শুরুর দু’সপ্তাহে যে জমাট আইপিএলের প্রতিশ্রুতি মিলেছিল, তৃতীয় সপ্তাহে এসে যেন সেই কথার বরখেলাপ হবার শঙ্কা জেগেছে। এক চেন্নাই-কলকাতা ম্যাচ ছাড়া সপ্তাহের আর সবগুলো ম্যাচেই তো ফল জানা হয়ে গিয়েছিল খেলার অর্ধেক পেরোতে না পেরোতেই। মাঝে ছয়দিনের বিরতি পেয়েও বিশেষ কোনো ফায়দা হয়নি মহেন্দ্র সিং ধোনির দলের, শারজাহর শুরুর দুই ম্যাচকে রাজস্থানের জন্যে মনে হচ্ছে পূর্বজন্মের স্মৃতি। আইপিএলের তিন নম্বর সপ্তাহান্তেও অবশ্য ভাগ্য বদলায়নি তিনটি দলের; দিল্লি-মুম্বাইর চলছে বৃহস্পতি, পাঞ্জাব আটকে আছে শনিতেই।
এক নজরে আইপিএলের তৃতীয় সপ্তাহ
বেঙ্গালুরু বনাম রাজস্থান
শারজাহর বাইরে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই যেন পার্থক্যটা টের পেলেন রাজস্থানের ব্যাটসম্যানেরা। আগের দু’ম্যাচে অনায়াসে ২০০ পার করা ব্যাটসম্যানরাই আবুধাবিতে নেমে তুলতে পারলেন মোটে ১৫৪। সহজ লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু খেই হারায়নি কখনোই। দেবদূত পাড়িকাল আর বিরাট কোহলির অর্ধশতকে প্রয়োজনীয় রান তুলে ফেলেছিল ৫ বল বাকি থাকতেই। এ অর্ধশতকের সুবাদে দারুণ এক রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন দেবদূত, সবচেয়ে কম সংখ্যক আইপিএল ইনিংসে আর বয়সে তিন অর্ধশতক তুলে নেবার কৃতিত্ব এখন এই ২০-বছর বয়সী ব্যাটসম্যানের।
দেবদূতের চাইতেও বেঙ্গালুরুকে বড় তৃপ্তি দেবে বিরাট কোহলির রানে ফেরা। আইপিএলে সবচেয়ে বাজে শুরুর পরে এ ম্যাচ দিয়েই মৌসুমে প্রথম অর্ধশতকের দেখা পেলেন বিরাট কোহলি। যদিও স্বভাবসুলভ কোহলীয় ইনিংস নয়, তবে ৭ চার আর ২ ছক্কায় ৫৩ বলে গড়া ৭২ রানের ইনিংসটি নিশ্চিত করেই আত্মবিশ্বাস যোগাবে পড়তি-ফর্মের এই সময়টাতে।
দিল্লি বনাম কলকাতা
আরও একবার শারজায় ম্যাচ, আরও একবার ছক্কার ফুলঝুরি, আরও একবার রান-উৎসব। পৃথ্বী শ’র ৪১ বলে ৬৬ আর ঋষভ পন্তের ১৭ বলে ৩৮ রানের ইনিংসকে এমনিতেই সাইক্লোন ক্যাটাগরিতে ফেলতে হয়, তবে সেদিন সব স্পটলাইট কেড়ে নিয়েছিল শ্রেয়াস আইয়ার নামের টাইফুন। তার ৩৮ বলে ৮৮ রানের ইনিংসে দিল্লির সংগ্রহটা দাঁড়িয়েছিল ২২৮-য়ে। চতুর্দিকের সীমানা যতই ৬০-৬৫ মিটার হোক না কেন, কলকাতার জন্যে এই রান তাড়া করা কঠিনই ছিল।
লক্ষ্যের পেছনে ছোটা আরও কঠিন হয়ে গিয়েছিল, কেননা সুনীল নারাইন (৫ বলে ৩) ওপেনিংয়ে আবারও হয়েছিলেন ব্যর্থ, আন্দ্রে রাসেল (৮ বলে ১৩) আর দীনেশ কার্তিক (৮ বলে ৬) ব্যাট হাতে হারিয়ে খুঁজেছেন নিজেদের। তবুও যে কলকাতা ২১০ অব্দি পৌঁছালো, সে কৃতিত্ব নীতিশ রানার সঙ্গে ইয়োন মরগান আর মৌসুমে প্রথম খেলতে নামা রাহুল ত্রিপাঠির। রানা করেছিলেন ৩৫ বলে ৫৮; আর ২৪ বলে চাই ৭৯ রান এমন সমীকরণকে ১২ বলে ৩২-য়ে নামিয়ে এনেছিলেন ত্রিপাঠি এবং মরগান।
তবে গোটা টুর্নামেন্টেই ধারাবাহিকতার প্রতিমূর্তি নোর্খিয়ের কাছে মরগান হার মানতেই কলকাতা পথ হারিয়েছিল আবার। শেষতক দুই দলের ব্যবধান থেকে গিয়েছিল ১৮ রানের।
মুম্বাই বনাম হায়দরাবাদ
অবশেষে অষ্টম ইনিংসে এসে প্রথমবারের মতন ২০০-য়ের নিচে দলীয় স্কোর দেখলো শারজা। মুম্বাইয়ের করা ২০৮ রানের জবাব দিতে নেমে হায়দরাবাদ থেমে গিয়েছিল ৩৪ রান কমে।
মৌসুমে কুইন্টন ডি ককের প্রথম অর্ধশতক আর বাকিদের টুকটাক কিছু অবদানে মুম্বাই এগোচ্ছিল বড় সংগ্রহের দিকেই, তবে রানটা ২০০ পেরিয়েছিল মূলতঃ ক্রুনাল পান্ডিয়ার শেষ চার বলের ঝড়ে (৫০০ স্ট্রাইকরেটে ২০ রান)। তাড়া করতে নেমে ১৪-তম ওভার পর্যন্ত ঠিক রাস্তাতেই ছিল হায়দরাবাদের ইনিংস। শেষ ৩৬ বলে ৭ উইকেট হাতে রেখে তখন চাই ৭৯ রান, ক্রিজে ৩৯ বলে ৫৭ রানে অপরাজিত ছিলেন ডেভিড ওয়ার্নারও। শারজা তখন তাই আরও এক রোমাঞ্চকর সমাপ্তি দেখবার অপেক্ষাতেই ক্ষণ গুনছিল।
তবে হায়দ্রাবাদের ইনিংস কক্ষচ্যুত হলো এরপরেই। উইকেট পড়লো চারটি, ডেভিড ওয়ার্নার পারলেন না ইনিংসের গিয়ার বদলাতে, শেষ ৩৬ বলে হায়দ্রাবাদ রান তুললো মাত্র ৪৪।
আইপিএলে অধিনায়ক হিসেবে নিজের পঞ্চাশতম ম্যাচে ওয়ার্নার হেরে গেলেন ৩৪ রানে। অর্জনের বিশালত্ব সম্ভবত বোঝা যাবে এই তথ্যে, এর আগে একজনমাত্র বিদেশী অধিনায়কই আইপিএলে নেতৃত্ব দিয়েছেন পঞ্চাশের বেশি ম্যাচে, রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে ৫৫ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছিলেন শেন ওয়ার্ন।
পাঞ্জাব বনাম চেন্নাই
লড়াইটা যখন পয়েন্ট টেবিলের তলানির দুই দলের ছিল, তখন হেরে গিয়ে এক দলের পিছিয়ে পড়াটাই নিয়তি ছিল। পাঞ্জাব দশ উইকেটে হেরে গিয়ে সেই নিয়তিই বরণ করে নিয়েছিল।
অবশ্য সে জন্যে খেলার ধরন পুরোপুরি বদলে ফেলতে হয়েছিল চেন্নাইকে। আগের ম্যাচগুলোতে শুরুতে রক্ষণাত্মক খেলতে খেলতে আস্কিং রানরেটকে ১৫-য়ের ওপরে তুলে ফেলাই ছিল চেন্নাইয়ের বৈশিষ্ট্য, এ ম্যাচে শেন ওয়াটসন আর ফ্যাফ ডু প্লেসি শুরুটা করেছিলেন বেশ আক্রমণাত্মক। পাওয়ারপ্লেতে রান এসেছিল ৪৬, তাদের আক্রমণের ধারা জারি ছিল পরবর্তী ওভারগুলোতেও। ১০০ পার হয়েছিল প্রথম দশ ওভারেই, আর ম্যাচ শেষ হয়েছিল ১৪ বল বাকি থাকতেই উদ্বোধনী জুটি শেন ওয়াটসন আর ফ্যাফ ডু প্লেসির ব্যাটেই। ১০ উইকেটের জয়ে তাদের গড়া এই ১৮১ রানের জোট আইপিএল ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
এর আগে পাঞ্জাবের ইনিংসেও রেকর্ড হয়েছিল একটি। লোকেশ রাহুলের ক্যাচ নিয়ে দীনেশ কার্তিকের পরে দ্বিতীয় উইকেটরক্ষক হিসেবে ১০০ ক্যাচ নেবার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি।
দিল্লি বনাম বেঙ্গালুরু
মৌসুমের প্রথম ম্যাচেই খেলেছিলেন ২১ বলে ৫৩ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস, পঞ্চম ম্যাচে এসে মার্কাস স্টয়নিসের ব্যাট ঝলসে উঠল আরেকবার। আবারও খেললেন ৫৩ রানের ইনিংস, তবে বল লাগলো আগেরবারের চেয়ে পাঁচটি বেশি। তার এই ইনিংসের সঙ্গে পৃথ্বী শ’ আর ঋষভ পন্তের ছোট্ট দু’টো ঝড়ে দিল্লি প্রথমে ব্যাট করে তুলেছিল ১৯৬ রান।
জবাব দিতে নেমে বেঙ্গালুরুকে লক্ষ্যগামী মনে হয়নি কখনোই। উইকেট পড়েছে নিয়মিত বিরতিতেই, রান-বলের মাঝে ব্যাপক তারতম্যের ইনিংস খেলতে পারেননি কেউই। শেষতক বেঙ্গালুরু থেমেছিল ১৩৭ রানেই। দাঁতে দাঁত চেপে করা বিরাট কোহলির ৩৯ বলে ৪৩ রানের ইনিংসই হয়ে ছিল সর্বোচ্চ।
মুম্বাই বনাম রাজস্থান
আইপিএল ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে টানা পাঁচ ম্যাচে ১৯০ কিংবা তার বেশি রান করবার কৃতিত্বটা মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স দেখিয়েছিল এ ম্যাচেই। আবুধাবিতে রাজস্থানের বোলারদের তুলোধুনো করে এবারে করেছিল ১৯৩। প্রতি ম্যাচেই দারুণ শুরু পেলেও মৌসুমের প্রথম ফিফটির দেখা সূর্যকুমার যাদব পেয়েছিলেন এ ম্যাচেই, তার ৪৭ বলের ৭৯ রানের ইনিংসটিই মূলতঃ মুম্বাইকে নিয়ে যায় রাজস্থানের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এক জস বাটলারের ফর্মে ফেরার খবরটি দেয়া ছাড়া রাজস্থানের ইনিংস নিয়ে বলবার আছে সামান্যই। রাজস্থানের ১০৯ বল স্থায়ী ইনিংসে বাটলার যে ৪৪ বল খেলেছিলেন, রাজস্থান ম্যাচে ছিল ঠিক ততসংখ্যক বলেই। ব্যক্তিগত ৭০ রানে তিনি ১৪তম ওভারে ফেরত আসতেই কার্যত শেষ হয়ে যায় রাজস্থানের জয়ের স্বপ্ন।
শেষতক রাজস্থানকে ১৯তম ওভারে ‘অলআউট’ করে মুম্বাই পায় মৌসুমে ষষ্ঠ ম্যাচে চতুর্থ জয়ের দেখা। ‘অলআউট’ শব্দে বাড়তি জোর দেবার কারণ, মৌসুমে এমন ঘটনা ঘটল এ নিয়ে মাত্র তিনবার।
চেন্নাই বনাম কলকাতা
আইপিএলে উত্তেজনা ছড়ানো ম্যাচের তালিকায় তৃতীয় সপ্তাহ থেকে একমাত্র এই ম্যাচটিরই বোধহয় ঠাঁই হবে। ১৩-তম ওভারে মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে শতরানে পৌঁছানোর পরেও যদি কোনো দল যদি ২০ ওভার শেষে ১৬৮ রান তুলতে ব্যর্থ হয়, তবে তো ম্যাচটি উত্তেজনা ছড়াবেই।
আগের ম্যাচের ধারা মেনে এ ম্যাচেও অর্ধশতক তুলেছিলেন শেন ওয়াটসন, তাকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিলেন তিনে নামা আম্বাতি রায়ুডুও। তবে ১৩তম ওভারের প্রথম বলেই রায়ুডু আউট হতেই চেন্নাইয়ের ইনিংসে লেগেছিল মড়ক, শেষ ৪৭ বলে চেন্নাই তুলেছিল মাত্র ৫৮ রান।
এর আগে প্রথমে ব্যাট করে কলকাতা করেছিল ১৬৭, যার প্রায় অর্ধেকই এসেছিল রাহুল ত্রিপাঠির ব্যাটে। মৌসুম শুরুর চার ম্যাচ বেঞ্চে বসে কাটানো রাহুল কেকেআর লাইনআপে এসেই যেন পাল্টে দিচ্ছেন দৃশ্যপট, দিল্লির সঙ্গে ১৬ বলে ৩৬ রানের ইনিংসের পরে চেন্নাইয়ের বিপক্ষে করেছিলেন ৫১ বলে ৮১। নারাইনের ব্যাট হাতে বাজে ফর্মের মধ্যে দলে ঢুকেই রাহুলের এমভাবে সেঁটে যাওয়াটা নিশ্চিত করেই চিন্তার ভাঁজ কমাবে কেকেআর ম্যানেজমেন্টের কপালে।
পাঞ্জাব বনাম হায়দরাবাদ
যখন দলকে তাড়া করতে হবে ২০০-য়ের বেশি রান, তখন স্বাভাবিকভাবেই চাওয়াটা থাকে টপ-অর্ডার থেকে কমপক্ষে দু’জন ব্যাটসম্যানের দারুণ দু’টো ইনিংস। পাঞ্জাবের টপ-অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা সেদিন তো ব্যর্থ হয়েছিলেনই, এমনকি নিকোলাস পুরানের ৩৭ বলে ৭৭ রানের ইনিংসকে (এ ম্যাচে তার ১৬ বলের ফিফটি টুর্নামেন্টের দ্রুততম) একপাশে ঠেললে বাদবাকি ১০ ব্যাটসম্যানের ৮ জনই আউট হয়েছিলেন এক অঙ্কের রানে। পাঞ্জাবকে মাত্র ১৬.১ ওভারে অলআউট করে দিয়ে হায়দরাবাদও পেয়েছিল পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে তাদের সবচেয়ে বড় জয়।
এদিন ম্যাচের প্রথম থেকেই হায়দরাবাদ পেয়ে গিয়েছিল ম্যাচের নাটাই। এ ম্যাচেই আইপিএলে ৫০তম বারের মতোন ওয়ার্নার অর্জন করেছেন পঞ্চাশ পেরোবার কৃতিত্ব, কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে এ নিয়ে টানা নয় ম্যাচে পঞ্চাশ পেরিয়েছেন তিনি। আগের মৌসুমে যে দু’জন মিলে ১০ ইনিংসেই ৪ বার গড়েছিলেন শতরানের জুটি, সেই বেয়ারস্টো-ওয়ার্নার মিলে ২০২০ আইপিএলে গড়েছিলেন প্রথম শতরানের জোট। ১৬০ রানে তাদের জুটি ভাঙলে কিছুটা খেই অবশ্য হারিয়েছিল হায়দরাবাদের ইনিংস, তবে উইলিয়ামসনের ১০ বলে ২০ রানের সুবাদে ঠিকই মৌসুমে প্রথম ২০০ রানের মাইলফলক ছুঁয়েছিল হায়দরাবাদ৷ তাদের এই ম্যাচের পরে এক বেঙ্গালুরুই বাকি রইলো ২০০ রানের দ্বারে পৌছাতে।
ওয়ার্নার-বেয়ারস্টোর ১৬০ রানের সুবাদে পাঞ্জাবের তিলকে আঁকা হয়েছে এক লজ্জার রেকর্ড। ওয়ার্নারকে আউট করবার আগে পাঞ্জাবের বোলারদের শেষ উইকেটপ্রাপ্তির উল্লাস ছিল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে ম্যাচে। মাঝে চলে গিয়েছিল সাত দিন আর ২১.৩ ওভার, রান খরচ হয়েছিল ৪০৮।
দিল্লি বনাম রাজস্থান
তৃতীয় সপ্তাহের শেষ ম্যাচটি ৪৬ রানে হারলেও রাজস্থানের ক্রিকেটারদের খুব সম্ভবত অনুতাপে ভুগতে হয়নি, বরং মস্ত বড় এক কুসংস্কার দূর হয়েছে বলে তাদের হালকাই বোধ করবার কথা। দিল্লির সঙ্গে ম্যাচেই যে প্রমাণ হলো, খারাপ খেললে হারতে হবে যে কোনো ভেন্যুতেই, এমনকি ভেন্যুর নামটি যদি শারজাহও হয়।
এর আগে শারজায় হওয়া ৮ ইনিংসের ৭টিতেই হয়েছিল ২০০-এর বেশি রান, এ ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে দিল্লি ১৮৪ করেছিল বলে মধ্যবিরতিতে খানিকটা দুশ্চিন্তাতেই বোধহয় ভুগেছিলেন রিকি পন্টিং। তবে প্রথম ছয় ওভারে রাজস্থান মাত্র ৪১ রান তোলার কারণেই হোক কিংবা ১৩ ওভারের ভেতরে ৫ উইকেট খোয়ানোতেই, এ ম্যাচে দিল্লি নির্ভার হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই।
সব উইকেট হারিয়ে রাজস্থান শেষমেশ অলআউট হয়ে গিয়েছিল দুই বল বাকি থাকতেই। এ জয়ে ৬ ম্যাচে পাঁচ জয় নিয়ে তৃতীয় সপ্তাহ শেষে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষ দলটির নাম দিল্লি ক্যাপিটালসই।
চার নম্বর সপ্তাহের আগে চার দিক
-
চোটাঘাত
ভুবনেশ্বর কুমারের সঙ্গে চোটাঘাতের সম্পর্কটা যেন নিত্যকার ঘটনা হয়ে যাচ্ছে। এবারে উরুর চোটে পড়ে আইপিএল থেকে ছিটকে গেলেন পুরোপুরি, এমনকি সামনের ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে খেলতে পারবেন কি না, তা নিয়েও জেগেছে সংশয়। হায়দরাবাদ ইতঃমধ্যেই পৃথ্বীরাজ ইয়ারাকে ঘোষণা করেছে ভুবনেশ্বরের বিকল্প হিসেবে।
ভুবনেশ্বরের মতোই আরেক দুর্ভাগা বলা চলে অমিত মিশ্রকে। কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিপক্ষে ম্যাচে ফিরতি ক্যাচ ধরতে গিয়ে অনামিকার ফ্লেক্সর টেন্ডনে চোট পাওয়াতে এ বছরে আর তার খেলা হবে না আইপিএলে। দিল্লি শিবিরে ইনজুরির হানা দেবার খবর আছে আরও। ঋষভ পন্ত পায়ের চোট নিয়ে ছিটকে গিয়েছেন অন্তত এক সপ্তাহের জন্য। পন্তের অনুপস্থিতিতে কোপটা যাচ্ছে তাই শিমরন হেটমায়ারের ওপর দিয়ে, এখন যে উইকেটরক্ষক হিসেবে বিদেশি অ্যালেক্স ক্যারিকে জায়গা দিতে হবে একাদশে।
-
স্মিথ-স্যামসনের পড়তি ফর্ম এবং রাজস্থান
শারজাহতে ঝড়ের গতিতে রান করা স্মিথ আর স্যামসন যেন অন্য ভেন্যুগুলোতে হারিয়ে খুঁজছেন নিজেদের। দলীয় অধিনায়ক স্মিথ শারজাহতে যেখানে দুই ম্যাচেই রান করেছিলেন ১১৯, শারজাহর বাইরে চার ম্যাচ খেলে তার রান সেখানে ৩৮ এবং টানা তিন ম্যাচে তিনি আউট হয়েছেন এক অঙ্কের রানে। এমনকি শারজাহ’তে প্রথম দু’ম্যাচে ২১৪ স্ট্রাইকরেটে ১৫৯ রান দেখে যাকে গৌতম গম্ভীর আখ্যা দিয়েছিলেন ‘ভারতের সবচাইতে ভালো তরুণ ব্যাটসম্যান’, সেই স্যামসনের পরের চার ম্যাচ মিলিয়ে তার রান মোটে ১৭, যা কি না শারজাহতে তার মারা ছক্কাসংখ্যার (১৬) চাইতে মাত্র ১ রান বেশিই।
টপ-অর্ডারের গুরুত্বপূর্ণ দুই সদস্যের এমন রানখরা রাজস্থানকে ভোগাচ্ছে বেশ। প্রথম দুই ম্যাচের পরে তারা শুরুর ছয় ওভারে রান তুলেছে সাতেরও কম, এবং প্রতি ম্যাচেই তা কমছে একটু একটু করে। শারজাহতে তাদের তৃতীয় ম্যাচে তারা তুলেছিল মাত্র ৪১ রান, মুম্বাইয়ের বিপক্ষে ম্যাচের পাওয়ারপ্লেতে তাদের রান এসেছিল ৩ উইকেট হারিয়ে ৩১।
বেন স্টোকস রাজস্থানের দলে আসবেন খুব সম্ভবত পরের ম্যাচ থেকেই, তবে রাজস্থানকে কোয়ালিফায়ারে উন্নীত হবার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে স্যামসন আর স্মিথের রানে ফেরাটাও বড্ড জরুরি।
-
দিল্লির স্বপ্নযাত্রা, পাঞ্জাবের দুঃস্বপ্নযাত্রা
মূল একাদশের প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যানই মৌসুমে এখন অব্দি করেছে কমপক্ষে ১৩০ রান, শুরুটা ধীরে করলেও শিমরন হেটমায়ার রাজস্থানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে খেলেছেন ২৪ বলে ৪৫ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস। অমিত মিশ্রকে হারালেও বোলাররা দারুণভাবে করছেন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, কমপক্ষে চার ইনিংসে বল করেছেন এমন সব বোলারই মৌসুমে পেয়েছেন কমপক্ষে পাঁচ উইকেট। যে পাঁচ ম্যাচ দিল্লি জিতেছে, তার প্রত্যেকটিতেই ম্যাচসেরার পুরষ্কার জিতেছেন দিল্লির ভিন্ন ভিন্ন পাঁচ প্লেয়ার। এ থেকে বোঝা যায় দিল্লির একাদশে ম্যাচ উইনারদের পরিমাণ।
সব মিলিয়ে রিকি পন্টিংয়ের দল যেন আছে স্বপ্নউড়ানে। হুট করে ‘২০১৪-য়ের রাজস্থান রয়্যালস’ হয়ে না গেলে কোয়ালিফায়ারের চার দলের একটি হিসেবে দিল্লির নাম লিখে দেয়া যায় অনায়াসেই।
পন্টিংয়ের ঠিক বিপরীতমুখী মানসিক অবস্থায় রয়েছেন অনিল কুম্বলে। শীর্ষ পাঁচ রানসংগ্রাহকের দু’জনই তার দলের, এমনকি দু’জন বোলার এখন পর্যন্ত নিয়েছেন আটের বেশি উইকেট। তবুও কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব সাত ম্যাচ খেলে পেয়েছে মোটে দুই পয়েন্ট। অধিনায়কত্বকে লোকেশ রাহুল যেন ভাবছেন রাজ্যের বোঝা, নিজের স্বভাবজাত খেলাকে বাদ দিয়ে চাইছেন দায়িত্ব নিয়ে খেলতে। কে বিশ্বাস করবে, ফ্রি-ফ্লোয়িং লোকেশ রাহুল খেলেছেন এবারের আইপিএলের মন্থরতম পঞ্চাশের ইনিংস!
লাভ হচ্ছে না কিছুতেই, এমনকি ভাগ্যের সামান্যতম সহযোগিতাও যেন তারা পাচ্ছে না এখন অব্দি। দিল্লির সঙ্গে সুপার ওভারে হার, রাজস্থানের বিপক্ষে ম্যাচে তেওয়াটিয়ার নায়ক হয়ে ওঠা, পাঞ্জাবের গল্পগুলো কেবলই হতাশার। মৌসুমের বাকি ম্যাচগুলো তাদের জন্যে রীতিমতো মারো নয়তো মরার।
-
চেন্নাই, চলো বাড়ি ফিরে যাই
পয়েন্ট টেবিলে পাঞ্জারের অবস্থানটা তলানিতে হলেও ১৩তম আইপিএলের জঘন্যতম দলটির তকমা নিশ্চিত করেই জুটবে চেন্নাইয়ের কপালে। অভিজ্ঞতাকে বাড়তি দাম দিয়ে দল গড়েছিল সব বুড়োদের নিয়ে, এখন সে বুড়োরাই গলায় বিঁধছে কাটা হয়ে। বুড়োদের নিয়ে দল গড়ায় সবচেয়ে বড় ঘাটতিটা ধরা পড়ছে ফিল্ডিংয়ে, প্রতি ম্যাচেই প্রতিপক্ষ কিছু বাড়তি রান পাচ্ছে চেন্নাইর বয়স্ক ফিল্ডারদের ধীরগতির ফিল্ডিংয়ের সুবাদে।
পাঞ্জাব আর কলকাতার সঙ্গে ম্যাচ দিয়ে ফর্মে ফেরত আসবার ইঙ্গিত দিয়েছেন ওয়াটসন, তবে বাকিদের অবস্থা এখনো তথৈবচ। কলকাতার সঙ্গে নিশ্চিত জয়ের ম্যাচ হাতছাড়া হয়েছে মিডল-অর্ডারের ব্যর্থতায়, এমনকি কেদার যাদব-আম্বাতি রায়ুডুদের ব্যাটিং প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে তাদের জয়ের মানসিকতা নিয়েও। যে ম্যাচগুলো পূর্বকালে ধোনি ফিনিশ করতেন অবলীলায়, এখন অব্দি তিনিও ব্যর্থ সেসব ইনিংসে। শেষের দিকের ওভারগুলোতে চেন্নাইয়ের বোলাররা রানও বিলাচ্ছেন দেদারসে। মৌসুমের প্রথম ম্যাচকে হিসেবের বাইরে রাখলে বাকি পাঁচ ম্যাচে ১৬-২০ ওভারকালে বোলাররা ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন গড়ে ১০.৮৪ করে; সে-ও কলকাতার সঙ্গে শেষ পাঁচ ওভারে মাত্র ৩৯ এসেছিল বলে।
চারদিকে এত ফুটো নিয়ে আইপিএল সমুদ্রে চেন্নাই জাহাজ ভাসিয়েছিল বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়েই, তবে মাঝসমুদ্রে এসে বোধহয় বুঝতে পারছে, নিলামের বিকিকিনিতে অমন গোয়ার্তুমি না করলেও চলতো।