায়। তবে এবার আর চাপের মুখে হেরে যাননি সাঙ্গাকারা, ঠাণ্ডা মাথায় ৩৫ বলে ৫২ রানের ইনিংস খেলে দলকে প্রথমবারের মতো টি-টুয়েন্টির বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেন এই চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার। ফাইনালে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটিও জিতে নেন তিনি। আর এ ম্যাচের মধ্য দিয়েই টি-টুয়েন্টি ফরম্যাটকে বিদায় জানান কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনে।
সে বছরের আগস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে গল টেস্টে ক্যারিয়ারের নবম ডাবল সেঞ্চুরি করেন সাঙ্গাকারা। ২০১৫ সালের শুরুতে নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে শুরুতে টেস্ট সিরিজে সুবিধা করতে না পারলেও ওয়েলিংটন টেস্টে নিজের জাত চেনান তিনি। পুরো গ্রিন পিচে একা লড়ে অসাধারণ এক ডাবল সেঞ্চুরি করেন সাঙ্গাকারা। ওয়ানডে সিরিজেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন তিনি।
এদিকে মাহেলা ও সাঙ্গাকারা ২০১৫ বিশ্বকাপ খেলেই ওয়ানডে থেকে বিদায়ের ঘোষণা দেন। নিজের শেষ বিশ্বকাপে অনন্য এক নজির গড়েন এই কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান। বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও স্কটল্যান্ড- এই চার দলের বিপক্ষে টানা চার ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করেন তিনি। টানা চার ওয়ানডেতে সেঞ্চুরির ঘটনা এর আগে কখনোই ঘটেনি। তবে এই সংখ্যাকে পাঁচে নিয়ে যেতে পারেননি সাঙ্গাকারা। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ৪৫ রান করে আউট হন তিনি। ওই ম্যাচ হেরে শ্রীলঙ্কাও বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়, আর এর মাধ্যমে সাঙ্গাকারার বর্ণাঢ্য ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে।
এদিকে ওয়ানডে থেকে অবসরের পর টেস্ট দলেও সেভাবে মনোযোগ রাখতে পারছিলেন না সাঙ্গাকারা। বন্ধু মাহেলা সব ফরম্যাটকেই বিদায় বলে দিয়েছিলেন। তাই টেস্ট দলে তিনি বড্ড একা হয়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া কাউন্টি ক্লাব সারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় জাতীয় দলে আগের মতো টানা অনুশীলনও করতে পারছিলেন না। এ কারণে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে সুবিধাও করতে পারেননি। শেষপর্যন্ত বোর্ডের অনুরোধ উপেক্ষা করে ভারতের বিপক্ষে কলম্বো টেস্ট খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন কুমার সাঙ্গাকারা।
৪০৪ ওয়ানডে খেলে প্রায় ৪২ গড়ে ১৪,২৩৪ রান সংগ্রহ করেন কুমার সাঙ্গাকারা, সেঞ্চুরির সংখ্যা ২৫টি আর ফিফটি ৯৩টি। সাথে গ্লাভস হাতে রয়েছে ৩৮৩টি ক্যাচ ও ৯৯টি স্ট্যাম্পিং। টেস্ট ক্যারিয়ারটা আরো বেশি সমৃদ্ধ। ১৩৪ টেস্ট খেলে ৫৭.৪১ গড়ে তার সংগ্রহ ১২,৪০০ রান। টেস্টে সেঞ্চুরি ৩৮টি আর ফিফটি ৫২টি। দুই ফরম্যাটেই লঙ্কানদের মধ্যে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহাক সাঙ্গাকারাই। আর ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় শচীনের পরেই তার অবস্থান। এখানে একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে বয়স বাড়ার সাথে সাথে যেখানে খেলোয়াড়দের খেলার ধার কমতে থাকে সেখানে সাঙ্গাকারার খেলার ধার বয়স বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে। এর পেছনে মূল রহস্য কী?
এর মূল কারণ অধ্যবসায়। অনুশীলনে সাঙ্গাকারা ছিলেন ভীষণ মনোযোগী ছাত্র। কীভাবে নিজের খেলায় আরো উন্নতি করা যায় তা নিয়ে তিনি কোচদের সাথে অনেক সময় ব্যয় করতেন। তার কাভার ড্রাইভকে বলা হয় ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম পারফেক্ট কাভার ড্রাইভ, তবে এটা কিন্তু মোটেও ঈশ্বরপ্রদত্ত কোনো প্রতিভার ফসল নয়! নেটে হাজার হাজার বার কাভার ড্রাইভের অনুশীলনের ফলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। তিনি জানতেন, তার হাতে মাহেলার মতো অনেক বেশি শট নেই, কিংবা তিনি লারার মতো ন্যাচারাল স্ট্রোকমেকারও নন।
তবে প্রতিভায় পিছিয়ে থাকাটাকে নিজের দুর্বলতা ভেবে থেমে থাকেননি সাঙ্গাকারা। কঠোর অনুশীলন করে তিনি অন্য সব শট আয়ত্ত করেছিলেন। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে স্কয়ার অফ দ্য উইকেটের শটগুলোতেই তিনি শুধুমাত্র পারদর্শী ছিলেন, কিন্তু ক্যারিয়ার শেষ করার সময়ে সুইপ, রিভার্স সুইপ, ওভার দ্য উইকেট, স্লগ সুইপ- সব শটে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। মাহেলা কিংবা লারার চেয়ে প্রতিভায় পিছিয়ে থাকলেও ক্যারিয়ার শেষে তাদের চেয়ে সাঙ্গাকারার পরিসংখ্যানই বেশি সমৃদ্ধ! তাই জীবনে চলার পথে প্রতিভার কমতির কারণে যদি কিছুটা পিছিয়ে থাকেন, তবুও হাল ছাড়বেন না। সাঙ্গাকারার মতো অধ্যবসায়ী হলে সেই কমতি কাটিয়ে উঠে সাফল্যের সিঁড়িটা ঠিকই খুঁজে পাবেন।