বিরাট কোহলি: এক যোদ্ধার যুদ্ধজয়ী ম্যাচের গল্প

১.

পরিস্থিতিটা কঠিন ছিল, খুবই কঠিন।

অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলংকা আর ভারতকে নিয়ে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের পয়েন্ট তালিকায় ৩ নম্বরে থাকাটা টেন্ডুলকার, শেবাগদের সমন্বয়ে গঠিত ভারতের মতো দলের জন্য কিছুটা অপমানজনকই। ফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রাখতে হলে গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচটাতে শ্রীলংকার বিপক্ষে শুধু জিতলেই হবে না, জিততে হবে ৪০ ওভারের মাঝেই। সেটা করতে পারলেও ফাইনাল নিশ্চিত নয়, তাকিয়ে থাকতে হবে শ্রীলংকা বনাম অস্ট্রেলিয়ার শেষ ম্যাচের দিকে। সেই ম্যাচে শ্রীলংকার আবার হারতে হবে, তাহলেই সম্ভব ভারতের ফাইনাল খেলা। 

এতগুলো ফ্যাক্টর মাথায় রেখে ম্যাচ খেলতে নামাটা অবশ্যই চাপের বিষয়। ২০১২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ভারত আর শ্রীলংকা যখন মাঠে নামলো, তখন স্বাভাবিকভাবেই শ্রীলংকা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেই ম্যাচটা আরম্ভ করলো।

২.

ম্যাচের শুরুতে ভাগ্যদেবী ভারতের দিকেই মুখ তুলে তাকালেন। টস জিতে ভারত ফিল্ডিং নিলো। উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপের জন্য বোলিং দিয়ে যতটা সম্ভব কম রানে প্রতিপক্ষকে আউট করে একটা লক্ষ্য দাঁড় করানো। আবার লক্ষ্যটা এমন হতে হবে যাতে সেটা ৪০ ওভারের মাঝেই অতিক্রম করা যায়।

শ্রীলংকা দল খুব সাবধানে ম্যাচ আরম্ভ করলো। তিলকারত্নে দিলশানের সাথে ম্যাচে ওপেনিং করতে নামলেন অধিনায়ক জয়াবর্ধনে নিজেই। প্রথম ১০ ওভারের পাওয়ার প্লেতে মাত্র ৪১ রান করলেও শ্রীলংকা কোনো উইকেট হারায়নি। তাদের প্রথম উইকেট পড়লো ১১ তম ওভারের শেষ বলে। দলীয় ৪৯ রানে জয়াবর্ধনে যখন আউট হলেন, তখন তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ ২২ রান। মাঠে নামলেন শ্রীলংকার আরেক ব্যাটিং নির্ভরতা কুমার সাঙ্গাকারা। এই দুজন খুব বেপরোয়াভাবে না খেললেও স্কোর বোর্ডে রান উঠে আসছিল। দলীয় ১০০ রান আসলো ২২ তম ওভারে, আর ১৫০ রান ৩২ তম ওভারে। এর মাঝে দুজনই ফিফটি করে ফেলেছেন। দিলশান খরচ করেছেন ৬৮ বল ( ৫টি চার) এবং সাঙ্গাকারা ৫৫ বল (৩টি চার, ১টি ছয়)।

দিলশান এবং সাঙ্গাকারার সেঞ্চুরিতে শ্রীলংকা বড় লক্ষ্যমাত্রা দাঁড় করায় Image Source: sahilonline.org

ব্যক্তিগত অর্ধশত পূরণ করার পরেও দিলশান যে খুব বেশি আক্রমণাত্মক হননি সেটা বোঝা গেল সেঞ্চুরি করার পর। পরের পঞ্চাশ রান করতেও বল খেলেছেন ৬৪টি, এই সময়ের মাঝে আর মাত্র ৩টি বাউন্ডারি মেরেছেন। হয়তো বড় একটি ইনিংস খেলার লক্ষ্য ছিল তার।অবশ্য অন্যপ্রান্তে সাঙ্গাকারা হাত খুলে খেলাতে দিলশানকে রানের গতি নিয়ে খুব বেশি ভাবতে হয়নি। সাঙ্গাকারা পরের ৫০ রান করতে মাত্র ২৯ বল খরচ করায় দলীয় রানটা কখনোই খুব বেশি ঝুঁকির মাঝে পড়েনি। সাঙ্গাকারা ব্যক্তিগত ১০৭ রানে আউট হলেও দিলশান টিকে রইলেন শেষ পর্যন্ত। ৫০ ওভার শেষে দলীয় সংগ্রহ দাঁড়ালো ৩২০, যেখানে মোট রানের অর্ধেকই আসলো দিলশানের (১৬০) ব্যাট থেকে।

৩.

ফাইনালে যাবার সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখার জন্য ৪০ ওভারে ৩২০ রান, যেকোনো আমলেই টার্গেটটা খুব সহজ নয়। যে সময়ে ভারত ম্যাচটি খেলতে নেমেছিল, সেই সময় পর্যন্ত ৩২০ রান তাড়া করে ম্যাচ জেতার রেকর্ড ছিল মাত্র ১৩টি, এর মাঝে ১০টি ম্যাচ জেতার জন্য ব্যাটিং দলকে খেলতে হয়েছে ৫০ তম ওভার পর্যন্ত।

কাজেই লক্ষ্যমাত্রাটা অসম্ভব না হলেও খুব কঠিন ছিল সেটা বলাই যায়। এর মাঝে যুক্ত হয়েছিল আবার মালিঙ্গা ফ্যাক্টর। যেকোনো কন্ডিশনেই মালিঙ্গার বিপক্ষে ব্যাটিং করা কষ্টকর। তাছাড়া সেই সিরিজে মালিঙ্গা ৬ ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়ে ফর্মে থাকারও ইংগিত দিচ্ছিলেন।

মালিঙ্গাও ছিলেন ফর্মে; Image Source: YouTube

বড় রান তাড়া করতে গেলে ব্যাটিং দলকে দুটো কাজ খুব ভালোভাবে করতে হয়। প্রথমটি আক্রমণাত্মক ব্যাটিং, আর দ্বিতীয়টি উইকেট ধরে রাখা। ক্রিকেট বোঝেন এমন যেকোনো মানুষই জানেন যে কাজটা কতটা কঠিন। আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করলে উইকেট হারানোর সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। তবে এমন পরিস্থিতিতে জিততে চাইলে কঠিন কাজটি করতেই হবে।

ভারতের পক্ষে ওপেনিংয়ে নামলেন বীরেন্দর শেবাগ ও শচীন টেন্ডুলকার। শুরু থেকেই স্বভাবজাত আক্রমণাত্মক খেলতে লাগলেন তারা। দলীয় ৫০ রান উঠে গেল ষষ্ঠ ওভারেই। কিন্তু এর পরপরই ভারত একটা ধাক্কা খেল। সপ্তম ওভারের দ্বিতীয় বলেই শেবাগ আউট হলেন মাহরুফের বলে, আউট হবার আগে ৩০ রান করতে খরচ করেছিলেন মাত্র ১৬টি বল। নতুন ব্যাটসম্যান গৌতম গম্ভীর আর টেন্ডুলকারও আস্কিং রান রেটের সাথে পাল্লা দিয়ে রান করতে লাগলেন। কিন্তু দলীয় ৮৬ রানের মাথায় টেন্ডুলকারও আউট হয়ে গেলে ভারত আক্ষরিক অর্থেই বিপদে পড়ে গেলো।

মাঠে তখন নামলেন বিরাট কোহলি।

শচীন-শেবাগের জুটির কারণে ভারতও ম্যাচ জয়ের আশা ছাড়েনি  Image Source: SportsWallah

৪.

২০১২ সালে বিরাট কোহলি খুব ভালো ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচিত হলেও ২০১৮ সালের মতো গ্রেট হিসেবে বিবেচিত হতেন না। টেন্ডুলকারের মতো ব্যাটসম্যান দলে থাকায় নজরটা তার উপর থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। তবে ৮১টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৪৫.৫৯ গড় আর ৮৩.২৭ স্ট্রাইক রেটের সাহায্যে ৩,১০০ রান করে ফেলা একজন ব্যাটসম্যানের উপর নির্ভর করাটাও অমূলক ছিল না। তখন পর্যন্ত ওয়ানডেতে কোহলির ৮টি সেঞ্চুরি করাও হয়ে গিয়েছিল, যার মাঝে ৫টিই ছিল রান তাড়া করতে নেমে। মাঠে নেমে কোহলি আর গম্ভীর দুজনেই উইকেট ধরে খেলার দিকে মনোযোগী হলেন। দুজনের অর্ধশত রানের জুটি হতে বল খরচ হলো ৪৮টি; পরের অর্ধশত অবশ্য হয়ে গেলো মাত্র ৪১ বলেই। ইতিমধ্যে দুজনেই নিজেদের ব্যক্তিগত অর্ধশতক পূরণ করে ফেলেছেন। গম্ভীর বল খেলেছেন ৪৭টি (৪টি চার), আর কোহলি ৪৪টি (৩টি চার, ১টি ছয়)।

গম্ভীরও খেলেছেন একটি স্থিতিশীল এবং কার্যকরী ইনিংস; Image Source: Essentially Sports

ব্যক্তিগত অর্ধশত রান করার পর কোহলি একটু হাত খুলে খেলতে শুরু করলেন। গম্ভীরও যোগ্য সঙ্গ দিতে থাকলেন। ব্যক্তিগত ৬৪ রান করে যখন গম্ভীর আউট হলেন, তখন ভারতের সংগ্রহ ২৭.৩ ওভারে ২০১ রান; এই জুটিতে রান হয়েছে ১১৫। মাঠে নামলেন আরেক আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান সুরেশ রায়না।

৫.

রায়না যখন নামলেন, তখন জিততে হলে ভারতের প্রয়োজন ২২.৩ ওভারে ১১৯ রান। কিন্তু ফাইনালে যাওয়ার জন্য ভারতকে বোনাস পয়েন্ট পেতে হলে ম্যাচটা জিততে হবে ১২.৩ ওভারের মাঝে; ৯.৬৭ রান রেট তখন পর্যন্ত কঠিনই মনে হচ্ছিল। বাধ্য হয়েই তাই দুজনকে কিছুটা ঝুঁকি নিতেই হলো; তার সুফলও পেল ভারত। ২৮ থেকে ৩২- বোলিং ডিপার্টমেন্টের নেওয়া পাওয়ার প্লের এই ৫ ওভারে রান আসলো ৫৮। ভারতও যেন পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেলো। এই দুজনের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের কারণে বাকি ৮ ওভারে ষাটোর্ধ্ব রান আর মোটেও কঠিন কিছু মনে হচ্ছিল না। ৩৫ তম ওভারেই ভারতের ৩০০ রান হয়ে গেলো। ততক্ষণে কোহলির সেঞ্চুরিও হয়ে গিয়েছে। কোহলি আর রায়নার ১০০ রানের জুটিও হয়ে গেলো মাত্র ৪৫ বলে।

সেঞ্চুরির পর কোহলির উল্লাস; Image Source: CricIndeed

ম্যাচ শেষ হয়ে গেলো মাত্র ৩৬.৪ ওভারেই। সেঞ্চুরির পর ১০ বলে কোহলি করেছেন ৩৩ রান। দুজনের ১২০ রানের জুটিতে রায়নার সংগ্রহ মাত্র ৪০ রান। এই তথ্য থেকেই বোঝা যায় কোহলি কতটা নিজে স্ট্রাইক নিয়ে খেলেছেন।

৬.

ম্যাচটি ভারত জিতে গেলেও শেষ পর্যন্ত ফাইনাল খেলতে পারেনি। শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে শ্রীলংকা ফাইনাল খেললেও ফাইনালের শেষ হাসিটা অস্ট্রেলিয়াই হেসেছিল। তবে সত্যিকারের ক্রিকেটপ্রেমীরা কোহলির বীরত্বের কথাটা ভুলতে পারেনি।

ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছাড়ছেন কোহলি এবং রায়না; Image Source: uniquelog.blogspot.com

রান অনেকেই করেন, কিন্তু দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের দিন একইসাথে উইকেট ধরে রেখে আক্রমণাত্মকভাবে খেলে বড় স্কোর তাড়া করে জেতাতে খুব অল্প কয়েকজন স্পেশাল ব্যাটসম্যানই পারেন।

নিঃসন্দেহে কোহলি সেই স্পেশালদের মাঝে একজন।

This article is in Bangla language. It discusses about a special innings by Kohli on 28 February, 2018. Necessary sources have been hyperlinked.

Feature Image: DNA India

Related Articles

Exit mobile version