চ্যাম্পিয়ন্স লীগের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে নাপোলির বিপক্ষে ম্যাচের শেষ মুহূর্তে মিলিকের শট ঠেকিয়ে দিয়ে ম্যাচের অন্যতম নায়ক হয়ে উঠেছেন ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকার। মিলিকের শটটি এই গোলরক্ষক অসাধারণভাবে ব্লক করায় শেষ পর্যন্ত ১-০ গোলের নিয়ে মাঠ ছাড়ে লিভারপুল, এবং ইউসিএলের শেষ ষোলোতে জায়গা করে নেয় তার দল। কেন এতটা আলোচিত হচ্ছে এই সেভটি? কারণ গোলটি হলে ম্যাচ ১-১ গোলের ড্র’তে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রায় শতভাগ, এবং ড্র হলে শেষ ষোলোতে লিভারপুলের পরিবর্তে জায়গা করে নিতো নাপোলি। ঠিক এই কারণেই প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। লিভারপুল কোচ ক্লপ তো প্রশংসার চূড়ান্ত করেছেন,
“যদি আমি জানতাম অ্যালিসন এতটা ভালো, তাহলে আমি দ্বিগুণ মূল্যও পরিশোধ করতাম।”
আসলে কতটা ভালো অ্যালিসন? এই প্রশ্নের উত্তর শুধুমাত্র একটি ম্যাচ বা এক কথায় দেওয়া সম্ভব না। সেই সাথে এই প্রশ্নের উত্তরের সাথে পাওয়া যাবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, লিভারপুলের রক্ষণে অ্যালিসনের প্রভাব ও ভূমিকা কতখানি।
২০১৮-১৯ মৌসুমের শুরুটা লিভারপুলের এতটা দুর্দান্ত হয়েছে যে, খোদ লিভারপুল সমর্থকদের অনেকেই হয়তো এরকম কিছু আশা করেনি। চলতি মৌসুমে লিভারপুলের জালে বল জড়িয়েছে মাত্র ৬ বার, এবং তারা লিগে এখনও একটি ম্যাচও হারেনি! প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসে ১৬ ম্যাচ শেষে লিভারপুলের চেয়ে এত কম গোল হজম করেছে এরকম কোনো দল নেই। লিগের এই পর্যায়ে লিভারপুলের সমান সবচেয়ে কম গোল হজম করেছিলো ২০০৮-০৯ ও ২০০৪-০৫ মৌসুমের চেলসি এবং ২০০৪-০৫ মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল চেলসি। লিভারপুলের জালে সবচেয়ে কম গোলের পরিসংখ্যানে ধারেকাছে নেই ইউরোপ সেরা লিগগুলোর শীর্ষ দলগুলোও। প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ম্যানচেস্টার সিটি গোল খেয়েছে ৯টি, লা লিগার শীর্ষে থাকা বার্সেলোনার জালে বল জড়িয়েছে ১৯বার (১৫ ম্যাচে) এবং এমনকি বুন্দেসলিগার লিগ টেবিলের শীর্ষ ও অপরাজিত দল ডর্টমুন্ডও হজম করেছে ১৪ গোল (১৪ ম্যাচে)।
উল্লেখিত তুলনামূলক পরিসংখ্যান থেকে সহজেই বুঝা যাচ্ছে, এই মৌসুমে লিভারপুলের রক্ষণ কতটা নিখুঁত ও সুদৃঢ়। রক্ষণদুর্গের আলোচনায় গোলরক্ষকের উপরে থাকা ডিফেন্ডারদের ভূমিকা শুরুতে চলে আসে সবসময়, এবং তাদের অবদান অনস্বীকার্য। ক্লপের অধীনে লিভারপুলের রক্ষণে চেহারা একেবারেই বদলে দিয়েছেন সেন্টারব্যাক ভ্যান ডাইক, সাথে উল্লেখযোগ্য আরনল্ড ও গোমেজের পার্ফরম্যান্সও। তবে, লিভারপুলের দুর্ভেদ্য রক্ষণদুর্গ গড়ে তোলায় রক্ষণভাগের এই ডাচ খেলোয়াড়ের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। লিভারপুলের ডিফেন্ডারদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পরও অ্যালিসন নিজেকে প্রমাণ করেছেন তার পারফরম্যান্স দিয়ে, এবং দলের অবস্থানে তার ভূমিকা কতখানি, সেই আলোচনায়ও রেখেছেন নিজস্ব ছাপ।
লিভারপুলের জার্সিতে প্রথম মৌসুমে ব্রাজিলিয়ান এই গোলরক্ষক এখন পর্যন্ত ২২ ম্যাচের ১২ টিতে একবারও বল জালে জড়াতে দেননি, বা ক্লিন শিট রেখেছেন। প্রিমিয়ার লিগের ক্ষেত্রে তার এই ক্লিন শিট সংখ্যা ১৬ ম্যাচে ১০টি। শুধুমাত্র ক্লিন শিট দিয়ে যদি এককভাবে গোলরক্ষকের কৃতিত্ব নিরপেক্ষভাবে বিচার করা না যায়, তাহলে এবারে চোখ রাখতে হবে অন টার্গেট শট সেভ করার হারের দিকে, যা একান্তই গোলরক্ষকের কৃতিত্ব। অন টার্গেট শটে অ্যালিসনের সেভ করার হার ৮৫.৭১%, যা এই মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগ সেরা এখনও। গত মৌসুমে লিভারপুলের গোলবারের নিচে ছিল যথাক্রমে লরিস কারিউস ও মিনিওলেট। লিভারপুলের হয়ে গত মৌসুমে কারিউস খেলেছেন ১৯ টি ম্যাচ এবং তার সেভ করার হার ছিল মাত্র ৬৮.৮৯%, অন্যদিকে সমানসংখ্যক ম্যাচে মিনিওলেটের সেভ করার হার মাত্র ৬০%! যদিও সাধারণ পরিসংখ্যান অনুযায়ী একজন গড়পড়তা গোলরক্ষকের সেভ করার হার হওয়া উচিত ৬৮.৪%! যাই হোক, এই দুই গোলরক্ষকের পরিসংখ্যানে সাথে সাধারণ তুলনাতেই দেখা যাচ্ছে, লিভারপুলের সার্বিক পারফরম্যান্সে অ্যালিসন কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
লিভারপুল রক্ষণভাগের শক্তিশালী পারফরম্যান্স ও ফর্মের কারণে একটা ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, হয়তো অ্যালিসনকে খুব একটা কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়নি, বা গোলমুখের লক্ষ্যে থাকা শটগুলো হয়তো তেমন একটা জোরালো ছিল না। নাহ, প্রিমিয়ার লিগের মতো একটি আসরে অ্যালিসন গোলমুখে সহজ সময় কাটিয়েছেন, এমনটা ভাবাই নিতান্তই অমূলক। উপরন্তু, লিভারপুলের গোলবারের নিচে অ্যালিসন কতটা দুর্দান্ত ছিলেন, এবং তার পারফরম্যান্স যে দলের জন্য কতটা প্রভাব বিস্তারকারী, তার একটি তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায় ফুটবলের তথ্য বিশ্লেষণকারী বিশেষ ওয়েবসাইট স্ট্যাটসবম্বের বিশ্লেষণ থেকে।
সুনির্দিষ্ট তথ্য বিশ্লেষণ করে এই ওয়েবসাইট হিসাব করে একটি সামগ্রিক ধারণা বা পরিসংখ্যান তৈরি করেছে যে, একজন গোলরক্ষক প্রত্যাশা অনুযায়ী কতগুলো গোল সেভ করেছেন, বা অন টার্গেট শট ও সাধারণ পরিস্থিতি অনুযায়ী কতগুলো গোল সেভ করেছেন। এখানে দেখা গেছে যে, এই মৌসুমে অ্যালিসন যে শটগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন, সেই শটগুলো থেকে আনুমানিক গোল হওয়া উচিত ছিল ১১.১৪টি! কিন্তু সেখানে ব্রাজিলিয়ান এই গোলরক্ষকের হাত গলে গোল হয়েছে মাত্র ৬টি! ঠিক এখানেই প্রিমিয়ার লিগের অন্য দলগুলোর সাথে লিভারপুলের বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন এই অসাধারণ গোলরক্ষক।
পারিসংখ্যানিক দৃষ্টিকোণ থেকে যতগুলো গোল হজম করার কথা ছিল একজন গোলরক্ষকের এবং তার বিপরীতে যত গোল খেয়েছেন, সেই তালিকায় গত মৌসুমে লিভারপুলের দুই গোলরক্ষকের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ২৩ ও ৩৩! কিন্তু, চলতি মৌসুমে লিভারপুলের হয়ে একই তালিকার শীর্ষে রয়েছেন অ্যালিসন। হিসাব অনুযায়ী কারিউসের গোল খাওয়ার কথা ১১.৪৭ টি, কিন্তু তার সময়ে প্রতিপক্ষ বল জালে জড়িয়েছে ১২ বার। কারিউসের চেয়ে বাজে অবস্থা ছিল মিনিওলেটের, ১৭.৯৯ টি গোল হওয়ার কথা থাকলেও, তিনি হজম করেছিলেন ২২ টি। যত গোল হওয়ার কথা ছিল, তার চেয়েও ৪.০১ টি গোল বেশি হয়েছে মিনিওলেটের সময়!
চেলসির বিপক্ষে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে ১-১ গোলের ড্রয়ের ম্যাচে ওয়ান-অন-ওয়ান অবস্থায় হ্যাজার্ডকে পরাস্ত করা, মার্সেসাইড ডার্বিতে পয়েন্ট ব্ল্যাংক থেকে গোমেজের হেড সেভ করা কিংবা শুরুতেই বলা চ্যাম্পিয়ন্স লীগে মিলিকের শট থামিয়ে দেওয়া অ্যালিসনের পারফরম্যান্স ছাড়াও উল্লেখযোগ্য আরেকটি ব্যাপার হলো, এ মৌসুমে লিভারপুল তিনটি ড্র ও আরও পাঁচটি ম্যাচ জিতেছে মাত্র একটি গোলের ব্যবধানে। এই ম্যাচগুলোতেই অ্যালিসনের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ছাড়া লিভারপুল হয়তো লীগের শীর্ষ দল হতে পারতো না। কারণ, গত মৌসুমেই দলটির গড় শট সেভ করার হার ছিল ৬৪%, যা ছিল সংশ্লিষ্ট তালিকার ১৯তম এবং একই তালিকায় এই মৌসুমে লিভারপুল ৮৬% শট সেভ করে রয়েছে তালিকার সেরা অবস্থানে।
বিপদজনক অবস্থানে এই গোলরক্ষকের কিছু অহেতুক ড্রিবল করা নিয়ে সমালোচনা হলেও, এই মৌসুমে দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছেন লিভারপুলের অন্যতম সেরা এই ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়। মৌসুমের শেষ অবধি যদি তিনি এই ফর্ম ধরে রাখতে পারেন, তাহলে হয়তো লিভারপুলের ট্রফি তালিকায় যুক্ত হতে পারে নতুন কিছু অর্জন।