কি বললেন, বিপর্যয়? তা সে-রকম বিপর্যয়ে ভারতীয় ক্রিকেট এর আগেও পড়েছিল। একবার দলের প্রধানতম ছয় ক্রিকেটার বোর্ডের বিরুদ্ধে নেমেছিলেন আইনি লড়াইতে, অন্যবার বিশ্বকাপে বাজে ক্রিকেট খেলে বাদ পড়েছিল গ্রুপপর্ব থেকে, আরেকবার তো অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অস্ট্রেলীয়দের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল বানর-বিতর্কে; চাইলে খুঁড়ে-টুঁরে বের করা যাবে এমন হাজার কেচ্ছা। কিন্তু ২০১৩ সালে যা হয়েছিল, তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, এমন বিতর্কের জন্ম নতুন করেই দেয়া লাগবে। আর সববার তো প্রতিদ্বন্দ্বী মিলেছিল, সেবারে যে লড়াইটা নিজের সঙ্গেই লড়তে হয়েছিল!
২০১৩ আইপিএল ফিক্সিং-কেলেঙ্কারি, তিন বছরের সময়কালে ভারতীয় ক্রিকেটকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রথম পর্বের পর থেকে বাকিটা এবার জেনে নেওয়া যাক এই পর্বে।
গুরুনাথ মায়াপ্পনও বাজিকর
কেবলমাত্র তিন ক্রিকেটারকে শাস্তি দিয়েই তো শেষ নয়, বরং বিসিসিআইর সামনে এর চেয়েও বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন গুরুনাথ মায়াপ্পন আর রাজ কুন্দ্র। নারায়নস্বামী শ্রীনিবাসন তড়িঘড়ি করে দু’জন বিচারপতি নিযুক্ত করে চেষ্টা করেছিলেন তাদের অভিযোগ থেকে ছাড়ানোর। তবে আগেই জানানো হয়েছে, তার সেই চেষ্টা ধোপে টেকেনি। উল্টো ২২ সেপ্টেম্বর পুলিশ আদালতে যে অভিযোগপত্র জমা দেয়, সেখানে জানানো হয়, গুরুনাথ মায়াপ্পনের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া ভিজিটিং কার্ডে তার পরিচয় লেখা ছিল সিএসকের ‘টিম প্রিন্সিপাল’। প্রত্যক্ষদর্শী নরেশ হিম্মতাল মাকানির বক্তব্য অনুযায়ী, গুরুনাথ মায়াপ্পন সিএসকের মালিকই ছিলেন, এমনকি ২৪-১২-২০১১ হতে ০৯-০১-২০১২ এর মধ্যে যেকোনো একদিন আইপিএলের তৎকালীন চেয়ারম্যান রাজীব শুক্লা তাকে দলের মালিক হিসেবেই একটি ই-মেইল করেছিলেন।
পুলিশের জমা দেয়া চার্জশিটে আরও জানানো হয়, মে’র ১২ তারিখে রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে চেন্নাই সুপার কিংসের ম্যাচ চলাকালীন (স্থানীয় সময় রাত ৮:৫৮) ফোনে কথা হয় বিন্দু দারা সিং আর মায়াপ্পনের মধ্যে, যে ফোনকলে মায়াপ্পন জানান, সিএসকে ১৩০-৪০ রানের মধ্যে কোনো একটা স্কোর করবে। চেন্নাই সেদিন ১৪১ করেছিল শেষমেশ, এবং এই রানকে যথেষ্ট নয় ভেবে সিএসকের ‘টিম প্রিন্সিপাল’ হওয়া সত্ত্বেও মায়াপ্পন বাজির টাকা ফেলেছিলেন রয়্যালসের পক্ষে।
বিন্দু এবং মায়াপ্পনের মধ্যেকার এমন আরও কিছু কথোপকথনের উল্লেখ ছিল পুলিশের অভিযোগপত্রে। ১৪ মে চেন্নাই-দিল্লি ম্যাচের আগে সিএসকে দলে কোনো পরিবর্তন আসছে না এবং তারাই ম্যাচটি জিতবেন বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
পুলিশের এমন অভিযোগপত্র পাবার পর প্রথম গঠিত হওয়া তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেনি আদালত। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে বিসিসিআইর জন্যে নিযুক্ত করে তিন সদস্যের পৃথক আরেকটি তদন্ত কমিটি, এল নাগেশ্বর রাও আর আসাম ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য নিলয় দত্তকে নিয়ে গড়া কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পান মুকুল মুদগাল।
তারা দায়িত্ব নেবার পরদিনই বিসিসিআই সভাপতির দায়িত্ব ফিরে পান শ্রীনিবাসন। এক শর্তে, আইপিএল সংক্রান্ত বিষয়ে টুঁ শব্দটিও করতে পারবেন না তিনি।
মুদগাল কমিশন
ভারতীয় ক্রিকেটের ক্রান্তিলগ্নে বিচারপতি মুকুল মুদগালের অংশগ্রহণ সেবারই প্রথম নয়। ১৯৮৯ সালে ছয় ভারতীয় ক্রিকেটার (কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, দিলীপ ভেংসরকার, কপিল দেব, কিরণ মোরে, রবি শাস্ত্রী এবং অরুণ লাল) আইনি লড়াই জিতেছিলেন বিসিসিআইর বিরুদ্ধে এবং সেবার খেলোয়াড়দের পক্ষ হয়ে লড়েছিলেন এই মুদগাল। অনিয়ম-দুর্নীতি হলে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড যেকোনো স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় পড়বে না, বরং এটি নানানভাবেই ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে এবং এর বিরুদ্ধে পাবলিক ইন্টারেস্ট পিটিশন দায়ের করা চলে, ২০০১-য়ের সেপ্টেম্বরে এই মর্মে রুলও জারি করেছিলেন এই বিচারপতি। ২০১১তে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব থেকে অবসর নেয়া এই বিচারককে ২০১৩তে সুপ্রিম কোর্ট যখন আরেকবার ডেকেছিল বিসিসিআইকে উদ্ধারকরণ কার্যক্রমে অংশ নিতে, এক সাংবাদিককে মজা করে তিনি তাই বলেছিলেন,
‘I don’t think the BCCI will be very keen to have me on the panel.’
দায়িত্ব পেয়েই কমিশনের সদস্যরা মুম্বাই পুলিশ, গুরুনাথ মায়াপ্পন, শ্রীনিবাসন থেকে শুরু করে কথা বলেন সৌরভ গাঙ্গুলি, জগমোহন ডালমিয়ার সঙ্গেও। অতঃপর ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ তারিখে জনসম্মুখে জানান দেন তাদের ৮৫-পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের। আগের কমিশনের প্রতিবেদনের সঙ্গে ১৮০° বৈপরীত্য রেখে মুদগাল কমিশন জানান, রাজ কুন্দ্র এবং গুরুনাথ মায়াপ্পনের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগই সত্য বলে মানেন তারা। তারা দু’জনে আইপিএল অপারেশন রুলসের ২.২.১ ও ২.১৪ ধারা, আইপিএল অ্যান্টি-করাপশন কোডের ২.২.১, ২.২.২ ও ২.২.৩ ধারা এবং আইপিএল কোড অব কন্ডাক্ট ফর প্লেয়ারস অ্যান্ড টিম অফিসিয়ালসের ২.৪.৪ ধারা ভঙ্গ করেছেন বলে মত দেয় কমিশন। সিএসকে যে প্রতিনিয়ত দাবি করে আসছিল, মায়াপ্পন তাদের মালিকপক্ষের কেউ নন, এ প্রসঙ্গে কমিশন মন্তব্য করেন,
‘The franchisee appears to be contradicting the factual position as has already been observed by the committee.’
শ্রীশান্তসহ যে পাঁচ ক্রিকেটারকে শাস্তি দিয়েছে বিসিসিআই, তাও যে যথোপযুক্ত, তাদের রিপোর্টে লেখা হয়েছিল এমন কথাও। সঙ্গে সঙ্গে সিলগালা খামে করে সুপ্রিম কোর্টে মুদগালের নেতৃত্বাধীন কমিশন ‘কাদের বিরুদ্ধে খেলাধুলায় জোচ্চুরির অভিযোগ আছে’ শীর্ষক একটি চিঠিও পাঠান। অনেক খুঁড়ে ১৩ জনের নাম ছিল সেই খামে, এতটুকুন জানলেও সেই ১৩ জনের মধ্যে থাকা গুরুনাথ মায়াপ্পন, নারায়নস্বামী শ্রীনিবাসন আর রাজ কুন্দ্র ছাড়া আর কারও নামই জানা যায়নি স্পষ্ট করে। কেননা, ওই নামগুলো কেবলমাত্র দায়িত্বরত বিচারপতিদের জানবারই এখতিয়ার ছিল।
ধোনি কি ফিক্সিংয়ে জড়িত ছিলেন?
কিন্তু যা কিছু গোপন কিংবা নিষিদ্ধ, তার প্রতিই যে মনুষ্যজাতির আকাঙ্ক্ষাটা চিরকালীন। পষ্টাপষ্টি কারও নাম জানা যায়নি বলেই গুঞ্জন উঠেছিল নানা নামকে ঘিরে, এর মধ্যে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে নিয়ে ওঠা জলঘোলা হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। চেন্নাই সুপার কিংসের অধিনায়ক হবার পরেও ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে তার দলের নাম আসা অবধি এ নিয়ে একবারও সাংবাদিকদের সামনে মুখ খোলেননি তিনি। আর মুখ খোলেননি বলেই সাংবাদিকেরা তার নামে কেচ্ছা রটানোর সুযোগ পেয়েছিলেন আরও বেশি করে। এর মধ্যে ‘জি মিডিয়া কর্পোরেশন’ এবং ‘নিউজ ন্যাশন প্রাইভেট লিমিটেড’ নামক দু’টি বেসরকারি গণমাধ্যম ফিক্সিংয়ে ধোনির সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রমাণে নেমেছিলেন আঁটঘাঁট বেঁধে। কুমার বলে এক সাংবাদিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি করে বেড়ান, ১২ মে ২০১৩-য়ের রাজস্থান রয়্যালস বনাম সিএসকের ম্যাচের ফিক্সিংয়ে ধোনিরও অংশ ছিল বলে কমিশনকে জানিয়েছিলেন এক বুকি। কিন্তু ধোনির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি মুদগাল কমিশন কিংবা সুপ্রিম কোর্ট। উল্টো, ধোনি চার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শতকোটি রুপির মানহানির মামলা ঠুকে দিলে মাদ্রাজ হাই কোর্ট ওই সংবাদমাধ্যমগুলোকে নির্দেশ দেয়, ধোনি সংক্রান্ত যেকোনো খবর প্রচার থেকে বিরত থাকতে।
ধোনিকে নিয়ে তখন অভিযোগ ছিল আরও একটি। গুরুনাথ মায়াপ্পন সিএসকের কোন পদে আছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় মুদগাল কমিশন এমএস ধোনির কাছেও জানতে চেয়েছিলেন এই প্রশ্নের উত্তর। এবং ধোনির উত্তর পেয়ে মুদগাল কমিশনের রিপোর্টে লেখা হয়:
“Mr MS Dhoni, Mr N Srinivasan and officials of India Cements took the stand that Mr Meiyappan had nothing to do with the cricketing affairs of Chennai Super Kings and was a mere cricket enthusiast supporting Super Kings.”
কিন্তু এই সরল স্বীকারোক্তিতে সিএবির কৌসুলি হরিশ সালভে খুঁজে পান অপরাধের গন্ধ। তার মতে, ধোনি মায়াপ্পনের সঙ্গে সিএসকের সংশ্লিষ্টতার পুরোপুরিটাই জানতেন এবং জেনেশুনেই তথ্য গোপন করেছেন। আর বিসিসিআই কিংবা আইসিসির কোড অব কন্ডাক্টের ধারা মতে, অন্যের অপরাধ গোপন করা ব্যক্তিও সমানমাত্রায় দোষী। অতএব, ধোনিরও শাস্তি প্রাপ্য।
তবে ধোনি ভুল কিছু করেছেন, এমন কোনো প্রমাণ সুপ্রিম কোর্ট পায়নি। তিনি ধোনি বলেই আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে গিয়েছেন, এমন কিছুও ভাববার সুযোগ নেই। কেননা, সুপ্রিম কোর্ট বিন্দুবিসর্গ সন্দেহ ব্যতিরেকেই ‘নির্দোষ’ ছাড়পত্র দিয়েছিল অভিযোগ ওঠা সকল ক্রিকেটারকে।
বিসিসিআইতে রদবদল, আরেকবার
যাদের ঘিরে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ উঠেছিল আইপিএলে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা যৌক্তিক কি না, এর বাইরে মুদগাল কমিশন তাদের রিপোর্টে সুপ্রিম কোর্টকে পরামর্শ দিয়েছিল আইপিএল এবং বিসিসিআইর স্বচ্ছতা আনয়নকল্পেও। মার্চের ২৫ তারিখ থেকে সেই পরামর্শগুলোই বিসিসিআইকে জানাতে শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট, যার সর্বপ্রথম কোপটাই গিয়ে পড়ে শ্রীনিবাসনের ওপর। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ তাকে অনুরোধের সুরে আদেশ দেয়, বিসিসিআইর সভাপতি পদ থেকে সরে দাঁড়াতে, এবং দায়িত্বটা সাবেক ভারতীয় ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কারের হাতে তুলে দিতে। দু’দিন বাদের শুনানিতে আরও বড় রদবদলের পরামর্শ আসে সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকে। সিএসকের স্বত্ত্বাধিকারী ইন্ডিয়া সিমেন্টসের কর্মচারীবৃন্দ, যারা কি না বিসিসিআইতেও বসে ছিলেন আসন গেড়ে, তাদের প্রত্যাহার চেয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। এবং সবচেয়ে বড় আঘাত হয়ে আসে, সুপ্রিম কোর্ট যখন চেন্নাই সুপার কিংস এবং রাজস্থান রয়্যালসের নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করে শুনানিতে।
এই শেষের দাবিটি ছাড়া অন্য দাবিগুলো বিসিসিআই মেটাতে শুরু করে দিয়েছিল সাততাড়াতাড়িই। ২০১৪ সালের আইপিএল-সংক্রান্ত বিষয়াদিতে বিসিসিআই প্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন সুনীল গাভাস্কার, আর আইপিএলের বাইরের সমস্ত ব্যাপারে বোর্ডের সবচেয়ে প্রবীণ সহসভাপতি শিবলাল যাদব দেবেন নেতৃত্ব – এমন ঘোষণা এসেছিল এসেছিল মার্চের ২৮ তারিখে। পরদিনই মেনন সতীশকে লজিস্টিক ম্যানেজারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে বাস্তবায়ন শুরু হয় ইন্ডিয়া সিমেন্টসের কর্মচারীদের অপসারণ প্রকল্পের। তবে আইসিসিতে বিসিসিআই’র প্রতিনিধির পদটা তখনো শ্রীনিবাসনের অধীনেই ছিল। বিসিসিআইর অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে সুপ্রীম কোর্টও জড়ায়নি এ দ্বন্দ্বে। তবে ক্রিকেটারদের বৈশ্বিক সংগঠনের প্রধান ফিকা শীঘ্রই জানিয়ে দিয়েছিল তাদের বিবৃতি। যিনি বিসিসিআইর দায়িত্বেই নেই, তিনি কী করে আইসিসিতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন, তা তার বোধগম্য হচ্ছে না বলেই ফিকা প্রধান পল মার্শ জানিয়েছিলেন তখন।
মার্শের দাবিটা বৈশ্বিক হয়ে উঠবার আগেই শ্রীনিবাসন ফিরতে চেয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের দায়িত্বে, তবে সুপ্রিম কোর্ট তাকে বাইরে রেখেছিল সমস্ত অনুরোধের পরও। উল্টো ১৬ এপ্রিলের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট জানায়, মুদগাল কমিশন যে ১৩ জনের ব্যাপারে তদন্ত করতে বলেছিল, নারায়নস্বামী শ্রীনিবাসন সে তালিকার ১৩ নম্বর। এমন আসামীর হাতে তারা তো ক্ষমতা তুলে দেবেই না, উল্টো শ্রীনিসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে বিসিসিআইকে নিরপেক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠনের আদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের আদেশ পেয়ে বিসিসিআই তিন সদস্যের কমিটি গঠন করতে চেয়েছিল আরকে রাঘবন, জেএন প্যাটেলের সঙ্গে রবি শাস্ত্রীকে নিয়ে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সে কমিটি পছন্দ হয়নি, তারা আরও একবার তদন্ত করতে ডেকেছিল মুদগাল কমিশনকে। আগের তিন সদস্যের সঙ্গে এবারে অবশ্য জুড়ে গিয়েছিলেন আরও দু’জন, আইপিএস অফিসার বিবি মিশ্র এবং সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে সৌরভ গাঙ্গুলি।
আরও একবার অনুসন্ধানের পর এই পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় একই বছরের ৩রা নভেম্বর। রাজ কুন্দ্র, গুরুনাথ মায়াপ্পনের সঙ্গে সঙ্গে বিসিসিআই সভাপতি নারায়নস্বামী শ্রীনিবাসন আর আইপিএলের চীফ অপারেটিং অফিসার সুন্দর রমনেরও যে আইপিএলে ফিক্সিং-কেলেঙ্কারির ঘটনাপ্রবাহে যোগসাজশ ছিল, রিপোর্টে উল্লেখ ছিল এমন কথাই। শ্রীনিবাসন কিংবা রমন ম্যাক্স-গড়াপেটায় জড়িত ছিলেন বা ম্যাচ নিয়ে বাজি ধরেছিলেন, এমন কিছু অবশ্য নয়। শ্রীনিবাসন জানতেন, একজন ক্রিকেটার কোড অব কন্ডাক্ট ভঙ্গ করছেন; তবুও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। রমন একজন বুকিকে চিনতেন এবং ওই বুকি তার সঙ্গে এক মৌসুমে আটবার যোগাযোগ করবার পরেও তদন্ত কমিশনের কাছে দাবি করেছিলেন, ‘আইপিএলের বাজি-সংক্রান্ত ব্যাপারে আমি অজ্ঞাতবাসে রয়েছি।’ এমনকি গুরুনাথ মায়াপ্পন, রাজ কুন্দ্র বাজি লাগাচ্ছেন, এমন তথ্য জানবার পরেও কোনো ব্যবস্থা নেননি বলে লেখা হয়েছিল চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে।
সঙ্গে যে তিন ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে তদন্ত করবার সুপারিশ ছিল মুদগাল কমিশনের প্রথম রিপোর্টে, তারাও যে কোনোরূপ সন্দেহ ছাড়াই নির্দোষ, মুদগাল কমিশন এমন কথা লিখেই ইতি টেনেছিল তাদের তদন্তের।
এরপর কী?
এই তদন্তের পর আর কোনো সময়ক্ষেপণের মধ্যে দিয়ে যেতে চায়নি সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট তাদের বিচার জানিয়ে দেয় বিসিসিআইকে। মেয়ে-জামাইকে বাঁচাতে তদন্ত ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন, এমন অভিযোগ থেকে তাকে মুক্তি দিলেও এবারে সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল শ্রীনিবাসনকে, বেছে নিতে হবে বিসিসিআই কিংবা সিএসকের যেকোনো একটিকে। কেননা, এতে স্বার্থের সংঘাতটা দেখা দেয় প্রকটভাবে। বিসিসিআইর গঠনতন্ত্রের যে ৬.২.৪-ধারার বলে শ্রীনিবাসনসহ বিসিসিআই’র অন্যেরা ফ্র্যাঞ্চাইজি দলেরও অংশ হতে পারতেন, আদালত দাবি করে সেখানে সংশোধন আনয়নেরও। ২০১৫ আইপিএলে সিএসকে কিংবা রাজস্থানের অংশগ্রহণের অনাপত্তিপত্রও এদিনই দিয়েছিল আদালত। তবে সঙ্গে সঙ্গে নতুন আরেকটি কমিটি গঠন করে দিয়ে কোর্ট এ-ও জানিয়ে দেয়, ফ্র্যাঞ্চাইজি দু’টি কি পরিমাণ শাস্তির মুখোমুখি হবে, আদৌ হবে কি না, তা নির্ধারণ করবে ওই কমিটিই।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছ থেকে এমন আদেশ প্রাপ্তির পরে উচ্চবাচ্যের আর তো কোনো সুযোগ থাকে না। শ্রীনিবাসনও আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি পরবর্তী বিসিসিআই সভাপতি নির্বাচনে। অবশ্য সে সিদ্ধান্ত জানাবার আগেই আদালতের নির্দেশ অমান্য করে আইপিএলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন তিনি। আর আদালতে সেই অন্যায়ের কথা তুলবার জন্যে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বিহারের প্রতিনিধি তো তৈরিই ছিলেন।
চারিদিকে এত বিরুদ্ধমতের চাপে কোনোকিছু করেই পার পাননি শ্রীনিবাসন, বিসিসিআইতে (আইসিসিতেও কি নয়?) শেষ হয়েছিল শ্রীনি-রাজত্বের। তখন কেবল বিসিসিআই’র সামনে একটিই ঝঞ্ঝা, আইপিএল থেকে সিএসকে-রাজস্থানকে নিষিদ্ধ করা।
চেন্নাই-রাজস্থানের নিষেধাজ্ঞা, শ্রীশান্তের মুক্তি
আইপিএলের অষ্টম আসর শেষ হবার মাসদুয়েকের মধ্যেই আরএম লোধার নেতৃত্বাধীন কমিটি জানিয়ে দিয়েছিল সাজার পরিমাণ। চেন্নাই সুপার কিংসের মালিক ইন্ডিয়া সিমেন্টস এবং রাজস্থান রয়্যালসের মালিকপক্ষ জয়পুর আইপিএল নিষিদ্ধ হয়েছিল দুই মৌসুমের জন্য। আর যাদের জন্যে এত হ্যাপা, সেই গুরুনাথ মায়াপ্পন আর রাজ কুন্দ্রের কপালে নিষেধাজ্ঞার খড়্গটা নেমেছিল আজীবনের জন্য।
বিসিসিআইর তরফ থেকে শ্রীশান্ত, চাভানের ওপর আজীবনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল আগেই। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে তো মামলা লড়ছিল মুম্বাই পুলিশও। কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণাদির অভাবে দিল্লির এক ট্রায়াল কোর্ট ২০১৫তে এসে তাদেরকে মুক্তি দেয় অভিযোগ থেকে। যদিও এ খবর প্রকাশ পাবার পরই বিসিসিআই জানিয়ে দেয়, এতে তাদের তরফ থেকে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার নড়চড় হবে না একটুও।
নড়চড় অবশ্য হয়েছিল, কেবল শ্রীশান্তের ক্ষেত্রে। একপক্ষ থেকে মুক্তিসনদ নিয়ে শ্রীশান্ত লড়াইতে নামেন বিসিসিআই’র আজীবন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে। প্রথমে কেরালার আদালত থেকে আদেশপত্র নিয়ে এসেছিলেন আজীবন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে। সেটা বিসিসিআই মানতে রাজি না হলে তাদের দাঁড় করিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টে। সেখান থেকে আজীবন নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ কমানোর আদেশ এলে বিসিসিআই তা নামিয়ে আনে সাত বছরে।
অবশেষে এ বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর ফুরিয়েছে তার ৭ বছরের নিষেধাজ্ঞা। শ্রীশান্ত এমন তোড়জোড় করছেন দেখে বিসিসিআইতে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ কমানোর আর্জি করেছিলেন অঙ্কিত চাভানও। দু’জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তো একই ছিল! এ বছরের জুলাইয়ের দুই তারিখে করা সে আর্জির ফলাফল অবশ্য জানা যায়নি এখনো। জানা যায়নি অজিত চান্দিলার ভাগ্যলিখনও। অবশ্য তাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কিংবা হবে কি না, বিসিসিআই তো কখনো সুস্পষ্ট করে বলেইনি সে কথা।
বিসিসিআই এখন আর তাদের নিয়ে ভাবে কি না, কে জানে! বড় বড় যুদ্ধে এমন দুয়েকটা সৈন্যের জীবন তো গিয়েই থাকে!