সময়টা খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না ব্রায়ান লারার। সিরিজে আগের ছয় ইনিংসে রান ছিল যথাক্রমে ২৩, ০, ০, ৮, ৩৬, ৩৩। প্রশ্ন যতটা না পারফরম্যান্সের, তার চেয়ে বরং প্রশ্নটা ছিল আউট হওয়ার ধরনে। নানারকম গুঞ্জন চলছিল চারিদিকে, সাথে চোখ রাঙাচ্ছিল হোয়াইটওয়াশের সম্ভাবনাও। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো মনে হচ্ছিল, কোয়ালিটি পেস অ্যাটাকের বিরুদ্ধে কিছুটা যেন অস্বস্তিতে ভুগছেন লারা। প্রত্যাশার চাপ তাই মাথায় চেপে বসেছিল পর্বতসমান হয়ে। তার উপর খেলতে নেমে কোনো রান করার আগেই পঞ্চম বলে একটা জোরালো আবেদন হয় তার বিরুদ্ধে; স্টিভ হার্মিসনের বলে সেই আবেদনে আম্পায়ার সাড়া না দিলেও সেটা যে চাপটা বাড়িয়ে দিয়েছিল আরো বেশি, সেটা না বললেও চলে।
এই ইনিংসের আগে ফর্মের সাথে যুঝতে হয়েছে লারাকে। ফর্মে ফেরার জন্য কী করেননি তিনি! কখনো নিজেকে উপরে তুলে এনেছেন, কখনো নেমেছেন ডাউন অর্ডারে, নিজের ব্যাকলিফট বদলেছেন। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না যেন, এই ইনিংসটাই ছিল ফর্মে ফেরার সেরা সুযোগ। চাপ তাই বাড়ছিলই ধীরে ধীরে। মাঠে নামার আগে লারা তাই বলেই নেমেছিলেন,
“সামনের এই পাঁচদিনের উপর নির্ভর করবে অধিনায়ক হিসেবে আমার ভবিষ্যৎ।”
বয়স ততদিনে হয়ে গেছে ৩৪, সে ভবিষ্যৎটা যে খুব একটা ভালো দেখাচ্ছে না, সেটা লারা নিজেও জানতেন। কমেন্টেটর জিম ম্যাক্সওয়েলের মতো অনেকে তো তার শেষের শুরুও দেখতে শুরু করে দিয়েছিলেন!
কিন্তু তিনি যে ব্রায়ান লারা, ‘ক্রিকেটের বরপুত্র’! চাপটাকে তাই উড়িয়ে দিলেন এক তুড়িতে, প্রায় দশ ঘন্টা ক্রিজে কাটিয়ে দিলেন দাঁতে দাঁত চেপে। ছ’মাস আগে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার ম্যাথু হেইডেনের কাছে হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করলেন অ্যান্টিগায়, করলেন অপরাজিত ৪০০ রান! ২০০৪ সালের ১২ এপ্রিল সেন্ট জোনসে এক অতিমানবীয় ইনিংস খেলে ইতিহাসে নিজের নামটা লিখিয়ে নিলেন আজীবনের জন্য!
ইতিহাসে নাম লেখানো? সেটা অবশ্য করেছিলেন আরো দশ বছর আগেই, ১৯৯৪ সালে ওই অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন পার্কেই। ৩৬ বছরের পুরোনো স্যার গ্যারি সোবার্সের রেকর্ড যখন প্রথমবারের মতো কেউ ভাঙলেন, তাতেই তো অমরত্ব নিশ্চিত করে ফেলেছেন তিনি! তবে তাতেই সন্তুষ্ট থাকার মানুষও তো তিনি নন!
২০০৩ সালে পার্থে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হেইডেন যখন নয় বছরের রেকর্ড ভেঙে নতুন মাইলফলক অতিক্রম করলেন, তাতে আঁতে ঘা লেগেছিলো নিশ্চয়ই। মনে মনে ফুঁসছিলেন রেকর্ডের জন্য, সেটাই যেন ফুঁড়ে বেরোলো সেন্ট জোনসে। শুধু সেখানেই থামলেন না, করে বসলেন কোয়াড্রুপল সেঞ্চুরি! উল্লেখ্য, এর আগে পুরো ফার্স্ট ক্লাস ইতিহাসেই কোয়াড্রুপল সেঞ্চুরি ছিলো মাত্র দশটি, এর মধ্যে আবার একটা ছিলো তাঁর নিজেরই!
সেন্ট জোনসের পিচ বরাবরই দারুণ ব্যাটিংবান্ধব, সেটার সাক্ষী তিনি নিজেই। তবে পরিস্থিতি ঠিক পক্ষে ছিলো না, উপরন্তু ওই ম্যাচে নামতেও হয়েছিলো খুব দ্রুত। প্রথম দিনের খেলা শুরুর প্রথম ঘন্টা শেষ হতে না হতেই ওপেনার ড্যারেন গঙ্গা যখন ফিরে গেলেন, স্কোরকার্ডে রান উঠেছে মাত্র ৩৩। নামার পরপরই এমন এক আপিলের মুখোমুখি হলেন, নিশ্চিতভাবেই এ যুগে সেটায় রিভিউ নেওয়া হতো এবং তিনি হয়তো আউটও হয়ে যেতেন তাতে! সে যাত্রা বেঁচে যাওয়ার পর হয়ে উঠলেন ধৈর্য্যের প্রতিমূর্তি, প্রথম দিনে অপরাজিত অবস্থায় মাঠ ছাড়ার আগে করলেন ৮৯ রান। সে রানে যতটা না শিল্পের ছোঁয়া ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, চোয়ালবদ্ধ সংকল্প। অনেকদিন পর যে অবশেষে রানের দেখা পেলেন তিনি!
দ্বিতীয় দিনে দেখা মিললো ‘সত্যিকারের’ ব্রায়ান লারার, দর্শনীয় সব শট আর আগ্রাসী মানসিকতা মিলিয়ে মাঠে যেন সৌন্দর্য্যের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন। উইকেটের পিছনে থেকে তাকে দেখছিলেন ইংল্যান্ডের উইকেটরক্ষক জেরাইন্ট জোন্স, তার লেখা একটা কলামে পরে তিনি বলেছেন,
“ওর পিছনে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা দেখছিলাম আমি। বোঝা যাচ্ছিল, এদিন সে কিছু একটা করে দেখানোর মিশনে নেমেছে। খুব ভালো করে তার জানা ছিল, সে খুব বড় কিছু করতে চলেছে; এটা ওর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। সিরিজে প্রতিটা ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হেরে যাওয়ায় যে চাপটা তৈরি হয়েছিল, পুরোটা যেন সে একসাথে নিয়েই মাঠে নেমেছিল। ডেলিভারও করেছে!”
সেদিন ভাগ্যও যেন ছিল লারার পক্ষে। প্রথম দিনে দারুণ বোলিং করে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন স্টিভ হার্মিসন, দ্বিতীয় দিনে সেভাবে বোলিং করতেই পারলেন না ‘রানিং অন দ্য উইকেট’ অপরাধের জন্য। ফলে হার্মিসনের জায়গায় বোলিং করলেন মার্কাস ট্রেসকোথিক, সেটাও ১৮ ওভার! জেরাইন্ট জোন্স পরে বিদ্রুপ করে বলেছেন,
“সে আমাকে দিয়ে রীতিমতো বাই রানের ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করিয়েছে!”
তবে ভাগ্য তো সাহসীদের পক্ষেই হাসে! দ্বিতীয় দিন শেষে যখন ফিরছেন, ততক্ষণে নিজের নামের পাশে লিখিয়ে ফেলেছেন ৩১৩ রান, তখনো অপরাজিত তিনি। স্কোরকার্ডে দলের রানও জমেছে ৫৯৫, তবে যুদ্ধ যে এখনো শেষ হয়নি!
তৃতীয় দিন সকালে রান করতে বেশ বেগ পেতে হলো লারাকে, দারুণ বোলিং করে তাকে ক্রিজে বেঁধে রাখলেন হার্মিসন এবং ফ্লিনটফ। শুধু ৩৩২ রানেই তিনি আটকে ছিলেন ২২ বল ধরে, এর মধ্যে একটি রানও করতে পারেননি তিনি! তবে ড্রিংকস ব্রেকের পর আবারও দারুণ স্বচ্ছন্দ্য লারা, সাথে দারুণ সঙ্গ দিচ্ছিলেন উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান রিডলি জ্যাকবস। দ্বিতীয় দিনের মতো এদিনও বোলিং করতে পারলেন না ম্যাথু হগার্ড, সে সুযোগ নিয়ে লারা-জ্যাকবস এগিয়ে গেলেন বিশাল সংগ্রহের পথে। দ্বিতীয় ড্রিংকস ব্রেকের কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতো সোবার্সকে টপকালেন লারা।
তবে ৩৭০ হওয়ার পর হঠাৎই গ্যারেথ বেটির বলে সুইপ করতে গিয়ে টাইমিংয়ে গড়বড় হয়ে গেল, হাত চেপে ধরে বেশ কিছুক্ষণ ধরে বসে রইলেন লারা। মাঠে তখন পিনপতন নীরবতা, সবাই উৎকণ্ঠিত… ঠিক আছেন তো তিনি?
ফিরলেন কিছুটা ধাতস্থ হয়েই, তবে এরপর আর সময় নেননি। খুব দ্রুতই ছুঁয়ে ফেললেন এমন এক উচ্চতা, যাতে এর আগে কেউ কোনোদিন পৌঁছাতে পারেনি। কোয়াড্রুপল সেঞ্চুরি! ‘ব্রায়ান চার্লস লারা’, রিমেম্বার দ্যাট নেইম!
এত এত নাটকীয়তার মধ্যেও সবাই মেনেই নিয়েছিলো, খেলার ভাগ্যে হয়তো লেখা আছে ‘ড্র’ রেজাল্টটাই! কিন্তু ইংল্যান্ড টি ব্রেকের আগেই দুই ওপেনার হারিয়ে ফেলায় নড়েচড়ে বসলো পুরো ক্রিকেটবিশ্ব। মাত্র ২৮৫ রানে অলআউট হয়ে গেলো ইংল্যান্ড, ফলে জোরেশোরে উঠলো আর একটা আলোচনা- রেকর্ডের পিছনে ছুটতে গিয়ে লারা কি তবে জয়ের সম্ভাবনা ধূলোয় মিশিয়ে দিলেন?
প্রথম এ ব্যাপারে মুখ খুললেন রিকি পন্টিং,
“আমরা এভাবে ক্রিকেট খেলি না। অস্ট্রেলিয়ান কোনো খেলোয়াড়কে এরকম কিছু করতে দেখাটাই কষ্টকল্পনা। তাদের পুরো ইনিংসটাই একজনের ইনিংসকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য আবর্তিত হয়েছে, আর সেটা করতে গিয়ে ম্যাচটাই হাত থেকে বের হয়ে যেতে পারত।”
ইংলিশ কমেন্টেটর টনি গ্রেগও পন্টিংয়ের সাথে গলা মেলান,
“তার এমন ইনিংসে আমি উচ্ছ্বসিত নই। হ্যাঁ, আমি মানছি যে সে অনেকক্ষণ ধরে টিকে ছিলো ক্রিজে, দারুণ খেলেছে। কিন্তু এটাও সত্যি যে এই ইনিংস নিয়ে উচ্ছ্বাসের কিছু নেই। স্পষ্টত তার মাথায় শুধু রেকর্ড ছাড়া আর কিছুই ছিল না; আর সে যতক্ষণ অব্দি সেখানে না পৌঁছায়, ততক্ষণ অব্দি সে খেলে গেছে। আমি যদ্দুর খেলা বুঝি, এটা খেলার খুব ভালো কোনো পথ নয়, বিশেষত আপনি যখন দলের অধিনায়ক। এটাই বুঝিয়ে দেয়, অধিনায়ক হিসেবে ব্রায়ান লারা খুব একটা ভালো নন।”
সত্যিই কি খুব স্বার্থপরতা দেখিয়েছিলেন লারা? ৭৫১ রানের বিশাল সংগ্রহ নিয়ে প্রথম ইনিংস ঘোষণার পরও ম্যাচের বাকি ছিল আড়াই দিনেরও বেশি, দু’বার প্রতিপক্ষকে অলআউট করার জন্য তর্কসাপেক্ষে সেটাকে যথেষ্ট বলা যেতেই পারে! তবে সে তর্কে আজ না যাওয়াটাই সমীচীন।
অধিনায়ক হিসেবে হয়তো সেরা ছিলেন না, তবে এই ইনিংস দিয়েই ব্যাটিংয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছিলেন আবারও। সর্বোচ্চ রানের ইনিংস দ্বিতীয়বারের মতো নিজের করে নেওয়ার মতো সাহস যে অন্য কারো পক্ষেই দেখানো সম্ভব ছিল না, কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে সেটা বলে দেওয়াই যায়! ম্যাচ শুরুর আগে চোখ রাঙানো হোয়াইটওয়াশ থেকে দলকে বাঁচিয়েছিলেন ঠিকই, যদিও দলকে জেতাতে পারেননি। তবে বরাবরই ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ হয়ে লড়ে আসা ক্যারিবিয়ান রাজপুত্র একা হাতে যে দলকে বয়ে নিয়েছেন, দলের প্রয়োজনের মুখে এই ইনিংসটাকে সামান্য শ্রদ্ধার্ঘ্যরূপেই দেখা হোক না!