১.
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস কোনটি? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকে অভিষেক টেস্টে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫ রানের ইনিংসটির কথা বলবেন। যারা বলবেন, তাদের যুক্তিটি পুরোপুরি ভুল নয়। বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে কেমন পারফর্ম করবে, তৎকালীন বেশিরভাগ ক্রিকেট বোদ্ধাই সেটি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। সেই মুহূর্তে জীবনের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেই শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে বুলবুলের এমন সাবলীল একটি ইনিংস অনেককেই অবাক করেছিল।
কেউ কেউ আবার কেনিয়ার বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক জয়ে মোহাম্মদ রফিকের ৭৭ রানের ইনিংসটির কথাও বলতে পারেন। যে কোনো সেক্টরেই ‘প্রথম’ ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমবার কোনো বড় ঘটনা ঘটার আগে মানসিকভাবে কিছুটা পিছিয়ে থাকে সবাই। জয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেও অনেক ম্যাচ হেরে যেতে হয় মানসিক শক্তির অভাবে।
অনেকে আবার সর্বজয়ী অষ্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মোহাম্মদ আশরাফুলের ১০০ রানের ইনিংসটির কথা বলবেন। সেসময় অস্ট্রেলিয়া সমসাময়িক অন্যান্য দল থেকে অনেক বড় ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। তাদের বিপক্ষে মোটামুটি এক হাতেই ম্যাচটা বের করে নেন আশরাফুল। ক্রিকেট ইতিহাসের আপসেটের যত ম্যাচ আছে, এই ম্যাচটিকে সেগুলোর মধ্যে প্রথম হিসেবে মেন নেন অনেকেই।
ছোট দলের জন্য বড় দলকে হারানোর কিছু ফর্মুলা আছে। আগে ব্যাটিং করে মোটামুটি একটা সংগ্রহ দাঁড় করানো, তার পর বোলিংয়ে প্রথমদিকেই দুয়েকটি উইকেট ফেলে বিপক্ষে দলকে চাপে ফেলে দেওয়া। এরপর শেষ পর্যন্ত চাপটা ধরে রাখা। কিন্তু সেই ফর্মুলা ভেঙে আপসেটের এই তালিকায় প্রথম দশটি ম্যাচের মধ্যে একমাত্র কার্ডিফের সেই ম্যাচটিই চেজ করে জেতা।
ইদানিংকালের অনেকে গত বিশ্বকাপে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের টানা দুই সেঞ্চুরির কথাও আনতে পারেন বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস হিসেবে। এই সেঞ্চুরিই বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভুত হবার ভিত গড়ে দিয়েছে।
কেউ যদি লর্ডসে তামিম ইকবালের সেঞ্চুরির কথা বলেন, তাহলে সেটিকেও অযৌক্তিক বলা যাবে না। ক্রিকেট ইতিহাসে লর্ডস সবসময়েই আলাদা একটি জায়গা নিয়ে আছে। সেই মাঠে শচীন-লারার মতো ব্যাটসম্যানেরও সেঞ্চুরি নেই।
তবে এতসব ইনিংসের মাঝে, বেশিরভাগ মানুষই ভুলে যান ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফিতে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে আকরাম খানের অপরাজিত ৬৮ রানের ইনিংসটির কথা। এই ভুলে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে।
প্রথমত, ম্যাচটি আন্তর্জাতিক ছিল না। দ্বিতীয়ত, খেলাটি টেলিভিশনে দেখানো হয়নি। আর তৃতীয়ত, অনেকের মাঝেই সাবেকদের কিছুটা কম সম্মান করার প্রবণতা রয়েছে।
এই লেখাটির মাধ্যমে আকরাম খানকে সম্মান জানানোর সাথে সাথে, বর্তমান প্রজন্মের মানুষদেরকে ইনিংসটির গুরুত্ব বোঝানোর একটু চেষ্টা করা হলো।
২.
বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পেছনে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর বিষয়টি একটি বড় ভূমিকা রেখেছিল। অথচ একটু উনিশ-বিশ হলে বাংলাদেশ ১৯৯৯ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার সুযোগটাই পেত না। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ খেলতে না পারলে বাংলাদেশ যে ক্রিকেটে আরো অনেকদিন পিছিয়ে থাকতো, সেটা তো বলাই বাহুল্য।
সেসময় নন টেস্ট প্লেয়িং দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে আইসিসি ট্রফি খেলে বিশ্বকাপে আসতে হতো। আইসিসি ট্রফির চ্যাম্পিয়ন, রানার্স আপ আর তৃতীয় স্থান অর্জনকারী তিনটি দল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেতো। ১৯৯৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ চ্যম্পিয়ন হওয়ার কারণে অনেকে আনন্দ মিছিল করলেও নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটির আগে অনেকে ক্রিকেট নিয়ে খুব বেশি সিরিয়াস ছিল না। এই কারণে খুব অল্প সংখ্যক মানুষই জানতেন ম্যাচটার কথা।
সেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফরম্যাটে প্রথম পর্বের পর দ্বিতীয় পর্বে এক গ্রুপে ছিল বাংলাদেশ, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড আর হংকং। এখান থেকে দুটো দল সেমিফাইনাল খেলার কথা ছিল। বৃষ্টির জন্য নেদারল্যান্ড আর বাংলাদেশের একটি করে ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ায়, এই দুই দলের মুখোমুখি ম্যাচটা হয়ে যায় অনেকটা নক আউটের মতো। যে দল জিতবে, সেই দলই পরের পর্বে যাবে। তবে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়ে ১ পয়েন্ট পেলেও বাংলাদেশের চলতো।
ম্যাচ শুরুর আগে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশই ফেভারিট ছিল। যদিও ইতিহাস বাংলাদেশের বিপক্ষে ছিল। ‘৯৬ এর বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ খেলতে পারেনি ‘৯৪ এর আই.সি.সি ট্রফিতে এই নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে হেরেই। তাছাড়া টুর্নামেন্ট শুরুর আগের একটি প্রস্তুতি ম্যাচেও বাংলাদেশ হারে নেদারল্যান্ডের কাছে। তাই অল্প হলেও কিছুটা ভয় তো ছিলই।
টস জিতে বাংলাদেশ ফিল্ডিং নেয়, ৪৯.৫ ওভারে ১৭১ রান করে অল আউট হয় নেদারল্যান্ড। ৫০ ওভারে টার্গেট মাত্র ১৭২ রান। হাসতে হাসতেই ম্যাচটা জেতার কথা বাংলাদেশের। কিন্তু ম্যাচের ৩য় ওভারের মাঝেই প্রথম তিনজন ব্যাটসম্যান (নাইমুর রহমান, সানোয়ার হোসেন, আমিনুল ইসলাম) মাত্র ১৩ রানে সাজঘরে ফিরে যাওয়ায় আকরাম খানকে নামতে হয় ক্রিজে। পরের ওভারে আতাহার আলি আউট হলে বাংলাদেশের রান দাঁড়ায় ৪ উইকেটে ১৫। এর মাঝে শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।
নেদারল্যান্ড চাইছিল কোনো রকমে ম্যাচটির ২০ ওভার সম্পূর্ণ করতে। তাহলে ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথড অনুযায়ী ম্যাচের ফলাফল নির্ধারিত হবে। ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথড অনুযায়ী ২০ ওভারে মাত্র ৩৭ রান করলেই বাংলাদেশ জিতে যেত, তবে সেই শর্তটা পূরণ হতো, যদি কোনো উইকেট না হারাতো। ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ায় সেই টার্গেট হয়ে গেল ৭৭, যা কিনা সেই মূহুর্তে বাংলাদেশের জন্য করতে পারাটা অসম্ভবেরই অপর নাম ছিল। বাংলাদেশ তখন চাইছিল কোনো রকমে সময় নষ্ট করে খেলাটা ২০ ওভার পর্যন্ত যেতে না দিতে, আর নেদারল্যান্ড চাইছিল, কোনো রকমে ২০ ওভার শেষ করতে। ২০ ওভার তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য দুই প্রান্ত থেকে স্পিনার লাগিয়ে দেয় নেদারল্যান্ড।
কিন্তু নেদারল্যান্ডের এত চেষ্টার পরেও, ৭ বল বাকি থাকতেই বৃষ্টির জন্য ম্যাচ বন্ধ হয়ে যায় ।
৩.
বাংলাদেশের সমর্থকরা তখন স্বাভাবিকভাবেই খুশি। যে ম্যাচের সাথে বিশ্বকাপে খেলতে পারা আর না পারা জড়িত, সেই ম্যাচ নিয়ে রিস্ক নিতে কে চায়। তবে বাংলাদেশের সমর্থকদের বেশিক্ষণ খুশি হতে না দিয়ে পৌনে এক ঘণ্টা পর থেমে গেল বৃষ্টি। ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথডে হিসেব করা হলো, ৩৩ ওভারে ১৪১ রানের নতুন টার্গেট দাঁড়ালো বাংলাদেশের। বৃষ্টির আগে বাংলাদেশ করেছিল ১৮.৫ ওভারে ৫৬ রান, তার মানে, বাকি ১৪.১ ওভারে করতে হবে ৮৫ রান। ৮৫ বলে ৮৫।
খেলাটা রেডিওতে শোনায় দেশে থাকা সমর্থকরা বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের চিন্তাযুক্ত মুখ দেখতে পারছিলেন না। তবে স্বাভাবিকভাবেই খেলোয়াড়দের ভেতর যে প্রেশার কাজ করছিল, তা সমর্থদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ছিল। ৭৭ রানে মিনহাজুল আবেদিন নান্নুও আউট হয়ে যাবার পর স্বীকৃত ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে রইলেন শুধুমাত্র আকরাম খান। ৮৬ রানে এনামুল হক মনিও আউট হয়ে গেলেন।
কিন্তু এরপরেই যেন আকরাম খান ম্যাজিক দেখানো শুরু করলেন। বোলার সাইফুলকে নিয়ে এক প্রান্ত ধরে রেখে খেলতে থাকলেন তিনি। অধিনায়ককে এমন খেলতে দেখে সাইফুলও যেন গুরুত্বের দিক দিয়ে জীবনের সেরা ইনিংস খেলে ফেললেন। মাত্র ২০ বলে ১৮ রান করলেও তিনি আকরাম খানের সাথে গড়ে তুললেন ৪০ বলে ৫০ রানের একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্টনারশিপ। সাইফুল যখন আউট হলেন, তখন বাংলাদেশের প্রয়োজন ২ ওভারে ৫ রান। রুদ্ধশ্বাস সমাপ্তির জয়সূচক রানটা আকরাম খানই নিলেন।
৪.
এরপর চলে গেছে অনেক সময়। প্রায় ২০ বছর আগের সেই ম্যাচ তখনকার অনেকেরই হয়তো মনে নেই। আবার অনেকের হয়তো ইনিংসটির কথা জানাও নেই। একটি উঁচু বিল্ডিং যখন তৈরি হয়, তখন সবাই সেটি দেখে মুগ্ধ হয়, কিন্তু অনেকেই সেটার ভিত্তির কাজটুকু সম্পর্কে জানে না। ক্রিকেটে বাংলাদেশ আজ যতটুকু এগিয়েছে, তার পেছনে আকরাম খানের ইনিংসটার গুরুত্ব সেই ভিত্তিপ্রস্তরের মতোই।
আকরাম খানের সেই ইনিংসটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা কিনা, তা হয়তো বলা যাবে না; তবে সেরাদের পথ দেখিয়েছে সেই ইনিংস, এই কথাটি চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়।