দ্য কিউই ক্রিকেট স্টাইল

নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট বুঝি বেঁচে নেই আর। নামতে নামতে র‍্যাঙ্কিংয়ের তলানিতে গিয়ে হয়েছে অবস্থান। লাল বল আর সাদা পোষাক বা রঙিন পোষাকের সাদা বলের ক্রিকেট। আশান্বিত হওয়ার মতো কিছু নেই কোথাও। হাল ছেড়ে দিয়েছেন রস টেলর — শুধুমাত্র টেস্ট ক্রিকেটের অধিনায়ক হতে অস্বীকৃতি তার। দায়িত্বের ভার কাঁধ পেতে নিয়েছেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। আর শুরুটা কী ভয়াবহ! ৪৫ রানেই অলআউট। অর্ধশতকেরও বেশি সময় পর এই লজ্জা।

সময় এগিয়ে চলে, মানুষ এগিয়ে যায়, অথচ নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট বুঝি কেবলই পেছায়। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই কবে ১৯৪৬ সালে ৪২ রানে অলআউট হয়েছিল, দ্বিতীয় পালায় করেছিল সাকুল্যে ৫৪ রান। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় সারির দলটা ৮ উইকেটে ১৯৯ রানে ঘোষণা দিয়েছিল ইনিংস, তবু দেড় দিনেই ম্যাচের পরিসমাপ্তি। ঐ একটি ম্যাচের পর অস্ট্রেলিয়া প্রায় আড়াই যুগ বা দশ হাজারেরও বেশি দিন নিউ জিল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেট খেলেনি আর। ১৯৭৪ সালে গিয়ে দ্বিতীয়বার অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পায় নিউ জিল্যান্ড। ইংল্যান্ড অবশ্য অমন ‘কঠোরতা’ দেখায়নি, ১৯৫৫-এর কিউই ক্রিকেট গ্রীষ্মে নিউ জিল্যান্ডকে চূড়ান্ত লজ্জা উপহার দিয়েছিল ইংল্যান্ড। অকল্যান্ড টেস্টের প্রথম ইনিংস শেষে মাত্র ৪৬ রানে এগিয়ে থাকা লেন হাটনের দল ম্যাচটা জিতে নেয় ইনিংস ও এক কুড়ি রানে। নিউ জিল্যান্ডের ২৬ রান — এখনো পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বনিম্ম দলীয় স্কোর।

দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন যেন গর্ত খুঁড়ে লজ্জা বের করে এনেছে সেদিন! কেপটাউনের নিউল্যান্ডস-এর ‘ভূতুড়ে পিচ’ নামে খ্যাতি আছে। একদিনেই ২৩ উইকেটের পতন দেখেছে তা। কিন্তু নিউ জিল্যান্ড তেমন কিছু দেখাতে পারে না। দিনশেষে দক্ষিন আফ্রিকার স্কোর দাঁড়ায় ২৫২/৩। আর তখনই নিউ জিল্যান্ডের টিম ম্যানেজমেন্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, এভাবে আর চলতে পারে না। এবার কিছু একটা করা দরকার। সেই ‘কিছু একটা’ এমনই দাঁড়ায় যে, পরের কয়েক বছরে তারা পরিণত হয় বিশ্বের অন্যতম দাপুটে ক্রিকেট শক্তিতে, এবং সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়ে নিউ জিল্যান্ড পায় ক্রিকেট বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও সম্মাননা।

ম্যাককালাম ও উইলিয়ামসন। নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের পরিবর্তন যাদের হাত ধরে; Image Source: Getty Images

*****

কেপটাউনের এক হোটেল রুমে ড্রিংকসের ক্যান হাতে বসেছেন ম্যাককালাম। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার, অধিনায়কত্বের শুরুটা এত জঘন্য হয়েছে। নিউল্যান্ডসের ফকফকা রোদে বীভৎস এক দুঃস্বপ্ন দেখেছেন তিনি। ঘুম ভাঙলেই দুঃস্বপ্ন কেটে যাবে সে সুযোগ নেই; কারণ এই দুঃস্বপ্নই কেড়ে নিয়েছে তার ঘুম। দরজায় ‘ঠক ঠক’ করছে কেউ। অনুমতি পেয়ে ঢুকলেন মাইক হেসন, নিউ জিল্যান্ডের হেড কোচ। একটু পর এলেন দলের ম্যানেজার, তারপর সহকারী কোচ। চারটি মস্তিষ্ক নিবিড় পরিকল্পনায় মগ্ন; তারা নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের দুঃস্বপ্নের চূড়ান্ত সমাপ্তি চায়।

‘তুমি যদি গতানুগতিক নেতৃত্ব দিতে চাও, তাহলে কোনো কথা নেই। কিন্তু নেতৃত্বের ছাপ যদি রেখে যেতে চাও, তাহলে এখনই সময়। তোমাকেই ঠিক করতে হবে, তুমি ‘যেমন চলছে চলুক না’ বলে কাজ চালিয়ে যাবে, নাকি একটা সমাধানে পৌঁছাবে।’

ম্যাককালামের প্রতি মাইক হেসনের স্পষ্ট বার্তা — বাছা, নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ঠিক করার মহান দায়িত্ব পেয়েছো তুমি। হেলায় হারিয়ো না। 

ম্যাককালাম করণীয় ঠিক করে নেন। তার আগেই তারা সবাই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন, এখন তাদের অবস্থান ‘শূন্য’ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, পিছিয়ে যাওয়ার আর কিছু নেই। এবার এগুতে হবে।

*****

নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট দল তো আর কোনো ব্যক্তি মানুষের সম্পত্তি নয়। বরং তা জনগণের। যদি কোনো অধিনায়ক তার মতো করে দলটাকে গড়ে তোলেন, তাহলে তার একটা প্রভাব পড়ে সত্যি, কিন্তু দলটা তো আর ঠিক জনগণের হয়ে উঠে না। নিউ জিল্যান্ডে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা রাগবি। বাস্কেটবল, নেটবল এমনকি ফুটবলও বেশ পছন্দ করে দেশবাসী। ২০১০-এর ফুটবল বিশ্বকাপে নিউ জিল্যান্ডের অংশগ্রহণ তো রীতিমতো বিপ্লবই বলা যায় সে দেশের ফুটবলে। বাস্কেটবল, নেটবলে বৈশ্বিক সাফল্য ধরা দেয় প্রায়ই, রাগবিতে তো বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দলই বলা যায়। ঝুলিতে আছে একাধিক বিশ্বচ্যাম্পিয়নের তকমা। এত জনপ্রিয় খেলার ভিড়ে ক্রিকেট যদি অবস্থান করে নিতে চায়, তাহলে শুধু বিশ্বক্রিকেটে সাফল্য পেলেই হবে না, দলটাকে ধারণ করতে হবে নিউ জিল্যান্ডবাসীর চরিত্রও। তা চরিত্রটা কেমন? জনগণের চরিত্র প্রতিফলিত হয়, এমন কিউই ক্রিকেট কীভাবে সম্ভব?

সত্তরের দশকে নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট ইংলিশ ক্রিকেট কাঠামো ও স্টাইল অনুসরণের চেষ্টা করত। নব্বই দশক ও এই শতাব্দীর সূচনায় সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট-উত্থানে তারা প্রতিবেশী দেশের ক্রিকেট চরিত্র ধারণের চেষ্টা করে। কিন্তু কেমন খাপছাড়া মনে হয় তা। নিজেদের সঙ্গে খাপ খায়, একদম নিজস্ব, যা কি না পুরো নিউ জিল্যান্ডকেই প্রতিনিধিত্ব করবে তেমন ক্রিকেট চরিত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান ম্যাককালাম। দলটা তার নয়, বা মাইক হেসনের নয়, কিংবা নতুন কোনো অধিনায়ক এলে তারও হবে না। দলটা সবসময় নিউ জিল্যান্ডের জনতার প্রতিনিধিত্ব করবে, সুতরাং তেমন কোনো চরিত্র হওয়া চাই। একেকজন একেক রকম  মত দেন। কঠোর পরিশ্রমী, বিনয়ী, উদারচেতা, উদ্ভাবনী… নানান মডেল ভেসে আসে। কিন্তু নিউ জিল্যান্ড এমন কোনো রুপকথার রাজ্য নয় যে, এখানে সব কেবল ইতিবাচকতাই ভিড় করে আছে। ভালো-মন্দ মিলেমিশে আছে এখানে। তাহলে দলটা হয়ে উঠবে এমন — যারা ক্রিকেট মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাড় দেবে না একরত্তি। কিন্তু প্রতিপক্ষের জন্য বরাদ্দ রাখবে সর্বোচ্চ সম্মান। নিজেদের কাজে কোনো ফাঁকি দেবে না, প্রতিপক্ষ তার চেয়েও ভালো কাজ উপহার দিলে তাতে মনঃক্ষুন্ন হবে না মোটেও। বাহবার করতালিতে উপভোগ করবে তা। তাই বাংলাদেশের কাছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে হেরে সেমিফাইনাল থেকে বাদ গেলেও মন খারাপের বালাই নেই। যোগ্য দল হিসেবেই জিতেছে বাংলাদেশ — অকপট স্বীকৃতি নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের।

কোনো ধার করা ব্যাপার নয়, স্বকীয় ও আপন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চরিত্রই হয়ে উঠে — কিউই ক্রিকেট স্টাইল।

জনতাকে প্রতিনিধিত্ব করা ‘কিউই ক্রিকেট স্টাইল’ লুফে নেয় মানুষ। রানার্সআপ হলেও উষ্ণ অভ্যার্থনা; Image Source: Dean Rowland/Getty Images  

*****

কোনো দলে যদি নেতার প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিতই না হয়, তাহলে দলটায় নেতার অবদান ‘ঘন্টা’। ব্যক্তিত্ব ও কর্তৃত্বে যিনি যত দাপুটে, তার দলও ততই প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠে। ম্যাককালাম জানেন তা। তাই সতীর্থদের জন্য তিনি মন্ত্র ঠিক করেন,

‘যখনই তুমি নিউ জিল্যান্ডের জার্সি গায়ে মাঠে নামছো, তা বিশ্বের যে প্রান্তেই হোক — ভুলে যাও তোমার স্কোরকার্ড কী বলছে, দেখার প্রয়োজন নেই ম্যাচের পরিবেশ ও পরিস্থিতি। মাথায় গেঁথে রাখো একটাই ব্যাপার — নিউ জিল্যান্ড এই গ্রহের সেরা দল, এবং তুমি এই দলটাকে প্রতিনিধিত্ব করছো। তোমার আচরণে, হাঁটা-চলা-বলা সবটাতে তুমি গোটা দুনিয়াকে স্পষ্ট জানিয়ে দেবে, এই ভূখন্ডে সবচেয়ে ভালো ক্রিকেট খেলে এই দলটাই।’

মাইক হেসন বুঝতে পারেন, দলটা স্বার্থপর কিছু ক্রিকেটারে ভারী হয়ে গেছে। সুতরাং হালকা করতে হবে, পরিবর্তে দলে ভেড়াতে হবে নিবেদিত ও দায়িত্ববান ক্রিকেটার। ৩০-৪০ রান করে বা দুটো উইকেট নিয়ে বা একটা স্পেল ভালো করে তুমি যদি ভেবে থাকো দলে তোমার জায়গা পাক্কা, তাহলে অন্য পথ দেখো। এই দলটা তাদের জন্য, যারা মাঠে নামবে নিজের সেরাটা উজার করে দিতে।

ফিল্ডিংয়ে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দেন ম্যাককালাম। চুল পরিমাণ ছাড় দিতেও নারাজ তিনি। প্রায় সময় দেখা গেছে, বলের পিছু পিছু ছুটছেন তিনি, বাউন্ডারির আগে আগে শেষ মুহূর্তে নিজের শরীরটাকে ভাসিয়ে দিয়েছেন হাওয়ায়, চিতার ক্ষিপ্রতায় সীমানাদড়ি ছুঁতে যাওয়া বলটাকে এপাশে রেখে তিনি চলে গেছেন ওপাশে। নিশ্চিত চারটা হয়ে গেছে তিন বা দুই রান। অবিশ্বাস্য ক্যাচ নিয়েছেন অতিমানবীয় দক্ষতায়, যেন কোনো জিমন্যাস্টিক শো। ম্যাককালামের সময়ে অবিস্মরণীয় বহু ম্যাচ নিউ জিল্যান্ড উপহার দিয়েছে। তার স্থির বিশ্বাস — সেই সময় ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং সব বিভাগেই দলটা কেবলমাত্র অতি আক্রমণাত্মক ক্রিকেটই খেলেনি, স্রেফ ‘ইনসেইন’ পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।

ম্যাককালামের ক্ষ্যাপাটেপনা তিনি পুরো দলের মধ্যে সঞ্চারে সক্ষম হয়েছিলেন, দলটা যেন হয়ে উঠে নেতার প্রতিচ্ছবিই!

ম্যাককালামের প্রতিপক্ষের স্বস্তি নেই মোটেও; Image Source: Phil Walter/Getty Images 

*****

ব্রেন্ডন ম্যাককালামের নেতৃত্বে ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে আধুনিক ক্রিকেটের অবিসংবাদিত ‘ডন’ কুমার সাঙ্গাকারা পান উষ্ণ অভিবাদন। সাঙ্গাকারার দ্বিশতকের পরও ম্যাচটা নিউ জিল্যান্ড জেতে ১৯৩ রানের বিশাল ব্যবধানে। একটু একটু করে কিউই ক্রিকেটের নিজস্ব মডেল বিশ্বক্রিকেটের মনোযোগ কেড়ে নিতে সক্ষম হয়।

ফিলিপ হিউজের সংবাদ শুনে বিমূঢ় হয়ে পড়ে পুরো দল। ক্রিকেট মাঠে নামার সমস্ত শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে সবাই।    

দ্য শো ইজ মাস্ট গো অন। একজন প্রস্তাব রাখে, আমরা কিছুতেই ইচ্ছাকৃত কোনো বাউন্সার দেবো না। ম্যাচে আর কোনো বাউন্সার পায়নি পাকিস্তান। মধ্যপ্রাচ্যে পাকিস্তান তখন একপ্রকার অপরাজেয়। আবুধাবিতে প্রথম টেস্টে নিউ জিল্যান্ড হেরেছে ২৪৮ রানের বিশাল ব্যবধানে। দুই ইনিংস মিলিয়ে পাঁচ উইকেটের বেশি নিতে পারেনি। শারজার দ্বিতীয় টেস্টে সেই পাকিস্তানকেই রীতিমতো পর্যদুস্ত করল ম্যাককালামের দল। ওভারত প্রতি প্রায় পাঁচ (৪.৮১) রান তুলে ৬৯০ রানের বিশাল চূড়ায় চড়ে বসে, পাকিস্তানকে উপহার দিল ইনিংস ও ৮০ রানের পরাজয়। ১৮৮ বলে ২০২ রানের বিধ্বংসী ইনিংসে ম্যাককালাম নেতৃত্ব দিলেও উইলিয়ামসনও কম যাননি, ২৪৪ বলে ১৯২ করেছিলেন তিনি।

ম্যাককালামের পর অবধারিতভাবে নেতৃত্বের বাহুবন্ধনী পরেন কেন উইলিয়ামসন। ম্যাককালামের গড়ে দেওয়া ‘কিউই ক্রিকেট স্টাইল’ যদি রক্তমাংসের কেউ হয়, তাহলে বোধহয় তা কেন উইলিয়ামসনই হবেন। সামর্থ্যের সবটা দিয়ে লড়াই করে যদি পরাজয় জোটে, তবুও আক্ষেপ কিছু নেই। সেটা যদি হয় বিশ্বকাপ ফাইনাল, তাতেও চিন্তায়-দর্শনে-বিশ্বাসে নেই আহামরি কোনো রদবদল। ভাগ্যের ফেরে প্রতিপক্ষের ব্যাটে লেগে অতিরিক্ত ‘চার রান’ জমা হয়, নিজের দিক থেকে শতভাগ উগরে দেয়া, শুধুমাত্র বিদঘুটে নিয়ম বা নিয়তির পরিহাসে বিশ্ব শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরা হয় না — তাও তেমন কোনো অভিযোগ নেই। দুঃখ-বেদনা-কষ্ট যা-ই থাক, তা চেপে প্রতিপক্ষের জন্য উষ্ণ করতালিতে কার্পণ্য নেই কিছুমাত্র। কিউই ক্রিকেট স্টাইল — কেবলমাত্র মুগ্ধই করে না, বিস্মিতও করে। অবাক আনন্দ-শ্রদ্ধায় অর্জন করে সসম্ভ্রম কুর্ণিশ।

ব্যাকফুট পাঞ্চ। তাতেও দারুণ নমনীয়, বুঝি বল আর্তনাদ করবে; Image Source: Hagen Hopkins/Getty Images

*****

নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটে আগ্রাসন, আক্রমণ, আত্মবিশ্বাস জুড়েছিলেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। তবে ধারাবাহিকভাবে বিশ্ব ক্রিকেটে দাপট দেখাতে যে স্থৈর্য, দক্ষতা ও মানসিকতা প্রয়োজন, তা যেন উইলিয়ামসনেই পুরোমাত্রায় বিরাজমান। সেই কৈশোর থেকে নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ তিনি, মার্টিন ক্রো বহু আগেই বলে রেখেছিলেন — এই ছেলে একদিন নিউ জিল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান হবে। উইলিয়ামসনের আগ পর্যন্ত সে দেশের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান ছিলেন মার্টিন ক্রো — যিনি আবার স্বদেশের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট মস্তিষ্কেরও মালিক ছিলেন। উইলিয়ামসন ইতোমধ্যে অগ্রজকে ‘ঠিক’ প্রমাণ করেছেন ব্যাটসম্যানশিপে, জীবদ্দশায় কিঞ্চিৎ তা দেখেও গেছেন ক্রো। কিন্তু কিউই অধিনায়কের ক্রিকেট-মস্তিষ্কের অসাধারণত্ব খুব একটা দেখে যেতে পারেননি; ক্রো নিশ্চয়ই গর্ববোধ করতেন, তার ব্যাটসম্যানশিপের মতো ক্রিকেট মগজেও তাকে উইলিয়ামসনের টেক্কা দেয়া দেখে।

ম্যাককালামের খুনে মেজাজ। প্রতিপক্ষকে ক্ষুধার্ত বন্য নেকড়ের মতো ছিঁড়ে-খুড়ে খাওয়াতেই যেন সমস্ত আনন্দ। ২০১৫-এর বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটাতে ২২৬ বল হাতে রেখে ম্যাচ জিতল নিউ জিল্যান্ড। টিম সাউদির ক্যারিয়ার বেস্ট ৩৩ রানে ৭ উইকেটের ফলে ইংলিশ ব্যাটিং ১২৩ রানেই গুটিয়ে যায়। ম্যাককালামের ২৫ বলে ৭৭ রানের টর্নেডো-ইনিংসে ১২ দশমিক ২ ওভারেই খেলা শেষ। ম্যাককালাম বলেন,

‘ছেলেবেলা থেকে ঠিক এইরকম ক্রিকেটই আমি খেলতে চেয়েছি।’

তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে শুধু হারাবেই না, ওদের বিশ্বাস-অহং-সক্ষমতা সমস্ত ধূলিস্মাৎ করে দেবে। সেবার গোটা বিশ্বকাপ জুড়ে নিউ জিল্যান্ড খেলেছে অমন আক্রমণাত্মক ক্রিকেট। সাউদি প্রায় দেখতেন তার আট-নয়জন সতীর্থ তার খুব কাছেই ফিল্ডিং করছে, রঙিন পোষাকের ক্রিকেটেই। চার-পাঁচটা স্লিপ তো সাধারণ ব্যাপার। ম্যাককালামের মতো আক্রমণাত্মক মানসিকতা ধারণ করেন কেন উইলিয়ামসনও। তবে তাতে আছে নমনীয়তা ও কোমলতার নান্দনিক ছোঁয়া। তিনিও প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে দেন, কিন্তু তাতে অমন খুনে ও বন্য মেজাজ পরিলক্ষিত হয় না।

বিশ্ব টি-টোয়েন্টির প্রথম ম্যাচ স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে। একাদশে নাথান ম্যাককালাম, মিচেল সান্টনার, ইশ সোধির মতো তিন স্পিনার রেখে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিলেন কিউই অধিনায়ক। সাউদি-বোল্ট জুটি বেঞ্চে, একজনমাত্র ফাস্ট বোলার — অ্যাডাম মিলনে। নাগপুরের স্লো টার্নিং উইকেটে ভারতকে মাত্র ৭৯ রানে অলআউট করে দিয়ে উইলিয়ামসন জানিয়ে দিলেন, তিনিও প্রতিপক্ষকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে ওস্তাদ, শুধু পদ্ধতিটা ভিন্নমাত্র।

কিউই ক্রিকেট স্টাইল-যার হাত ধরে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির পথে; Image Source: ICC

*****

নিউ জিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেট পিচ ধীর প্রকৃতির ছিল, পরিবেশের কারণেই দ্রুতগতির বোলার বেরিয়ে আসত না সেখান হতে। ব্যাটসম্যানরাও ছিলেন পিচ-পরিস্থিতির মতো। কিন্তু বৈপ্লবিক রূপান্তর এলো ঘরোয়াতে। উইকেটগুলো হয়ে উঠলো বাউন্সি ও ফাস্ট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের বেতনভাতা সংক্রান্ত চুক্তি নিয়েও কাজ হলো। ফলে ক্রিকেট আর সেভাবে অনিশ্চিত ক্যারিয়ার হিসেবে থাকল না সেখানে। দ্রুতগতির বোলার, মারদাঙ্গা ব্যাটসম্যানে ভরপুর হয়ে উঠল নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট। কাইল জেমিসনের মতো দীর্ঘদেহী একজন — যিনি অন্য যেকোনো খেলাকে বেছে নিতে পারতেন, বরং বাস্কেটবল বা রাগবির মতো ক্রীড়াক্ষেত্র আদর্শ মানা হয় জেমিসনদের মতো মানুষের জন্য। নিউ জিল্যান্ডে ক্রিকেট বদলে গেছে অনেকটাই, কিউই ক্রিকেট স্টাইল সেদেশের মানুষের মন কেড়ে নিয়েছে দারুণভাবে। মানুষ এখন ক্রিকেটে আগ্রহ পায়, নিজেদের খুঁজে পায়, বিনোদিত হয়, যেমনটা উপভোগ করে রাগবি বা অন্য খেলা।

স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের নেতৃত্বে একটা সোনালী প্রজন্ম এসেছিল নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটে। ক্রিস কেয়ার্নস, শেন বন্ড, নাথান অ্যাস্টল, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি, স্কট স্টাইরিস, ক্রেইগ ম্যাকমিলান… দুর্দান্ত প্রজন্মের সর্বোচ্চ উপযোগ নিতে ব্যর্থ হয় তারা। তবে টিম সাউদি, কেন উইলিয়ামসন, ট্রেন্ট বোল্ট, মিচেল সান্টনার, টম ল্যাথাম, নিল ওয়াগনার, বিজে ওয়াটলিংদের নিয়ে গড়া এবারকার সোনালী প্রজন্ম নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট ইতিহাসেরই শ্রেষ্ঠতম দল, সন্দেহাতীতভাবেই।

বিশ্বমানের ব্যাটিং লাইনআপ তাদের। দলটা প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ভারসাম্যপূর্ণ। বোলিংয়ে চমৎকার বৈচিত্র্য; বোল্ট-সাউদি-ওয়াগনার ত্রয়ীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কাইল জেমিসন। কনওয়ের মতো একজন ক্ষ্যাপাটে জুড়েছেন দলে, যিনি ক্রিকেটের জন্য সমস্ত বাজি রাখতে পারেন। উন্মাদপ্রায় ওয়াগনার দলের জন্য নিংড়ে দেন সর্বস্ব, পায়ের ভাঙা আঙুল নিয়েও একটানা বোলিং করে যান ক্লান্তিহীন।

‘ও একটা আস্ত পাগল। একদম অন্যরকম একজন। যে লড়াইটা সে উপহার দিয়েছে, যে আগ্রাসন সে দেখিয়েছে তা এককথায় অসাধারণ।’

প্রতিপক্ষের পরাজিত অধিনায়কের কণ্ঠেও স্তুতিবাণী। রিজওয়ানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আজহার আলীও বলেন,

‘হ্যাটস অফ। সে যা করেছে তা অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। আপনি যখন আপনার দেশের জন্য খেলবেন, এভাবেই খেলা উচিৎ।’

কৃতজ্ঞ কণ্ঠে কেন উইলিয়ামসনও দেন ধন্যবাদ,

‘ওর হৃদয়টা অনেক বড়। দল ও দেশের জন্য সব করতে পারে সে।’

ওয়াগনার নন শুধু, ল্যাথাম-ওয়াটলিং-টেলর সবাই প্রয়োজনের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যান সামর্থ্যের সবটা দিয়ে। দ্য কিউই ক্রিকেট স্টাইল — হারার আগে কিছুতেই হার মানা যাবে না।

নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের পেস চতুষ্টয়; Image Source: ESPNcricinfo

*****

গত দু’বারের রানার্সআপ তারা। প্রথমবারের মতো আয়োজিত টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুটও তাদের মাথায়। কান পাতলেই মৃদু গুঞ্জন, ক্ষীণ ফিসফাস, কখনো ঘোমটা ছেড়ে বেশ জোরগলায়ও আওয়াজ উঠে — দলটা আদতেই এতটা যোগ্য কি না? ভাগ্যের সহায়তায় অমন চূড়ায় উঠল কি না? গড়পড়তা একটা দল নেহায়েৎ ভাগ্য-টাগ্য পেয়ে ‘অতি-আলোচনা’ ও ‘অতি-কদর’ পাচ্ছে কি না?

কিউই ক্রিকেট স্টাইল — কার্যপদ্ধতি যথাযথ রাখতে পারলেই খুশি। অর্জন, স্বীকৃতি তাতে যদি জোটে, তাহলে তা উপভোগে যেমন আনন্দ, ঠিক তেমনি সাফল্য যদি ধরা না দেয়, তাতেও ক্লেদ নেই খুব একটা। প্রতিপক্ষের জন্য, ক্রিকেটের জন্য সম্মান ও নিবেদন যেন ঠিক থাকে। নিজেদের কাজে কোনো ফাঁকি থাকা চলবে না।

যে সময় তুমি স্লেজিং বা প্রতিদ্বন্দ্বিকে উত্যক্ত করার পেছনে দেবে, সে সময়টা বরং নিজের দক্ষতার উন্নতিতে দাও। তোমার ব্যাটিং ভালো হবে, বোলিং ভালো হবে, ফিল্ডিং ভালো হবে। অন্যের পেছনে না লেগে, অন্যের পেছনে সময় ব্যয় বাদ দিয়ে তুমি বরং নিজের পেছনে সময় দাও। আখেরে কাজে দেবে। পূর্বসূরী ম্যাককালামের মতো কেন উইলিয়ামসনও তাই ভাবেন। স্লেজিংয়ের মতো বাজে ব্যাপার আর নেই। ক্রিকেট নিছক খেলামাত্র, সেখানে কেন শুধু শুধু অন্যকে বিরক্ত করা। তার চেয়ে বলটাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিলেই হয়; এমন বাউন্সার দাও, বল তার নাকের পাশ দিয়ে হুঙ্কার ছেড়ে যাক, কানে কানে ভয় ঢুকিয়ে দিক। ব্যাটে এমন দোল তোলো, বোলার তোমার সামনে বল ফেলার জায়গা যেন খুঁজে না পায়।

ফলোথ্রুতে বোল্ট মুচকি হেসে চলে যান। চোখে চোখে শাসানোর কিছু নেই। উইলিয়ামসন ব্যাটিংয়ে মোলায়েম পরশ বুলান। সাউদি শাণিত করেন নিজেকেই। সান্টনার নিখুঁত হতে চান আরো। জেমিসন প্রত্যাখ্যান করেন কোহলি বরাবর ডিউক বলে বোলিংয়ের প্রস্তাব — তা সে দেশের লিগ তাকে যত বিত্তবানই করে দিক। কান্ট্রি ফার্স্ট।

অর্জনের আনন্দ; Image Source: ICC 

কিউই ক্রিকেট স্টাইল — দল ও দেশের জন্য চূড়ান্ত নিবেদিত। নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে পুরোপুরি আপোষহীন। ক্রিকেট ও খেলাধুলার মহান সৌহার্দ্যবোধে দাগ দেয়া যাবে না। খেলাটাকে খেলার মতোই খেলতে হবে, আনন্দ ও সম্মানের সঙ্গে; তবে কর্তৃত্ব প্রকাশে বিন্দুমাত্র ছাড় নেই।

এই ‘কিউই ক্রিকেট স্টাইল’ অনুসরণ করেই তলানি থেকে দলটার অবস্থান এখন শীর্ষে। সুউচ্চ চূড়া থেকে অবনমন হতে পারে যেকোনো সময়, অন্য কেউ নিতে পারে সে স্থান; কিন্তু স্বকীয় এই স্টাইলের অবনমন যেন না হয়, কিউই ক্রিকেট সেটাই নিশ্চিত করতে চায়!    

This article is in Bengali language, on about how New Zealand establishing a cricket style which is represented in terms of attitude people of this country.

Featured Image Credit: Getty Images

Related Articles

Exit mobile version