‘Get busy living, or get busy dying.’
‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ সিনেমার এই সংলাপটি আপনি শুনেছেন বলেই অনুমান। নিশ্চয়ই সিনেমাটাও দেখা। গতকাল রাতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে হারের পর কারও মনে আচমকাই সংলাপটা মনে পড়ে গেলে তাকে ঠিক দোষ দেয়া যাবে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের গতির সঙ্গে বাংলাদেশের যে ১৮০ ডিগ্রি বৈপরীত্য, তাতে তো এই সংলাপই ভরসা।
বাংলাদেশ অবশ্যই মরে যেতে ব্যস্ত থাকাদের দলে। আর সব দল যেখানে বেছে নিয়েছে ‘হাই রিস্ক, হাই রিওয়ার্ড’ ক্রিকেট, ভয়ডর শব্দটা যেখানে আস্তাকুঁড়ের কোনো অভিধানেই খুঁজে পাওয়া যায়, বাংলাদেশ সেখানে ব্যস্ত নিরাপদ ক্রিকেট খেলতে। প্রতিপক্ষকে ম্যাচ থেকে ছিটকে ফেলার জমানায় তারা চাইছে লড়াই করার মতো সংগ্রহের পেছনে ছুটতে, এখনো। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচটা যাতে নবতম সংযোজন।
স্কোরকার্ডে লেখা আছে, বাংলাদেশে ৩০৩ করেও হেরেছে। ম্যাচে ৩২টা চার আর ৪টা ছয় মারার পরও ১৫-২০ রানের কম হওয়ার আক্ষেপ অধিনায়কের রয়ে গেছে। তবে যা লেখা নেই, এই রান কম হওয়ার পেছনে নিরাপদ ক্রিকেট খেলতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও কম দায়ী নয়।
তামিম ইকবালই বলেছেন, জিম্বাবুয়েতে শুরুর এক ঘণ্টা সময়টুকু বোলারদের দিলে পরে বাকি সময়টা ব্যাটিংয়ের জন্য খুব সহজ। এখানে রান হয়। টসে হেরে ব্যাট করতে নামার পরে প্রথম পাওয়ারপ্লেতে তাই ৫১ রান তোলা কিংবা লিটন দাসের শুরুর সংগ্রামের একটা ব্যাখ্যা তাই অধিনায়কের কথাতেই মেলে। ওই সময়টুকু উইকেটবিহীন কাটিয়ে পরের ৪০ ওভারে রানটাকে যথাসম্ভব বাড়িয়ে নেওয়া হবে, দলের পরিকল্পনা এমন হওয়াটাই তাই স্বাভাবিক।
কিন্তু এরপরে কী হলো? পরের ৫০ রান তুলতে উইকেট খোয়া গেল না ঠিকই, তবে সময় লাগল ৮৭ বল। ক্যাপ্টেন নিজেই যার জন্যে কাঠগড়ায় উঠবেন। প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটার হিসেবে তামিম আট হাজার ওয়ানডে রান পূর্ণ করলেন সেদিন, সঙ্গে পেলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৯২তম অর্ধশতক। কিন্তু প্রথম ৩৫ বলে ৩২ রান তোলা তামিম ৫০ পর্যন্ত যেতে লাগিয়েছেন ৭৯ বল। ৪০-৫০ রানের সময়টুকুই সবচেয়ে দীর্ঘ, ওই ১০ রানের জন্য খেলেছিলেন ৩০ বল। এমনও নয় যে তিনি মারতে চাইছিলেন, কিন্তু সংযোগটা কেবল বাতাসের সঙ্গেই হচ্ছিল; তিনি মারছিলেনই না।
একদিকে লিটনের সংগ্রাম, সঙ্গে ফিফটির কাছাকাছি এসে অধিনায়কের শম্বুকগতির ব্যাটিং, ১০০ পর্যন্ত যেতেই পেরিয়ে গেল ইনিংসের প্রায় অর্ধেক। দু’জনে মিলে ১১৯ রানের জুটি গড়লেন ঠিকই, তবে রানরেট তুলতে পারলেন ৪.৬৪ পর্যন্ত। একটু স্মরণ করিয়ে দিই, ২০১৯ বিশ্বকাপের পরে ওপেনিং জুটিতে ১০০+ রান এসেছে ৪০ বার। এবং, এই সময়ে এর চেয়ে ধীরগতিতে ওপেনাররা সেঞ্চুরি জুটি করেছেন মাত্র দু’বার। কোনো অর্থেই খাটো করা হচ্ছে না, তবে সেই দুটো জুটিও গড়েছেন ওমান এবং নেদারল্যান্ডসের ব্যাটাররা।
অথচ, এই ম্যাচে কিন্তু একজন বোলার বসিয়ে একাদশে নেওয়া হয়েছিল বাড়তি একজন ব্যাটার, তার মানে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত হয়ে গিয়েছিলেন দলের পঞ্চম বোলার, সব ঠিকঠাক এগোলে মেহেদী হাসান মিরাজকে নামতে হতো আট নম্বরে। অথচ পুরো ৫০ ওভার খেলেও বাংলাদেশ ব্যবহারই করতে পারল না সেই বাড়তি ব্যাটার নেওয়ার সুযোগ, উইকেট পড়ল মাত্র দু’টি, শেষ তিন ওভারে এল ২০ রান, আর যে উইকেটে অন্য যেকোনো দল ৩৫০ তোলার জন্যে দৌড়াবে, বাংলাদেশ হিমশিম খেল ৩০০ রান তুলতেই। এর জন্যে কি ‘নিরাপদ’ ক্রিকেট খেলাই দায়ী নয়?
শুধু তো তামিম-লিটনের পার্টনারশিপেই নয়, কিংবা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচের ব্যাটিংটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, এই ঝুঁকিহীন ক্রিকেট খেলার ধ্যানধারণা বোধহয় বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মজ্জাগত। সাম্প্রতিক ঘটনা বলে উদাহরণ হিসেবে এনামুল হক বিজয়কেই মনে পড়ছে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের এক মৌসুমে রেকর্ড ১,০৩৮ রান করে জাতীয় দলের দরজা খুললেন তিনি। স্ট্রাইকরেট আর চার-ছয়ের পরিসংখ্যানও বলছিল, এবার বোধহয় তাকে দিয়ে ‘হাই রিস্ক, হাই রিওয়ার্ড’ ক্রিকেটের জমানায় প্রবেশ করতে পারবে বাংলাদেশ। প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম বলটাতেই জায়গা বানিয়ে চার মেরে বুঝিয়েছিলেন, তিনিও ওই ধারণাতে বিশ্বাস বুনেই এসেছেন। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম দুই টি-টোয়েন্টিতে যেই রান পেলেন না, চলে গেলেন ‘ধরে খেলা’ তত্ত্বের খোঁজে। তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে আক্রমণই করতে চাইলেন না। আর যখন করলেন, তখনই আউট। ফলাফল, ১১ বলে ১০ রান!
সবচেয়ে অবাক করা কাণ্ডটা অবশ্য ঘটালেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তাড়া করতে হতো ২০৬ রান। কিন্তু ওয়ান ডাউনে নেমে তিনি খেলে গেলেন ২৭ বলে ২৬ রানের ইনিংস৷ সেদিন কেবলমাত্র পাঁচটা বল দেখে বোঝা গিয়েছিল, তিনি আক্রমণ করতে চান। তার এভাবে উইকেট আঁকড়ে পড়ে থাকার মূল্য বাংলাদেশ দিয়েছিল ম্যাচটা ১৭ রানে হেরে।
অথচ, অন্য দেশের ক্রিকেটাররা এসব ক্ষেত্রে কী করেন? জেসন রয় যেমন ইদানীং রান করছেন না। এই গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডের হয়ে পাঁচটা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলে তিনি ৮০ বলে রান করেছেন ৫৯। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর ডেটাও বলছে, মাত্র ৫৮.৮ শতাংশ বলই তিনি চাওয়ামতো ব্যাটে-বলে করতে পেরেছেন। মানে, প্রতি ২.৪ বল অন্তর অন্তর একটা করে ভুল শট নির্বাচন করেছেন। তবুও আক্রমণ করা থামাচ্ছেন না, কারণ দল তার কাছে সেটাই চাইছে। এবং, এই ব্যাটিংটা করেই তিনি দলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। আর তাই এই ভয়াবহ দুঃসময়েও দলকে পাশে পাচ্ছেন। ক্রিস জর্ডান তো এমনও বলেছেন,
‘দল ২৫০ শতাংশ সমর্থন দিচ্ছে ওকে।’
এই যে সবার ওপরে দলকে রাখার প্রচেষ্টা, ক্রিকেটটা যেহেতু টিম গেম, সবার ভেতরেই তো এই তাড়না কাজ করার কথা। নিজের ব্যাটিং সম্পর্কে বলতে গিয়ে সঞ্জু স্যামসন তাই যখন বলেন,‘আমি খুব বেশি রান করতে আসিনি। আমি অল্প রান করব, যা দলের কাজে লাগবে’, তখন খুব বেশি অবাক লাগে না। ভারত এখন তাকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটেই চিন্তা করছে, আর ওই ফরম্যাটগুলোতে স্ট্রাইকরেটের গুরুত্বই খুব সম্ভবত সর্বাগ্রে; স্যামসনকে তাই উচ্চঝুঁকির ক্রিকেটই খেলতে হবে। নিজের রানটা না হয় না-ই বাড়ল তাতে।
কিন্তু, বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের ব্যাপারেও কী তেমনটা বলা যাবে? প্রশ্নটা আরও জাগিয়ে দিয়েছেন বোর্ড পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারের পর সরাসরিই তো বললেন, ক্রিকেটাররা দলে নিজের জায়গা ধরে রাখতে খেলেন:
‘খুব হতাশ। পুরোপুরি ক্রিকেটারদের দোষ দেব। তাদের প্রয়োগ সম্পূর্ণ ভুল ছিল। জানি যে আমাদের (ওভারে) ১০-১২ রান করে লাগবে, তবু আমরা ওভারে ৬-৭ করে নিচ্ছি। কাউকে দেখলাম না, ছয় মারার চেষ্টা করেছে। সবাই ২-১ করে নিয়েছে। নিজের জায়গা ধরে রাখতে একটা মোটামুটি রান করে নিজেকে নিরাপদ রাখলাম।’
এই নিরাপদ থাকতে চাওয়ার প্রচেষ্টাটা শুধু তো ব্যাটিংয়ে নয়, দল নির্বাচন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই। নতুন কাউকে সুযোগ দিলে তিনি এসেই পারফর্ম করবেন নিশ্চয়তা নেই, হেরে যাওয়ার ঝুঁকিটাই বেশি – এই চিন্তাতেই না জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও মাঠে নামানো হলো সম্ভাব্য সেরা দল – যার মূল্যটা চড়া দামেই চুকোতে হচ্ছে। ম্যাচ চলতে চলতেই পায়ে বলের আঘাত পেয়েছিলেন শরিফুল ইসলাম, ওভার বাকি রেখেই ড্রেসিংরুমে উঠে পড়তে হয়েছিল তাই। তবে এর চেয়েও বড় খবর, ব্যাটিংয়ের সময় হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়েছেন লিটন দাস। যা আশঙ্কা, তাতে এশিয়া কাপ মিস করাটাও অসম্ভব নয়।
এই সেরা দল নিয়েও অবশ্য লাভ হলো না গতকাল। আর হারের পরপরই সাকিব আল হাসানেরই একটা পুরনো উক্তি আলোচনায় এলো ফের। কথাটা তিনি বলেছিলেন গত দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে প্রথম ওয়ানডে জয়ের পরে। সেদিন দলের পরিকল্পনা নাকি ছিল ২৭০-২৮০ রান তুলেই বোলিংয়ে নামার। কিন্তু উইকেটে গিয়ে তার মনে হয়েছিল, এই রানটা কেবল সম্মানজনক পরাজয়ই নিশ্চিত করবে। হার আটকাতে পারবে না। ইয়াসির রাব্বির সঙ্গে মিলে তাই শুরু করলেন আক্রমণ। শেষ পর্যন্ত ৬৪ বলে ৭৭ করে আউট হলেন ঠিকই, তবে প্রথম ৩০ ওভারে ১৩৫ রান তোলা বাংলাদেশকে পাঠানোর চেষ্টা করলেন ৩১৪ রানের গন্তব্যে। পরে প্রমাণ হলো, জিততে গেলে ওই রানটাই দরকার ছিল। কারও না কারও বেপরোয়া হওয়ারই দরকার ছিল।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৬ বছর কাটিয়ে দেওয়ার পরে সাকিবের সবচেয়ে বড় মাহাত্ম্যটা বোধ হয় এখানেই লুকিয়ে। হাজারটা দায়িত্বশীলের ভিড়ে বেপরোয়া হওয়ার সাহস তিনিই করেছিলেন।
সম্মানজনক পরাজয় নয়, এই লোকটা জিততে চেয়েছিলেন।