নিউ জিল্যান্ডের মসজিদে বন্দুক হামলার ঘটনায় কাঁদছে পুরো দেশ। সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় দেশগুলোর অন্যতম এই কিউইরা বরাবরই অসম্প্রদায়িক, শ্রদ্ধাশীল প্রতিটি ধর্মের প্রতি। তাই তো ন্যক্কারজনক এই ঘটনার পর সেখানকার মুসলিমদের নিরাপত্তা দিতে সরব হয়েছে সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও। কাঁদছে তাদের ভাইদের জন্য। দল বেঁধে হাতে হাত ধরে নামাজের সময় পাহারা দিচ্ছে মসজিদের আঙিনা। সব মিলিয়ে এই দুঃখের মাঝেও নিউজিল্যান্ডের এসব উদ্যোগগুলো প্রশংসিত হয়েছে বিশ্বজুড়ে।
তবে যারা ক্ষতিগ্রস্থ, তারাই শুধু বুঝতে পারেন, সাধারণ জীবনে ফিরে আসাটা সহজ হবে না। হামলায় আহত ব্যক্তি কিংবা নিহতদের পরিবারের সদস্যরা ঠিক কবে আবারও আত্মবিশ্বাসের সাথে হেসেখেলে বেড়াবেন, তা নিয়ে সংশয় আছে। সংশয় ছিল, বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের নিয়েও। যারা কি না নিউজিল্যান্ডের সেই ক্রাইস্টচার্চ হামলার মুখ থেকে কোনোরকমে বেঁচে ফিরেছেন।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ক্রিকেটারদের খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা চলছে বটে, কিন্তু মন পড়ে আছে সেই ভয়াল মুহূর্তের কাছে। তামিম ইকবাল-মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা সেদিনের কথা ভুলতে পারবেন না কখনোই। কিন্তু আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতার সেই সময়ে পাওয়া মানসিক আঘাত থেকে বের হতে হলে ক্রিকেটই একমাত্র পথ। সতীর্থরাও চেষ্টা করছে সৌম্যদের সেই খারাপ অবস্থা থেকে বের করে আনতে। তাই তো জোর দিচ্ছে ক্রিকেটে ফেরানোর। কারণ ক্রিকেটই একমাত্র পথ, যেখানে সবকিছু ভুলে থাকা সম্ভব।
১.
ক্রাইস্টচার্চ হামলার মুখে পড়ে বেঁচে ফেরা জাতীয় দলের অনেক ক্রিকেটারই ক্রিকেটে ফিরতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ৫০ ওভারের লিস্ট ‘এ’ লিগ ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের মাধ্যমে পেশাদার ক্রিকেট শুরু করছেন তারা। লক্ষ্য, ভয়াল দুঃস্মৃতিকে ভুলে থাকার চেষ্টা করা।
শুরুটা হয়েছে জাতীয় দলের ওপেনার সৌম্য সরকারকে দিয়ে। আবাহনী লিমিটেডের অনুশীলনে তাকে দেখে চমকে উঠেছিলেন অনেকে। সবাই ভেবেছেন, সৌম্যরা এখন পরিবারকেই সময় দেবেন। কারণ তারা যে মৃত্যুকূপ থেকে ফিরেছেন, সেখানে ৪৯ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
যদিও সৌম্যকে এই অবস্থায় ক্রিকেটে ফেরানোর পুরো কৃতিত্বটা কেবলই মাশরাফি বিন মুর্তজার। ওপেনার সৌম্যর ভাবনা, মাশরাফির কিছু কথা তাকে এতো দ্রুত ক্রিকেটে ফেরানোর সুযোগ করে দিয়েছে। নিউজিল্যান্ডের সেই ঘটনাকে মনে করিয়ে দিয়ে সৌম্য বললেন,
‘যখনই আমি বাসায় একা থাকি, তখনই ওই ঘটনাগুলো মনে পড়ে। যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।’
মাশরাফি এ বিষয়ে বলেছেন,
‘আমার কাছে মনে হয়েছে, তাদের (আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন যেসব ক্রিকেটার) এই মানসিক ট্রমা থেকে বের করে আনার সবচেয়ে সেরা উপায় হলো ক্রিকেটে ফেরা। কারণটা হলো, আপনি যদি দেখেন, এই ধরণের সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার আলাদা কোনো উপায় আসলেও নেই। সে কারণেই আমি সৌম্যকে ডিপিএলের ক্যাম্পে যোগ দিতে বলেছি। যদিও সিদ্ধান্তটা তাকেই নিতে হবে।’
এরই মধ্যে সৌম্য আবাহনীর হয়ে খেলা শুরু করেছেন। এখন পর্যন্ত দুই ম্যাচে মাঠে নেমে ৩৩ ও ৩৬ রানের দু’টি ইনিংস খেলেছেন, উইকেটে নিয়েছেন একটি।
বিসিবি সূত্রে জানা গেছে, অন্যান্যরাও ধীরে ধীরে ক্রিকেটে ফেরা শুরু করবেন। সেই শুরুটা হবে ঢাকা লিগের মাধ্যমেই। এর আগে দেশে ফেরার পরই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন দলের সদস্যদের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর পরামর্শ দেন। পুরো দলকে আপাতত ক্রিকেট থেকে বাইরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।
২.
নিউজিল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ খেলছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। গত ১৬ মার্চ অনুষ্ঠেয় তৃতীয় টেস্টের আগে অনুশীলন শেষে জুম্মার নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মেহেদী হাসান মিরাজ, সৌম্য সরকারসহ আরও বেশ কয়েকজন। মসজিদের খুব কাছে থাকা অবস্থায় তারা বাসের ভিতর থেকে টের পান, মসজিদে গোলাগুলি হচ্ছে। একজন নারী তাদেরকে মসজিদে ঢুকতে নিষেধ করেন। ওই ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন ক্রিকেটাররা। দেখেছিলেন, কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছিল মসজিদে আসা মানুষ।
সেদিন কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছিলেন তামিমরা। হোটেলে ফিরে কেঁদেছিলেন সতীর্থদের জড়িয়ে ধরে। পুরো দলের সঙ্গে ছিল না কোনো নিরাপত্তা। ঘটনার পরপরই দ্রুত দেশের বিমান ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে দলকে স্বাগত জানান বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। তখনই তিনি ক্রিকেট থেকে আপাতত দূরে থাকতে বলেন সবাইকে। এই মুহূর্তে দলের বেশিরভাগ সদস্য যেমন পরিবারকেই সময় দিচ্ছেন, তেমনই সৌম্য’র মতো অনেকেই ক্রিকেটে ফেরা শুরু করছেন।
টেস্ট দলের নতুন সদস্য সাদমান ইসলামও ছিলেন নিউজিল্যান্ড সফরে। তাঁর বাবা শহীদুল ইসলাম চাকরি করেন বিসিবির ডেভলাপমেন্ট কমিটিতে। তিনিও মনে করেন, বাসায় বসে থাকলে ছেলেরা আরও বিপাকে পড়বে। ক্রিকেটে ফেরাটাই হবে উত্তম সমাধান।
ছেলের প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,
‘আমি তাকে দ্রুত ক্রিকেটে ফিরতে বলেছি। বাড়িতে থাকলে তাদের মানসিক চাপ আরও বাড়বে। কারণ বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরা আসছেন, তারা বারবার ছেলেদের ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছেন, যা তাদের ট্রমাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এগুলো তারা আর নিতে পারছে না, অস্বস্তিতে ভুগছে। ক্রিকেটে ফিরলে হয়তো ঘটনাগুলো ভুলে থাকা তাদের জন্য সহজ হবে।’
ভুলে থাকার চেষ্টায় সাদমানও শেষ পর্যন্ত মাঠে নেমেছেন। শাইনপুকুরের হয়ে একটি ম্যাচও খেলেছেন এর মধ্যে। তবে সাদমানের মাঠে ফেরা নিয়ে শঙ্কা ছিল অন্য কিছুতে, কোমরের চোট নিয়ে ভুগছিলেন তিনি।
মাঠে ফেরার আগে বলেছিলেন,
‘আমি এখনও জানি না, আমি মাঠে নামতে পারবো কি না। কারণ আমি কোমরের চোট নিয়ে ভোগান্তিতে আছি। তবে আমি ক্রিকেটে ফেরার জন্য মুখিয়ে আছি। আমার কাছে মনে হয়, ক্রিকেটই এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু।’
৩.
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল দেশে ফিরে নিউ জিল্যান্ড নিয়ে সবচেয়ে বড় যে সমালোচনাটা করেছে, তা হলো নিরাপত্তা। তারা জানিয়েছে, কেবল নিউজিল্যান্ড নয়, পশ্চিমা বিশ্বের কোনো দেশেই তাদের জন্য নিরাপত্তা থাকে না বললেই চলে। যে কারণে দেশগুলোতে খেলতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।
ক্রিকেটারদের অভিযোগের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন বিসিবি প্রধানও। বাংলাদেশ অতিথি দলগুলোকে যে ধরনের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে, তার সিকিভাগও যদি বাংলাদেশ সফরকালীন সময়ে পায়, সেটাও অনেক বড় ব্যাপার হবে বলে তিনি মনে করেন। ক্রিকেট বিশ্বের প্রতি তিনি এ ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।
এদিকে তৃতীয় টেস্ট ঠিক কবে আবারও গড়াবে, তা নিয়ে চলমান অবস্থায় নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে নিউজিল্যান্ডের পক্ষ থেকে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ দল আবারও নিউজিল্যান্ডে সফর করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন নিউজিল্যান্ডের ক্রীড়ামন্ত্রী গ্র্যান্ট রবার্টসন।
তিনি বলেছেন,
‘নিউ জিল্যান্ড ও বাংলাদেশ ক্রিকেট দল, এবং আমাদের দুই দেশের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক, তা কোনো ব্যক্তির হিংসা আর ঘৃণায় ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। আমি আশা করি, সময় গড়ানোর সঙ্গে বাংলাদেশ দল এবং তাদের সমর্থকেরা নিউজিল্যান্ডে ফিরতে নিরাপদ বোধ করবে। আমি জানি, তারা এটাও মনে করবে, নিউজিল্যান্ডে তাদেরকে দু’হাত বাড়িয়েই বরণ করে নেওয়া হবে।’