১০ নভেম্বর, ২০০৯। স্ত্রী টেরেসা ও ১০ মাস বয়সী কন্যা লায়লার কপালে চুমু খেয়ে সকাল ৯টার দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন রবার্ট এনকে। স্ত্রীকে বলেছিলেন তার ক্লাবের ট্রেইনিং সেশনে যোগ দিতে যাচ্ছেন। ইন্ডিভিজুয়াল ট্রেইনিং সেশন, সকালে ফিটনেস কোচ, আর বিকেলে গোলকিপিং কোচের সাথে অনুশীলন করবেন তিনি। ছয়টা বাজার আগেই ফেরত চলে আসবেন।
মিথ্যে বলেছিলেন। সেই মঙ্গলবার হ্যানোভারে কোনো ট্রেইনিং সেশন ছিল না। বাড়ি থেকে বের হয়ে তিনি সারাদিন গোটা শহর ঘুরে বেড়িয়েছেন, টানা ৮ ঘন্টা গাড়ি চালিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত গাড়ি থামান এলিভেস রেলওয়ে ক্রসিংয়ের কাছাকাছি গিয়ে। ততক্ষণে মনটাকে স্থির করে ফেলেছেন পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে।
গাড়ি থেকে নেমে রেললাইনের ওপর দাঁড়ান তিনি। দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে এক্সপ্রেস ট্রেইন। নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলেন, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ট্রেনের ধারালো চাকার আঘাতে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেল তার শরীর।
রবার্ট এনকের আত্মহত্যার খবর খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হেমন্তের সেই বিষণ্ণতামাখা সন্ধ্যায় পুরো দেশজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। জার্মানি জাতীয় দলের গোলকিপার, হ্যানোভার-৯৬ ক্লাবের কাপ্তান স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বেছে নিয়েছেন। যারা তাকে চিনতেন কিংবা চিনতেন না, সকলের মনেই তার মৃত্যুসংবাদ নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, কেন তিনি নিজের জন্য এমন পথ বেছে নিয়েছিলেন? রবার্ট এনকে ছয় বছর ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। এমনকি নিয়মিত ডাক্তারের চেকআপেও ছিলেন।
ডিপ্রেশন। হতাশা। বিষণ্ণতা। অবসাদ। কখনো কখনো বিষণ্ণতায় ভুগে আত্মহত্যা করা মানুষের সংখ্যা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়।
রবার্ট এনকে একজন পুরোদস্তর পেশাদার ফুটবলার। প্রতি সপ্তাহান্তে বুন্দেসলিগার প্রথম শ্রেণির ক্লাবের হয়ে খেলছিলেন, ২০১০ বিশ্বকাপের জন্য জার্মানি জাতীয় দলে প্রায় সুযোগ পেয়েও গিয়েছিলেন। শান্ত ও নম্র স্বভাবের একজন মানুষ, যিনি কঠিন থেকে কঠিনতম সময়েও মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারতেন, মুখে যার স্নিগ্ধ একটা হাসি লেগেই থাকত, সেই মানুষটা ছয় বছর ধরে বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন, তা পরিবারের লোকেরা ছাড়া কেউ কখনো জানতে পারেননি, তিনি কাউকে কিছু বুঝতে দেননি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, তার জীবন ঠিকঠাকই তো চলছিল। অথচ ভেতরে হয়তো কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।
১৯৭৭ সালের ২৪ আগস্ট গিসেলা এনকে ও ড্রিক এনকের পরিবারে জন্ম নেন রবার্ট এনকে। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন তিনি। জার্মানির পূর্বাংশের বাসিন্দা ছিল এনকে পরিবার। সেখানকারই স্থানীয় ক্লাব এসভি জেনাফার্মের হয়ে খেলা শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে কার্ল জেইস জেনা ক্লাবের স্কাউটদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি, ৮ বছর বয়সে সেখানে যোগ দেন রবার্ট এনকে। সেখানে যোগ দিয়েছিলেন স্ট্রাইকার হিসেবে। কিন্তু সেখানকার কোচদের নির্দেশনায় পজিশন বদলানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি, হাতে তুলে নেন গোলকিপিং গ্লাভস, বনে যান গোলকিপার।
১৯৯৫ সালে কার্ল জেইস জেনার হয়ে সিনিয়র টিমে তার অভিষেক হয়। বার্লিন দেয়াল ভাঙার পর সে বছর কার্ল জেইস জেনা জার্মান ফুটবলের দ্বিতীয় ডিভিশনে উঠে এসেছে। জেনার হয়ে সাদামাটা অভিষেক হয় রবার্ট এনকের। তিনি দ্বিতীয় ডিভিশনে মাত্র তিনটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন সেই মৌসুমে। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে, এর পরের বছরেই ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে বরুশিয়া মুনশেনগ্লাডবাখের হয়ে খেলার জন্য প্রস্তাব পান তিনি। গ্লাডবাখের তৎকালীন গোলকিপার ইউয়ে কাম্পসের ব্যাকআপ গোলকিপার হিসেবে তাকে দলে নেওয়া হয়েছিল।
গ্লাডবাখে রবার্ট এনকের প্রথম মৌসুম একদম ভালো যায়নি। ইউয়ে কাম্পস সবসময়ই প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে খেলতেন, অনুশীলনের সময়েও। তিনি তখনই গ্লাডবাখের লেজেন্ডারি ফিগার। কাম্পসের ফিজিক এবং গোলকিপিং স্টাইলে অলিভার কানের প্রচ্ছন্ন প্রভাবটা টের পাওয়া যেত। অলিভার কান তার সমসাময়িক এবং পরবর্তী অনেক গোলকিপারের আদর্শ হয়ে ছিলেন, এখনও আছেন। এনকে যথেষ্ট লম্বা ছিলেন, ৬ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতা; ঈর্ষণীয় উচ্চতা, কিন্তু দৈহিক গঠন কিংবা গোলকিপিং স্টাইল আবার কান বা কাম্পসের ঠিক অতটাও আগ্রাসী নয়। এনকে তাই সতীর্থ গোলকিপারকে দেখে প্রায়ই ভাবতেন, তিনি হয়তো বুন্দেসলিগার জন্য মানানসই গোলকিপার নন, এখানে তিনি টিকতেই পারবেন না।
ব্যাকআপ গোলকিপারদের সবসময় অনুপ্রাণিত করা, তাদের আত্মবিশ্বাস জিইয়ে রাখা যেকোনো ফুটবল ম্যানেজারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই ব্যাকআপ গোলকিপারদের অনেকেই হয়তো পুরো লিগে বড়জোর একটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবেন, বা হয়তো পাবেনই না। কিন্তু এই মানুষটিও যেন দলের প্রতি ডেডিকেটেড থাকেন, নিজেকে দলের মূল্যবান সদস্য হিসেবে ভাবেন, সেই দিকটি মাথায় রাখতে হয় একজন ম্যানেজারকে। তা নাহলে একজন তরুণ গোলরক্ষক নিজের স্কিল নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করেন, পথ হারাতে বসেন। এই হতাশার গোলকধাঁধায় একবার ঢুকে গেলে সেই চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসাটা কঠিন হয়ে পড়ে। এই চক্রে পড়ে গিয়েছিলেন এনকে, কাম্পসের মতো কিংবদন্তির সাথে খেলতে গিয়ে একপর্যায়ে নিজেকে নিয়ে হতাশ হয়ে পড়তে শুরু করেন রবার্ট এনকে।
তবে অনুশীলনের সময়ে নিজেকে আরও ভালো গোলরক্ষকে রূপান্তর করতে যে প্রয়াস তিনি চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তা বৃথা যায়নি। ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে প্রথমবারের মত খেলার সুযোগ পান ২০ বছর বয়সী রবার্ট এনকে। বুন্দেসলিগায় অভিষেক হয় তার শালকের বিপক্ষে। অভিষেক ম্যাচে ক্লিনশিট রেখেছিলেন, ৩-০ গোলে জয় পায় গ্লাডবাখ। তবে দুই গুরুত্বপূর্ণ ডিফেন্ডার এফেনবার্গ এবং মার্টিন ডাহলিনকে আগের মৌসুমে ছাড়তে বাধ্য হয় গ্লাডবাখ। এই দুই ডিফেন্ডারের অভাব বেশ ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছিল। লিগের শেষদিকে গিয়ে ডাই ফোহলেনরা পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে নেমে যায়। তবে রবার্ট এনকে একাই সামলাচ্ছিলেন গ্লাডবাখের গোলবার। কিন্তু ড্রেসিংরুমের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, স্ট্রাইকারদের সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা, কাগজের চেয়েও নাজুক ডিফেন্স আর ক্লাব ম্যানেজারের পরিবর্তন সব মিলে গ্লাডবাখের অবস্থা হয়ে ওঠে শোচনীয়।
এই এতসবের মাঝে লেভারকুসেনের সাথে খেলার তারিখ এগিয়ে আসে। লেভারকুসেনের কাছে ৮-২ গোলে বিধ্বস্ত হয় গ্লাডবাখ। এরপর উলভসবুর্গের কাছে ৭-১ গোলে গ্লাডবাখ পরাজিত হলে রেলিগেশন নিশ্চিত হয়ে যায়। এরপর গ্লাডবাখ আবারও কোচ বদলায়। ক্লাবের ম্যান-ম্যানেজমেন্টে চরম ব্যর্থতা আর ঘন ঘন কোচ বদলের ফলে রবার্ট মানসিকভাবে বিরক্ত হয়ে যান। তিনি গ্লাডবাখ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
মিউনিখের বিখ্যাত দল ১৮৬০ মিউনিখ থেকে আগ্রহ দেখালেও ইয়ুপ হেইঙ্কেসের বেনফিকায় যোগ দেন রবার্ট এনকে। ইয়ুপ হেইঙ্কেস, যিনি খেলোয়াড়ি জীবনে পশ্চিম জার্মানি ও মুনশেনগ্লাডবাখের হয়ে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলেছিলেন, ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন রবার্ট এনকেকে। ইয়ুপ হেইঙ্কেস তাকে খেলার আমন্ত্রণ দিলে তিনি আর সে প্রস্তাব ফেরাতে পারেননি।
কিন্তু হঠাৎই বিপত্তি দেখা গেল, বেনফিকার সাথে সাইন করার পরেই হোটেল রুমে ফিরে এসে অনবরত কাঁদতে থাকেন এনকে। তার বান্ধবী এবং এজেন্ট দুজনেই হতচকিত হয়ে যান এই ঘটনায়। ইয়ুপ হেইঙ্কেসের সাথে আলোচনা করে সেদিনই তিনি পর্তুগিজ পাপারাজ্জিদের চোখ এড়িয়ে জার্মানিতে ফিরে আসেন। ঝুঁকি এড়াতে এস্তুদিয়ান্তেস থেকে কার্লোস বসিয়োকে সাইন করান হেইংকেস। এনকে পারলে আর ফিরতেনই না বোধহয় পর্তুগালে। কিন্তু কিছুদিন পর চুক্তির সম্মান-রক্ষার্থে বেনফিকায় ফিরে আসতেই হয় তাকে।
আসলে লেভারকুসেনের সাথে ৮-২ গোলে সেই ম্যাচ হারার পর এবং জার্মানি ছেড়ে নতুন দেশ পর্তুগালে মানিয়ে নেওয়ার চিন্তায় তিনি প্রচণ্ড নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন। সেই দুঃস্বপ্ন থেকে তিনি বের হতে পারছিলেন না। এজন্যই সেদিন হোটেলরুমে তার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়।
হেড কোচ ইয়ুপ হেইঙ্কেস ও গোলকিপিং কোচ ওয়াল্টার জুংহানস তাকে মানসিকভাবে সমর্থন যুগিয়ে যান। অফিশিয়াল স্টাফদের এই ছোট্ট জার্মান দল তাকে স্বদেশভূমির মতোই উষ্ণতা ও নিরাপত্তা দিচ্ছিল যেন।
বসিয়োর পারফরম্যান্সে নাখোশ হেইঙ্কেস রবার্ট এনকে’কে পর্তুগিজ লিগের সেই মৌসুমের প্রথম ম্যাচেই মূল একাদশে নামান। রিও এভের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ১-১ গোলে ড্র করে বেনফিকা, এনকেও বেশ ভালো পারফর্ম করেন। আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে শুরু করেন। একটা সময় বেনফিকার অধিনায়কও বনে যান তিনি। বেনফিকা আর লিসবন প্রেস নিয়ে দিব্যি সময় কেটে যেতে থাকে তার।
সে বছরেই বেনফিকার বি-টিম থেকে প্রোমোটেড হয়ে সিনিয়র টিমে সুযোগ পান ১৭ বছর বয়সী জোসে মরেইরা। আর নভেম্বরের মধ্যেই বেনফিকায় ফার্স্ট চয়েস গোলকিপার হয়ে ওঠেন এনকে। কার্লোস বসিয়ো হয়ে যান থার্ড চয়েস গোলকিপার। মরেইরা এনকেকে দেখে শিখতেন, যেভাবে তিনি শিখেছিলেন কাম্পসের কাছ থেকে। আবার এনকে মরেইরার কাছ থেকে পর্তুগিজ শিখতেন অবসরে। এভাবেই মরেইরা আর এনকে পরস্পরের ভালো বন্ধু হয়ে ওঠেন।
২০০০-০১ মৌসুম শুরুর মাত্র চারদিনের মাথায় হেইঙ্কেস বেনফিকা ছাড়লেও এরপরের কোচদেরও ফার্স্ট চয়েস গোলকিপার ছিলেন রবার্ট এনকে। বেনফিকায় তিনি যাদের অধীনে খেলেছেন, তাদের মধ্যে জোসে মরিনহো ছিলেন অন্যতম। পরের মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং আর্সেনাল থেকে খেলার জন্য প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এনকে এবং তার বান্ধবী টেরেসা লিসবনেই সুখী ছিলেন, তাই ইংল্যান্ডে যাননি। বেনফিকা বড় কোনো ট্রফি বা লিগ না জিতলেও ক্লাব ম্যানেজমেন্ট তাকে সম্মান করতেন। এমনকি ক্লাবের ভক্তরাও তাকে খুব ভালোবাসতেন। আর তাছাড়া মরেইরা তাকে খুব ভালোবাসতেন, বড় ভাইয়ের মতই দেখতেন। মরেইরাকেও এনকে নিজের আপন ছোট ভাইয়ের মতোই দেখতেন।
উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে বেনফিকা খেললেও রবার্ট এনকে তেমন আহামরি পারফর্ম করতে পারেননি। লিগে সাফল্য পেলেও ইউসিএলে পারফর্ম করতে না পারায় তিনি জার্মানি ফুটবল ফেডারেশনের দৃষ্টি কাড়তে ব্যর্থ হন। এ কারণেই ২০০২ সালে জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত স্কোয়াডে ডাক পাননি, ডাক পেয়েছিলেন জন লেহম্যান।
রবার্ট এনকে বুঝতে পারেন, ক্যারিয়ারে উন্নতি করতে চাইলে এবার দল ও দেশ দুটোই বদল করতে হবে। তাই তিনি যখন ইউসিএলের আরেক নিয়মিত দল বার্সেলোনার হয়ে খেলার ডাক পান, লুই ভ্যান হালের বার্সায় যোগ দিতে বেশি একটা ভাবেননি। বার্সেলোনার শত বছরের ইতিহাসে রবার্ট এনকে ছিলেন তৃতীয় জার্মান খেলোয়াড়। এর আগে মাত্র দু’জন জার্মান খেলার সুযোগ পেয়েছেন কাতালাদের জার্সিতে, এমিল ওয়াল্টার এবং বার্নড শ্যুস্টার। এরপর অবশ্য বার্সেলোনা নিজেদের গোলবারের জন্য খুঁজে পেয়েছে আরেক জার্মান রত্ন – মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগান।
ততদিনে এনকের বয়স ২৫ হয়ে গিয়েছে। বার্সেলোনা তখন একটা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। রোনালদো, লুইস ফিগো, পেপ গার্দিওলার অভাব পূরণ হয়নি তখনও। সবচেয়ে বেশি চিন্তা এই গোলকিপিং পজিশন নিয়েই ছিল। এন্ডনি জুবিজারিতা, ভিক্টর বাইয়্যা, কার্লোস বুসকেটস এবং রুড হেস্প কেউই জায়গাটি নিজের করে নিতে পারেননি। তবে আর্জেন্টাইন গোলকিপার রবার্তো বোনানো, ভিক্টর ভালদেস এবং রবার্ট এনকে – এই তিনজনকেই সাইন করানোর পর বার্সার গোলবার নিয়ে চিন্তা কমে আসে। ২০০২ সালের জুন মাসে ফ্রি’তে বেনফিকা থেকে বার্সেলোনায় খেলতে আসেন তিনি।
ইউসিএলের অন্যতম সফল ক্লাবের হয়ে খেলার সুযোগ পেলেও আজ এত বছর পর এই সিদ্ধান্তটিকে খুব ভুল মনে হয়। এনকে ছিলেন ট্র্যাডিশনাল গোলকিপার। কাতালান ক্লাবের গোলকিপারদের মনোভাবই থাকে দল যখন অ্যাটাকে যাচ্ছে তখন ডি-বক্সের কিনারে এসে দাঁড়িয়ে থাকা। কিন্তু বার্সেলোনার গোলকিপারদের এই চিরাচরিত গোলকিপিং ধরন থেকে এনকের ধরন ছিল আলাদা। রবার্ট এনকে কখনোই গোলবার অরক্ষিত রেখে বের হতেন না। এমনকি প্রতিপক্ষের ক্রস উড়ে আসলেও সেটাকে আগ বাড়িয়ে ধরতে না গিয়ে গোলবার সামলানোটাই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন।
বার্সেলোনার গোলকিপিং কোচ ফ্রান্স হোয়েকের সাথে নতুন গোলকিপিং স্টাইল নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন এনকে। কিন্তু নতুন স্টাইলের সাথে মানিয়ে নেওয়া তার কাছে ভীষণ কঠিন মনে হচ্ছিল। বোনানো এবং ভালদেস – দু’জনে এনকের থেকেও বেশি প্লেয়িং টাইম পাচ্ছিলেন। অল্টারনেট করে দু’জনেই খেলছিলেন। তাই ফ্রান্স হোয়েকের স্টাইলের সাথে তারা যতটা সহজভাবে মানিয়ে নিতে পারছিলেন, এনকে পারছিলেন না। বার্সেলোনার কোচিং স্টাফ এনকের ট্র্যাডিশনাল গোলকিপিং অ্যাপ্রোচ পরিবর্তন করার উপর বারবার জোর দিচ্ছিলেন। হুট করে কতটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছিলেন তাকে, বিবেচনাও করেননি। যেই ধাঁচের গোলকিপিং এত বছর ধরে তার সঙ্গী হয়ে ছিল, সেই গোলকিপিং স্টাইল নিয়ে তার আত্মবিশ্বাসের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়।
রবার্ট এনকে বেনফিকায় সাফল্য পেয়েছিলেন, কারণ ইয়ুপ হেইঙ্কেস এবং কোচিং স্টাফদের অনেকেই স্বদেশীয় হওয়া ছাড়াও তাদের প্রত্যেকেই খুব সহানুভূতিশীল মানুষ ছিলেন। রবার্ট এনকে অল্পতেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন। তার এই নিরাপত্তাহীনতা কিংবা বিষণ্ণতা নিয়ে সবসময়ই সচেতন থাকতেন তারা। কিন্ত লুই ভ্যান হালের কোচিং স্টাইল অন্যরকম, রাফ এন্ড টাফ। খেলোয়াড়দের সাথে এতটাও মিশতে পারতেন না, মনের খোঁজখবর রাখতে পারতেন না। হার্ডকোর প্রোফেশনাল পরিবেশ, বেনফিকার থেকে অন্যরকম। লুই ভ্যান হালের সাথে প্রথমদিনের পরিচয়পর্বে তিনি খোলামেলাভাবেই বলে দেন যে তিনি এনকে’কে চেনেন না, কোনোদিন তার নাম শোনেননি বা খেলাও দেখেননি। তিনি এনকে’কে দলে চাননি। বার্সেলোনার স্পোর্টিং ডিরেক্টর জোরাজুরি করেছেন বলেই তিনি এনকে’কে সাইন করাতে বাধ্য হয়েছেন।
১১ সেপ্টেম্বর, ২০০২ তারিখে কোপা দেল রে’র একটি ম্যাচে তৃতীয় ডিভিশনের দল নভেলডার বিপক্ষে এনকের অবশেষে বার্সেলোনার জার্সিতে অভিষেক হয়। সেই ম্যাচে নিয়মিতভাবে যারা স্টার্ট করেন মূল একাদশে, তাদের সবাইকে বিশ্রাম দেন ভ্যান হাল। এনকে ছাড়াও আরেক নতুন সাইনিং হুয়ান রোমান রিকেলমেরও অভিষেক হয় সেই ম্যাচে। ম্যাচের সমস্ত স্পটলাইট রিকেলমের উপরই ছিল। কিন্তু রক্ষণভাগের শেষ মানুষ রবার্ট এনকের জন্যও ম্যাচটি কম চ্যালেঞ্জিং নয়। গোলকিপিং কোচ হোয়েক নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন, একজন সাবস্টিটিউট গোলকিপারের পক্ষে একটা কাপ ম্যাচে নিজেকে প্রমাণ করা কতটা কঠিন চ্যালেঞ্জ – তাও যখন দলের মূল খেলোয়াড়রা নেই। তার উপর নভেলডার পিচ ন্যু ক্যাম্পের মতো এত মসৃণ নয়, রুক্ষ-শুষ্ক মাঠ, যেখানে-সেখানে উঁচুনিচু। সন্ধ্যার পরের ম্যাচগুলোয় ফ্লাডলাইটও ঠিকমতো জ্বলে না।
ম্যাচের প্রথমার্ধে ১-০ গোলে বার্সা এগিয়ে ছিল। কিন্তু এক ঘন্টার ভেতর দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে শুরু করল। দ্বিতীয়ার্ধে ২০ মিনিটের ভেতর বার্সার জালে ৩ বার বল পাঠায় নভেলডার খেলোয়াড়রা। লেভারকুসেনের কাছে ৮-২ গোলে হারার পর সেই ২০ মিনিট সম্ভবত এনকের জীবনের ভয়ঙ্করতম সময় ছিল, একটা গোলও তিনি আটকাতে পারেননি। ৩-২ গোলে ম্যাচ হেরে যায় বার্সেলোনা।
সেই ম্যাচের পরে তার বার্সেলোনা সহ-খেলোয়াড় ফ্রাংক ডি বোয়ার ম্যাচ হারের পুরো দোষ চাপিয়ে দেন রবার্ট এনকের ওপর। প্রেস কনফারেন্সে তুলোধুনো করতেও ছাড়েননি। লুই ভ্যান হালও ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড়দের সাথে প্রচন্ড চেঁচামেচি করেন, সবচেয়ে বেশি খারাপ ব্যবহার করেছিলেন এনকের সাথেই। বেশ করে দু’কথা শুনিয়ে দেন ভ্যান হাল তাকে।
২ মার্চ ২০০৩ তারিখে ওসাসুনার বিপক্ষে স্বল্প সময়ের জন্য মাঠে নেমেছিলেন তিনি, ২-২ গোলে ম্যাচটি ড্র হয়। এনকের লা লিগার অভিজ্ঞতাও অতটুকুই।
নভেলডার বিপক্ষে দুঃস্বপ্নের মতো সেই ম্যাচটি ছাড়াও চ্যাম্পিয়নস লিগে দু’টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন ক্লাব ব্রুগে এবং গ্যালাতাসারাইয়ের বিপক্ষে। ভালদেসই ছিলেন ভ্যান হালের ফার্স্ট চয়েস গোলকিপার।
২০০২-০৩ মৌসুম বার্সেলোনার জন্য খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। মৌসুমের প্রথমার্ধ শেষে বার্সেলোনা পয়েন্ট টেবিলে ১২-তে নেমে আসে। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে ভ্যান হাল বার্সেলোনা থেকে বিদায় নেন।
নভেলডার সাথে সেই ম্যাচে হারের প্রভাব ড্রেসিংরুমে এবং মাঠে সতীর্থ ও কোচের করা অপমানের প্রভাব এতটাই পড়েছিল তার উপর যে তিনি ডিপ্রেশনে পড়ে যান। ঐ ম্যাচের ৪ মাস পর থেকে এনকে একজন স্পেশালিস্টকে দেখাতে শুরু করেন ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠার জন্য। ২০০৩-০৪ মৌসুমের শেষের দিকে তাকে ফেনেরবাখে লোনে পাঠায় বার্সেলোনা। ফেনেরবাখকে তখন কোচিং করাচ্ছিলেন জার্মান কোচ ক্রিস্টফ ডোম। জার্মান কোচ বলেই হয়তো ফেনেরবাখে যেতে রাজি হয়েছিলেন এনকে। এনকে এবং টেরেসা দু’জনেই ভেবেছিলেন, এই লোন হয়তো সাময়িক। কয়েকটা ম্যাচ ভালো খেলতে পারলেই বার্সেলোনার নতুন ম্যানেজার ফ্রাংক রাইকার্ড হয়তো তাকে ডেকে পাঠাবেন, খেলার সুযোগ দেবেন। সে কারণে এনকের পরিবার বার্সেলোনাতেই রয়ে গিয়েছিলেন। এনকে’র এজেন্ট ইয়োর্গ নেবুলাং কেবল তার সাথে ইস্তাম্বুলে গিয়েছিলেন। নেবুলাংই ছিলেন সেখানে তার একমাত্র সঙ্গী।
তবে রবার্ট এনকের জন্য তুরস্কের জীবনটাও খুব কঠিন হয়ে গিয়েছিল। ‘কালচারাল শক’ বলেও একটি ব্যাপার রয়েছে। জার্মানি, স্পেন কিংবা তুরস্কের সংস্কৃতি বা জীবনাচরণ একেবারেই আলাদা। ফেনেরবাখ ইউরোপের বড় ক্লাবগুলির একটি, সেখানে খেলার সুযোগ পাওয়াটাও একেবারে ছোটখাটো কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু এনকে’র মানসিক অবস্থা এতটাই নাজুক ছিল যে তিনি ফেনেরবাখে গিয়ে সবসময়ই অস্বস্তিতে ভুগতেন। তিনি মাত্র একটি ম্যাচ খেলেছিলেন, প্রতিপক্ষ ছিল ফেনেরবাখের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্তানবুলস্পোর। ৩-০ গোলে সেই ম্যাচ হারার পর ফেনেরবাখের ভক্তদের কাছ থেকে যে পরিমাণে বিদ্বেষ ও কটূক্তি শুনতে হয়েছিল তাকে, তার ডিপ্রেশন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, প্যানিক অ্যাটাক হতে থাকে। তুরস্কের ফুটবল সমর্থকরা এমনিতেই উগ্রবাদী হিসেবে পরিচিত। সেই ম্যাচের পর বোতলও ছুঁড়ে মারা হয়েছিল তাকে লক্ষ্য করে। এনকে পরিবারের অভাব অনুভব করতে থাকেন, দিশেহারা হয়ে যান। এমনকি লোন-স্পেল বাতিল করে তিনি স্পেনে ফেরত যাওয়ার জন্যেও অনুরোধ জানান বার্সেলোনাকে।
এই এক ম্যাচের পরই রবার্ট এনকে বার্সেলোনায় ফিরে আসেন। কিন্তু রাইকার্ডের স্কোয়াডে এনকের জন্য আর কোনো জায়গা ছিল না। চার মাস পর এনকে ধারে যোগ দেন স্পেনের দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব টেনেরিফেতে, এই আশায় যে হয়তো স্বল্প পরিচিত কোনো লিগে বা স্বল্প প্রতিযোগিতার কোনো লিগে খেলে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসটা ফিরে পাবেন।
বার্সেলোনায় এনকে’র আকস্মিক পতন যদি হয়ে থাকে ট্র্যাজিক, তারই সাবেক গ্লাডবাখ সতীর্থ স্ট্রাইকার মার্কো ভিয়ার পতনটা রীতিমতো উদ্ভট। গ্লাডবাখের হয়ে খেলার সময় প্রথম সাত বুন্দেসলিগা ম্যাচে তিন গোলের পর মার্কো এমন এক ডুবই মারলেন, শেষতক গিয়ে ভিড়তে হলো ইতালিয়ান চতুর্থ বিভাগে গিয়ে। এতশত ঘটনাবলীর মধ্যেও দু’জনের মধ্যে যোগাযোগটা ছিল নিয়মিত, দু’জনের মধ্যে বোঝাপড়াটাও ছিল দারুণ। এতটাই যে এনকের আত্মশ্লাঘা শোনার মানুষটা ছিলেন মার্কোই। এই দুই ‘ব্যাকবেঞ্চারের’ বন্ধুত্ব যেন অদ্ভুত এক রহস্য; তবে এনকে’র ক্যানারি আইল্যান্ডে পাড়ি জমানোর পিছনে চিন্তাভাবনার নাগাল পেতে হলে এই রহস্য বুঝতে হবে।
এনকে যখন স্পেন-তুরস্ক ঘুরছেন, তখন ভিয়াও এক ক্লাব থেকে আরেক ক্লাবে খেলে যাচ্ছিলেন, থিতু হতে পারছিলেন না কোথাও। ভিয়া তখন নিজের ভেতর খুঁজে চলেছেন ১৮ বছর বয়সী সেই তরুণকে, যে কি না গ্লাডবাখের ড্রেসিংরুম মাতিয়ে রাখত। বেকহ্যাম-রোনালদোরা তখন ফুটবল বিশ্বকে শাসন করছেন। মিডিয়া এবং ভক্তদের প্রত্যাশার চাপ সামলে দিনের পর দিন তারা অনবদ্য পারফরম্যান্স করে যাচ্ছেন। কিন্তু সবাই বেকহ্যাম-রোনালদো নন, মিডিয়ার অ্যাটেনশন এবং সাধারণ ভক্তদের কৌতূহলোদ্দীপক চোখ কিছু মানুষকে অস্বস্তিতেও ফেলে। ভিয়াই এনকে’কে পরামর্শ দিয়েছিলেন, মিডিয়ার সার্ভেইলেন্সের আড়ালে থেকে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণির কোনো ক্লাবে খেললে হয়তো আত্মবিশ্বাসটা ফিরে পেতে পারেন এনকে। সেই পরামর্শটি বেশ কাজে লেগেছিল এনকের।
এনকে টেনেরিফের হয়ে খেলতে রাজি হলেও বড় ক্লাবের হয়ে খেলার ইচ্ছেটা সবসময়ই মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন। কিন্তু বড় ক্লাবের হয়ে খেলা মানেই গ্লোবাল মিডিয়ার অ্যাটেনশনে থাকা, প্রতিনিয়ত সমালোচনার মুখোমুখি হওয়া। তাই তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন, মানসিকভাবে আরো শক্তিশালী হতে হবে তাকে, হারিয়ে ফেলতে বসা প্যাশনটাকে জিইয়ে রাখতে হবে যেকোনো মূল্যে।
টেনেরিফে রবার্ট এনকে’কে ধারে খেলতে এনেছিল ক্লাবের আরেক প্রতিষ্ঠিত সেগুন্ডা গোলকিপার আলভেইরো ইগলেসিয়াসের ব্যাকআপ হিসেবে। মিডিয়ার অ্যাটেনশন থেকে দূরে এবং ফার্স্ট চয়েস গোলরক্ষক হিসেবে প্রতি ম্যাচে খেলতে নামার চাপ না থাকায় মানসিক অবসাদ কাটিয়ে উঠছিলেন তিনি, খেলাটাকে সত্যিকার অর্থেই উপভোগ করতে শুরু করেছিলেন। একা একা, পরিবার থেকে দূরে থাকাটাও তাকে আর অতটা কষ্ট দিচ্ছিল না। ক্যানারি আইল্যান্ডের উষ্ণ আবহাওয়াও মনকে চনমনে করে তুলতে যথেষ্ট। এনকে টিমের সবার সাথে মিশছিলেন, কখনো কখনো টিমমেটদের নিজের গাড়িও ব্যবহার করতে দিতেন। সতীর্থ গোলকিপারদের গোলকিপিং-এর নানা কলাকৌশলও শেখাতেন তিনি।
ইগলেসিয়াসের থেকে ভালো গোলকিপার হওয়া সত্ত্বেও ব্যাকআপ গোলকিপার হিসেবে বেঞ্চে বসে থাকাটা কখনোই তার মনঃপীড়ার কারণ হয়নি। এমনকি তিনি ইগলেসিয়াসের পারফরম্যান্সও গভীর মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করতেন, নোট রাখতেন, ভুলত্রুটি নিয়ে আলোচনা করতেন। বলা যায়, তিনি অনেকটা গোলকিপিং কোচ হিসেবেই কাজ করেছিলেন ইগলেসিয়াসের জন্য।
এরপর ইগলেসিয়াস ইনজুরিতে পড়লে দীর্ঘ নয় মাস পর প্রথমবারের মতো স্টার্টিং ইলেভেলে খেলার সুযোগ পান রবার্ট এনকে। ২-১ গোলে এলচের বিপক্ষে জয় পায় টেনেরিফে। সেই মৌসুমের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত সবগুলো ম্যাচেই খেলেছিলেন এনকে। সচরাচর পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে পড়ে থাকা টেনেরিফে সেবার সম্মানজনক অষ্টম স্থানে উঠে আসে। যদিও জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের নজর কাড়ার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি ইউরো ২০০৪-এর ডাক পাননি। তাতে এনকে যে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন, এমনও নয়। টেনেরিফে জীবনকে উপভোগ করছিলেন তিনি। নিজের সীমাবদ্ধতা, নিজের ইন্সিকিউরিটিগুলো কাটিয়ে উঠছিলেন।
এনকে শুধু চেয়েছিলেন তার সতীর্থ-কোচ-টিম স্টাফ সবাই তার সামর্থ্যে ভরসা করুক, তাকে বুঝুক। একবার যদি তাকে বিশ্বাস করে তার সতীর্থরা, তিনি স্টার্টিং ইলেভেনে খেলুন আর না-ই খেলুন, মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকতেন। বেনফিকা এবং টেনেরিফের সময়টা তারই সাক্ষ্য দেয়। বড় ক্লাবের হয়ে খেলতে চাওয়া দোষের নয়, কিন্তু বড় ক্লাবের হয়ে খেলার যে চাপ, যে পরিবেশ, তার সাথে এনকে মানিয়ে নিতে পারেননি বলেই বার্সেলোনার হয়ে তার সময়টা ভালো যায়নি।
হয়তো টেনেরিফেতেই ক্যারিয়ারটা লম্বা করতেন আরো, কিংবা ফিরে যেতেন স্পেনের অন্য কোনো ক্লাবে। কিন্তু তা হয়নি। ২০০৪-০৫ মৌসুমে তিনি ফ্রি ট্রান্সফারে জার্মান ক্লাব হ্যানোভারের সাথে দু’বছর খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন এবং জার্মানিতে ফিরে আসেন। হ্যানোভারের হয়ে সম্ভবত ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটিয়েছেন তিনি। ২০০৫-০৬ মৌসুমে জার্মান কিকার ম্যাগাজিনের জরিপে বুন্দেসলিগার সেরা গোলকিপার হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৬-০৭ মৌসুমে স্টুটগার্ট তাকে ফ্রি ট্রান্সফারে বাগিয়ে নিতে চাইলেও তিনি হ্যানোভারের সাথে ২০০৯-১০ মৌসুম পর্যন্ত খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন।
হ্যানোভারের হয়ে ক্যারিয়ার ভালো গিয়েছিল বটে, কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবনের জন্য সে কথা প্রযোজ্য ছিল না। টেরেসা যখন গর্ভবতী ছিলেন, তখনই মেডিক্যাল চেকআপের মাধ্যমে জানা যায় যে অনাগত সন্তানটি হৃৎপিন্ডে কঠিন রোগ নিয়ে জন্মাবে, বেশিদিন বাঁচানোও যাবে না তাকে। এমনকি গর্ভপাত করার পরামর্শও দিয়েছিলেন ডাক্তাররা। কিন্তু এনকে এবং টেরেসা বাচ্চাটিকে পৃথিবীর আলো দেখানোর সিদ্ধান্ত নেন। এনকের জার্মানিতে ফিরে আসার মূল কারণও এটিই ছিল। টেনেরিফেতে খেলার থেকে জার্মান কোনো ক্লাবে খেলা এবং স্ত্রী ও অসুস্থ বাচ্চার পাশে থাকাটাই তিনি বেশি জরুরি মনে করেছিলেন।
২০০৪ সালে রবার্ট এনকের মেয়ে লারা জন্ম নেয়। ছোট্ট শিশুটি ‘হাইপোপ্লাস্টিক লেফট হার্ট সিনড্রোম’ রোগ নিয়ে জন্মায়। লারার হার্টে অপারেশনও করা হয়। কিন্তু তবুও পুরোপুরিভাবে মেয়ের হৃদরোগ সারেনি, উপরন্তু অস্ত্রোপচারের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। লারা বধির হয়ে যায়, ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমেই কেবল লারাকে সুস্থ করে তোলা যেত। সেই অপারেশনও করা হয়, অপারেশন সাকসেসফুলও হয়। কিন্তু দুটো অপারেশনের ধকল নিতে পারেনি ছোট্ট লারা, ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে মারা যায় সে।
মেয়ের মৃত্যু এনকের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। তার মনোজগৎ একেবারে এলোমেলো হয়ে যায়। তবুও এই শোক সামলে ওঠার চেষ্টা করছিলেন তিনি। ২০০৬-০৭ মৌসুমে হ্যানোভার নতুন কোচ ডিয়েটার হেকিংকে নিয়োগ দেয়। হেকিংয়ের অধীনে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলে যাচ্ছিলেন, ব্যক্তিগতজীবনে বিপর্যস্ত থাকলেও। মেয়ে মারা যাওয়ার এক সপ্তাহের ব্যবধানে তিনি লেভারকুসেনের বিপক্ষে খেলতে নেমেছিলেন, সেই ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র হয়।
এর দু’সপ্তাহ পর জার্মানি জাতীয় দল থেকে ডাক পান, সাত বছর পর। এর আগে ডাক পেয়েছিলেন ১৯৯৯ সালের কনফেডারেশন কাপের সময়, কিন্তু খেলার সুযোগ পান নি। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে জার্মানি জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয় তার ডেনমার্কের বিপক্ষে, ২৯ বছর বয়সে। যদিও সেই ম্যাচ জার্মানি ১-০ গোলে হেরে যায়।
২০০৮ সালের ইউরো স্কোয়াডেরও সদস্য ছিলেন এনকে। কিন্তু ‘আনইউজড সাব’ হিসেবে রয়ে যান তিনি। রানারআপ হিসেবে সেই ইউরো শেষ করে জার্মানি। জার্মানির হয়ে মোট ৮টি ম্যাচ খেলেছিলেন রবার্ট এনকে।
জার্মানির হয়ে শেষ ম্যাচটি খেলেছিলেন ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট আজারবাইজানের বিপক্ষে, সেই ম্যাচে তিনি ক্লিনশিট রেখেছিলেন। ২০০৭-০৮ মৌসুমে হ্যানোভারের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৮-০৯ মৌসুমে তিনি বুন্দেসলিগার সেরা গোলকিপার নির্বাচিত হন। হ্যানোভার-৯৬’এর হয়ে তিনি ১৮০টি ম্যাচ খেলেছিলেন। বুন্দেসলিগা ক্যারিয়ারে ফেস করা ৩৩টি পেনাল্টির মধ্যে ১৪টিই সেভ করেছিলেন।
২০০৮ সালে জন লেহম্যান অবসরে গেলে রবার্ট এনকেই জার্মানিই মূল গোলকিপার হয়ে ওঠেন। ২০০৮ সালে ট্রেইনিংয়ে ইনজুরড হলে দু’মাসের জন্য মাঠের বাইরে চলে যান। এসময় লেভারকুসেনের তারকা গোলকিপার রেনে এডলার দলে জায়গা করে নিতে এনকের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। যদিও ইনজুরি থেকে ফিরে এসে তিনি আবার গোলবার দখল করে নেন। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসে আবার মাঠের বাইরে চলে যান। হ্যানোভার থেকে জানানো হয়, ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশনের কারণে তিনি কয়েকটি ম্যাচ খেলতে পারবেন না। পরে অবশ্য জানা যায়, সে সময় তার ডিপ্রেশন আবার ফিরে এসেছিল। সে সময় ৬টি ম্যাচ না খেলায় চিলির সাথে ম্যাচের জন্য তাকে জাতীয় দলে নেওয়া হয়নি। যদিও এনকে আত্মহত্যা করার পর চিলির সাথে সেই ম্যাচটি বাতিল করে জার্মান এফএ।
জার্মানি জাতীয় দলের গোলকিপার হিসেবে কারা কারা ২০১০ বিশ্বকাপে খেলতে যাচ্ছেন, সে নিয়ে আলোচনা তখন তুঙ্গে। হিলডারব্র্যান্ড, এডলার, নয়্যার এবং এনকে – চারজনেরই নাম উচ্চারিত হচ্ছিল। জাতীয় দলে জায়গা পাওয়া উচিত কি উচিত নয়, এ নিয়ে নানাজনে নানামত দিচ্ছেন। নয়্যার এবং হিলডারব্র্যান্ডের থেকেও এগিয়ে ছিলেন এনকে। কিন্তু এসব আলোচনা এবং ক্লাবের অধিনায়কের দায়িত্ব – সবকিছু নিয়ে তিনি খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন মানসিকভাবে। ২০০৯-১০ মৌসুমের শুরু থেকেই সেটার ছাপ পড়ছিল তার দৈনন্দিন জীবনে, খেলায়, আচরণে। টেরেসা বুঝতে পারছিলেন সবই। তিনি হ্যানোভার দলের বাকি খেলোয়াড়দের সাথে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করেন, অনুরোধ করেন এনকেকে দেখেশুনে রাখতে, সহানুভূতিশীল আচরণ করতে। মিডফিল্ডার হ্যামো বালিখ এনকেকে চোখে চোখে রাখতেন সবসময়, ট্রেইনিংয়ের সময় সাহস যোগাতেন, সঙ্গ দিতেন।
এনকে এবং টেরেসা লায়লা নামের একটি বাচ্চা মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন। কিন্তু লায়লার দিকে যতবার তাকাতেন, ততবারই তার নিজের মেয়ে লারার কথা মনে পড়ত। হয়তো লায়লার মাঝে লারাকে খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মেয়েকে হারানোর বেদনাটাই তাতে বারবার তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে।
আত্মহত্যা করার আগের কয়েক সপ্তাহ প্রচণ্ড বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন তিনি, তার জগৎ একেবারে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। টেরেসা এবং নেবুলাং দুজনেই তাকে বারবার জিজ্ঞেস করতেন তার বিষণ্ণতায় ভোগার কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করতে, মনের ভেতর দুঃখ চেপে না রাখতে। কিন্তু তিনি যেন কেমন অনুভূতিশূন্য হয়ে গিয়েছিলেন, ভেতরে কী চলছে মুখের অভিব্যক্তি দেখে বোঝা যেত না।
জীবনের শেষ ম্যাচ, হ্যামবুর্গের বিপক্ষে যে ম্যাচ ২-২ গোলে ড্র হয়, সেই ম্যাচের ৯০টি মিনিট কেমন যেন যন্ত্রের মত খেলেছেন। আত্মহত্যা করার দু’সপ্তাহ আগে তিনি ডয়েচে ভেলে চ্যানেলকে একটি সাক্ষাৎকারও দেন। মিডিয়া রিপ্রেজেন্টিটিভ কিংবা দর্শক, কেউ বুঝতে পারেননি, এনকে এমন ভয়ংকর একটি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন আর কিছুদিন পর।
এনকে মারা যাওয়ার পর পুলিশ সুইসাইড নোট উদ্ধার করে। তবে সেই সুইসাইড নোটে কী লেখা ছিল, তা পুলিশ কিংবা টেরেসা কেউই কখনো জানাননি। তবে টেরেসা জানান, কয়েক বছর ধরেই ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন এনকে, এই ডিপ্রেশনই তাকে আত্মঘাতী হতে বাধ্য করেছে।
ডিপ্রেশন কিংবা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনো আমরা খুব বেশি সচেতন নই। প্রিয় দল না জিতলে বা ক্লাবের কোনো কোনো ম্যাচে ভালো না খেললে ফুটবলারদের কিংবা যেকোনো স্পোর্টসপারসন বা সেলিব্রেটিকে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করতে আমরা পিছুপা হই না। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে এসব নোংরা কমেন্ট ছুড়ে দেওয়া যেন আরো সহজ এখন। ভালো পারফর্ম করতে না পারলে একজন খেলোয়াড় যথেষ্ট মনোকষ্টে থাকেন এমনিতেই, তার ওপর ভক্ত-সমর্থকদের এসব মন্তব্য কাটা ঘায়ে নুন ছিটানোর মতোই। খেলাধুলায় ট্রল – ব্যান্টার চলেই। কিন্তু সেগুলোর সঙ্গে অপমান কিংবা ব্যক্তিগত আক্রমণের সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ তো ডেথ থ্রেটও দিয়ে বসেন। কিছুদিন আগেই আর্সেনাল গোলকিপার লেনোকে একজন মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছিলেন, “Do it like Enke” – অর্থাৎ লেনোরও উচিত এনকের মতো একই পথ বেছে নেওয়া। ভাবতে পারেন? এ কারণে লেনো জানান, আজকাল তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার কমেন্টগুলো পড়েনই না।
ফুটবলে পরিবর্তন আসছে, এখন ক্লাব এবং জাতীয় দলগুলোও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন। ডিপ্রেশন নিয়ে খেলোয়াড়রাও সচেতন। ঠিকঠাক কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। সেদিন এনকে যদি মুখ খুলতেন, ডিপ্রেশন লুকিয়ে না রেখে একটু সাহস করে আলোচনা করতেন, হয়তো তাকে সাহায্য করা সম্ভব হতো, হয়তো এভাবে তাকে জীবনের ইতি টানতে হতো না। ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষদের প্রতি আমাদের সহানুভূতিশীল হওয়া প্রয়োজন। একটু সহানুভূতিশীল ব্যবহার করলেই হয়তো একজন মানুষ সুস্থভাবে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন, সুখী হতে পারেন।