সদ্য শেষ হওয়া রাশিয়া বিশ্বকাপে দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বসেরার মুকুট পরে দিদিয়ের দেশমের ফ্রান্স। অথচ ফ্রান্স দলের অর্ধেকের পৈতৃক নিবাস সুদূর আফ্রিকার দেশগুলোতে। পগবা, কান্তে, এমবাপে সহ বড় বড় তারকাদের আদি নিবাস আফ্রিকা মহাদেশে। তবে সবার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা প্যারিস কিংবা মার্শেই শহরের আলো বাতাসেই। কসমোপলিটন এর শহর প্যারিসেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমন ভিন্ন দেশ থেকে আসা বহু ফরাসি। তেমনি ভাবে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই বিশ্বজনীনতা দেখা যায়। খেলোয়াড়েরা সহজেই পেয়ে যাচ্ছেন ভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব। জাতীয় দলে খেলার সময় কেউ কেউ আদি নিবাস বেছে নেন কেউবা চান নতুন দেশের জার্সি গায়ে জড়িয়ে খেলতে। তাতে করে ফুটবল মাঠে পরিবারের বিভাজনও দেখা যায়। চলুন দেখে আসা যাক এমন কিছু সহোদর যারা দুই ভিন্ন দেশের জার্সি জড়িয়েছেন।
ফ্লোরেন্তিন পগবা ও পল পগবা
বড় দুই ভাই ম্যাথিয়াস পগবা আর ফ্লোরেন্তিন পগবার জন্মের পর পুরো পরিবার সহ ফ্রান্সে পাড়ি জমায় এই গিনিয়ান পরিবার। সেই ফ্রান্সের সেঁত এতিয়েনে জন্ম পল পগবার। ছোট বেলা থেকেই ফ্রান্সের মাটিতে ফুটবল খেলে বেড়ে উঠেছেন। নজর কাড়েন বড় বড় ক্লাবগুলোর। ম্যানচেস্টার থেকে জুভেন্টাসের হয়ে মাঠ কাঁপিয়ে ২০১৬ সালে ১০৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে আবার সেই ওল্ড ট্রাফোর্ডে ফিরেন এই প্রতিভাবান মিডফিল্ডার। ফ্রান্সের হয়ে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ জেতার পর জাতীয় দলের হয়েও এই বয়সেই খেলে ফেলেছেন ৬০টি ম্যাচ, করেছেন ১০ টি গোল। জিতেছেন সবচেয়ে আরাধ্য ট্রফি বিশ্বকাপও। এরই মধ্যে ফ্রান্সের মাঝমাঠের হৃৎপিন্ড হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
অন্য দিকে বড় ভাই ফ্লোরেন্তিন পগবা ফ্রান্সের হয়ে অনূর্ধ্ব-২০ দলের হয়ে তিনটি ম্যাচ খেললেও পরে খেলছেন গিনির হয়েই। রক্ষণভাগে খেলা এই ফুটবলার গিনির হয়ে মাঠে নেমেছেন ২১ বার। ক্লাব ক্যারিয়ারে একটা সময় সেঁত এতিয়েনে খেললেও সুবিধা করতে পারেননি তেমন। বিভিন্ন ক্লাবে যাযাবরের মতো ঘুরে এখন খেলছেন তার্কিশ লিগে।
রাফিনহা আলকানতারা ও থিয়াগো আলকানতারা
ইতালিতে জন্ম নেওয়া এই দুই ভাইয়ের বাবা ম্যাজিনহো ছিলেন ব্রাজিল জাতীয় দলের এক সময়কার ফুটবলার। ব্রাজিলের হয়ে জিতেছিলেন বিশ্বকাপ শিরোপাও। সেই সুবাদে ব্রাজিলের নাগরিকত্ব ছিলো দুই ভাইয়েরই। লা মাসিয়ায় খেলার জন্য দুই ভাই পাড়ি জমান স্পেনে। সেখান থেকে স্পেনের বয়সভিত্তিক দল গুলোতে খেলে জাতীয় দল হিসেবে স্পেনকেই বেছে নেন থিয়াগো আলকানতারা। উপেক্ষা করেন ব্রাজিল দলের হয়ে খেলার সুযোগ। অন্যদিকে ছোট ভাই হাঁটেন বাবার পথে। সেলেসাওদের বিখ্যাত হলুদ জার্সিই বেছে নেন রাফিনহা।
বর্তমানে বায়ার্নে খেলা থিয়াগো স্পেনের হয়ে ইতিমধ্যে ৩১ টি ম্যাচ খেললেও রাফিনহা ব্রাজিলের হয়ে খেলেছেন মাত্র ২টি ম্যাচ। বয়স ভিত্তিক দলগুলোতে ভাইয়ের মতো স্পেনের হয়ে খেললেও ২০১৩ সালে সিদ্ধান্ত নেন ব্রাজিলের হয়ে খেলার। তার সেই সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিলো তা বুঝিয়ে দেন ২০১৬ সালে ব্রাজিলের হয়ে ফুটবলে প্রথম অলিম্পিক গোল্ড মেডেল জিতে।
কেভিন প্রিন্স বোয়াটেং ও জেরোম বোয়াটেং
বাবা মা ঘানাইয়ান হলেও দুই ভাইয়ের জন্মই পশ্চিম বার্লিনে। ২০০৫ অনূর্ধ্ব ইউরোতে জার্মানির হয়ে খেলেন বড় ভাই কেভিন প্রিন্স বোয়াটেং। ২০০৯ সালে জার্মানির জাতীয় দলে ডাক পান এই সাসুয়েলো ফরোয়ার্ড, তবে বিশৃঙ্খলার দায়ে দল থেকে বাদ পড়েন। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেন জার্মানির হয়ে আর মাঠে নামবেন না, যোগ দেন ঘানার জাতীয় দলে। ২০১০ বিশ্বকাপে ঘানার স্বপ্নের বিশ্বকাপ যাত্রায় দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন কেভিন।
অন্যদিকে বায়ার্নে খেলা ছোট ভাই জেরোম বোয়াটেং শুরু থেকেই খেলছেন ডাই ম্যানশ্যাফটদের হয়ে। ২০০৯ সালে অভিষেক হওয়া এই রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের এখন পর্যন্ত জার্মানির জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন ৭৩ বার। ২০১৪ সালে জিতেছেন ফিফা বিশ্বকাপ শিরোপা।
গ্রানিত শাকা ও তাউলান্ত শাকা
আলবেনিয়া থেকে উদ্বাস্তু হয়ে অনেকেই পাড়ি জমান সুইজারল্যান্ডে। শাকা পরিবারও তেমনিভাবে শরণার্থী হয়ে হয়ে তাঁবু গাড়েন সুইজারল্যান্ডে। দুই ভাইয়ের বেড়ে ওঠা সুইজারল্যান্ডের বাসেলে। তবে বড় ভাই নিজ দেশ আলবেনিয়া বেছে নিলেও গ্রানিত সুইজারল্যান্ডের হয়েই মাঠ মাতানো শুরু করেছেন। আর্সেনালের এই মিডফিল্ডার দ্বিধায় ছিলেন কোন দেশের হয়ে খেলবেন তা নিয়ে। কিন্তু সুইস ফুটবল ফেডারেশনের কাছে থেকে বেশি সহানুভূতি পাওয়ায় সুইজারল্যান্ডকেই বেছে নেন তিনি। এখনও পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ৬৬ টি ম্যাচ।
অন্যদিকে বাসেলে খেলা তাউলান্ত সুইজারল্যান্ডের হয়ে সবগুলো বয়সভিত্তিক দলে খেলার পরেও ২০১৪ সালে এসে মত বদলান। আলবেনিয়া থেকে খেলার ডাক পেয়ে সুইজারল্যান্ডকে উপেক্ষা করেন। এখন পর্যন্ত আলবেনিয়ার হয়ে তাউলান্ত খেলেছেন ২০টি ম্যাচ।
ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরি ও ম্যাসিমিলিয়ানো ভিয়েরি
ইতালিয়ান ফুটবলার রবার্তো ভিয়েরির দুই ছেলে ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরি ও ম্যাসিমিলিয়ানো ভিয়েরি। বাবার ক্যারিয়ারের জন্য একটা বড় সময় অস্ট্রেলিয়াতে কাটাতে হয়েছিলো দুই ভাইকে। তবে ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরির মত এত স্বনামধন্য ফুটবলার ছিলেন না ম্যাসিমিলিয়ানো ভিয়েরি।
ইন্টার মিলান কিংবদন্তী ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরি খেলেছেন লাৎসিও, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, জুভেন্টাসের মত বড় বড় ক্লাবে। ইতালির ফুটবল ইতিহাসেও নিজের নাম লিখিয়েছেন। ইতালির হয়ে ৪৯ ম্যাচে করেছেন ২৩ গোল। ১৯৯৮ ও ২০০২ বিশ্বকাপ খেলে গোল করেছেন ৯টি। পেলের করা জীবিত সেরা ১২৫ জন ফুটবলারের লিস্টে ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরির নামও রয়েছে।
অন্যদিকে তার সহোদর ম্যাসিমিলিয়ানো জুভেন্টাস ও নাপোলির হয়ে খেললেও তেমন সুবিধা করতে পারেননি। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের জন্য বেছে নেন ছোটবেলায় বেড়ে উঠা অস্ট্রেলিয়াকে। তবে সেখানেও খেলতে পেরেছেন মোটে ৫টি ম্যাচ।
লিওনার্দো বাকুনা ও জুনিনহো বাকুনা
নেদারল্যান্ডে বেড়ে উঠা এই দুই ফুটবলারের মধ্যে একজন নেদারল্যান্ডের জার্সি বেছে নিলেও আরেকজন খেলছেন পৈতৃক নিবাস কুরাসাও এর হয়ে। বড় ভাই লিওনার্দো বাকুনা খেলেছেন অ্যাস্টন ভিলার হয়ে। বর্তমানে রিডিং এর মধ্যমাঠের এই খেলোয়াড় অবশ্য ক্যারিয়ারের শুরুতে নেদারল্যান্ডের হয়ে খেলা শুরু করেন। বয়সভিত্তিক দল গুলোতে ডাচদের হয়ে খেলেছেন ২৫টি ম্যাচ। তবে ২০১৬ সালের মার্চে মা বাবার দেশ ক্যারিবীয় দ্বীপ কুরাসাও থেকে ডাক পেলে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন সেখানেই। এই পর্যন্ত সেই দেশের হয়ে ১৭ ম্যাচে ৬টি গোল করেছেন বাকুনা।
অন্যদিকে ছোট ভাই জুনিনহো এখন পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ না পেলেও খেলছেন বয়সভিত্তিক দলে। অনূর্ধ্ব-২১ দলের হয়ে ইতিমধ্যে ৩ ম্যাচে ২ গোল করে নজর কেড়েছেন। তবে ভবিষ্যতে ডাচদের জার্সি গায়ে জড়ানোর স্বপ্ন জুনিনহোর।
ফ্লোরেন্ত মালুদা ও লেসলি মালুদা
বড় ভাই ফ্লোরেন্ত মালুদার মত এত বিখ্যাত ছিলেন না লেসলি মালুদা। দুই জনের জন্মই ক্যারিবীয়ান দ্বীপ গায়ানায়। তবে বেড়ে উঠেছেন প্যারিসে। ছোট ভাই লেসলি মালুদা ফুটবল ক্যারিয়ারে তেমন ভাবে লাইমলাইটে না আসলেও বড় ভাই ফ্লোরেন্ত মালুদার জাতীয় দলের ক্য্যারিয়ার ক্লাব ক্যারিয়ারের মতই ছিলো সমৃদ্ধ। ফ্রান্সের হয়ে খেলেছেন ৮০টি ম্যাচ। ২০০৬ সালে রানার্স আপ হওয়া দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ক্লাব ক্যারিয়ারের বড় একটা অংশ কাটিয়েছেন লিওঁ এবং চেলসিতে।
তবে ২০১৭ সালে ফিরে গিয়েছিলেন নিজ দেশে। ছোট ভাই লেসলি মালুদার মত গায়ে জড়িয়েছিলেন গায়ানার জার্সি। তবে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। খেলেছেন মোটে ৪ টি ম্যাচ। অন্যদিকে ছোট ভাই গায়ানার হয়ে খেলছেন মাত্র ৬টি ম্যাচ।