জেসি ড্যানিয়েল রাইডার বেশ কয়েকবার সংবাদের শিরোনামে এসেছেন। কখনো জানালার কাঁচে ঘুষি দিয়ে হাত কেটে, কখনো ম্যাচের আগের রাতে অতিরিক্ত মদ পান করে কিংবা কখনো পানশালার বাইরে মারপিট করে কোমায় চলে গিয়ে। এর মধ্যেই ক্রিকেটের ‘ব্যাড বয়’ হিসাবে পরিচিত পেয়ে গেছেন রাইডার। নিয়মিত মদ্যপান, আম্পায়ারদের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়া এবং বেপরোয়া জীবন কাটানোর কারণে প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় নিজেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে রেখেছেন তিনি।
জেসি রাইডার ১৯৮৪ সালে ৬ই আগস্ট ওয়েলিংটনের মাস্টারটন এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর অন্য আট-দশটা শিশুর মতো সঠিক লালনপালনে বড় হননি তিনি। খুব ছোটবেলায় তার বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর নেপিয়ারে বাবা পিটারের সাথে বেড়ে উঠতে থাকেন রাইডার। কিন্তু বাবা তার দিকে খেয়াল রাখার সময় পেতেন না। সকালে কাজে বেড়িয়ে পড়তেন, রাতে ফিরতেন। রাইডার বলেন, “আমার বাবা সকালে বের হতেন, রাতে ফিরতেন। তখন আমি আমার বন্ধুদের সাথে উঠোনে ক্রিকেট খেলতাম। যা ইচ্ছে তা করতাম, কোনো সীমাবদ্ধতা ছিল না আমার জীবনে।”
মাত্র ১৪ বছর বয়সে রাইডারের বাবা তাকে ছেড়ে চলে যান। একদিন তার এক বন্ধুর বাসায় তাকে রেখে এক সপ্তাহের জন্য অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন বলে জানান। সপ্তাহ শেষ হলেই তাকে নিতে আসার কথা সেখান থেকে, কিন্তু তার বাবা পিটার আর আসেননি। তারপর থেকে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতে শুরু করেন রাইডার। ভালো-মন্দের পার্থক্য শিখিয়ে দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। মাত্র ১৪ বছর বয়সে মুদ্রার ওপিঠ দেখে ফেলেন তিনি। শৈশব কাটে বন্ধুদের বাড়িতে বাড়িতে। বন্ধুদের বিছানার এক কোণে ঘুমিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন লাগামহীন রাইডার। তখন তার ইচ্ছেমতো খেলাধুলা কিংবা মদ্যপান করায় বাধা দেয়ার মতো কেউ ছিল না। তার মা নর্থল্যান্ডে নতুন সংসার বাধেন। রাইডার সেসময় প্রচুর ইনডোর ক্রিকেট খেলতেন এবং বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি করেই সময় কাটাতেন।
ক্রিকেটে তার অসাধারণ প্রতিভা কিছুদিনের মধ্যেই সবার সামনে আসে। ২০০২ সালে কলেজের হয়ে ২৭২ রানের ইনিংস খেলে সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্টসের দলে জায়গা করে নেন রাইডার। ঐ বছরেই অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। ২০০৪ সাল সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্টস ছেড়ে ওয়েলিংটনের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেন রাইডার। ধারাবাহিক পারফর্মেন্সে ৩০ জানুয়ারি ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ড জাতীয় দলে ডাক পান তিনি।
নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের তৎকালীন নির্বাচক রিচার্ড হ্যাডলি তাকে দলে নেওয়ার ক্ষেত্রে জানান, ব্রেন্ডন ম্যাককালামের সাথে ইনিংস গোড়াপত্তনে জেসি রাইডার যোগ্য ব্যক্তি। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার অ্যাডাম প্যারোরে দলে তার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। জেসি রাইডার বেশ মোটা এবং নিউজিল্যান্ড দলে খেলার উপযুক্ত নন বলে জানান তিনি। সব সমালোচনা উড়িয়ে দিয়ে ক্রিকেটের ক্ষুদ্র সংস্করণ টি-টুয়েন্টির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রাইডার পথচলা শুরু করেন ২০০৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি।
অভিষেক টি-টুয়েন্টি ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২১ বলে ২২ রানের ইনিংস খেলেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৬২ বলে অপরাজিত ৭৯ রান করে অ্যাডাম প্যারোরেকে ভুল প্রমাণ করেন রাইডার। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের প্রথম পরীক্ষায় ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হন তিনি। কিন্তু বেপরোয়া রাইডার ইংল্যান্ড সিরিজ শেষ হওয়ার পরদিন রাতেই পার্টিতে গিয়ে বাথরুমের কাঁচ ঘুষি দিয়ে ভাঙতে চেষ্টা করেন। এর ফলে তার হাত মারাত্মকভাবে কেটে যায় এবং তার ঐ মৌসুমে আর খেলা হয়নি।
২০০৮ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে আবারো ক্রিকেটে ফিরেন তিনি। ঐ সফরেই প্রথমবারের মতো সাদা পোশাকে মাঠে নামেন রাইডার। মদ্যপান করে অস্বাভাবিক কাণ্ড ঘটানো প্রতিদিনকার রুটিন ছিল তার। নিজের প্রথম মৌসুমে টেস্ট এবং ওয়ানডেতে ভালো পারফরমেন্স করলেও বেপরোয়া চলাফেরার কারণে আবারো আলোচনায় আসেন তিনি। ২০০৯ সালের ৭ জানুয়ারি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডে শেষে সারারাত ছিলেন পার্টিতে। সেখানে অতিরিক্ত মদপান করে পরদিন অনুশীলনে যোগ দিতে পারেননি। এর ফলে সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডে খেলতে পারেননি রাইডার। সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে দলে ফিরে ২১ রানের ইনিংস খেলেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ শেষে জাস্টিন ভন এবং রাইডারের ম্যানেজার অ্যারোন ক্লে জানান, রাইডার তার মদ পানের বাজে অভ্যাস দূর করতে ‘কোল্ড টার্কি’তে যেতে প্রস্তুত আছেন। সেখান থেকে ফিরে ভারতের বিপক্ষে ব্যাটে বলে অসাধারণ সময় কাটান রাইডার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম শতক করেন ঐ সিরিজেই। ৫ ম্যাচের সিরিজে ৫৬.২৫ ব্যাটিং গড়ে করেন ২২৫ রান করেছেন
ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত ছিলেন রাইডার। হ্যামিল্টনে সিরিজের প্রথম টেস্টেই ১৬২ বলে করেন ১০২ রান। নেপিয়ারে পরের ম্যাচেই খেলেন ক্যারিয়ার সেরা ২০১ রানের ইনিংস। ৩২৮ বলে ২০১ রানের ইনিংসে ২৪টি চার এবং ১টি ছয় হাঁকান রাইডার।
তার রানের ক্ষুধা এতটাই তীব্র ছিল যে, দ্বিশতক হাঁকানোর পর আউট হয়েও ব্যাট ছুঁড়ে মারেন সাজঘরের সাজানো চেয়ারে। তখনকার সময়ে দ্বিতীয় কিউই ব্যাটসম্যান হিসাবে পরপর দুই ম্যাচে শতকের রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ১২ বলে ৩১ রান করার পর ইনজুরিতে পড়েন তিনি। এ কারণে নিজের প্রথম বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের মাঝপথেই দেশে ফিরতে হয় তাকে। মাঝখানের দুই মৌসুমে ইনজুরির কারণে বেশ কয়েক ম্যাচে দলের বাহিরে ছিলেন। ব্যাট হাতের পারফর্মেন্সও ছিল নড়বড়ে। শেষপর্যন্ত ২০১২ সালের ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সাময়িক অবসরের সিদ্ধান্ত নেন রাইডার। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন ইনজুরি এবং শৃঙ্খলাহীন ক্যারিয়ার।
ক্রিকেট থেকে দূরে থাকলেও শিরোনাম থেকে দূরে থাকেননি জেসি রাইডার। ২০১৩ সালে ২৮ মার্চ ক্রাইস্টচার্চে পানশালার বাহিরে নৃশংস হামলার শিকার হয়ে দুইদিন কোমায় ছিলেন। ক্রিকেট থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেয়ার পর ঘরোয়া ক্রিকেটে মনোনিবেশ করেছিলেন তিনি। ওয়েলিংটনের হয়ে ঘরোয়া টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করার জন্য ক্রাইস্টচার্চে অবস্থান করছিলেন রাইডার। মৌসুমের শেষ ম্যাচে কেন্টারবুরির কাছে তার দল হেরে যায়। ম্যাচ হারার পর রাইডার তার সতীর্থদের নিয়ে ঘুরতে বের হয়ে যান, সেখানেই ঘটনার সূত্রপাত হয়। ক্রাইস্টচার্চের উপকূলবর্তী শহর মেরিভেইলের আইকম্যান’স বারের বাহিরে প্রথম আক্রমণে শিকার হন তিনি। খুব অল্পতেই ঘটনার মীমাংসা হয়েছিল। কিন্তু পরের বার আবারো কথা কাটাকাটি হয় এবং আক্রমণকারীরা রাইডারের মাথার খুলিতে মারাত্মকভাবে আঘাত করেন। এরপর তিনি দুইদিন কোমায় ছিলেন। কোমা থেকে ফিরে এসে হামলার সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন রাইডার।
সুস্থ হয়ে ২০১৩ সালের শেষ সপ্তাহে জাতীয় দলে ফের জায়গা করে নেন রাইডার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরেন তিনি। প্রত্যাবর্তনের দ্বিতীয় ম্যাচেই খেলেন বিস্ফোরক এক ইনিংস। কোরি অ্যান্ডারসনের বিশ্বরেকর্ডের দিনই ৪৬ বলে শতক হাঁকান, যা কিছু সময়ের জন্য নিউজিল্যান্ডের হয়ে দ্রুততম ওডি’আই শতকের রেকর্ড ছিলেন।
মাত্র একমাসের স্থায়িত্ব ছিল জেসি রাইডারের প্রত্যাবর্তনের। তিনি সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন ২০১৪ সালের ৩১শে জানুয়ারি। রাইডার নিউজিল্যান্ডের হয়ে ১৮টি টেস্ট, ৪৮টি ওয়ানডে এবং ২২টি টি-টুয়েন্টিতে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৮টি টেস্ট ম্যাচে ৪০.৯৩ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ১,২৬৯ রান, বল হাতে তার ঝুলিতে ছিল ৫ উইকেট। ওয়ানডেতে ৪৮ ম্যাচে ৩৩.২১ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ১,৩৬২ রান এবং শিকার করেছেন ১২টি উইকেট। টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে ২২ ম্যাচে ২২.৮৫ ব্যাটিং গড়ে ৪৫৭ রান করেছেন রাইডার।
বর্তমানে এসেক্সের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেট খেলছেন রাইডার। ব্যাটে বলে সমানভাবে পারফর্মেন্স করার সাথে বিভিন্ন সময়ে উল্টোপাল্টা কাজ করেও শিরোনামে এসেছেন। কাউন্টি ক্রিকেট এবং নিজ দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফর্মেন্সে আবারো জাতীয় দলের দোরগোড়ায় আসার পর করে বসেন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গত বছর ওয়েলিংটন ক্লাবের ক্রিকেট ম্যাচের সেমিফাইনালে কারোরির বিপক্ষে পিটোন-এস্টবার্নের হয়ে খেলছিলেন রাইডার। ম্যাচের একপর্যায়ে রাইডারের বলে আম্পায়ার লেগ বিফোরের আবেদনে সাড়া না দিলে তিনি ক্ষুদ্ব হয়ে আম্পায়ারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই ঘটনায় ম্যাচের দুই আম্পায়ার ওয়াটকিন এবং পল কামিন্স ম্যাচ রেফারির কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
এই ঘটনার পরও ৩২ বছর বয়সী জেসি রাইডারের আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা হবে কিনা, সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু মা-বাবার স্নেহহীন লাগামছাড়া জীবনের কারণেই জেসি রাইডারের এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠা, সেটা বলাই যায়।
তথ্যসূত্র
১) en.wikipedia.org/wiki/Jesse_Ryder