কিছু ম্যাচ কখনো নিয়ম মানে না। পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন, সেটা নিয়ে মানুষের আগ্রহ থাকবেই। ফুটবলে যেমন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, ক্রিকেটে ঠিক তেমনই ভারত-পাকিস্তান। এই দুই দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক উত্তাপ ম্যাচটার আকর্ষন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। দুই দলের মুখোমুখি ১৩১টি লড়াইয়ে ভারতের ৫৪টি জয়ের বিপক্ষে পাকিস্তানের জয় ৭৩টি হলেও কোনো এক বিচিত্র কারণে বিশ্বকাপে ভারতকে কখনো হারাতে পারেনি পাকিস্তান।
একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক বিশ্বকাপে হয়ে যাওয়া দুই দলের ম্যাচ গুলোর দিকে।
১৯৯২ বিশ্বকাপ
দুই দলের শুরুটাই সেই বিশ্বকাপে খারাপ ছিল। ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হারের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটা বৃষ্টির জন্য পরিত্যক্ত হয় ভারতের। পাকিস্তানের অবস্থাও ছিল বাজে; ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১০ উইকেটে হারের পর দুর্বল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়ে কিছুটা ফেরত আসলেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৭৪ রানে অলআউট হয়ে আবারও নিজেদের দুর্বলতার জানান দেয়। সৌভাগ্যবশত, সেই ম্যাচটা বৃষ্টির জন্য পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
এই অবস্থান থেকে দুই দল যখন মুখোমুখি হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই ফেভারিট খুঁজে বের করার জন্য অতীত ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হয়। সেই ইতিহাসে বেশ ভালোভাবেই পাকিস্তান এগিয়ে ছিল। মুখোমুখি হওয়া আগের ১৭টি ম্যাচে ভারত জয় পেয়েছিল মাত্র ২টিতে।
টস জিতে ভারত ব্যাটিং বেছে নেয়। এক পর্যায়ে ১৪৮ রানেই ৫ম উইকেটের পতনের পর ভারত ২০০ রান করতে পারবে কি না, সেটা নিয়েই সমর্থকেরা ভাবনায় পড়ে যায়। সেই ভাবনা থেকে ভারতীয় সমর্থকদের মুক্তি দেন শচীন টেন্ডুলকার। তার অপরাজিত ৫২ আর কপিল দেবের ২৬ বলে ৩৫ রানের একটা ক্যামিওর সুবাদে ভারত করে ২১৬ রানের একটা লড়াইযোগ্য স্কোর।
ব্যাট করতে নেমে পাকিস্তানিরা দাঁড়াতেই পারেনি। আমির সোহেলের ৬২ আর মিয়াঁদাদের ৪০ রান বাদে বলার মতো স্কোর কেউই করতে পারেননি। পাকিস্তান অলআউট হয় ১৭৩ রানে। ব্যাটিংয়ে ৫২ রান করার পর বোলিংয়েও ১ উইকেট নিয়ে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন শচীন টেন্ডুলকার।
১৯৯৬ বিশ্বকাপ
দুই দলের মুখোমুখি হবার কথা ছিল ফাইনালে। সেভাবেই সব পরিকল্পনা করা ছিল। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চললে ফাইনালের আগে মুখোমুখি হবার কথা ছিল না এই দুই দলের। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধাল পাকিস্তান নিজেই। গ্রুপপর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হেরে গিয়ে গ্রুপে দ্বিতীয় হওয়ায় কোয়ার্টার ফাইনালেই ভারতের বিপক্ষে খেলতে হল, সেটাও ভারতের মাটিতে।
আগের বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছাড়াও ভারতের বিপক্ষে এই ম্যাচে পাকিস্তানের ফেভারিট হবার আরো কিছু কারণ ছিল। গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচে পাকিস্তানের এক হারের বিপরীতে ভারত হেরেছিল দুই ম্যাচ। এছাড়া ‘৯২ বিশ্বকাপের সেই ম্যাচের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে হওয়া ৪টি ম্যাচের কোনোটাতেই তাদেরকে হারাতে পারেনি ভারত।
তবে ম্যাচ শুরুর আগে একটা খবরে মানসিকভাবে ভারত কিছুটা এগিয়ে যায়। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে ওয়াসিম আকরাম ইনজুরিতে পড়লেও ধারণা করা হচ্ছিল যে, ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে তিনি একাদশে থাকবেন। কিন্তু ম্যাচ শুরু হবার কিছুক্ষণ আগে জানা যায় যে, তিনি দলে থাকতে পারবেন না। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে অধিনায়ক এবং ওয়াসিম আকরামের মতো এমন একটা পারফর্মারের অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে পাকিস্তানকে ধাক্কা দেয়।
টস জিতে ভারত ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু থেকেই পাকিস্তানের আঁটসাঁট বোলিংয়ের বিপক্ষে ধীরগতিতে রান করতে থাকে ভারত। একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিল ভারতের রান ২২৫-২৩০ রানে গিয়ে থামবে। কিন্তু শেষ দিকে অজয় জাদেজার ঝড়ো ব্যাটিং এ পরিস্থিতি পালটে যায়। পুরো টুর্নামেন্টে এবং সেই ম্যাচের প্রথম স্পেলেও দুর্দান্ত বোলিং করতে থাকা ওয়াকার ইউনিস শেষ দুই ওভারে বেধরক মার খান। তার শেষের দুই ওভারে ৪৪ রানই মূলত পাকিস্তানকে চাপে ফেলে দেয়।
ব্যাটিংয়ে পাকিস্তানের শুরুটা চমৎকারই ছিল। আমির সোহেল আর সাঈদ আনোয়ারের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে একটা ভালো সূচনা পায় পাকিস্তান। কিন্তু দলীয় ৮৪ রানে ৩২ বলে ৪৮ রান করা সাঈদ আনোয়ার আউট হলে পাকিস্তানের ব্যাটিং বিপর্যয় শুরু হয়। ধীরে ধীরে আস্কিং রেট বাড়তে থাকে। একটা পর্যায়ে পাকিস্তান আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সেলিম মালিক আর জাভেদ মিয়াঁদাদ কিছুটা টিকতে পারলেও সেটা ম্যাচ জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল না। শেষ পর্যন্ত ৩৯ রানের হার মেনে নেয় পাকিস্তান। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন ৯৩ রান করা সিধু।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ
এই বিশ্বকাপে দুই দলের জন্যেই ম্যাচটা মোটামুটি গুরুত্বহীন ছিল। সুপার সিক্সে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হারার পরই ভারতের সেমিতে যাওয়ার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে, খুব বেশি অঘটন না ঘটলে সেমির পথে পাকিস্তান ভালোভাবেই এগিয়ে ছিল। তবে টুর্নামেন্টে গুরুত্ব না থাকলেও মর্যাদার দিক থেকে ম্যাচটা গুরুত্বপূর্ণই ছিল।
টুর্নামেন্টে পাকিস্তান ছিল ভালো ফর্মে। গ্রুপপর্বে একমাত্র বাংলাদেশের বিপক্ষে হারটাকে বিশেষজ্ঞরা ‘অঘটন’ হিসেবেই দেখেছিল। টস জিতে ভারত ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নেয়। রাহুল দ্রাবিড় এবং আজহারউদ্দিনের অর্ধশত রানের পরও ভারত করতে পারে মাত্র ২২৭ রান।
রান তাড়া করায় পাকিস্তানের দুর্নাম সবসময়ই ছিল। গ্রুপপর্বে বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একমাত্র হারটা হয়েছিল, সেটাও রান তাড়া করতে গিয়েই। তবে ব্যাটিং করতে গিয়ে সাঈদ আনোয়ারের সাবলীল ব্যাটিংয়ে মনে হচ্ছিল, সহজ জয়ই পেতে যাচ্ছে পাকিস্তান। কিন্তু ৩৬ রান করে আনোয়ার আউট হয়ে যাবার পর থেকেই ভারত ম্যাচে ফেরত আসে। মাঝে ইনজামাম উল হক এবং মঈন খান কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও সেটা হার আটকানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। প্রসাদের মাত্র ২৭ রানের বিপরীতে ৫ উইকেট দখল ৪৭ রানের একটা সহজ জয় পাইয়ে দেয় ভারতকে। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন প্রসাদ।
২০০৩ বিশ্বকাপ
নানা কারণেই তিন বছর যাবৎ দুই দলের মাঝে কোনো খেলা হচ্ছিল না। তাই ম্যাচটা নিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের মাঝে অনেক আগ্রহ ছিল। কিন্তু টুর্নামেন্টে ফর্মের দিক দিয়ে দুই দল পুরোপুরি বিপরীত দিকে অবস্থান করছিল। পাকিস্তান টুর্নামেন্টে এসেছিল স্মরণকালের সবচাইতে অভিজ্ঞ এবং তারকানির্ভর দল নিয়ে। সাঈদ আনোয়ার, আফ্রিদি, মোহাম্মদ ইউসুফ, ইউনিস খান, ইনজামাম উল হক, আবদুল রাজ্জাকের সমন্বয়ে গড়া ব্যাটিং লাইনআপ এবং ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আখতারের সমন্বয়ে বোলিং লাইনআপ যেকোনো দলের ঈর্ষা জাগানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এই দল নিয়েও গ্রুপপর্বে নামিবিয়া এবং নেদারল্যান্ড বাদে আর কারো বিপক্ষে জয় পাওয়া হয়নি। জয় পাওয়া দূরে থাকুক, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হারটা তো শোচনীয়ই ছিল। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটা তাই ছিল পরের পর্বে যাওয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে, ভারত তখন দুর্দান্ত ফর্মে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটা বাদে প্রতিটা ম্যাচেই দাপুটে জয় নিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগেই পরের পর্ব নিশ্চিত করে ফেলেছিল ভারত। ‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে পাকিস্তানের সেরাটা বের হয়ে আসে’ – এই কথাটার সত্যতা প্রমাণের জন্যেই যেন টস জিতে প্রথমে ব্যাট করে ৩৪ ম্যাচ পর সাঈদ আনোয়ারের সেঞ্চুরিতে ২৭৩ রানের একটা স্কোর দাড় করায় পাকিস্তান।
ধারণা করা হচ্ছিল যে, শক্তিশালী বোলিং লাইনআপ নিয়ে ভারতকে সহজেই আটকে ফেলবে পাকিস্তান। কিন্তু শচীন টেন্ডুলকারের ৭৫ বলে ৯৮ রানের একটা অসাধারণ ইনিংসের কল্যাণে ৪৬তম ওভারেই জয় তুলে নেয় ভারত। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন শচীন টেন্ডুলকার।
২০১১ বিশ্বকাপ
এই বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে ফেভারিট হিসেবেই যাত্রা শুরু করে ভারত। তবে পাকিস্তানের শুরুটাও খারাপ হয়নি, গ্রুপপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েই পরের পর্বে আসে পাকিস্তান। ভারতের সাথে দেখা হয় সেমিফাইনালে।
টস জিতে ভারত ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। ওপেনিংয়ে শেবাগ ঝড়ে মাত্র ৬ ওভারেই ৪৮ রান করে ফেলে ভারত। কিন্তু ওয়াহাব রিয়াজের বলে শেবাগ আউট হবার পর মনে হলো, পিচটা আসলে বোলারদেরকেই সুবিধা দিচ্ছে। ১১ তম ওভারে কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটে। সাঈদ আজমলের বলে এল.বি.ডব্লিউ আউট হন শচিন টেন্ডুলকার। কিন্তু রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান শচীন। পরের বলে আবারও স্ট্যাম্পড হন শচীন। কিন্তু এবারও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি।
১৪তম ওভারে আফ্রিদির বলে শচীনের ক্যাচ মিস করেন মিসবাহ। তখন শচীনের রান মাত্র ২৭। ২০তম ওভারে আবারও আফ্রিদির বলেই ক্যাচ তোলেন শচীন, কিন্তু এবারও বেঁচে যান তিনি। এবার ক্যাচ মিস করেন ইউনিস খান। ২৬তম ওভারে যখন প্রথম বলেই ফর্মে থাকা যুবরাজ সিং আউট হন, তখন ভারত ২০০ রান করতে পারবে কি না, সেটা নিয়েই সমর্থকরা চিন্তিত ছিল। শেষ পর্যন্ত যে ভারত ২৬০ রান করতে পারল, সেটার পেছনে পাকিস্তানি ফিল্ডারদের অবদানই সবচেয়ে বেশি। শচীন টেন্ডুলকারের মতো ব্যাটসম্যান যদি ৫ বার জীবন পান, তাহলে সেই ম্যাচ জেতা যে দুষ্কর, সেটা বলাই বাহুল্য।
শেষ ওভারে পাকিস্তান অল আউট হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ম্যাচ হেরে গিয়েছিল অনেক আগেই। মিসবাহ-উল হকের ৭৬ বলে ৫৬ রানের ইনিংসটা কেবল মাত্র পরাজয়ের ব্যবধান কমিয়েছে। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকার।
২০১৫ বিশ্বকাপ
এই বিশ্বকাপে নিজেদের গ্রুপের প্রথম ম্যাচেই মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল। বিরাট কোহলির সেঞ্চুরি এবং শিখর ধাওয়ান ও সুরেশ রায়নার হাফ সেঞ্চুরিতে ৩০০ রানের একটা স্কোর দাঁড় করায় ভারত।
পাকিস্তান শুরু থেকেই উইকেট হারিয়ে ম্যাচ থেকে ছিটকে যায়। মিসবাহ-উল হকের ৭৬ রান কেবল পরাজয়ের ব্যবধান কমাতে সাহায্য করে। ম্যাচটা পাকিস্তান হারে ৭৬ রানে। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন বিরাট কোহলি।
পরিশিষ্ট
বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬ ম্যাচে মুখোমুখি হয়ে ৬টিতেই জয় পাওয়া ভারত নিঃসন্দেহে এই বিশ্বকাপেও ফেভারিট। ১৬ জুন মুখোমুখি হওয়া ম্যাচে অতীত ইতিহাস ছাড়াও টুর্নামেন্টের ফর্ম অনুযায়ীও ভারত ফেভারিট। তবে এই দুই দলের ম্যাচে কখনো পূর্বানুমান করা সম্ভব নয়। খুব ভালো দল নিয়েও পাকিস্তান এর আগে হেরে গিয়েছে ফর্মের সাথে লড়তে থাকা ভারতের কাছে।
বৃষ্টি বাগড়া না দিলে পাকিস্তান কি ৭-০ তে পিছিয়ে যাবে, নাকি ৬-১ করতে পারবে? সেটা দেখা যেতে পারে ১৬ জুন অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপের ম্যাচের পরই।