যুদ্ধ নয়, তবে যুদ্ধের চেয়ে যেন বেশি কিছু। ফুটবলের ময়দানে এগারো জন বাঙালি সন্তান নাকানিচুবানি খাওয়ালো ভিক্টোরিয়ার দেশের ১১ গোরাকে, প্রথমবার ভারতীয় কোনো দল জিতলো আইএফএ শিল্ড। খেলোয়াড়দের মাথায় তুলে চলল ৮০ হাজার দর্শকের উল্লাসনৃত্য। জয়োল্লাসের মিছিলে তখন সস্তা চটকের বদলে জাতীয়তাবাদী শ্লোগান। একটি দল হয়ে উঠলো গোটা একটি দেশ। ১০৬ বছর আগের ইতিহাসের এই শিহরণের নাম মোহনবাগান।
এই জনপদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুটা হয়েছিলো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের দ্বারা, যার কথা আমরা প্রায় মনেই রাখি না, অথচ এ আন্দোলনের ইতিহাসে অবিভক্ত ভারতে বাঙালির অংশীদারিত্ব সব থেকে গৌরবময়। অবহেলায় তা-ও যতটুকু আমরা মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতাদের বাঁচিয়ে রেখেছি, আন্দোলনের ইতিহাস থেকে ততটাই অপাঙক্তেয় করে রেখেছি শিবদাস ভাদুড়ি, অভিলাষ ঘোষ, কানু রায়কে। অথচ বাংলা তথা ভারতের জাতীয়তাবোধকে সর্বপ্রথম তারাই এই বার্তা দিতে পেরেছিলেন “আমরাও পারি”, ইংরেজদের দর্প চূর্ণ করে অবিভক্ত ভারতকে তারা দিয়েছিলেন অপরিসীম আত্মবিশ্বাস, বিজয়ের প্রাথমিক স্বাদ। কারা ছিলেন এরা? দলের গণ্ডি পেরিয়ে গোটা দেশের অনুপ্রেরণার নামই বা কীভাবে হয়েছিলো মোহনবাগান?
মোহনবাগানের জন্ম ও উত্থান
মোহনবাগান, ওপার বাংলার ফুটবল উন্মাদনার আরেক সমার্থক শব্দ। আজও ফুটবলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল লড়াই মানেই যেন ঘটি-বাঙালের চিরায়ত দ্বৈরথ, যার আঁচে আন্দোলিত হয় গোটা পশ্চিমবঙ্গ। সেই মোহনবাগান ক্লাবটি কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা বার্সেলোনার থেকেও বয়সে বড়। বাম তাত্ত্বিক বা দুঁদে নেতাদের ভাষ্যে চটুল সংস্কৃতি, খেলা, ধর্ম ইত্যাদির দ্বারা মানুষকে সহজেই ভুলিয়ে রাখা যায়, তখন তারা ভুলে যায় তাদের অধিকারের কথা, শোষণের প্রতিবাদে গর্জে ওঠার কথা। সম্ভবত সে সূত্র অনুসরণ করেই ভারতের জনগণের রাজনৈতিক অসন্তোষের বিপরীতে তাদের মজে থাকবার জন্য ‘আফিম’ হিসেবে ব্রিটিশরা নিয়ে আসে ফুটবল। ওদিকে খেলাকে যতই ‘অরাজনৈতিক’ বলা হোক, রাজনীতি আর খেলাকে কখনোই সম্পূর্ণ আলাদা রাখা যায়নি। শোষকের অস্ত্রকে তাই শোষকের বিরুদ্ধেই ঢাল করবার সিদ্ধান্ত নিলো বাঙালিরা। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহের নানা সৃষ্টিশীল অনুপ্রেরণা তৈরির অংশ হিসেবে ফুটবল খেলাটাকে সেই থেকে নিজের করলো বাঙালি। এরই সূত্র থেকে উত্তর কলকাতার ফড়িয়াপুকুরে তিন অভিজাত মিত্র, সেন ও বসু পরিবার এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেন। পরিবারের কিরটী মিত্রের বাড়ি মোহনবাগান ভিলায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ক্লাবটির নাম রাখা হয় ‘মোহনবাগান স্পোর্টস ক্লাব’, পরবর্তীতে যার নাম হয় ‘মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব’। ক্লাবের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন বসু পরিবারের নামী আইনজীবী ভূপেন্দ্রনাথ বসু।
১৮৯৩ সালে কোচবিহার কাপে অংশগ্রহণের দ্বারা প্রথম কোনো টুর্নামেন্টে নাম লেখায় মোহনবাগান। ১৯০৪ সালে সেই কোচবিহার কাপ জয়ের মাধ্যমে জয়রথ শুরু হয় তাদের। ১৯০৫ সালেে দ্বিতীয়বারের মতো এই ট্রফি জেতার পর সে বছরই চুঁচুড়ায় আয়োজিত গ্ল্যাডস্টোন কাপে তৎকালীন আইএফএ শিল্ড জয়ী ডালহৌসিকে মোহনবাগান ৬-১ গোলে পরাজিত করে। ১৯০৬ সালে মোহনবাগান ট্রেডস কাপ, গ্ল্যাডস্টোন কাপ ও কোচবিহার কাপ একসঙ্গে জয় করে। ১৯০৭ সালে তারা আবার ট্রেডস কাপ জেতে। ১৯০৮ সালেও এই কাপ জিতে পরপর তিন বছর এই কাপ জয়ের রেকর্ড সৃষ্টি করে মোহনবাগান।
আইএফএ শিল্ড ১৯১১ ও একটি নতুন ইতিহাস
১৯১১ সালের জুলাই মাস। বঙ্গভঙ্গ ও ক্ষুদিরামের ফাঁসি নিয়ে ফুঁসছে তখন দুই বাংলার জাতীয়তাবাদী জনতা। প্রতিবাদের আগুন নেভাতে দমননীতি বেছে নিয়েছিলো ব্রিটিশ সরকার। বাড়ি গিয়ে গিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছিলো ‘স্বদেশী’দের, যাদের অনেকে হয়েছিলেন হত্যা-গুমের শিকার। এই রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সকল ভাষাকে যখন দমন করা হচ্ছিলো, তখনই আশার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে হাজির হয় মোহনবাগান। ভারতবর্ষের সবথেকে সম্মানজনক ফুটবল টুর্নামেন্ট আইএফএ শিল্ডের সেমিফাইনালে তারা হারিয়ে দেয় ইংরেজ ক্লাব মিডলসেক্সকে। ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে ছিলো আরেক ইংরেজ ক্লাব ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট। ইতোপূর্বে ভারতীয় কোনো ক্লাব আইএফএ শিল্ড জিততে পারেনি। তাই মোহনবাগানকে ঘিরে রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়লো গোটা ভারতবর্ষে।
“পদাঘাতের বিপরীতে পদাঘাত কেবলমাত্র ফুটবলেই সম্ভব।” কথাটি বলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। ফুটবলের জয়কে তাই প্রতিবাদের নতুন ভাষা হিসেবে দেখতে ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নতুন অনুপ্রেরণা চেয়েছিলো বাঙালিরা। স্বদেশীদের আন্দোলন যতই সহিংস হয়েছে, ইংরেজের দমননীতিও তত প্রবল হয়েছে। তাই সহিংসতার পুরনো পন্থায় বাঙালি যখন কিছুটা ক্লান্ত ও দিকভ্রান্ত, তখন ২০ গজ আঘাত সীমার হাতবোমার বদলে আরো বড় আঘাত সীমার ‘বোমা’ ব্যবহার করতে চাইলো বাঙালিরা। সেই বোমাটি ছিলো ফুটবল। বাঙালির এ উদ্দীপনাকে দেখানো হয়েছে ১৯১১’র সেই ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে নির্মিত পশ্চিম বাংলার ছবি ‘এগারো‘র কিছু সংলাপে।
– “শোনো, ওসব বোমা মেরে আর বড় লাট মেরে কিসসু হবে না, কিসসু হবে না। ওরা হচ্ছে রক্তবীজের ঝাঁড়।”
– “তা যা বলেছো, একটা মরলে দশটা গজায়।”
– “হ্যাঁ, ঐ যমদূতগুলোর মাঠেই শাস্তি। আগের খেলাতেই দেখলে না, অভিলাষ ঘোষ ঐ গোরা পল্টনের চোখ ফেটে দিলো। কী হলো? এখনো দিব্যি খেলে বেড়াচ্ছে। তাঁর ফাঁসিও হয়নি, কারাপানিও হয়নি।”
এ উদ্দীপনা ছিলো সংক্রামক, যা আন্দোলিত করেছিলো গোটা ভারতবর্ষকেই। জাতীয় জীবনে পর্যদুস্ত ভারতবাসীর জয়ের একটা তীব্র ক্ষুধা ঘুমিয়ে ছিলো, সাথে ছিলো শিরদাঁড়া সোজা রেখে শোষকের দর্পে পাল্টা কষে লাথি দেবার তীব্র বাসনা। মোহনবাগানের সেই ফাইনালটি তাই আর শুধু কোনো খেলা রইলো না। ২৯ জুলাইয়ের ফাইনালকে তারা পরাধীনতার নৈরাশ্য পায়ে ঠেলার ও বিজয়ের প্রথম সুখ অনুভব করবার উপলক্ষ্য হিসেবে দেখছিলেন।
অবশেষে এলো সেই দিন। ইডেন গার্ডেনে ৮০ হাজার মানুষের ঢল। দর্শনার্থী সামলাতে সরকারকে সেদিন চালু করতে হয়েছিলো অতিরিক্ত ফেরি ও রেল পরিসেবা। ঢাকা, বরিশাল বা চট্টগ্রাম থেকেই নয়, আসাম, বিহার, উত্তর প্রদেশ থেকেও অনেকে এসেছিলেন এ মহারণের সাক্ষী হতে। কেবল বুট পরতে অস্বীকৃতি জানানোয় ১৯৫০ এর ফুটবল বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েও খেলতে পারেনি ভারত, এ জনপ্রিয় ধারণাটি সত্য না হলেও মোহনবাগানের খেলোয়াড়েরা কিন্তু সেদিন নেমেছিলেন খালি পায়েই। ওদিকে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের দীর্ঘদেহী ফুটবলাররা ছিলেন ক্রীড়াসজ্জায় সুসজ্জিত।
প্রথমার্ধে এক গোলে পিছিয়ে থেকে বিরতিতে যায় মোহনবাগান। বিরতির পরপরই অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ির গোলে সমতা আনে তারা। ম্যাচ শেষের অল্প কিছুক্ষণ আগে অভিলাষ ঘোষের গোলে জয় পায় মোহনবাগান। উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। “জয়তু মোহনবাগান” নয়, সবার মুখে মুখে বরং “বন্দে মাতরম”। আবেগের জোয়ারে ভাসিয়ে সেদিন ফুটবলই বাঙালি তথা ভারতকে দিয়েছিলো বিদ্রোহের নতুন ভাষা। ব্রিটিশ ভদ্রলোকীয় অহমকে চূর্ণ করে প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে আইএফএ শিল্ড জেতে মোহনবাগান। কবি করুণানিধন বন্দ্যোপাধ্যায় এ উপলক্ষে মানসী পত্রিকায় লিখেন এক কবিতা, যার শেষ দিকের দুটো লাইন ছিলো এমন-
গোল দিয়েছে গোরার গোলে বাঙালির আজ জিত,
আকাশ ছেয়ে উঠছে উধাও উন্মাদনার গীত।
ঝিমিয়ে পড়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চাঙ্গা হয়েছিলো সেই জয়ের উদযাপনে ঢাকের প্রতিটি আওয়াজে, প্রতিটি শ্লোগানে। এই জয়ের পর বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলন এতটাই জোরালো হয় যে, ঐ বছরের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। এমনকি বিদ্রোহের আগুন এমনই দানা বাঁধে যে, অনেকটা ভীত হয়েই ব্রিটিশ সরকার রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লী সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় বলে মনে করা হয়।
অন্যদিকে সেই ১৯১২ সাল থেকে প্রতিষ্ঠা তারিখ ১৫ আগস্টকে ক্লাব প্রাঙ্গনে ‘মোহনবাগান দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হয়, পরবর্তীতে কাকতালীয়ভাবে ভারতও ১৯৪৭ সালের একই দিনে স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর পর ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমান রাজীব গান্ধী মোহনবাগানকে ‘জাতীয় ক্লাব’ ঘোষণা করেন। শোনা যায়, শিল্ড ফাইনাল শেষে বিজয় মিছিল যখন ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো, তখন অধিনায়ক শিবদাসকে জনৈক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেন, “এরা (ব্রিটিশরা) কবে যাবে?” অধিনায়কের উত্তর ছিল, “যেবার আমরা ফের শিল্ড জিতবো।” কাকতালীয়ভাবে বাগানের দ্বিতীয় শিল্ড ঘরে এসেছিল ১৯৪৭ সালেই! সেই থেকেই এই জয়কে কেবল খেলার “একটি জয়” আর মোহনবাগানকে শুধু “একটি দল” এজন্যই বলা যায় না! আবেগের তাড়না থেকেই সেটা সম্ভব হয় না!
এপার বাংলা ও মোহনবাগানের নিবিড় যোগ
ওপার বাংলায় ব্রিটিশ ভারতে সব থেকে জনপ্রিয় ও পুরনো ফুটবল ক্লাব যেমন ছিলো মোহনবাগান, তেমনি এপার বাংলায় ছিলো ওয়ারী ক্লাব (প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ওয়েলিংটন ক্লাব), যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রামদাস ভাদুড়ি। ঢাকার এই ভাদুড়ি পরিবারেরই সন্তান ছিলেন মোহনবাগানের অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ি ও অন্যতম খেলোয়াড় বিজয়দাস ভাদুড়ি। আর ‘১১ এর শিল্ডজয়ী কানু রায় ও রাজেশ সেনগুপ্ত খেলোয়াড় জীবনের শুরুতে ছিলেন ওয়ারীতেই। এমনকি শিল্ডজয়ী দলের অধিকাংশই ছিলেন ‘বাঙাল’ বা পূর্ববঙ্গের আদি বাসিন্দা। সেই থেকে মোহনবাগানের সাথে আত্মার যোগ আছে এপার বাংলারও, ফাইনাল দেখতে এমনি এমনি এ বাংলা থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে যায়নি!
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ফুটবল যেমন বিপ্লবের অনুষঙ্গ হয়েছে, তেমনি একাত্তরেও হয়েছে, যা আমরা হয়তো অনেকেই জানি না। জনমত গঠনের জন্য স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীরা, জর্জ হ্যারিসন-রবি শঙ্কররা বা কূটনীতিকরাই শুধু চেষ্টা করেননি, সাইদুর রহমানের প্যাটেলের সংগঠনে বাংলাদেশ ফুটবল দলও এ কাজটি করেছিলো। ৮ আগস্ট, ১৯৭১ এ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অনুমতিক্রমে নদীয়ার কৃষ্ণনগর মাঠে বাংলাদেশ ফুটবল দল প্রীতি ম্যাচ খেলেছিলো গোষ্ঠ পাল একাদশের বিপক্ষে। অখ্যাত এ ছদ্মনামের আড়ালে সেদিন আসলে খেলেছিলো সেই মোহনবাগানই। কেবল মানুষের ভালোবাসার সম্পর্কে নয়, সেদিন থেকে এপার বাংলার ইতিহাসও কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হলো মোহনবাগানের। আর তাই ইস্টবেঙ্গলের মতো শুধু ‘বাঙালদের’ বা মোহামেডানের (কলকাতা) মতো শুধু ‘মুসলিমদের’ ক্লাব নয় মোহনবাগান। হিন্দু-মুসলিম, বাঙাল-ঘটি নির্বিশেষে এ ক্লাব আমাদের ক্লাব, বাঙালির ক্লাব।
ইতিহাসে মোহনবাগানকে খোঁজা নিষ্প্রয়োজন, কেননা মোহনবাগান নিজেই একটি ইতিহাস। সবুজ-মেরুন জার্সি মানেই প্রবল প্রতিজ্ঞায় এগিয়ে যাবার উদ্যম। মোহনবাগান তাই একটি দল নয়; একটি আবেগ, একটি দেশ। ভালোবাসায় চিরঅক্ষয় থাকুক মোহনবাগান। স্মৃতির পাতায় আরো দ্যুতি নিয়ে বেঁচে থাকুন শিবদাস, অভিলাষেরা।
ফিচার ইমেজ- Wikimedia Commons