ডন ব্র্যাডম্যান! এই নামের আগে-পরে কত বিশেষণই তো যুক্ত করেছেন কত ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ, শত ক্রিকেট লিখিয়ে। তবে সবাই মোটামুটি এই বিশেষণে উপসংহার টেনেছেন, ‘অতিমানব’!
হাবিবুল বাশার অবশ্য তাতেও তুষ্ট হবেন না, ব্র্যাডম্যানকে তো তিনি মানুষ বলেই গণ্য করবেন না। অমন ৯৯.৯৪ গড় দেখে হাবিবুল বাশারের এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক! বিশ্বকাপে কোনো টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানের গড় ১০.৫০ হলে তিনি তেমনটা মনে করতেই পারেন।
বিশ্বকাপে কমপক্ষে শত রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে হাবিবুল বাশারের গড়টাই সবচেয়ে বাজে। তবে ধারেকাছে তিনি আরও অনেককেই পাবেন, প্রায় গোটাবিশেক ম্যাচ খেলে ফেলার পরেও যাদের গড়টা বিশ ছাড়ায়নি।
বিশ্বকাপে সবচেয়ে কম গড়ধারী পাঁচজন ব্যাটসম্যানকে নিয়ে যদি আপনার জানার আগ্রহ থাকে, তবে লেখার বাকি অংশটা আপনার জন্যই।
১. হাবিবুল বাশার (গড় ১০.৫০)
ক্রিকেটে হাঁটি-হাঁটি পা-পা যুগে অনেক ভুলে যাওয়ার মতো রেকর্ডের সাক্ষীই হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সেই যুগের দর্শক হলে টানা ৪৭ ম্যাচ জয়হীন থাকার রেকর্ড তো হরহামেশাই আপনার স্মৃতির দরজায় টোকা দিয়ে যায়।
বিশ্বকাপেও তো রেকর্ডের কমতি নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ রানে অল আউট হবার লজ্জা, ইনিংসের প্রথম তিন বলেই হ্যাটট্রিকের শিকার হওয়ার লজ্জার সাথে যোগ করে নিন বিশ্বকাপের সবচেয়ে কম গড়ধারী ব্যাটসম্যানের নামটিও- হাবিবুল বাশার।
বিশ্বকাপ নিয়ে কতজনই তো কত স্বপ্ন দেখেন, হাবিবুল বাশারেরও নিশ্চয়ই দেখেছিলেন। তবে স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে যে বিস্তর ফারাক তিনি দেখেছিলেন, তা যে তিনি দুঃস্বপ্নেও দেখেননি, তা ঘোষণার সুরেই বলে দেয়া যায়! কোন ব্যাটসম্যানই বা নিজের বিশ্বকাপ অভিষেক ম্যাচে ডাকের স্বপ্ন দেখেন!
কানাডার বিপক্ষে সেই ম্যাচটা অবশ্য বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেরই এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ঐতিহাসিক জয়ের পর থেকে বাংলাদেশ জয়হীন, কানাডার বিপক্ষে ম্যাচটি তাই ছিলো এই রথ থামানোর। কানাডা শেষ বিশ্বকাপ খেলেছিলো ১৯৭৯ সালে, তার ওপর ২০০৩ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ সাউথ আফ্রিকার মাটিতে কিছুদিন আগেই খেলে আসার অভিজ্ঞতা ছিলো বাংলাদেশের। যেকোনো দিনে, যেকোনো বিচারে বাজির দরে এগিয়ে ছিলো বাংলাদেশই।
বোলাররা সে পথে কাজ করেও রেখেছিলেন, কানাডাকে থামিয়ে দিয়েছিলেন ১৮০ রানে। কিন্তু ব্যাটসম্যানরা সেই সহজ লক্ষ্যকেই বানিয়ে ফেললেন দুর্গম-গিরি। বাংলাদেশ গুটিয়ে গিয়েছিলো ১২০ রানে। হাবিবুল বাশার ৮ বল খেলেও খুলতে পারেননি রানের খাতা।
রানের খাতা খুলতে পারেননি পরের ম্যাচেও। এবারে গোল্ডেন ডাক। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বেই বিদায় নিয়ে বাংলাদেশ ফিরলো ঘরে, হাবিবুল বাশার ফিরলেন রান না করে। মজার ব্যাপার হলো, ২০০৩ বিশ্বকাপে যাবার আগে খেলা সর্বশেষ ম্যাচেও হাবিবুল শূন্য রান করেছিলেন!
চার বছর পরের বিশ্বকাপে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিলো বিস্তর। ভারতের সাথে জয় পাওয়া ম্যাচে খুলেছিলেন রানের খাতা, অবশ্য মাত্র এক রানের জন্যই।
এই উন্নতির ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন পরের ম্যাচগুলোতেও। ১৮, ২৪ করে করে পৌঁছেছিলেন ৩২-এ। এর বেশি অবশ্য নয়।
এমন ইনিংসগুলো খেলে গড়ে ফেলেছিলেন এক রেকর্ড। ১০ ইনিংস খেলে রান করেছিলেন ১০৫। গড় ১০.৫০!
এর চেয়ে বাজে বিশ্বকাপ-গড় আর কারও নেই।
২. বাস্তিয়ান জেডেরেন্ট (গড় ১২.২৫)
বিশ্বকাপে মোট রান করেছিলেন ১৯৬, এর প্রায় এক-চতুর্থাংশ রানই এসেছিলো এক ম্যাচে। বিশ্বকাপে খেলা নিজের ২য় ম্যাচে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ১ম ম্যাচে ১ রানে অপরাজিত থাকার পর ২য় ম্যাচে ৫৮.০৬ স্ট্রাইক রেটের ৫৪, বিশ্বকাপ-গড় দেখাচ্ছিলো ৫৫। সেখান থেকে কমতে কমতে বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন ১২.২৫ স্ট্রাইক রেট নিয়ে।
সে করবেন না-ই বা কেন! ঐ ম্যাচকে আলাদা রেখে হিসেব করলে বাকি সতেরো ম্যাচের বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারে মাত্র চারটিতেই পৌঁছুতে পেরেছিলেন দুই অঙ্কে। এক রানে প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন তিনবার, রান করার আগেই ফিরেছিলেন আরও দুবার।
বিশ্বকাপে খেলা শেষ ম্যাচেও ফিরেছিলেন শূন্য রানে। শচীন টেন্ডুলকার ততদিনে ইনিংসে ২০০ রানের কীর্তি গড়ে ফেলেছেন, জেডেরেন্ট ২০০ রানে পৌঁছুতে পারেননি ১৮ ম্যাচেও।
৩. গ্র্যান্ট প্যাটারসন (গড় ১২.৩০)
গ্র্যান্ট প্যাটারসনের গড় ১২.৩০ কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোনো সুযোগই নেই। তাকে অভিশাপ দেয়া মানুষের সংখ্যা তো আর কম হবার কথা নয়!
যেকোনো খেলার, যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্যই বিশ্বকাপে খেলা যেখানে আজন্ম লালিত এক স্বপ্ন, সেখানে এই জিম্বাবুইয়ান ভদ্রলোক দুটি বিশ্বকাপ মিলিয়ে ম্যাচ খেলেছিলেন ১০টি। ভাগ্যের প্রসঙ্গ এই কারণেই এলো, তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের স্থায়ীত্ব সেই ১০ ম্যাচই।
জাতীয় দলে প্রথম সুযোগ পেয়েছিলেন ১৯৮৩ বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপে প্রথম সত্যিকারের অঘটন যাকে বলা হয়, সেই অস্ট্রেলিয়া-জিম্বাবুয়ে ম্যাচে।
খেলেছিলেন ২৭ রানের ইনিংস, আলী ওমরশাহের সাথে মিলে গড়ে তুলেছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ওপেনিং জুটি। বাকিদের টুকটাক সংগ্রহ আর ডানকান ফ্লেচারের ৬৯ রানে জিম্বাবুয়ে পেয়েছিলো লড়াই করার মতো পুঁজি। সেই রানই যথেষ্ট হলো ম্যাচ জয়ের জন্যে। গ্র্যান্ট প্যাটারসন দাবি করতে পারেন, ‘এতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আছে আমারও।’
খেলেছিলেন সেই বিশ্বকাপের বাকি ম্যাচগুলোতেও। তবে প্রতি ম্যাচেই পারফরমেন্সের গ্রাফ ছিলো নিম্নমুখী। ২৭ রান দিয়ে শুরু হওয়া ১৯৮৩ বিশ্বকাপ তাই শেষ হয়েছিলো নিরানব্বই রানে, সাড়ে ষোল গড়ে।
বিশ্বকাপ শেষে জিম্বাবুয়ে ম্যানেজমেন্ট তাই প্যাটারসনকে দলে রাখার যৌক্তিকতা খুঁজে পায়নি। যেমন যৌক্তিকতা পায়নি তাকে ছাড়া বিশ্বকাপে যাবার। মাঝের চার বছর উধাও হয়ে থেকে তাই তিনি দলে ফিরেছিলেন ১৯৮৭ সালে, আবারও আরেকটি বিশ্বকাপে।
আগের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে সেবারেও আরেকটু অবনমন। চার ম্যাচ খেলে করেছিলেন ২৪ রান। শেষটা হয়েছিলো দুঃখজনক রান আউটে, শূন্য রানে।
বাদ পড়াটা তাই অবধারিতই ছিলো। তবে ব্যতিক্রম ঘটিয়ে তিনি ফেরেননি ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে। ক্যারিয়ার তাই থমকে আছে ১০ ওয়ানডেতেই, যেখানে গড়টা মোটে ১২.৩০।
৪. গাই হুইটাল (গড় ১৪.৪৭)
বিশ্বকাপের নিকৃষ্ট কোনো রেকর্ডের তালিকা করতে বসলে গাই হুইটাল নামটা ঘুরেফিরেই আসে। বিশ্বকাপে ২০ ম্যাচ খেলেও পাননি অর্ধশতকের দেখা, ইনিংসটাই তো কখনো স্থায়ী হয়নি সে অর্থে।
১৮ ইনিংস ব্যাট করে চল্লিশের ঘরেই পৌঁছাননি কখনো, ত্রিশের ঘরেই পৌঁছেছিলেন মাত্র দুবার। দুবার আউট হয়েছিলেন শূন্য রানেও, এমনকি নিজের শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচেও।
বিশ্বকাপে ব্যাটিং গড় তাই কখনোই পঁচিশ ছাড়ায়নি। ছাড়ায়নি বলেই চেষ্টা করেছিলেন আরও বেশি। কখনো পুরোদস্তর খোলসের ভেতর ঢুকে গিয়ে ৩৬ বলে ৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন, আবার কখনো খেলেছিলেন নিজেকে আমূল বদলে ২৬ বলে ২৮ রানের আক্রমণাত্মক ইনিংসও।
আখেরে লাভ হয়নি কিছুই, বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন নামের পাশে ১৪.৪৭ গড় নিয়ে, ২৪৬ রানে।
৫. অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ (গড় ১৮.৭৯)
ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড-পাকিস্তানকে নিয়ে বিশ্বকাপের আগে আগে হওয়া কোকাকোলো কাপে এক ঝড়ো ফিফটি আর একটি ত্রিশোর্ধ্ব ইনিংস, সাথে গতির ঝড় তোলা বোলিংয়ে নজর কেড়েছিলেন নির্বাচকদের। ফলাফল, পরের মাসেই নিজ দেশে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্বকাপ দলে ডাক পেলেন ফ্লিনটফ।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখার এক মাসেরও কম সময়ে বিশ্বকাপ দলে, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের কাছে ১৯৯৯ সালের এপ্রিল-মে মাসটা স্বপ্নময় ঠেকলে তাকে দোষ দেয়া যায় না।
সেই স্বপ্নালু ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিলো খুব সহসাই। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, সেই বিশ্বকাপেই। মাঠে নামা পাঁচ ম্যাচের তিন ম্যাচেই পাননি ব্যাটিং, যে দুই ম্যাচে পেয়েছিলেন তার মাঝে একটি ইনিংসে করেছিলেন শূন্য। বোলিংয়েও অবস্থা ছিলো যাচ্ছেতাই, ইকোনমি রেট সাড়ে পাঁচ ছুঁইছুঁই।
নিজের সবচেয়ে ভালো বিশ্বকাপ কাটিয়েছিলেন পরের আসরে, ২০০৩ সালে। বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারের একমাত্র ফিফটির দেখা পেয়েছিলেন সেবারই, ৭.৫০ গড়কে পেছনে ফেলে সেই বিশ্বকাপে রান তুলেছিলেন ৩১.২০ গড়ে।
তবে চার বছর পরের বিশ্বকাপটা আবারও সেই ব্যর্থতার গল্পই। ১৩.১৪ স্ট্রাইক রেটের চেয়ে বেশি চোখে বাঁধে ৬৫.৭১ স্ট্রাইক রেট, ব্যাটিংটা যে মোটেই ফ্লিনটফ-সুলভ নয়।
ফ্লিনটফের জন্যে বিশ্বকাপটা তাই হয়ে রইলো অনন্ত এক আক্ষেপ, গড়টাই যে ২০ পেরোলো না। যেমন পেরোয়নি বাকি চারজনেরও।