১৯৭০ সালের কথা। যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠেনি বটে, তবে পূর্ব পাকিস্তানের আকাশে জমেছে নিকষ কালো মেঘ। ১৯৬১ সালে শুরু হওয়া তৎকালীন পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ‘আইয়ুব ট্রফি’ হুট করেই নাম বদলে হয়ে গেলো ‘বিসিসিপি ট্রফি’। সেই টুর্নামেন্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলে খেলেছিলেন রকিবুল হাসান এবং সৈয়দ আশরাফুল হক। এদের নাম বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
পূর্ব পাকিস্তানের আরো দুটি দল খেলেছিল সেই টুর্নামেন্টে। ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইটস এবং ইস্ট পাকিস্তান গ্রিন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্রিকেট দলের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের দলগুলো ছিল বেশ পশ্চাৎপদ এবং ক্ষীণশক্তি। ফলে হানিফ মোহাম্মদের পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস দলের বিপক্ষে বলতে গেলে উড়েই গিয়েছিল ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইটস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইস্ট পাকিস্তান গ্রিন কোনোমতেই পিআইএ-এর বিপক্ষে খেলতে রাজি না হওয়ায় প্রতিপক্ষকে ওয়াকওভার দিয়ে দেওয়া হয়।
এ টুর্নামেন্টের কিছুদিন পরই বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন পাকিস্তান (বিসিসিপি) ঝটপট ১৩টি দলকে নিয়ে আয়োজন করে অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্ট। এখানে বিসিসিপি ট্রফিতে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্বলতম পারফরম্যান্সের পরও সুযোগ হয়েছিল তিনটি পূর্ব পাকিস্তান দলের। বলা বাহুল্য, এমন ‘বদান্যতা’ এর আগে পূর্ব পাকিস্তান খুব একটা দেখেনি। এর পেছনে কারণও ছিল। যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার আগে শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানকে বশে আনার একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে চান। আর সেই রাজনীতির খেলায় পুতুল হিসেবে বেছে নিলেন ক্রিকেটকে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও যখন শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হল না, ক্ষোভের পাহাড় গড়তে শুরু করে তখনই। এমন সময় পাকিস্তান সফরে আসে মিকি স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক একাদশ, যে দলটিতে খেলেছিলেন নরম্যান গিফোর্ড, নিল হ’ক, রবিন হবস, রন হেডলি, জন মারে’সহ একঝাঁক তৎকালীন উঠতি ক্রিকেটার। প্রথম ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয় করাচিতে, ইন্তিখাব আলমের ব্যাটে-বলে দুর্ধর্ষ নৈপুণ্যে পাকিস্তান সে ম্যাচটি জিতে অনায়াসেই।
এরপরই ইয়াহিয়া খান নিজের মতো করে অঙ্ক কষলেন। ঘোষণা করা হল, পরের ম্যাচটি আয়োজিত হবে ঢাকার মাটিতে। পূর্ব পাকিস্তানের ‘পোস্টারবয়’ হিসেবে বিসিসিপি কাজে লাগাতে চাইল রকিবুল হাসানকে, কারণটা অনুমেয়। ঠিক এর আগের বছরই বেশ কিছু প্রথম শ্রেণি ম্যাচ খেলেছেন রকিবুল। পারফরম্যান্সও ছিলো নজরকাড়া। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি ম্যাচে তাকে দ্বাদশ ক্রিকেটার হিসেবেও রাখা হয়েছিল, তবে মাঠে নামা হয়নি। অবশেষে এল সে সুযোগ, তখন তার বয়স মাত্র ১৮।
দলের আর দশজনের মতো তাকেও একটি ‘গ্রে-নিকোলস’ ব্যাট দেওয়া হল ম্যাচের আগে। ব্যাটে লাগানো ছিলো পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) লোগো সম্বলিত একটি স্টিকার, যা চোখ এড়ায়নি রকিবুলের। আর একজন দায়িত্বশীল বাংলাদেশি (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানি) এবং আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক হিসেবে সেটা মেনে নেওয়া কোনোমতেই সম্ভব ছিল তার পক্ষে। তাই গভীর রাতে হোটেল পূর্বাণী ছেড়ে রকিবুল চললেন বন্ধু শেখ কামালের সঙ্গে দেখা করতে। সেখানেই সলাপরামর্শ সেরে ফিরে এলেন টিম হোটেলে।
পরেরদিন টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন ইন্তিখাব, আর আজমত রানার সঙ্গে ব্যাটিং করতে নামলেন রকিবুল। সকলে অবাক হয়ে দেখল রকিবুলের ব্যাটে পিপিপি’র লোগো বসানো স্টিকার নেই। গোটা গোটা করে লেখা এক স্টিকার, ‘জয় বাংলা’! সময়টা ছিল অগ্নিঝড়া, আর ‘জয় বাংলা’ স্টিকার তখন ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। উইজডেন ইন্ডিয়াতে রকিবুলের ভাষায়,
সবাই দেয়ালে, দরজায়, গাড়িতে কিংবা ব্যাগে লাগাতো স্টিকারগুলো। আমি যেটা করলাম, আমার গ্রে-নিকোলস ব্যাটে স্টিকারটার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকাটাও জুড়ে নিলাম। সে ম্যাচে আমি তেমন কিছুই করিনি, তবু সবাই এটার জন্যই আমাকে নিয়ে কথা বলল। একটা স্টেটমেন্ট করতে চেয়েছিলাম। দশজন পশ্চিম পাকিস্তানির সঙ্গে একই মাঠে খেলতে নেমেছি, আর আমার ব্যাটে ‘জয় বাংলা’ স্টিকার। সারাটা ম্যাচজুড়ে দর্শকদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত ছিল স্টেডিয়াম, সেটা নিয়েও আমাকে জবাবদিহিতার সামনে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু আমি আমার স্টিকার সরাইনি। আমরা লড়ছিলাম আমাদের অধিকারের আদায়ের সংগ্রামে, ভয়ে পিছিয়ে আসার সময় সেটা ছিল না।
গোটা মাঠ গর্জে উঠল সেই হর্ষধ্বনিতে, “জয় বাংলা” স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল চারদিক। মুক্তিযুদ্ধের আগে সেটাই ছিল ইয়াহিয়া’র কূটচালের বিরুদ্ধে সাহসিকতা এবং তারুণ্যে উদ্দীপ্ত একটা বার্তা, ‘মাথা নত করবে না বাংলাদেশ’। রকিবুল সেই ইনিংসে মাত্র এক রান করেই সাজঘরে ফিরেছিলেন, তবে সেটা বিন্দুমাত্র পার্থক্য গড়েনি। সত্যিকার বিজয়টা তো ছিনিয়ে এনেছিলেন ‘জয় বাংলা’ স্টিকারটির সঙ্গে সঙ্গেই, যা অগ্নিমশাল জ্বেলেছিল কয়েক হাজার পূর্ব পাকিস্তানির হৃদয়ে।
সে আগুন ছড়িয়ে যেতেও খুব একটা সময় নিল না। ইয়াহিয়া খান সেদিন বিকেলেই আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করলেন, পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত এবং সারা দেশে মার্শাল ল’ জারি করা হবে। ঢাকায় সে ঘোষণা সৃষ্টি করল তীব্র উত্তেজনা, আর সেই উত্তেজনার সঙ্গে রকিবুলের বীরত্ব মিলিয়ে রীতিমতো দাবানলে রূপ নিয়েছিল। সে দাবানলের প্রভাবেই ম্যাচ চলাকালীন সময়ে ছাত্রগোষ্ঠী আক্রমণ করল স্টেডিয়ামে, মিকি স্টুয়ার্ট ঘটনার বিস্তৃতি আঁচ করতে না পেরে অনুরোধ করেন ম্যাচটি শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করার জন্য। তাতে হিতে বিপরীত হল, আরো ক্ষেপে গেল ছাত্র-জনতা।
ব্যাপারটিকে বিন্দুমাত্র মেনে নিতে পারলেন না পাকিস্তান একাদশের হয়ে খেলতে নামা সরফরাজ নেওয়াজ। একজন সৈনিককে তিনি আহ্বান জানালেন ছাত্র-জনতার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণের জন্য। অগ্নিস্ফুরিত চোখে সেই সৈনিক উল্টো বন্দুক তাক করে ধরেছিলেন সরফরাজের দিকেই। ভয়ে মিইয়ে গেলেন সরফরাজ।
ম্যাচটি আর শেষ করা গেল না। দুই দলকেই মিলিটারি গাড়িতে করে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে, এরপর সেখান থেকে হোটেল পূর্বাণী। আন্তর্জাতিক একাদশ দলটি অনতিবিলম্বে লাহোরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যেতে সক্ষম হলেও পাকিস্তান একাদশের ক্রিকেটারেরা হোটেল থেকেই বেরোতে পারছিলেন না। অবশেষে ইন্তিখাবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং পাকিস্তান দলের ম্যানেজার ব্রিগেডিয়ার হায়দারের হস্তক্ষেপে কোনোক্রমে ঢাকা ছাড়তে সক্ষম হয় পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা।
সেদিনই বুঝে গিয়েছিলেন রকিবুল, সাদা জার্সি পরে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকের স্বপ্নটা দেখার আগেই উবে গেল। বিদায় সম্ভাষণ জানাতে গিয়ে জহির আব্বাসকে রকিবুল বললেন, “জহির, পরেরবার পাকিস্তানে এলে হয়তো নতুন পাসপোর্ট নিয়েই আসব!” সেই শব্দগুলোতে নিশ্চয়ই বাঘের গর্জন শুনতে পেয়েছিলেন জহির আব্বাস।
সেদিনের সেই ঘটনার কারণেই হয়তো আর টেস্ট ক্রিকেটে পা রাখা হয়নি রকিবুলের। আফসোস হয় না সেই অতৃপ্তির কথা ভেবে?
আমি আমার ক্যারিয়ারটা জলাঞ্জলি দিয়েছি, তার বিনিময়ে পেয়েছি আমার স্বাধীনতা, পেয়েছি আমার দেশের একটা নাম। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি-ই বা হতে পারে! স্বাধীনতা সংগ্রামে অগণিত মানুষের জীবনটাই চলে গেছে। সে তুলনায় আমার ক্যারিয়ার হারানো? কিচ্ছু না!
আরো একটা ‘স্বীকৃতি’ পেয়েছিলেন রকিবুল। জয় বাংলা স্টিকারের বদৌলতে তাকে পাকিস্তান থেকে সাময়িকভাবে নির্বাসিতও করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালের মার্চ। শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন,
ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।
তখন রকিবুল মাত্রই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। অস্থিরতা বাড়তে থাকল, পাকিস্তানের মতিগতিও পরিষ্কার হতে শুরু করল গোটা পূর্ব পাকিস্তানের কাছে। আগুন ছড়িয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তানে।
২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গভীর রাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র বাঙালির উপর। নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চলল নিষ্পাপ শিশু থেকে শুরু করে হাজার হাজার সাধারণ জনগণের উপর। এশিয়া টাইমস ইয়াহিয়া খানকে উর্ধ্বৃত করে বলল, “তিন মিলিয়ন মেরে দাও, বাকিরা এমনিই তাহলে আমাদের হাত চেটেপুটে খাবে।” সেদিনই বুঝে গেলেন রকিবুল, আর বসে থাকা চলবে না। সিদ্ধান্ত নিলেন দেশের জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। হাতের ক্রিকেট ব্যাট ছুঁড়ে ফেলে তুলে নিলেন বন্দুক। পাশে পেলেন তারই প্রিয় বন্ধু এবং ওপেনিং পার্টনারকে, আব্দুল হালিম চৌধুরী। এই আব্দুল হালিমই আমাদের শহীদ জুয়েল, যার নাম আজও আমাদের রক্তে নাচন ধরায়। জীবনের শেষ অপারেশনে গিয়ে হারিয়েছিলেন হাতের তিনটি আঙুল, এরপর স্বভাবোচিত রসিকতার সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, “হেভি আরাম লাগতেছে। দেশের জন্য রক্ত দেওয়া হইল, আবার জানটাও রাখা হইল। কইয়া বেড়াইতে পারুম, দেশের জন্য যুদ্ধ কইরা আঙ্গুল শহীদ হইছিল… হা হা হা…!”
তারা খেলার সাথে সেদিন রাজনীতি মিশিয়েছিলেন। আর মিশিয়েছিলেন বলেই জোর পেয়েছে স্বাধীনতার আন্দোলন। তার ফলাফল হিসেবেই আজ আমরা মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারি। হঠাৎ ছন্দপতনে আমরা পথ হারাই না; ওরাই আমাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, কোনোমতেই পথ হারানো চলবে না। দেশটা আমাদের, তাই কোনোমতেই সে দেশকে পদস্খলিত হতে দেওয়া চলবে না। তাদের আত্মদানে পাওয়া এই ‘বাংলাদেশ’ নামটা যে আমাদের রক্তে মিশে গেছে।
Featured Image Source : Associated Press/Cricinfo