মেয়েদের অর্জনে উল্লাস করেছিল ছেলেরা। বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল ভারতের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে এশিয়া কাপের ফাইনালে জয় তুলে নিল, মিরপুরের ড্রেসিংরুম তখন তামিম ইকবাল-মাশরাফি বিন মুর্তজাদের উদযাপনে টলমল। নারীরা ওই প্রথম কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে জায়গা করেছিল, প্রথমবারেই জিতেছিল শিরোপা।
কিন্তু নারী দল এশিয়া কাপের আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাজেভাবে হেরে ফিরলো। এশিয়া কাপে যে এমন কিছু হতে পারে, সেটা হয়তো সমর্থক, এমনকি টিম ম্যানেজমেন্টও কল্পনায় আনেনি। কল্পনায় এনেছিল দলের ক্রিকেটাররা। সেবার রোর বাংলাকেই এক সাক্ষাতকারে জাহানারা আলম জানিয়েছিলেন, আমরা সবগুলো ম্যাচে হেরেছিলাম। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে লড়াই করেছিলাম। তাই এশিয়া কাপে টি-টোয়েন্টিতে ভালো করার ক্ষমতা যে আমাদের আছে; তা আমরা বিশ্বাস করেছিলাম।
বিশ্বাসটা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছিল। তালুবন্দী হয়েছিল চ্যাম্পিয়নের ট্রফি।
মজার ব্যাপার হলো, এশিয়া কাপ নিয়ে সবচেয়ে আশা ছিল বাংলাদেশ পুরুষ দলকে নিয়ে। কিন্তু তারা পারেনি। তবে ২০১২ সালের আসরটি আজীবন মনে রাখবে বাংলাদেশ। সেবার পাকিস্তানের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচে মাত্র ২ রানের আক্ষেপ কান্না হয়ে ঝরেছিল মুশফিকুর রহিম, নাসির হোসেন আর সাকিব আল হাসানদের চোখে।
তারপর থেকে এশিয়া কাপে বাংলাদেশ কেবল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যই খেলেছে। ২০১৯ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে এবারের এশিয়া কাপ গড়াচ্ছে ওয়ানডে ফরম্যাটে। মাশরাফি বিন মুর্তজার মন্ত্রণায় এবারও বাংলাদেশের লক্ষ্য শিরোপা। সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠেয় এশিয়ার সবচেয়ে বড় এই ক্রিকেট টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হবে লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
১.
উইন্ডিজ সিরিজের সফলতা-ব্যর্থতার পর ঈদের আমেজ। সেটা শেষ করে সোমবার, ২৭ আগস্ট থেকে ৩১ সদস্যের বাংলাদেশ দল শুরু করেছে এশিয়া কাপের প্রস্তুতি ক্যাম্প। যদিও প্রথম থেকে সেই ক্যাম্পে থাকতে পারছেন না সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। পবিত্র হজের কারণে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন দেশসেরা অলরাউন্ডার সাকিব। অন্যদিকে, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ রয়েছেন উইন্ডিজে ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল)।
মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে প্রথমদিনে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ব্লিপ টেস্ট দিয়েছেন। অর্থাৎ, নিজেদের শারীরিক সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন ফিজিওদের কাছে। পরে হয়েছে ফিল্ডিং ও অন্যান্য অনুশীলন।
দিন শেষে দলের ক্রিকেটাররা জানিয়েছেন, এবারের এশিয়া কাপে তাদের লক্ষ্য শিরোপা জয়। আর এর পিছনে খুঁটি হয়ে দাঁড়াচ্ছেন দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা।
প্রথমদিনেই ছেলেদের মধ্যে দরকারি আত্মবিশ্বাসটা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন দেশসেরা এই ক্রিকেটার। তার কথা নিয়ে আরেক পেসার আবু জায়েদ রাহী জানিয়েছেন বাংলাদেশের এশিয়া কাপের পরিকল্পনা।
তিনি বলেছেন, “যদি আমাদের পরিকল্পনা জানতে চান, তাহলে আমরা বলবো আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। ড্রেসিংরুমে আমাদের একটা মিটিং হয়েছে। সেখানে মাশরাফি ভাই বলেছেন, আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারি এই বিশ্বাসটা আমাদের সবার মধ্যে রাখতে হবে। আমরা কেবল অংশগ্রহণই করতে যাচ্ছি না।“
উইন্ডিজ সফরে টেস্টের ব্যর্থতার পর ওয়ানডের জন্য সেখানে গিয়েছিলেন মাশরাফি। বদলে দিয়েছিলেন দলের পুরো অবস্থা। যার ধারাবাহিকতায় টি-টোয়েন্টিতেও সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সিরিজ জেতে। সেবার মাশরাফি বলেছিলেন, “তোরা যদি বিশ্বাস রাখিস, তাহলে তোরা পারবি।” বাংলাদেশ আসলেও পেরেছিল।
মেহেদী হাসান মিরাজ আরব আমিরাতের উইকেট ও কন্ডিশনকে সেভাবে আমলে নিচ্ছেন না। তার কাছে উপমহাদেশের উইকেটের মতোই আমিরাতের উইকেট। বলেছেন, “এশিয়ার কন্ডিশনে খেলা। এখানকার কন্ডিশনে আমরা অনেক খেলেছি। আমাদের অনেক প্লেয়ার খেলেছে উপমহাদেশে। আশা করি সব ঠিক থাকলে খুব ভালো হবে ফলাফল।“
চ্যালেঞ্জটাও মাথায় নিচ্ছেন। পাশাপাশি টোটকা খুঁজছেন নিজেদের কঠোর পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসে। নিজে সুযোগ পেলে ভালোকিছু করার চেষ্টা করবেন ও দলের শেষ চার বছরের ফিরিস্তি দিয়ে বলেছেন, “আমরা শেষ চার বছর কিন্তু ভালো ক্রিকেট খেলে আসছি। বিশ্বকাপ দেখেন, দেশে বলে বাইরে বলেন; আমরা অনেক ভালো ক্রিকেট খেলেছি। দাপুটে ক্রিকেট খেলেছি। ঐটাই আমাদের আত্মবিশ্বাস দিচ্ছে। আমাদের সিনিয়র ক্রিকেটাররা অনেক দাপট দেখিয়ে খেলে আসছে। জুনিয়ররাও অবদান রেখেছে। সব মিলিয়ে আমরা সবাই আত্মবিশ্বাসী। আমরা যদি আমাদের শতভাগ দিতে পারি তাহলে ভালো কিছু হবে।”
২.
পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, এখন পর্যন্ত এশিয়া কাপে কেবল পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় নেই বাংলাদেশের। তবে টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন রানের পরিসংখ্যানের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে পাকিস্তানের নাম। বাংলাদেশ এশিয়া কাপে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ তোলে ৩ উইকেটে ৩২৬ রান। একই ম্যাচে পাকিস্তান ৩২৯ করে জয় পায়। লজ্জার রেকর্ডেও নাম আছে বাংলাদেশের। এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন রানের প্রথম দুটিই বাংলাদেশের। ২০০০ সালে মাত্র ৮৭ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। সেবারও প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ম্যাচে তোলে ৯৪ রান। দূর্ভাগ্যবশত, সেই ম্যাচেও প্রতিপক্ষ পাকিস্তান।
অর্থাৎ, এশিয়া কাপের ইতিহাসে বাংলাদেশ যে পাকিস্তানের বিপক্ষে একটু খেই হারায়, তার প্রমাণ দিচ্ছে পরিসংখ্যান।
দিন বদলেছে। ২০১৫ সালের শেষ দিক থেকে আজকের বাংলাদেশ গড়েছে অনন্য নজির। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজও জয় করেছে লাল-সবুজ জার্সির খেলোয়াড়রা। তাই এবারের আসরে ‘পাকিস্তান’কে হয়তো আর ইতিহাস হিসেবে দেখতে চাইবে না বাংলাদেশ।
এশিয়া কাপ একবারই টি-টোয়েন্টি হয়েছিল। সেটা সর্বশেষ ২০১৬ আসরে। সেখানে বাংলাদেশের সাব্বির হাসান সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান সংগ্রহের তালিকায় রয়েছেন দ্বিতীয় অবস্থানে। ৫ ম্যাচে মোট ১৭৬ রান তোলেন তিনি। তবে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে এই জায়গাটা নিয়ে রেখেছেন ওপেনার তামিম ইকবাল। ১২ ম্যাচে তার সংগ্রহ ৫১৭ রান। রয়েছে ছয়টি হাফ সেঞ্চুরি। তার উপরে আছেন ভারতীয় কিংবদন্তি সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। ১৩ ম্যাচে তার মোট রান ৫১৮।
তবে এশিয়া কাপে সর্বোচ্চ রানের তালিকায় সবার উপরে আছেন শ্রীলঙ্কান কিংবদন্তি সনাৎ জয়সুরিয়া। ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ২৫ ম্যাচ খেলে ৫৩.০৪ গড়ে মোট ১২২০ রান পেয়েছেন তিনি। রয়েছে ছয়টি সেঞ্চুরি ও তিনটি হাফ সেঞ্চুরি।
বল হাতে বাংলাদেশের পক্ষে এশিয়া কাপে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ওয়ানডেতে বাঁহাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক। ১৮ ম্যাচে তিনি নিয়েছেন ২২ উইকেট। টি-টোয়েন্টিতে পেসার আল-আমিন হোসেন। ৫ ম্যাচে নিয়েছেন ৭ উইকেট। এশিয়া কাপে টি-টোয়েন্টির হিসেবে সব দল মিলে তিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি।
৩.
এশিয়া কাপ নিয়ে যখন এই আলোচনা তার মধ্যেই ঘটে গেছে অন্য ঘটনা। প্রস্তুতি ক্যাম্পের প্রথমদিনে নতুন অনুশীলন জার্সি পেলেন ক্রিকেটাররা। কিন্তু সেখানে নেই মূল স্পন্সর রবির নাম। ঘটনা কী?
জানা গেলো, দলের স্পন্সর হারিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। টেলিকমিউকেশন সংস্থা রবি আর জাতীয় দলের সঙ্গে থাকছে না। চুক্তির আগেই নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে তারা।
এর কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছে, মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান রবি ছাড়াও অন্যান্য টেলিকমিউনিকেশন সংস্থার সঙ্গে ব্যক্তিগত চুক্তি করেছে। সেই দায়েই এত কিছু।
বোর্ড অবশ্য এগুলোকে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ হিসেবে দেখছে। কারণ এই তিন ক্রিকেটারের সঙ্গে ঐসব সংস্থার চুক্তি বাতিল করার জন্য প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল বিসিবি। সে কারণে পুরো ব্যাপারটিকে সহজভাবে নেয়নি বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
কেবল তা-ই নয়, চুক্তির আগে নাম সরিয়ে নিলেও, পুরো অর্থ নেওয়ার পক্ষে বিসিবি। সেভাবেই এগোচ্ছে তারা। বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন বলেন, “মাশরাফির চুক্তিটা যখন হয়েছে তখন রবির সঙ্গে কনফ্লিক্টের এই টার্মসটা ছিল না। আগের যে চুক্তি ছিল রবির সঙ্গে দুই বছরের তখন এটা ছিল না। পরে এটা হয়েছে। সাকিবের বিষয়টা যখন এসেছে, তামিমের বিষয়টা যখন এসেছে; ব্যাপারগুলো আমরা তখন সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছি।“
তবে যতকিছুই হোক, এশিয়া কাপের আগেই নতুন স্পন্সরশিপ খুঁজবে বিসিবি। নতুন টুর্নামেন্টের নতুন জার্সিতে লেখা থাকবে নতুন কোনো সংস্থার নাম। সে নিয়ে শতভাগ আত্মবিশ্বাসী সুজন। বললেন, “চেষ্টা করছি এশিয়া কাপের আগেই স্পন্সর নিতে। সেক্ষেত্রে দু’রকম হতে পারে। কেবল এশিয়া কাপের জন্য আলাদা স্পন্সর হতে পারে। আবার যদি এমন হয় লং টার্মের জন্য, তাতেও ক্ষতি নেই।“
অর্থাৎ, এশিয়া কাপের মাঠে নামার আগেই বাংলাদেশে টুর্নামেন্টের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনায় মুখর। কিন্তু মাঠের পারফরম্যান্সটা কেমন করবেন মাশরাফি-সাকিবরা? আত্মবিশ্বাস আর যোগ্যতার সমন্বয় যদি হয়, তাহলে বোধ হয় হতে পারে সৌভাগ্যের সূর্যোদয়।
ফিচার ইমেজ- Indian Express