বর্তমান ফুটবল দুনিয়ায় মেসি-রোনালদো জুটির পর সব থেকে বেশি মাতামাতি ও বিতর্ক হয় ফুটবলের একদম উঠতি তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে, যারা ‘বিস্ময় বালক’ নামে খ্যাত। হয়তো ইউরোপে, কিংবা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের অখ্যাত কোনো ক্লাবে বেড়ে ওঠা কোনো কিশোর একটু পায়ের কারিকুরি দেখালেই ফুটবলবিশ্ব তার পেছনে লেগে যায়। আর কারিকুরির মাত্রা কিঞ্চিত বেশি হলে শুরু হয় মেসি বা রোনালদোর মতো জীবন্ত কিংবদন্তির সাথে তুলনা করা। যদিও তার ফল ভবিষ্যতে ভালো হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।
ইদানিং খেলোয়াড় কেনা-বেচার ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। সামান্য ঝলক দেখানো ফুটবলারকে চড়া মূল্য দিয়ে কিনে নিচ্ছে ইউরোপের বড় বড় ক্লাব। যদিও হুট করে ইউরোপে এসে সবাই তেমন সুবিধা করতে পারে না। যদি উদাহরণ দিই, প্রথমে আসবে ব্রাজিলিয়ান তরুণ গ্যাব্রিয়েল বারাবোসার নাম। ব্রাজিলিয়ান লিগে গোলের পসরা বসানো এই ফুটবলারকে তুলনা করা হয়েছিল গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার সাথে। পরে ইন্টার তাকে কিনে নেয়। কিন্তু ইন্টারের হয়ে তেমন সুবিধা করতে পারেননি বারাবোসা, অথচ লোনে আবার ব্রাজিলিয়ান লিগে ফিরে সান্তোসের হয়ে মাঠ কাঁপাচ্ছেন। ডর্টমুন্ডের তরুণ উসমান দেমবেলেকে চড়া দামে কিনেছিল বার্সেলোনা। তবে দেমবেলে টানা দুই মৌসুমে প্রত্যাশামাফিক পারফরম্যান্স উপহার দিতে পারেননি।
আবার, ব্যতিক্রমও আছে। যেমন, কিলিয়ান এমবাপে। ফরাসি ক্লাব মোনাকোতে তার বেড়ে ওঠা, পরবর্তীতে পিএসজি তাকে কিনে নেয়। বয়সটা মাত্র ২০ হলো তার। কিন্তু এখনই পিএসজির হাল ধরে ফেলেছেন। ফ্রান্সের হয়ে মাতিয়ে এসেছেন রাশিয়া বিশ্বকাপেও। হল্যান্ডের ডিফেন্ডার ডি লিটের ক্ষেত্রেও একই কথা। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তার কাঁধে ছিল আয়াক্সের আর্মব্যান্ড।
তো, অনেক তরুণ তুর্কির কথা তো জানা গেল। বর্তমান ফুটবলে কয়েকজন তরুণ প্রতিভার কথা জানা যাক, যাদের কালের স্রোতে হারিয়ে যাবার কথা নয়, পাশাপাশি নিয়ে ফুটবল ক্লাব ও সমর্থকদের চাওয়া-পাওয়া বেশি। এবং এদের বিশেষত্ব হলো, এরা সবাই বয়সে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের মধ্যে, যার অর্থ, কিশোর পর্যায়ে।
ফিলিপ ফোডেন, ম্যানচেস্টার সিটি
পেপ গার্দিওলা কোচিং করাবেন, আর ক্লাবের অ্যাকাডেমি থেকে কোনো তরুণকে গড়ে তুলবেন না, তা তো হয় না। ম্যানচেস্টার সিটি আসার পর গার্দিওলা পেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের তরুণ মিডফিল্ডার ফিলিপ ফোডেনকে। যদিও ফোডেন ম্যানসিটির হয়ে নয়, প্রথম নজর কেড়েছিলেন ইংল্যান্ড অনুর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে। ভারতে অনুষ্ঠিত সে বিশ্বকাপে স্যাঞ্চোসহ আরও অনেক উঠতি তরুণেরা ছিল। কিন্তু সেবারের আসরে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন ফোডেন।
গার্দিওলা স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে আসার পর প্রিমিয়ার লিগে ফোডেনের অভিষেক হয় ২০১৭-১৮ মৌসুমে, যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। স্প্যানিশ এই কোচ তখনই বুঝেছিলেন, এই কিশোরের ভেতর সুপ্ত প্রতিভা আছে।
ফোডেনের উন্নতির শুরু তখন থেকেই। ম্যানসিটির মধ্যমাঠে তারার মেলা হলেও ফোডেনকে গার্দিওলা প্রায়ই মাঠে নামিয়ে দেন। গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগসহ প্রিমিয়ার লিগে ফোডেন খেলেছেন প্রায় ১৫ ম্যাচ। শুধু মাঠে ৯০ মিনিট দেয়া নয়, কমিউনিটি শিল্ড ফাইনালের ম্যাচে টাইব্রেকারে পর্যন্ত ফোডেনের উপর ভরসা রেখেছেন গার্দিওলা। আর এতেই বোঝা যায় ফোডেনের আসন্ন ভবিষ্যত।
টেলিগ্রাফ’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গার্দিওলা বলেছেন,
‘আমি তার উপর প্রথম থেকেই ভরসা করি। যখন প্রথমবার আমি এখানে আসি, সে ১৫ অথবা ১৬ বছর বয়সী ছিল। ক্লাবের ডিরেক্টর তার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘একে তোমার চিনে রাখা উচিত’। তারপর ফোডেন যখন মূল দলের সাথে অনুশীলনে এল, তার খেলা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই।’
বিবিসি’কে দেয়া আরও এক সাক্ষাৎকারে ফোডেন সম্পর্কে গার্দিওলা আরও বলেছেন,
‘ফোডেন আমার কোচিং ক্যারিয়ারে দেখা অন্যতম সেরা প্রতিভাবান কিশোর।’
ডেভিড সিলভা, ফার্নান্দিনহো আগামী মৌসুমে ম্যানসিটি থেকে বিদায় নেবেন। তাই এটা অনুমেয় যে, ১৯ বছর বয়সী এই কিশোর খুব তাড়াতাড়ি ম্যানসিটির মধ্যমাঠের অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে যাচ্ছেন।
ক্যালাম হাডসন-অডোই, চেলসি
চেলসি ক্লাব যেন তরুণ প্রতিভাদের আতুরঘর। তবে তাদের অধিকাংশই থাকে অন্য ক্লাবে লোনে, এবং প্রায় সবসময় পরবর্তীতে তাদের মূল দলে জায়গা হয় না। রোমেলু লুকাকু, কেভিন ডি ব্রুইনদের পর ব্লুজদের অন্যতম হতাশা হলো এডেন হ্যাজার্ডের মতো তারকাকে হারানো। আর তাদের অ্যাকাডেমি থেকে মূল দলে থিতু হতে পারা খেলোয়াড়ের সংখ্যাও কম। সেই কমসংখ্যকদের মাঝে একটি প্রতিভার নাম ক্যালাম হাডসন-অডোই।
১৭-১৮ মৌসুমে মূল দলে অভিষেক হবার পর হাডসন-অডোইকে চেলসি আর সবার মতো লোনে পাঠায়নি। দলের প্রধান দুই উইঙ্গার উইলিয়ান ও পেদ্রোর ইনজুরির ফলে গত মৌসুমে বেশ কয়েক ম্যাচে তাকে ব্যবহার করেছিলেন মরিসিও সারি। ১০ ম্যাচ খেলেও লিগে তেমন ভালো খেলেনি তিনি, যদিও আলো ছড়িয়েছিলেন ইউরোপা লিগে। গত মৌসুমে চেলসির একমাত্র শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে হাডসন-অডোই ৯ ম্যাচে ৪ গোল ও ২ অ্যাসিস্ট করে মূলত আলোচনায় আসেন। নজরকাড়া পাস, বল আয়ত্ত্বে রাখার চতুরতা ও গোল করার প্রবণতার জন্য ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলে পরিচিত ছিলেন তিনি। যদিও চলতি বছর ইংল্যান্ডের মূল দলেও অভিষেক হয়ে গেছে তার।
চেলসির বর্তমান কোচ ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড তরুন তুর্কিদের বেশ কদর করেন। ডার্বি কাউন্টিতে থাকতে তার দলের বিশেষত্ব ছিল এই তরুণ শক্তি। বর্তমান চেলসি দলেও সেই একই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তাই তার অধীনে আরও উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে ১৮ বছর বয়সী ক্যালাম হাডসন-অডোইয়ের।
মইস কিন, এভারটন
জুভেন্টাসের অ্যাকাডেমিতে বেড়ে উঠলেও মইস কিন মূল দলে আসেন ২০১৬-১৭ মৌসুমে। তখনও রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদে খেলেন। মরিসিও সারি ইতালিতে, নাপোলির দায়িত্বে। যদিও সে সময়ে জুভেন্টাসের স্ট্রাইকার হিসেবে ছিলেন মারিও মানজুকিচ ও গঞ্জালো ইগুয়াইন। তাই পরের বছরে লোনে পাঠানো হয় তাকে। এক মৌসুমের লোন চুক্তিতে আবার গত মৌসুমে যখন তিনি জুভেন্টাসে ফেরত আসেন, দলের আক্রমণভাগে দিবালা, রোনালদো, মানজুকিচেরা। তারপরও ১৩ ম্যাচে ৬ গোল করে কিন প্রমাণ করেছিলেন, জুভেন্টাসের ভবিষ্যতের হাল ধরার জন্য তিনি ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছেন।
কিন্তু মরিসিও সারির নতুন জুভেন্টাসে স্ট্রাইকার পজিশনে গঞ্জালো ইগুয়াইন ফেরত আসার পর আর্জেন্টাইন তারকা পাওলো দিবালার জায়গা হয় না, অপরীক্ষিত তরুণ কিনের জায়গা কীভাবে হবে! তাই ক্যারিয়ার বাঁচাতে আগেভাগেই তিনি পাড়ি জমালেন প্রিমিয়ার লিগের দল এভারটনে।
একজন উঠতি তারকার প্রথম প্রয়োজন নিয়মিত মাঠে নামা। জুভেন্টাসে সেটা সম্ভব হতো না কিনের জন্য। কিন্তু এভারটনে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তাই এভারটনে নিয়মিত খেলে মইস কিন তার প্রতিভার সম্পূর্ণ ব্যবহার করতে পারবেন। ইতালির অনুর্ধ্ব-১৯ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ৫ ম্যাচে ৪ গোল করেছিলেন তিনি। মূল দলে জায়গা পেয়ে ইউরো বাছাইপর্বেও মইস কিন ২ ম্যাচে ২ গোল করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই ১৯ বছর বয়সী মইস কিনের জন্য ইতালির মূল দলের দরজাও খোলা। আর প্রিমিয়ার লিগে ঝলক দেখানো মানেই ইউরোপের বড় বড় ক্লাবের নজড় কেড়ে নেওয়া। মইস কিন শুধু সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেই হয়!
আলফনসো ডেভিস, বায়ার্ন মিউনিখ
ইউরোপের আর বাকিদের মতো ডেভিস তেমন জনপ্রিয় নন। তবে বয়স মাত্র ১৮ হলেও কানাডা মূল দলে তার অভিষেক হয়, যখন তার বয়স ১৬ বছর। ডেভিসের বেড়ে ওঠা এমএলএস লিগের ক্লাব ভ্যাংকুভার হোয়াইট ক্যাপসে। যদিও প্রথম দুই মৌসুমে ডেভিস তেমন নাম কামাতে পারেননি। কারণ উইংয়ের পাশাপাশি অধিকাংশ সময়ে তিনি খেলতেন লেফটব্যাক পজিশনে। তবে ২০১৮ সালে নতুন মৌসুমে ডেভিস পাকাপাকিভাবে উইঙ্গার পজিশনে খেলতে শুরু করেন এবং সে বছরই এমএলএস লিগে তার গোলখরা কাটে। ৩১ ম্যাচ খেলে ৮ গোল ও ৯ অ্যাসিস্ট করতে সক্ষম হন তিনি, এবং বায়ার্ন মিউনিখের স্কাউট দলের নজরে পড়ে যান।
এ বছরের শুরুতে গ্রীষ্মকালীন দলবদলের মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখ তাকে কেনে ৯ মিলিয়ন ইউরোতে। মূলত বায়ার্ন মিউনিখ তাদের ‘বি’ দলের জন্য প্রাথমিকভাবে ডেভিসকে এনেছিল। যদিও নিকো কোভাচ তাকে হতাশ করেননি, মৌসুমজুড়ে ৬ ম্যাচে খেলে অভিষেক গোলও পেয়েছিলেন তিনি। নতুন মৌসুমেও এক ম্যাচের জন্য নেমে ডেভিস মৌসুমের প্রথম গোলের দেখা পেয়ে গেছেন। বর্তমান বায়ার্ন মিউনিখ দলে উইঙ্গারের কমতি লক্ষণীয়। জার্মান দলটি নতুন উইঙ্গার কিনতে সক্ষম হয়নি। তাই ক্যোমান ও ন্যাব্রির বিকল্প হিসেবে দল তার জায়গা ইতঃমধ্যে পাকাপাকি হয়ে গেছে।
রদ্রিগো গোয়েস, রিয়াল মাদ্রিদ
২০১২ বা ২০১৩ সালের দিকে নেইমার যখন সান্তোসের মাঠ মাতাচ্ছিলেন, তখন বার্সেলোনার পাশাপাশি রিয়াল মাদ্রিদও চেষ্টা করেছিল তাকে বার্নাব্যুতে আনতে। তবে লস ব্লাঙ্কোসদের সে চেষ্টা সেবার সফল হয়নি। তাই ব্রাজিলে উঠতি কোনো তরুণ কিছুটা নাম করলেই রিয়াল মাদ্রিদ যেন উঠেপড়ে লাগে তার পিছনে। কোনোমতেই তারা আরেকটি নেইমার হারাতে চায় না। এবং এরই নতুন সংযোজন ১৮ বছর বয়সী উইঙ্গার রদ্রিগো গোয়েস।
সান্তোসের অ্যাকাডেমিতে বেড়ে ওঠা এই তরুণ মূলত নজর কাড়েন ২০১৮ সালের ব্রাজিলিয়ান লিগে ৩৫ ম্যাচে ৮ গোল ও ৩ অ্যাসিস্টের বদৌলতে। বয়স মাত্র ১৮ হলেও রদ্রিগো বেশ প্রতিভাবান। সান্তোসের হয়ে লেফট-মিড পজিশনে খেললেও দলের তারকা খেলোয়াড় ছিলেন তিনি, নিয়মিত ফ্রি-কিকও নিতেন। তবে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে প্রাক-মৌসুমের ম্যাচে তার খেলা দেখে বোঝা গেছে, ব্রাজিলিয়ানদের মতোই গতি ও ড্রিবলে পারদর্শী হলেও ক্রসিং ও এরিয়্যাল ডুয়েলসে ঘাটতি আছে তার। পাশাপাশি ফিনিশিংও ভালো নয়। তবে জিদানের অধীনে উন্নতি করার অনেক সময় আছে তার।
যদিও রদ্রিগোকে নিয়ে জিদানের ভিন্ন পরিকল্পনা আছে। উইঙ্গার হিসেবে খেললেও জিদান চান, রদ্রিগো আক্রমণের আরও নিচে নেমে খেলুক। তবে রদ্রিগো কতটা উন্নতি করতে পারবেন, বা আদৌ মাদ্রিদের একাদশে থিতু হতে পারবেন কি না, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। তাই আরও উন্নতি করার লক্ষ্যে আপাতত রদ্রিগোর স্থান রিয়াল মাদ্রিদের ‘বি’ দলে।
ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রিয়াল মাদ্রিদ
রদ্রিগো গোয়েসের মতোই ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের বেড়ে ওঠা ব্রাজিলে, তবে ভিন্ন ক্লাবে, ফ্ল্যামেঙ্গো। যদিও ফ্ল্যামেঙ্গোতে খেলার সময় তিনি গোল বা অ্যাসিস্ট খুব বেশি একটা করেননি। তবে দুর্দান্ত গতি, ড্রিবলিং করার দক্ষতা ও গোলক্ষুধা ছিল তার স্বভাবে। এ কারণেই তিনি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পান। ফ্লামেঙ্গোতে ভিনিসিয়ুস খেলতেন লেফট উইং ও লেফট-মিডফিল্ড পজিশনে। ঠিক তারই সাথে একই ক্লাব থেকে আরেক ব্রাজিলিয়ান প্লে-মেকার নজর কেড়েছিলেন। পরে লুকাস পাকেতাকে কিনে নেয় ইতালির ক্লাব এসি মিলান।
পাকেতা ছিলেন একদম উপযুক্ত নাম্বার টেন। তাই গোলসুযোগ তৈরি ও গোল করায় ছিলেন পটু। ভিনিসিয়ুসের দুর্দান্ত গতি ও ড্রিবল করার দক্ষতা থাকলেও তার দুর্বলতা ফিনিশিংয়ে। রিয়াল মাদ্রিদের প্রত্যেক ম্যাচেই তা লক্ষ্য করা গেছে। তাই মৌসুমজুড়ে পাকেতার মতো নিয়মিত গোলধারা ভিনিসিয়ুস বজায় রাখতে পারেননি। ফ্ল্যামেঙ্গোর হয়ে শেষ মৌসুমে ১২ ম্যাচে ৪ গোল ও ৩ অ্যাসিস্ট করে তিনি পাড়ি জমান রিয়াল মাদ্রিদে।
রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর ভিনিসিয়ুস বলেছিলেন, ‘আমি অনেকটা নেইমারের মতোই।’ এরপর রোনালদো বিদায়ের পর রিয়াল মাদ্রিদের প্রাক্তন কোচ সান্তিয়াগো সোলারি মূল দলে নিয়মিত খেলাতে শুরু করেন ভিনিসিয়ুসকে। পাস, ড্রিবল ও পায়ের কারুকাজ দেখিয়ে গত মৌসুমে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুকে মুগ্ধ করেছেন এই ১৯ বছর বয়সী ব্রাজিলিয়ান। লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগ ও কোপা ডেল রে মিলিয়ে প্রথম মৌসুমে তিনি খেলেছেন ৩০টি ম্যাচের মতো। যদিও সেভাবে গোল পাননি তার ফিনিশিংয়ে দুর্বলতার কারণে। বর্তমান কোচ জিনেদিন জিদানও ভিনিসিয়ুসকে মূল দলের খেলোয়াড় হিসেবেই ভাবছেন। তাই ফিনিশিংয়ের দুর্বলতাকে জয় করতে পারলে ভিনিসিয়ুসের মাদ্রিদের ভবিষ্যতের দিনগুলো বেশ ভালো কাটবে।
জ্যাদন স্যাঞ্চো, বরুশিয়া ডর্টমুন্ড
স্যাঞ্চো যখন ওয়াটফোর্ডে, তখন প্রথমবার তার গোল করার দক্ষতা ও চোখ-ধাঁধানো ড্রিবলিং নজরে আসে। ওয়াটফোর্ডে তিনি যোগ দিয়েছিলেন মাত্র ৯ বছর বয়সে। সে সময় থেকে চেলসি এবং আর্সেনাল ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েছিল স্যাঞ্চোকে দলে নিতে। কিন্তু উভয় ক্লাবই ব্যর্থ হয়। ১৪ বছর বয়সে তিনি উল্টে যোগ দেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। ২০১৭ সালে স্যাঞ্চো সিদ্ধান্ত নেন, তিনি ম্যানসিটি ছাড়বেন নতুন চ্যালেঞ্জের উদ্দেশ্যে। ম্যানসিটি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তার মন গলাতে পারেনি, স্যাঞ্চো পাড়ি জমান জার্মান ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে।
ইংল্যান্ডের অনুর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে বিশ্বকাপ ও অন্যান্য ম্যাচে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স সবসময়ই স্যাঞ্চোকে জনপ্রিয় রেখেছিল। তবে নিজেকে বর্তমান সময়ের সেরা কিশোর ফুটবলারদের একজন প্রমাণ করে তিনি নজর কাড়েন মূলত গত বছর। উসমান দেমবেলে বার্সেলোনা পাড়ি জমালে স্যাঞ্চো আসেন তার জায়গায়। এরপর, বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে বুন্দেসলিগায় গত মৌসুমে ৩৪ ম্যাচে ১২ গোল করার পাশাপাশি করিয়েছেন ১৪ গোল। এ মৌসুমের শুরুও করেছেন গোলবন্যায়; বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে সুপার কাপের ফাইনালে গোল পেয়েছেন, চলতি লিগেও ইতঃমধ্যে ৩ ম্যাচে ২ গোল করা হয়ে গেছে তার। শুধু বুন্দেসলিগায়ই নয়, ইংল্যান্ড জাতীয় দলেও টেনে নিয়ে গেছেন ক্লাবের পারফরম্যান্স।
মাত্র ১৯ বছর বয়সী এ তরুণ সাধারণত খেলেন উইংয়ে। তবে উইঙ্গার হলেও তিনি একজন প্রথাগত প্লে-মেকার। দুর্দান্ত গতি ও বল কন্ট্রোলের দরুন স্যাঞ্চো যেমন গোল করেন, তেমনই গোল সুযোগ তৈরিতেও সমানভাবে দক্ষ। তার অসাধারণ নৈপুণ্য দেখে অনেক বিশেষজ্ঞই তাকে ‘আগামীর ফুটবলের নায়ক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
জোয়াও ফেলিক্স, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ
শুধু পর্তুগালেরই নয়, বর্তমান ফুটবল বিশ্বে বিস্ময়বালকদের মধ্যে সব থেকে উপরের নাম দু’টির একটি স্যাঞ্চো হলে, অপরটি জোয়াও ফেলিক্স। অবশ্য বেনফিফার হয়ে তার উত্থান খুবই আকস্মিক।
২০১৭-১৮ মৌসুমে বেনফিকার ‘বি’ দলে ১৭ ম্যাচে ৪ গোল করেন ফেলিক্স। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। কিন্তু তার ড্রিবল, পাসিং অ্যাকুরেসি এবং ফিনিশিং যেন কোনো বর্ষীয়ান ফুটবলারের মতো। পরের মৌসুমে মুল দলে ফেলিক্সকে সুযোগ দেন বেনফিকার কোচ লুই ভিতোরিয়া। ফেলিক্সও হতাশ করেননি, সুযোগ পেয়ে তিনি বুঝিয়ে দেন, আগমন ঘটতে যাচ্ছে এক নতুন বিস্ময়বালকের।
১৯ বছর বয়সী ফেলিক্স একাধারে উইঙ্গার ও স্ট্রাইকার। তবে বেনফিকায় থাকতে তিনি ৪-৪-২ ফর্মেশনে একজন পূর্ণাঙ্গ স্ট্রাইকারের ভূমিকাতেই বেশি খেলতেন। তবে উইঙ্গার ও অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের ভূমিকাতেও তাকে দেখা গেছে। তবে ফেলিক্স সব থেকে বেশি পারদর্শী ফিনিশিং টাচে। বল কন্ট্রোলে তার একটু দুর্বলতা আছে। তাই একজন ফরোয়ার্ড হিসেবেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
বেনফিকায় মাত্র একটি বিস্ময় মৌসুম কাটানোর পর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ তাকে চড়া মূল্যে কিনে নেয়। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই তিনি ফুটবলবিশ্বে চতুর্থ দামী খেলোয়াড়। এই দলবদলের পর ডিয়েগো সিমিওনে ও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ বেশ সমালোচিত হয়েছিল। কারণ, মাত্র এক মৌসুমের ফলাফল দেখে ১৯ বছর বয়সী বালককে এমন অর্থ দিয়ে কেনা বোকামি ছাড়া আর কী হতে পারে! আর ফেলিক্সের দৈহিক গড়নও তেমন নয়, বেশ ইনজুরিপ্রবণও। তবে প্রাক-মৌসুম ও লা লিগার প্রথম ম্যাচগুলোতে ফেলিক্সের পারফরম্যান্স বলে দেয়, সিমিওনে রত্ন চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি।
ফেলিক্স তার অভিষেক ম্যাচ দুই গোল করে নায়ক বনে গিয়েছিলেন। সে ম্যাচে স্পোর্টিং লিসবনের বিপক্ষে ২-০তে বেনফিকা পিছিয়ে থাকার পর ফেলিক্স মাঠে নামেন। মাত্র ২৯ মিনিট খেলে নির্ঘাৎ হারের হাত থেকে দলকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। তার প্রথম গোল ছিল দুর্দান্ত এক ক্রস থেকে অভাবনীয় এক হেডে গোল, যা তার শারিরীক সক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলে। আসলে ফেলিক্স প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে কেমন খুনে স্বভাবের হয়ে ওঠেন, সেটা তার খেলা না দেখে অনুমান করা সম্ভব নয়। আর মাত্র ১৯ বছর বয়সী বালকের এমন গোল দেবার দক্ষতাকে ‘অবিশ্বাস্য’ বলেই মনে হয়।
ফেলিক্সকে বর্তমানে বলা হয় পর্তুগালের ‘নতুন রোনালদো’। ফেলিক্স তার মতোই প্রায় ৬ ফুট লম্বা, খেলেনও জুভেন্টাস তারকার মতোই ডান পায়ে। এমনকি খেলার ধরনেও বেশ মিল লক্ষণীয়। রোনালদো পর্তুগালের হয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে ছিলেন, আছেন এখনও। আর ১৯ বছর বয়সী জোয়াও ফেলিক্সের এই তো সবে শুরু!