চলতি মৌসুমে মেসির সফল ড্রিবলের সংখ্যা ১৪৪টি। আর অন্যদিকে, রক্ষণে এখনো ভার্জিল ভ্যান ডাইককে পেরিয়ে যেতে পারেননি কোনো ফুটবলার। মেসি যেমন অবিসংবাদিতভাবে এইবার লা লিগার সেরা খেলোয়াড়, তেমনই ভ্যান ডাইকের হাতে প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার ওঠাটা এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। তবে লড়াইটা কি শুধু মেসি বনাম ভার্জিল ভ্যান ডাইকই? সুয়ারেজ, কৌটিনহো, সালাহ, মানেদের নামেই বোঝা যাচ্ছে, লড়াইয়ের বিস্তৃতি আরো অনেক বেশি। ১ মে বার্সেলোনার ন্যু ক্যাম্পে মাঠের লড়াইয়ে দুই দলই চাইবে নিজেদের ষষ্ঠ চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জয়ে এক ধাপ এগিয়ে যেতে। আর সেজন্য জুর্গেন ক্লপ ও ভালভার্দে দুইজনের হাতেই রয়েছে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো তুরুপের তাস। সেই তাস তারা কীভাবে ব্যবহার করতে পারেন, সেটিই দেখবো আজ আমরা।
যেভাবে সেমিফাইনালে দুই দল
দুই দলের শুরুটা একইরকম হয়নি। বার্সেলোনা হেসেখেলে গ্রুপপর্ব পার করলেও লড়াই করেই নকআউট পর্বে জায়গা করে নিতে হয়েছে অলরেডদের।। বি গ্রুপে বার্সেলোনার সঙ্গী ছিল পিএসভি আইন্দহোফেন, টটেনহ্যাম ও ইন্টার মিলান। ইন্টার মিলান ও টটেনহ্যামের সাথে একটি করে ম্যাচ ড্র করা সত্ত্বেও ১৪ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে থেকে গ্রুপপর্ব শেষ করে বার্সেলোনা। অন্যদিকে বলা যায়, ডেথ গ্রুপেই ছিল লিভারপুল। সি গ্রুপে তাদের সঙ্গী ছিল পিএসজি, নাপোলি ও এফকে ক্রাভেনা। প্রতিটি দলের বিপক্ষেই অ্যাওয়ে ম্যাচে হেরেছিল লিভারপুল। তারপরও নয় পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থেকে নক আউট পর্বে ওঠে লিভারপুল। ভাগ্যও অবশ্য কিছুটা সহায় ছিল অলরেডদের পক্ষে। সমান নয় পয়েন্ট নিয়ে নাপোলি বাদ পড়ে হেড টু হেড পরিসংখ্যানে লিভারপুল থেকে পিছিয়ে থেকে।
গ্রুপপর্ব যা-ই হোক, দ্বিতীয় রাউন্ড ও কোয়ার্টার ফাইনালে দুই দল পাত্তাই দেয়নি প্রতিপক্ষকে। নকআউট পর্বে বার্সেলোনার মুখোমুখি হয় অলিম্পিক লিঁও। সেই ম্যাচে দুই লেগ মিলিয়ে ৫-১ ব্যবধানে জয় লাভ করে কাতালানরা। আর অন্যদিকে, লিভারপুল ৩-১ গোলে হারায় জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখকে। কোয়ার্টার ফাইনালেও দুই দলকে দেখা যায় বিধ্বংসী রূপে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে বার্সেলোনা উড়িয়ে দেয় ৪-০ গোলে, অন্যদিকে লিভারপুল পোর্তোকে নাকানিচুবানি খাওয়াও ৬-১ গোলে। আর তাতেই সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় বর্তমানের অন্যতম সেরা এই দুই জায়ান্ট।
রণকৌশল
বার্সার সম্ভাব্য স্কোয়াডে কোনো পরিবর্তনই না আসার সম্ভাবনাই বেশি। সামনে মেসির সাথে সুয়ারেজ আর কৌতিনহোর থাকাই নিশ্চিত করে দেয় সাবেক ক্লাবের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হচ্ছেন বার্সেলোনার এই দুই ফরোয়ার্ড। মাঝমাঠ সামলানোর দায়িত্ব থাকবে রাকিটিচ, বুস্কেটস ও আর্থুরের কাঁধে। আর রক্ষণে পিকের সঙ্গী হবেন লংলে। দুই ফুলব্যাকের একজন জর্ডি আলবা হবেন তা নিশ্চিত হলেও রাইট ব্যাকে সেমেদো নাকি রবার্তো খেলবেন তা সুনিশ্চিত নয়।
বল ধরে রেখে খেললেও বার্সেলোনাকে বিপদে ফেলতে পারে লিভারপুলের ফরোয়ার্ডত্রয়ী। সেক্ষেত্রে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে প্রথম লেগের মতো জর্ডি আলবাকে সম্ভবত কাউন্টার অ্যাটাক থামানোর জন্য কিছুটা নিচে নেমেই খেলতে হতে পারে, যেখানে আলবাকে মোকাবিলা করতে হবে সালাহকে। আলবার কম তৎপরতায় দায়িত্ব বেড়ে যাবে মেসি, সুয়ারেজ ও কৌতিনহোর কাঁধে। পোর্তোকে ধ্বংস করার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে লিভারপুলের দ্রুতগতির কাউন্টার অ্যাটাক। সালাহ, মানে ও ফিরমিনো, এই ত্রিফলার দ্রুতগতির ফুটবল সমস্যায় ফেলতে পারে বার্সেলোনার রক্ষণকে। লিভারপুলকে হারাতে হলে ভালভার্দেকে জোর দিতে হবে এই জায়গাটিতেই।
অন্যদিকে, অন্যান্য দল থেকে কিছুটা ধীরগতি খেলা খেলায় হিতে বিপরীতও হতে পারে। বার্সেলোনার বিপরীতে তেমন সুবিধাজনক অবস্থানে নাও থাকতে পারে লিভারপুল। কারণ লিভারপুলের দলের দিকে তাকালেই বুঝা যাবে মাঝমাঠ দখলে বার্সেলোনা থেকে তারা পিছিয়ে থাকবে অনেকটুকুই। তাই মধ্যমাঠে হেন্ডারসন, ফাবিনহো ও নাবি কেইটার পারফরম্যান্সের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে অলরেডের জন্য। তবে এই মৌসুমে লিভারপুলের রক্ষণের অতিমানবীয় পারফরম্যান্স লিভারপুলের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে আসতে পারে। এইবারের প্রিমিয়ার লিগের সেরা একাদশেই জায়গা হয়েছে তিন লিভারপুল ডিফেন্ডারের। ভ্যান ডাইক ছাড়াও জায়গা পেয়েছেন দুই ফুলব্যাক ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার ও অ্যান্ড্রু রবার্টসন। ভ্যান ডাইক মেসিকে আটকাতে পারবেন কি না, তা সময়ই বলে দিবে। তবে এই ডাচ ডিফেন্ডারের যে সেই সামর্থ্য রয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে এত সব দ্বৈরথে চাপা পড়ে গেছে সময়ের দুই অন্যতম সেরা দুই গোলকিপারের মুখোমুখি হওয়া। চলতি মৌসুমে দুই ক্লাবের হয়েই দুর্দান্ত খেলে এসেছেন টের স্টেগান ও অ্যালিসন বেকার। চ্যাম্পিয়নস লিগে এইবার ১০ ম্যাচ খেলে টের স্টেগান গোল খেয়েছেন মাত্র ৬টি। ক্লিনশিট রেখেছেন ৫ ম্যাচে। অন্যদিকে অ্যালিসন ১০ ম্যাচ খেলে ৯ গোল হজম করার পাশাপাশি ক্লিনশিট রেখেছেন ৪ ম্যাচে।
চোখ থাকবে যাদের উপর
ম্যাচের সবচেয়ে তারকা মেসির দিকে শুধু বার্সেলোনাই তাকিয়ে থাকবে না, বরং লিভারপুলের প্রার্থনা থাকবে যেন মেসি ‘মেসি’র মতো খেলতে না পারেন। বলতে গেলে, একা হাতেই বার্সেলোনাকে টানছেন এই ক্ষুদে জাদুকর। ১০ গোল নিয়ে এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় এক নাম্বার স্থান দখল করে আছেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন মেসি। তবে মেসির নাম নেওয়াতে পাশাপাশি আসবে ভার্জিল ভ্যান ডাইকের কথাও। মেসিকে আটকানোর গুরুভার তারই কাঁধে থাকবে। যদিও বিনয়ের সাথে ভ্যান ডাইক বলেছেন মেসিকে আটকানোয় উপায় তার জানা নেই, তবে সামর্থ্য ভ্যান ডাইকের অবশ্যই রয়েছে।
বার্সেলোনার মতো একজনে চড়েই নয়, লিভারপুল চড়ছে তাদের তিন তারকা সালাহ, মানে ও ফিরমিনোর উপরে। তিনজনেরই সমানসংখ্যক ৪টি করে গোল এইবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে। তবে এদের বাইরে দুই গোলকিপার অ্যালিসন ও টের স্টেগানও ম্যাচের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন।
ট্রিভিয়া
-
ইংলিশ ক্লাবের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগে সবচেয়ে বেশি জয়ের মালিক বার্সেলোনা। তারা ইংল্যান্ডের ক্লাবের বিরুদ্ধে জিতেছে ২৭ বার।
-
বার্সেলোনার মাঠে কখনোই হারেনি লিভারপুল। আগের চার দেখায় তাদের জয় দু’টি, আর বাকি দুইটি। একমাত্র ইংলিশ ক্লাব হিসেবে বার্সেলোনার বিপক্ষে এই রেকর্ড রয়েছে লিভারপুলের।
-
এইবারসহ ১১ বার সেমিফাইনালে লিভারপুল। এর আগের দশবারের আটবারই ফাইনালে উঠেছে অলরেডরা, যা কি না শতকরা হারে সর্বোচ্চ।
-
ক্যাম্প ন্যুতে সর্বশেষ ৩১ চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচ অপরাজিত বার্সেলোনা। এই ৩১ ম্যাচে জয় ২৮ টি ও ড্র ৩ টি। ১৫ গোল হজম করার বিপরীতে গোল করেছে ৩১ টি। এই ৩১ ম্যাচের কোনোটিতেই একের অধিক গোল খায়নি কিউলরা।
-
আর এক গোল করলেই চ্যাম্পিয়নস লিগে দ্বিতীয় দল হিসেবে ৫০০ গোলের মাইলফলক ছোঁবে বার্সেলোনা। তাদের সামনে রয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ (৫৫১ গোল)।
বিনা যুদ্ধে নাহি দিবো সূচাগ্র মেদিনী। দুই দলের মূলমন্ত্রই এটি। গতবারের ফাইনালিস্ট লিভারপুল কি টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে উঠবে, নাকি মৌসুমের শুরুতে ক্যাম্প ন্যুতে দর্শকদের চ্যাম্পিয়নস লিগ এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া মেসি দলকে নিয়ে যাবেন অঙ্গীকারের শেষ ধাপে। সেই উত্তর আর ন্যু ক্যাম্পে আগুনগরম লড়াইয়ের প্রথম লেগের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ১ মে পর্যন্ত।