জঙ্গি, বোমা হামলা, ড্রোন হামলা, জিহাদি, তালেবান; আফগানিস্তান দেশটার নাম শুনলে এই কয়টি শব্দই প্রথমে আমাদের মাথায় আসার কথা। কিন্তু আজকাল আরেকটা শব্দ জোর করে জায়গা করে নিয়েছে এদের সাথে। সেটি হচ্ছে ক্রিকেট। আফগানিস্তানের কথা আসলে তাই আকাশী নীল জার্সি পরা তরুণদের কথাও আসবে। এর সাথে আসবে একটি রূপকথাও।
গত পঞ্চাশ বছরে রাশিয়ান, আমেরিকান, তালিবান, জিহাদি, বিদ্রোহীদের আনাগোনায় বিধ্বস্ত এক জাতি, বিশ বছর আগেও যাদের ক্রিকেটের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না, তারাই যখন ক্রিকেটের সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে বসে, তখন তাকে রূপকথা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। আরো অবাক লাগে যখন দেখা যায় আজকে এই জাতির সবচেয়ে গর্বের বস্তু হয়ে উঠা ক্রিকেটের সাথে তারা পরিচিত হয়েছে মাত্র কয়েক দশক আগে পাকিস্তানের শরণার্থী শিবিরে। দুঃখের বিষয় হলো সেখান থেকে আজকে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া দলটি কখনো নিজের দেশে একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলারও সুযোগ পায়নি।
ক্রিকেটের সাথে পরিচয়
উপমহাদেশে ক্রিকেট এসেছে ব্রিটিশদের হাত ধরে। আফগানিস্তানও ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। কিন্তু ‘সাহেবদের খেলা’ ক্রিকেট তখন তাদের মন জয় করতে পারেনি। ক্রিকেটের সাথে আফগানদের পরিচয় হয়েছে আরও বহু পরে।
আশির দশকের শুরুতে যখন রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) আফগানিস্তান দখল করে নেয়, তখন রাশিয়ানদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে দলে দলে আফগানরা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় পাকিস্তানের উত্তর পূর্বাঞ্চলে। সেই শরণার্থী শিবিরেই তারা পরিচিত হয় পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটের সাথে। ব্যাট-বল হাতে শরণার্থী শিশুরা ভুলে যায় দেশে ফেলে আসা আতঙ্ককে। শরণার্থী শিবিরে বেড়ে উঠা এমনই এক শিশু হচ্ছেন বর্তমানে আফগান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা মোহাম্মদ নবী। ওই সময়ের কথা মনে করে নবী এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“মাঝে মাঝে আমরা দেশে ফিরে যেতাম নিজেদের ভিটে দেখতে। কিন্তু দেখে কিছুই ভালো লাগতো না। সবকিছুই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর- সবখানে বুলেটের দাগ। তখন পেশোয়ারে ফিরে আসতেই ভালো লাগতো। কারণ এখানে স্বাধীনতা আছে। ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা আছে।”
শুধু মোহাম্মদ নবী নয়, একই রকম অভিব্যক্তি হয়তো শোনা যাবে এই প্রজন্মের আরও অনেক আফগান ক্রিকেটারের কাছে। বর্তমান ক্যাপ্টেন আজগর স্ট্যানিকজাই, মোহাম্মদ শাহজাদ, নওরোজ মঙ্গলের মতো জাতীয় দলের অনেক খেলোয়াড়ই বেড়ে উঠেছেন পাকিস্তানের শরণার্থী শিবিরে, ক্রিকেটের হাতেখড়ি তাদের ওখান থেকেই।
দেশে ক্রিকেট-বিপ্লব ও জাতীয় দল গঠন
২০০১ সালে তালেবান শাসনের সমাপ্তি ঘটে আফগানিস্তানে। একই বছর ডিসেম্বরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসেন আফগানিস্তানের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হামিদ কারযাই। তখন থেকেই মূলত শরণার্থীরা পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরতে শুরু করে। মোহাম্মদ নবীও তার পরিবার নিয়ে দেশে ফেরেন ২০০২ সালে।
“যখন আমরা এখানে বেশি সময় কাটানো শুরু করলাম, তখন পেশোয়ারে ফিরে যাওয়াটা অদ্ভুত লাগা শুরু করলো। আর তখনই জাতীয় দল গঠন হয়। যখন জাতীয় দলে স্থান পেলাম, বুকের এক পাশে আফগানিস্তান লেখা জার্সি পরে খেলা শুরু করলাম, তখন গাঢ়ভাবে অনুভব করা শুরু করি যে আফগানিস্তানই তো আমার দেশ।”
এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন ওয়ান ডে অলরাউন্ডার র্যাংকিংয়ের চতুর্থ অলরাউন্ডার।
২০০২ সালেই পাকিস্তান ফেরত শরণার্থীদের নিয়ে জাতীয় দল গঠন করে আফগানিস্তান। কিন্তু তারা আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসে আরও অনেক পরে। ২০০৮ সালে আইসিসির ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লীগের পঞ্চম ডিভিশনে খেলা শুরু করে আফগানিস্তান। ন্যাচারাল ক্রিকেট দিয়ে আফগান তরুণরা চোখ কাড়তে সমর্থ হয় ক্রিকেটের কর্তা সংগঠন এমসিসির (মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব)। আফগানিস্তান ক্রিকেটের সাহায্যে এগিয়ে আসে এমসিসি। দাতব্য সংস্থা আফগান-কানেকশনের সহায়তায় তৃণমূল পর্যায়ে ক্রিকেটীয় সরঞ্জামাদি দেয়া থেকে শুরু করে প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের লন্ডনে ক্রিকেট স্কলারশিপ দিয়ে সাহায্য করতে থাকে এমসিসি। ফলাফল আসে খুব দ্রুত। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো টি-টুয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় আফগানিস্তান। মাত্র দু’বছরেই পঞ্চম ডিভিশন থেকে বিশ্ব আসরে। এর পরে আরও দুটি টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার পর ২০১৫ সালে ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় আসর ৫০ ওভারের বিশ্বকাপেও নাম লেখায় আফগানরা। আর এ বছর তো ক্রিকেটের অভিজাত শ্রেণীর সদস্য হিসেবেই নাম লিখিয়ে ফেললো আফগানিস্তান। ১২তম জাতি হিসেবে টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে এই ক্ষুদ্র সময়ে নিজেদের সাফল্যের মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত করলো তারা।
ক্রিকেট যখন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক
২০০১ সালে যখন তালিবানদের শাসন শেষ হল, তখন আফগানিস্তান যুদ্ধে জর্জরিত জাতিসত্ত্বায় বিভক্ত এক দেশ। নিম্ন স্বাক্ষরতার হার এবং গত কয়েক দশক ধরে চলা জাতিগত নিপীড়নের কারণে অধিকাংশ আফগানি তাদের জাতীয়তাবাদের ধারণাই ভুলে গিয়েছিল (যদিও জাতিগত নিপীড়ন এর পরেও চলেছে। কেননা, আমেরিকানরা আফগানিস্তানে পা রাখে ২০০১ সালেই, ৯/১১ এর পর)। প্রত্যেকটা জাতি, প্রত্যেকটা গোত্র প্রায় সময়ই হাঙ্গামায় লেগে থাকতো। তাদের সবাইকে এক ছাদের নিচে আনে ক্রিকেট। আফগানিস্তানের খেলা যখন চলে সবাই একসাথে বসে খেলা দেখে, জিতলে রাস্তায় নেমে সবাই একসাথে আনন্দ করে। প্রথম প্রথম তালিবানরা ক্রিকেটের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছিল; ক্রিকেট সময় নষ্ট করে, ধর্মীয় কাজে বাধা প্রদান করে। সাম্প্রতিক সময়ে শোনা যাচ্ছে, তালিবানরাও ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। ম্যাচের দিন তারাও একসাথে খেলা দেখে। ক্রিকেট ছাড়া অন্য কিছু কখনো এই জাতিকে একই সুতোয় গাঁথতে পারতো না।
৩৮% স্বাক্ষরতার দেশ আফগানিস্তানে সামাজিক পরিবর্তন আনতেও ব্যবহার করা হচ্ছে ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের জনপ্রিয়তাকে। পেসার শাপুর যাদরান ও হামিদ হাসানের প্রতিচ্ছবি ব্যবহার করে শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক কমিক বই ছাপানো হয়েছে। আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় দুই জাতীয় সমস্যা- ড্রাগ ও জঙ্গিবাদ মোকাবেলার উদ্দেশ্যে এই বই ছাপানো হয়েছে, যা প্রচার করে সৌহার্দ্য ও দেশপ্রেমের বাণী।
ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা
এটি আসলে নিয়তির নির্মম পরিহাস যে আফগানদেরকে তাদের জাতিগত ভালোবাসা খুঁজে পেতে এতদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। সেটিও আবার এসেছে কিনা পরিত্যক্ত শরণার্থী শিবির থেকে! ক্রিকেট এসেছে আফগান জাতির জন্য একটি আশীর্বাদ হিসেবে। বিদেশীদের শোষণ, মৌলবাদীদের নিপীড়ন, বুলেট-বোমার ক্ষত মুছে দিতে এসেছে ক্রিকেট।
“আপনি যদি কোনো হেলিকপ্টার দিয়ে পুরো দেশ ঘোরেন, নিচে তাকিয়ে আপনি শুধু ক্রিকেটই দেখবেন। মাঠে-ময়দানে সবাই ব্যাট-বল নিয়েই ব্যস্ত।”
আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান শাহজাদা মাসুদের এই বক্তব্যেই হয়তো আপনার বুঝে যাওয়ার কথা আফগানরা ক্রিকেটকে কতটা গ্রহণ করেছে, কীভাবে গ্রহণ করেছে। ক্রিকেটের প্রতি আফগানদের এই অনুরাগ দেখে আর তাদের ভেতরে থাকা সুপ্ত প্রতিভা দেখেই আফগানিস্তানের কোচের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রাক্তন ব্রিটিশ ক্রিকেটার ও নিউজিল্যান্ডের সাবেক কোচ এন্ডি মোলস। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ইংল্যান্ড সরকার তাকে নিষেধ করেছিল এ দায়িত্ব নিতে, নিষেধ করেছিল তার পরিবারও। যে দেশে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বোমা ফাটছে, সেখানে কে যেতে দিতে যায় নিজের প্রিয়জনকে?
“কোচিং করানোর সময় মাঝে মাঝে দেখা যেতো পাশে কোথাও বিকট শব্দে বোমা ফেটেছে। আকাশে ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার ওড়াওড়ি করছে। মনে হতো কোনো যুদ্ধের সিনেমায় কোচিং করাচ্ছি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই অবস্থার মধ্যেও কখনো ভয় লাগতো না। প্রতিদিন সকালে স্বাচ্ছন্দ্যেই কাজে বের হতাম”
সবকিছু অগ্রাহ্য করে আফগানিস্তানে কাজ করা এই কোচের ভাষ্য। বছরের পর বছর ধরে নিজের অস্তিত্বের সাথে যুদ্ধ করা লোকগুলোকে যখন ট্রেনিং দিচ্ছেন, তখন নিজের ভেতর ভয় ঢুকবেই বা কীভাবে!
সাফল্যের জন্য পুরো বিশ্বের ক্রিকেটাররা যখন নতুন নতুন ফর্মূলা পরখ করছে, তখন আফগানরা নিজের অস্তিত্বের জন্য লড়ছে। এখানে সফল হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। প্রতিদিনই বিষ্ফোরিত হওয়া বোমাগুলোকে ফাঁকি দিতে হবে।
২০১৭ আফগানিস্তান ক্রিকেটের ইতিহাসে এক স্মরণীয় বছর। এ বছর জুলাইয়ে আইসিসির বার্ষিক সভায় টেস্ট স্ট্যাটাস দেয়া হয় আফগানিস্তান ও আয়ারল্যান্ডকে। ১২তম জাতি হিসেবে ক্রিকেটের অভিজাত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয় আফগানিস্তান। জুলাই মাসেই তারা প্রথমবারের মতো ‘হোম অব ক্রিকেট’ খ্যাত লর্ডসে খেলার আমন্ত্রণ পায়। হোম অব ক্রিকেটে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল এমসিসি একাদশ। লর্ডসে খেললেও আজ পর্যন্ত নিজ দেশে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে পারেনি আফগানরা। আফগানিস্তানই একমাত্র দল, যারা টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে কিন্তু তাদের দেশে কখনো কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজিত হয়নি।
ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, হাঙ্গামা-হাহাকারের মধ্যে আফগানিস্তানে ক্রিকেট এসেছিল একটি আশীর্বাদ হয়ে। প্রাণহীন মরুভূমিতে প্রাণ নিয়ে এসেছে ক্রিকেট, এসেছে মরুর ফুল হয়ে। ১৫ বছরে ক্রিকেটে আফগানিস্তান যে উন্নতি করেছে, যতদূর এগিয়েছে, অন্যান্য দল তা ৫০ বছরেও করতে পারেনি। দশ বছর আগে ক্রিকেটের মানচিত্রেই ছিল না যে দল, তারা আজ নিজেদের যে স্তরে নিয়ে এসেছে, তা পুরো ক্রিকেট বিশ্বের জন্যই অনুপ্রেরণার বিষয়। যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝে, ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে উঠে এসে পড়শি দেশের শরণার্থী শিবির থেকে ধার করে আনা একটি খেলাকে নিয়ে এই দীর্ঘদেহী অদম্য আফগান তরুণদের এই উত্থান যেকোনো রূপকথাকেই হার মানাতে বাধ্য। সামনের দিনগুলিতেও তাদের এই উত্থান অব্যাহত থাকবে, এটাই সব ক্রিকেটপ্রেমীর প্রত্যাশা।
ফিচার ইমেজ: International Cricket Council & Pakistan Review, edited by the writer.