টেস্ট ক্যারিয়ারে অভিষেকের পর প্রথম তিন ম্যাচেই যখন সেঞ্চুরি করলেন তখন সবাই ধরেই নিয়েছিল তিনিই হতে যাচ্ছেন ভারতীয় ক্রিকেটের পরবর্তী এক মহাতারকা। সবকিছু চলছিল স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে দেখা দেয় দুর্যোগের ঘনঘটা। ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সফল এক অধিপতি মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন নিমিষেই হয়ে যান বিতর্কিত, আলোচিত এবং সমালোচিত।
১৯৬৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের রাজধানী হায়দ্রাবাদে জন্ম নেন এই মহাতারকা। বাবা আজিজউদ্দিন নিজের নামের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন আজহার উদ্দিন। মায়ের নাম ইউসুফ সুলতানা। স্কুল ক্রিকেট থেকে তার ক্রিকেট খেলার বিচরণ শুরু। হায়দ্রাবাদ ক্রিকেট লিগে তখন অল সেন্টস স্কুল নিয়মিত অংশ নিতো। আজহার পড়তেন সেই স্কুলে। ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন।
ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম ডিগ্রী লাভ করেন। কিছুদিন ভারতীয় স্টেট ব্যাংকে চাকরিও করেছেন। পাশাপাশি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে হায়দারাবাদের হয়ে মাতিয়েছেন রঞ্জি ট্রফি। সেই সুবাদে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রথম দেখা হয়েছে এই টেস্ট ক্রিকেটের সাথেই। ১৯৮৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর কলকাতার ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেনে যখন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আজহারের টেস্ট অভিষেক হয় তখন তার বয়স ছিল ২১। অভিষেকেই বাজিমাত; প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট এবং সাথে প্রথম সেঞ্চুরি। ১৯৮৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছেন প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ।
আজহার ছিলেন মূলত একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। নিয়মিত বল যদিও করতেন না, তবে বোলার হিসেবে ছিলেন ডানহাতি মিডিয়াম বোলার। ১৯৮৯ সালে তার হাতে দেওয়া হয় ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব। অধিনায়ক হিসেবে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪৭টি টেস্টে, যার মধ্যে জয় আসে ১৪ টেস্টে। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার নেতৃত্বে ১৭৪টি ম্যাচের মধ্যে ৯০টিতে জয় পায় ভারত। প্রবেশ করতে পারতেন ১০০তম টেস্ট খেলা কিংবা একদিনের ক্রিকেটে ১০,০০০ রান করা খেলোয়াড়দের ক্লাবে। সব ধরনের ক্রিকেট থেকে যখন তাকে নিষিদ্ধ করা হয় তখন ৯৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলা আজহারের রান সংখ্যা ৬,২১৬। ৩৩৪টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে তিনি রান করেন ৯,৩৭৪।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ
২০০০ সালে তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রনিয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচ ফিক্সিং এর অভিযোগ আনা হয়। বিশদ তদন্তে কেঁচো খুড়তে বের হয়ে আসে সাপ। এক বিবৃতিতে ক্রনিয়ে জানান, ১৯৯৬ সালে ভারতের বিপক্ষে কানপুর টেস্টের তৃতীয় দিন শেষে আমি আজহারের ফোন পাই। তিনি আমাকে সন্ধ্যায় রুমে ডাকেন। সেখানে তিনি আমাকে মুকেশ গুপ্তা নামক এক বুকির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর আমাকে একা রেখে আজহার চলে যান। সিবিআই এর রিপোর্টে নাম আসে অজয় জাদেজারও। সিবিআই সঞ্জয় চাওলা নামক আরেক বুকির সাথে আজহারের সাক্ষাতের তথ্য পায়। তদন্তে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে রাজকোটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এবং ১৯৯৭ ও ১৯৯৯ সালের পেপসি কাপে ম্যাচ ফিক্সিং এর সাথে আজহারের জড়িত থাকার ঘটনা। জাদেজাকে ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আর আজহার উদ্দিনকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়।
ক্যারিয়ারে অর্জন ও প্রাপ্তি
টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ম্যাচে যেমন সেঞ্চুরি করেছিলেন তেমনি ক্যারিয়ারের ৯৯ তম টেস্ট খেলতে নেমেও করেছিলেন সেঞ্চুরি। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩০০টি ম্যাচ খেলা প্রথম খেলোয়াড়ও তিনিই। সেই সময় ফিল্ডার হিসেবে সর্বোচ্চ ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ডটি ছিল তার নামেই। যদিও সেই রেকর্ডটি পরে তারই স্বদেশী রাহুল দ্রাবিড় ভেঙ্গে দেন। ১৯৮৬ সালে লাভ করেন অর্জুনা অ্যাওয়ার্ড। ১৯৮৮ সালে পান পদ্মশ্রী পুরস্কার। ১৯৯১ সালে ভূষিত হন ‘উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ খেতাবে।
ব্যক্তিগত জীবন ও বিতর্ক
ব্যক্তিগত জীবনেও কম ধকল সামলাতে হয়নি তাকে। ১৯৮৭ সালে পারিবারিক সম্মতিতেই বিয়ে করেছিলেন নওরিনকে। আজহার-নওরিন দম্পতির সংসার ভালোই চলছিল। নওরিনের কোল আলো করে আসে আয়াজ উদ্দিন ও আাসাদ উদ্দিন নামক দুই পুত্রসন্তান। বিজ্ঞাপনের বাজারে ভারতীয় ক্রিকেটারদের চাহিদা বহুকাল থেকেই। এক বিজ্ঞাপনে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অভিনেত্রী ও সাবেক মিস ইন্ডিয়া সংগীতা বিজলানির সাথে তার প্রথম পরিচয়, সংগীতা ছিলেন সালমান খানের সাবেক প্রেমিকা। শুরুর দিকের বন্ধুত্ব আস্তে আস্তে রুপ নেয় ভালবাসায়।
১৯৯৬ সালে প্রথম স্ত্রী নওরিনের সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে সংসার বাঁধেন সংগীতার সাথে। তাদের সংসারে কোনো সন্তান জন্মায়নি। ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আজহার উদ্দিনের প্রথম সন্তান আয়াজউদ্দিন প্রাণ হারায়। তার কিছুদিন পরেই সংগীতার সাথে বিচ্ছেদ ঘটে। তবে বিতর্ক ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। ভারতীয় ব্যাডমিন্টন তারকা জোয়ালা গাট্টার সাথে সম্পর্কের ব্যাপারেও কিছুটা গুজব উঠেছিল। ২০১৩ সালে তৃতীয়বারের মতো সংসার শুরু করে আজহার। বিয়ে করেন দীর্ঘদিনের বান্ধবী মার্কিন নাগরিক শ্যানোন ম্যারিকে।
রাজনীতিতে যোগদান
খেলোয়াড় জীবনের খ্যাতি রাজনৈতিক জীবনে ভালোই কাজে লাগিয়েছেন তিনি। ২০০৯ সালে যোগ দেন ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস দলে। তবে নিজ শহর হায়দ্রাবাদে নির্বাচন করার টিকিট পাননি। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে উত্তর প্রদেশের মোরাদাবাদ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন।
নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি
সব ধরনের ক্রিকেট থেকে তাকে নিষিদ্ধ করা হলে অন্ধ্র প্রদেশের উচ্চ আদালতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন তিনি। মামলাটি দীর্ঘদিন প্রক্রিয়াধীন ছিল। অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। উপযুক্ত এবং যথার্থ সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে উচ্চ আদালত তার ওপর থেকে আজীবন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আজহার জানান, এটা আমার জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। ১১ বছর ধরে আমি লড়াই করছি। অবশেষে ফলাফল আমার পক্ষে।
বড় পর্দায় আজহার
২০১৬ সালে মুক্তি পায় আজহারউদ্দিনের জীবনী নিয়ে তৈরি আজহার সিনেমাটি। সিনেমাটি তৈরি করেন টনি ডি সুজা, যেখানে মূল চরিত্রে অভিনয় করে বলিউড অভিনেতা ইমরান হাশমি। আজহার এর প্রথম স্ত্রী নওরিনের ভূমিকায় প্রাচি দেশাই এবং সংগীতা বিজলানির চরিত্রে অভিনয় করেন নার্গিস ফাখরি।
বিসিসিআই কর্তৃক আমন্ত্রণে ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে কানপুরের টেস্টটি ছিল ভারতের ৫০০ তম টেস্ট ম্যাচ। দিনটিকে স্মরণীয় রাখতে বিসিসিআই এর আয়োজনের কোনো কমতি ছিল না। সেই উপলক্ষে আমন্ত্রণ করা হয় ভারতের সাবেক সব টেস্ট অধিনায়কদের। বিসিসিআই স্মারকলিপি প্রদান করা হয় সব অধিনায়ককেই। সেদিন ৫০০ তম টেস্ট ম্যাচে ভারত জিতে যায় ১৯৭ রানের ব্যবধানে।
বিতর্কিত এক জীবনে প্রাপ্তির সংখা যে কম তা কিন্তু নয়। হয়তো আক্ষেপের পরিমাণটাই বেশি। নিজের দুর্ভাগ্যকেই হয়তো দোষারোপ করবেন তিনি। তবে ভারতীয় ক্রিকেটে তার অবদান নিঃসন্দেহে ভুলে যাওয়ার মতো নয়।
ফিচার ইমেজ: quora.com