২০০৪ সালে ১৮ বছর বয়সী ওয়েইন রুনি যখন সফল ক্যারিয়ারের স্বপ্ন নিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দিয়েছিলেন, তখন হয়তো তিনি নিজেও ভাবতে পারেননি যে অসংখ্য অর্জন ছাড়াও ইংল্যান্ডের এই মর্যাদাপূর্ণ ক্লাবের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে একদিন ওল্ড ট্রাফোর্ড ছাড়বেন তিনি।
১৯৮৫ সালের ২৪ অক্টোবর লিভারপুল শহরে জন্ম নেওয়া ওয়েইন মার্ক রুনির পেশাদার ফুটবলে পথচলা শুরু হয়েছিল মাত্র ১৬ বছর বয়সে; ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের একটি ম্যাচে টটেনহাম হটস্পার্সের বিপক্ষে সেদিন এভার্টনের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। ২০০২-০৩ মৌসুমে ২-২ গোলে ড্র হওয়া ঐ ম্যাচে কোনো গোল করতে না পারলেও, দলের প্রথম গোলটা এসেছিল তার পাস থেকে। এভার্টনের হয়ে নিজের প্রথম গোলের জন্যও তাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। অভিষেকের দেড় মাস পর ইংলিশ লিগ কাপের একটি ম্যাচে জোড়া গোলের মাধ্যমে পেশাদার ফুটবলে রুনি নিজের গোলের খাতা খুলেছিলেন। এর কিছুদিন পরই আর্সেনালের বিপক্ষে ম্যাচে বক্সের বাইরে দারুণভাবে বল নিয়ন্ত্রণ করার পর জোরালো শটের দর্শনীয় গোলের মাধ্যমে মাইকেল ওয়েনকে টপকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা বনে যান তিনি।
ইংলিশ মিডিয়ার মধ্যমণিতে পরিণত হওয়ার জন্য লিগ চ্যাম্পিয়ন আর্সেনালের বিপক্ষে তার এই জয়সূচক গোলটাই যথেষ্ট ছিল, রুনির নামের পাশে তখন ইংলিশ ফুটবলের নতুন বিস্ময়-বালকের তকমাটা লেগে গিয়েছিল। এভার্টনের প্রথম একাদশে নিয়মিত হওয়ার পর ইংল্যান্ড জাতীয় দলেও খুব দ্রুত ডাক পেয়েছিলেন তিনি। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ১৭ বছর বয়সী রুনি ইংল্যান্ড জাতীয় দলের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে অভিষেকের রেকর্ড গড়েন। শুধু তাই নয়, ২০০৪ সালের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে গোল করে টুর্নামেন্টের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ডটাও নিজের করে নিয়েছিলেন তিনি। সেবার ইংল্যান্ড কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নিলেও, রুনি ৪ ম্যাচে ৪ গোল করে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও সবাইকে মুগ্ধ করেছিলেন।
প্রতিভাবান এই স্ট্রাইকারকে নিয়ে ইংল্যান্ডের শীর্ষ ক্লাবগুলোর আগ্রহের কমতি ছিল না, কিন্তু এভার্টনও তাকে ক্লাবে ধরে রাখার ব্যাপারে ছিল নাছোড়বান্দা।
অবশেষে ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে তিনি এভার্টনের বাড়িয়ে দেয়া নতুন চুক্তিকে উপেক্ষা করে ২৫.৬ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দিয়েছিলেন। ১৮ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকারকে এতো মোটা অংকের বিনিময়ে কিনে নেওয়ার ব্যাপারে, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের মতো ঝানু ও হিসেবী ম্যানেজারকে রাজি হতে দেখে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বোর্ডের সদস্যরা পর্যন্ত বিস্মিত হয়েছিলেন।
ওল্ড ট্রাফোর্ডে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে ফেনারবাচের বিপক্ষে ম্যাচে খেলার মাধ্যমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সিতে তার অভিষেক হয়েছিল। মাঠে নেমে রেড ডেভিল সমর্থকদের মন জয় করতে দেরি করেননি রুনি, প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করে দলকে ৬-২ গোলে জেতাতে সাহায্য করেছিলেন। তবে ওল্ড ট্রাফোর্ডে নিজের প্রথম মৌসুমে তিনি কোনো শিরোপা জেতার সুযোগ পাননি, এফএ কাপের ফাইনালে আর্সেনালের কাছে টাইব্রেকারে হারার পাশাপাশি লিগে তৃতীয় স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে। দলকে কোনো শিরোপা জেতাতে সাহায্য করতে না পারলেও, তিনি মৌসুম শেষ করেছিলেন ক্লাবের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে (৪৩ ম্যাচে ১৭ গোল) এবং পাশাপাশি জিতে নিয়েছিলেন পিএফএ বর্ষসেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরস্কার।
২০০৫-০৬ মৌসুমে রুনি ইউনাইটেডের হয়ে ইংলিশ লিগ কাপ জিতেছিলেন, ফাইনালে জোড়া গোল করে ম্যাচসেরাও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তবে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা সেবারও জেতা হয়নি রেড ডেভিলদের, রানার-আপ হিসেবে মৌসুম শেষ করতে হয়েছিল। লিগে ২৬ ম্যাচে ১৬ গোল করা রুনি টানা দ্বিতীয়বারের মতো পিএফএ বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতার পাশাপাশি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মৌসুম সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন।
কিন্তু মৌসুমের শেষদিকে ইনজুরিতে পড়ে তার ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। পুরো ইংল্যান্ডবাসীর আশা-ভরসা তাকে ঘিরে ছিল, তাই পুরোপুরি সেরে উঠার জন্য নির্ধারিত সময়ের অপেক্ষা না করে খুব তাড়াহুড়ার সাথেই চিকিৎসা নিয়ে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ফলে মাঠে তিনি নিজের স্বাভাবিক রূপে অবতীর্ণ হতে ব্যর্থ ছিলেন। উলটো কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে খেলার ৬২ মিনিটে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডার রিকার্ডো কারভালহোকে ফাউল করার পর রুনিরই ক্লাব সতীর্থ আরেক পর্তুগিজ খেলোয়াড় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে রেফারির কাছে লাল কার্ডের আবেদন করেছিলেন। রুনি তা দেখে নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে রোনালদোকে ধাক্কা মারলে, রেফারি তাকে লাল কার্ড দেখাতে বাধ্য হন। অধিকাংশেরই ধারণা যে রুনিকে উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যেই কাজটা করেছিলেন রোনালদো, যেহেতু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে তারা একসাথে খেলার ফলে ইংলিশ এই স্ট্রাইকারের বদমেজাজ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালের ইউরোর মতো ঐ ম্যাচেও টাইব্রেকারে হেরে ইংল্যান্ডকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
তবে বিশ্বকাপ শেষে ঠিকই রোনালদোর সাথে নিজের ঝামেলাটা মিটমাট করে খেলায় মনোযোগ দিয়েছিলেন রুনি। রেড ডেভিলদের হয়ে প্রথম দুই মৌসুম লিগ শিরোপা অধরা থাকলেও, ২০০৬-০৭ মৌসুম থেকে ২০০৮-০৯ মৌসুম পর্যন্ত টানা তিনবার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জয়ী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আক্রমণভাগের অপরিহার্য সদস্য ছিলেন তিনি। ঐসময় সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলার পাশাপাশি দলের প্রয়োজনে মাঝেমধ্যেই আক্রমণভাগের অন্যান্য পজিশনেও খুব সহজেই নিজেকে মানিয়ে নিতেন রুনি। নিজে গোল দেওয়া বা সতীর্থদের জন্য গোল বানিয়ে দেওয়া – উভয় ক্ষেত্রেই সমান দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন সৃষ্টিশীল এই সেন্টার ফরোয়ার্ড। ২০০৬-০৭ মৌসুমে প্রথমবারের মতো ঘরোয়া লিগ শিরোপার স্বাদ পেয়েছেন তো বটেই, ইউনাইটেডের হয়ে ২৭ ম্যাচে ১২ গোলের পাশাপাশি ১১ অ্যাসিস্ট নিয়ে সেবার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টদাতা হিসেবে মৌসুম শেষ করেছিলেন রুনি। পরবর্তী মৌসুমে ইংল্যান্ডের পাশাপাশি ইউরোপেও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল, দ্বিতীয় প্রিমিয়ার লিগ পদকের সাথে তার ক্যাবিনেটে জমা হয়েছিল উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগেরও পদক। এমনকি ২০০৮ সালের শেষদিকে, দলকে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জেতাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাবটি নিজের করে নিয়েছিলেন।
২০০৯ সালে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ক্লাব ছাড়ায় দলের প্রধান খেলোয়াড়ের ভূমিকায় আবির্ভূত হতে হয়েছিল তাকে। ২০০৯-১০ মৌসুমে লিগ শিরোপা চেলসির কাছে হাতছাড়া হলেও পুরো মৌসুমজুড়েই দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের মাধ্যমে ৩২ ম্যাচে ২৬ গোল করে প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে মৌসুমের শেষদিকে হাঁটুর ইনজুরি তাকে কিছুটা ভুগিয়েছিল।
২০০৯-১০ মৌসুমে তার এই দারুণ ফর্ম দেখে সবাই ২০১০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের হয়েও মাঠে তার ঝলকের জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু রুনি সেই প্রত্যাশাটা মেটাতে একেবারেই ব্যর্থ ছিলেন, বিশ্বকাপে এতোই বাজে খেলেছিলেন যে পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই ইংলিশ মিডিয়া ও সমর্থকরা তার সমালোচনায় মুখর ছিল।
বিশ্বকাপের হতাশাজনক অভিজ্ঞতার পর নতুন মৌসুমের শুরুতেও রুনি মাঠে ছিলেন অনুজ্জ্বল। ফলে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ঐসময় তাকে দুইটি ম্যাচে বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছিলেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রথম একাদশ থেকে বাদ পড়ায় অনভ্যস্ত রুনি এতে হতাশ হয়ে এক বিবৃতিতে ক্লাব ছাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তবে ঐ বিবৃতির কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে ৫ বছরের নতুন চুক্তিতে সই করেছিলেন, রেড ডেভিল সমর্থকরাও তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছিল। চুক্তি নবায়নের পর নিজের সমস্যাগুলোকে পেছনে ফেলে নতুন উদ্যমে পরিশ্রম করা শুরু করেছিলেন এবং ২০১১ সালের শুরু থেকেই পুরনো ধারওবাহিকতায় খেলতে দেখা যায় তাকে। ফেব্রুয়ারি মাসে তো ওল্ড ট্রাফোর্ডে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে ওভারহেড বাইসাইকেল কিকের মাধ্যমে অবিশ্বাস্য একটা গোল করে বসেন।
সিটির বিপক্ষে তার এই জয়সূচক গোলটিকে স্বয়ং স্যার এলেক্স ফার্গুসন ওল্ড ট্রাফোর্ডে তার দেখা সেরা গোলের তকমা দিয়েছিলেন। সেবার ক্লাবের হয়ে লিগ শিরোপা জিতেই থেমে থাকেননি তিনি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালেও নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।
২০১১-১২ মৌসুমেও তিনি দারুণ খেললেও (৩৪ ম্যাচে ২৭ গোল) মৌসুমের শেষ ম্যাচে এসে ম্যানচেস্টার সিটির কাছে লিগ শিরোপা হাতছাড়া করতে হয়েছিল ইউনাইটেডকে।
২০১২-১৩ মৌসুমে তিনি ক্লাবের হয়ে ২০০ গোলের মাইলফলক ছুঁয়েছিলেন। ঐ মৌসুমে পঞ্চমবারের লিগ শিরোপার স্বাদ পেলেও মৌসুম শেষে আবারও ক্লাব ছাড়ার ইচ্ছা পোষণ করেন রুনি। তবে ২০১৩ সালের গ্রীষ্মে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নতুন ম্যানেজার ডেভিড ময়েস সবাইকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে রুনি ক্লাব ছাড়ছেন না। কিন্তু স্যার এলেক্স ফার্গুসনের অবসরের পর নতুন ম্যানেজারের অধীনে ২০১৩-১৪ মৌসুমে ক্লাবের পারফরম্যান্স ছিল অত্যন্ত হতাশাজনক এবং লিগে সপ্তম স্থানে থেকে মৌসুম শেষ করতে হয়েছিল রেড ডেভিলদের। ইউনাইটেডের এমন বাজে সময়েও রুনির পরিসংখ্যান যথেষ্ট ভালো ছিল, লিগে ২৯ ম্যাচে ১৭ গোল করার পাশাপাশি ৯ ম্যাচে ৮ অ্যাসিস্ট নিয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টদাতার তালিকায় তার নাম শীর্ষে ছিল।
২০১৪ সালের বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায়ের পর ইংল্যান্ড দলের অধিনায়কত্ব পেয়েছিলেন ২৮ বছর বয়সী রুনি। একই সময় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নতুন ম্যানেজার লুই ফন গালও তাকে ক্লাবের অধিনায়ক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তার বয়স এবং মাঠে খেলা বোঝার সক্ষমতা, ভালো পাসিং রেঞ্জ ও সতীর্থদের সাথে ভালো বোঝাপড়া বিবেচনা করে লুই ফন গাল পরবর্তী দুই মৌসুম রুনিকে প্রায়ই মিডফিল্ডে খেলিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে তার নেতৃত্বে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এফএ কাপ জিতেছিল। ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে ঐ কাপ ফাইনালে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছিলেন এবং এর ফলে ১২০ মিনিটে ২-১ গোলে জেতা ঐ ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ওল্ড ট্রাফোর্ডে নিজের শেষ মৌসুমে ক্লাবের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রেকর্ডে নাম লিখিয়েছেন তিনি। ২০১৭ সালের ২১ জানুয়ারি স্টোক সিটির বিপক্ষে ফ্রি-কিক থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি গায়ে নিজের ২৫০তম গোলের মাধ্যমে স্যার ববি চার্লটনকে টপকে ক্লাবের সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডটা নিজের করে নিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ২৪ মে উয়েফা ইউরোপা লিগ জয়ের মাধ্যমে তার রেড ডেভিল জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে মোট ৫৫৯ ম্যাচ খেলে তার গোলসংখ্যা ২৫৩। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ২৫০ গোলের পর রুনির হাতে এই বিশেষ পুরস্কারটা তুলে দিয়েছিলেন স্যার ববি চার্লটন নিজে।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ১৩ বছর খেলে সবধরনের শিরোপাই জিতেছেন তিনি। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, এফ এ কাপ, ইংলিশ লিগ কাপ। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ, ইউরোপা লিগ – কোনো শিরোপাই বাদ যায়নি। শুধু ২০১৬-১৭ মৌসুম ব্যতীত ইউনাইটেডের হয়ে প্রতিটি মৌসুমেই কমপক্ষে ১০টি গোল করেছিলেন। ক্লাবের হয়ে তার দীর্ঘ ধারাবাহিকতা প্রমাণের জন্য এই পরিসংখ্যানটাই যথেষ্ট। তার বিদায়বেলায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আরেক কিংবদন্তি গ্যারি নেভিল বলেছিলেন যে ওল্ড ট্রাফোর্ডে তিনি ১৯ বছরের ক্যারিয়ারে যতো স্ট্রাইকারের সাথে খেলেছেন, তাদের মধ্যে রুনিই সেরা।
ক্যারিয়ারের অন্তিম লগ্নে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে বিদায় নিয়ে নিজের প্রথম ক্লাব এভার্টনে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি।
২০১৬ সালের ইউরোতে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে পরাজয়ের পর ইংল্যান্ড জাতীয় দলে রুনির জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, যদিও তিনি ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে খেলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ২০১৭ সালের শুরুতে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার কয়েক মাস পর তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর ঘোষণা করেছিলেন। তবে এভার্টনের হয়ে রুনির ভালো খেলা দেখে তাকে জাতীয় দলে পুনরায় ডাক দেয়ার কথা বিবেচনা করেছিলেন ইংলিশ কোচ গ্যারেথ সাউথগেট, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর ঘোষণা করায় সেটা আর সম্ভব হয়নি। অবশ্য ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে অবসর ভেঙে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের হয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন তিনি। রুনিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় সংবর্ধনা দেয়ার উদ্দেশ্যেই এই ম্যাচের জন্য তাকে ইংল্যান্ড দলে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।
জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন করতে না পারলেও ১২০ ম্যাচে ৫৩ গোল করা রুনি ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবেই তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার সমাপ্ত করেছেন।
এভার্টনের হয়ে এক মৌসুম খেলার পর তিনি মেজর লিগ সকার খেলার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ডিসি ইউনাইটেডে যোগ দিয়েছিলেন। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ১৬ বছর খেলে ৪৯১ ম্যাচে ২০৮ গোল ও ১০৩ অ্যাসিস্ট করেছেন রুনি।
ডিসি ইউনাইটেডে যোগদানের কিছুদিন পরই তিনি অরল্যান্ডো সিটির বিপক্ষে একটি ম্যাচে অবিস্মরণীয় একটি অ্যাসিস্ট করেছিলেন। খেলার অন্তিম মুহূর্তে স্কোর ছিল ২-২, ঐ সময় একটি কর্নার পাওয়ার পর ডিসি ইউনাইটেড গোলের জন্য এতোই মরিয়া ছিল যে তাদের গোলকিপারও প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে এসে অবস্থান করেছিলেন। কিন্তু কর্নারের পর অরল্যান্ডো সিটি পালটা আক্রমণে চলে যায়, গোলবার উন্মুক্ত থাকায় ডিসি ইউনাইটেডের গোল খাওয়াটা ছিল অনিবার্য। দলের সবাই আশা ছেড়ে দিলেও রুনি হাল ছেড়ে দেননি। দৌড়ে নিজেদের অর্ধে গিয়ে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের কাছে থেকে বল কেড়ে নিয়ে দলকে নিশ্চিত গোল থেকে রক্ষা করার পর প্রতিপক্ষের ডি-বক্স বরাবর সতীর্থ লুসিয়ানো আকোস্তার উদ্দেশ্যে মাপা লং পাস দিয়েছিলেন। প্রায় ৫০ গজ দূর থেকে আসা রুনির দুর্দান্ত ক্রসটা গোলে পরিণত করে দলের জয় নিশ্চিত করেছিলেন আকোস্তা। নিজে গোল না করলেও রুনির বানিয়ে দেয়া এই গোলটাই আজীবন তার পরিশ্রমী ও লড়াকু মানসিকতার সাক্ষী হয়ে থাকবে।
ডিসি ইউনাইটেডের হয়ে দুই মৌসুম খেলে মেজর লিগ সকারে ৪৮ ম্যাচে ২৩ গোল ও ১৫ অ্যাসিস্ট করার পর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বিভাগের দল ডার্বি কাউন্টিতে যোগ দেন।
ডার্বি কাউন্টির হয়ে এক বছর খেলার পর ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে ক্লাবের ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলে তিনি পেশাদার ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। বর্ণাঢ্য ফুটবল ক্যারিয়ারের পর এখন কোচের ভূমিকায়ও সাফল্যের মুখ দেখবেন কি না তা সময়ই বলে দিবে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা ওয়েইন রুনির নতুন এই অধ্যায়ের জন্য শুভ কামনা রইলো।