ধরুন, সারাদিনের কর্মক্ষেত্রের খাটুনির পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে আপনি কোনো ফুটবল ম্যাচ দেখার জন্য মনস্থির করলেন। ঐ ম্যাচের ৯০ মিনিট থেকে আপনি কী আশা করবেন? অথবা পুরো বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্যেক ফুটবল ভক্তরা আসলে কী দেখতে চান? অবশ্যই ম্যাচের ফলাফল একটি বড় বিষয়, কিন্তু একটা ম্যাচ বা ৯০ মিনিটে আপনি আসলে পেতে চান রোমাঞ্চ। একজন খেলোয়াড় বল নিয়ে কারিকুরি করছেন, প্রতিপক্ষ্যের ডিফেন্ডারদের পাশ কাটিয়ে ছুটে চলেছেন নিপুণ দক্ষতার সাথে বা দুর্দান্ত ফ্রি-কিক, দুর্দান্ত গোল, অথবা একজন খেলোয়াড়ের ক্যারিশম্যাটিক চরিত্র — এসবই তো আপনাকে ফুটবলের রোমাঞ্চ এবং আনন্দ এনে দেবে।
হয়তো ফুটবল আপনার ধ্যানজ্ঞান। আপনি বোঝেন মাঠে বুসকেটস গোল না দিয়েও কী করতে পারেন। অথবা জানেন কান্তে, ক্যাসেমিরো বা রদ্রিদের খেলাটা ঠিক কেমন। কিন্তু খুব সাধারণ দর্শক এতসব বুঝবেন না। তারা খোঁজেন ধারাবাহিক পারফরম্যান্স, নিয়মিত গোল।
মেসি বা রোনালদোর কথা ধরুন। কেন তাদের খেলা ছেলে-বুড়ো সবাই পছন্দ করে? ঠিক এজন্যই। নেইমার ছিলেন এই প্রসঙ্গের এক অনন্য সংযোজন। এমনিতেই ব্রাজিল থেকে এসেছেন, ব্রাজিলের পিচঢালা রাস্তা বা এঁদো গলিতে নেইমার বল নিয়ে নেচেছেন। ফুটবলের সাথে তার সম্পর্ক প্রেমিকার মতো। দুর্দান্ত গতি, নিখুঁত ড্রিবলিং, ধারাবাহিক পারফরম্যান্স, নিয়মিত গোল — নেইমার ছিলেন ফুটবলের একটা সম্পূর্ণ ম্যাজিক্যাল বক্স। সাথে ছিল তার ক্যারিশম্যাটিক চরিত্র। এইসব কিছু মিলে নেইমার ছিলেন আদতেই মেসি এবং রোনালদোর যোগ্য উত্তরসূরী। না, শুধু কাগজে-কলমে আর মুখের কথায় নয় — নেইমার প্রমাণ দিয়েছিলেন ইউরোপিয়ান ফুটবল মঞ্চেও।
ব্রাজিল থেকে তো কত ফুটবলারই ইউরোপের মঞ্চে আসে। কেউ সেই মঞ্চ আলোকিত করে, আবার অনেকেই মঞ্চের আলোর পেছনের অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে একেবারেই হারিয়ে যান। ব্রাজিলের কষ্ট এবং বিষাদের জীবন ছেড়ে ইউরোপে এসে অনেকেই রঙিন চশমা পরে ফেলেন। এরপর একটু একটু করে তলিয়ে যান অথৈ সাগরে। বার্সেলোনা তখনও নেইমারকে দলে টানেনি। কিন্তু সান্তোসে থাকাকালীন সময় থেকেই পুরো বিশ্ববাসী জানত, ব্রাজিল থেকে একজন আসছে। লম্বাটে মুখ, চুলগুলো খাঁড়া খাঁড়া। বার্সার হয়ে নাম লেখানোর আগে তিনি সান্তোসের হয়ে ২২৬ ম্যাচে ১৩৬ গোল করেছিলেন।
ইউরোপে মাত্র এসেছিলেন, তাও বার্সার মতো জায়ান্ট এক ক্লাবে। ‘১৩-‘১৪ মৌসুমটা দলের সাথে মিলিয়ে নিতে নিতেই চলে গেল। ঐ মৌসুমে ৪৫ ম্যাচে ১৫ গোল এবং ১৫ অ্যাসিস্ট। নামের পাশে সংখ্যাগুলো খুব একটা মন্দ না, কিন্ত বার্সা তাকে বেশ বড় একটা অর্থের বিনিময়ে দলে টেনেছে। তাছাড়া ততদিনে নেইমারের নামডাকও হয়েছে বেশ। সান্তোসে থাকাকালীন সময় থেকে গুঞ্জন, এই ব্রাজিলিয়ান একেবারে ঈশ্বরের উপহার।
সেই নেইমার খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এলেন পরের মৌসুমে। বার্সেলোনার মতো দলে মেসি এবং সুয়ারেজের সাথে খেলছেন, নিজের মাত্র দ্বিতীয় মৌসুম। কিন্তু নেইমারের পারফরম্যান্স দেখে তা মনে হয় না। ঐ যে প্রথমে বললাম, দর্শকেরা দিন শেষে ফুটবল থেকে রোমাঞ্চ এবং আনন্দ পেতে চায়। নেইমারের ঐ মৌসুমের পারফরম্যান্স দর্শকদের নিখুঁত আনন্দ দিয়ে আসছিলেন। মেসি এবং সুয়ারেজের পাশে খেলেও নেইমারের একক পারফরম্যান্স ঠিকই বোঝা যেত। প্রতিটা ম্যাচে তার ইমপ্যাক্ট, বলের সাথে তার প্রেম এবং সেই প্রেমিকার সাথে নৃত্য — নেইমারের খেলা দেখাই যেন চোখের শান্তি। অতিমানবীয় জাদু ছিল সেই মৌসুমের পারফরম্যান্সে, বিশ্ববাসী বুঝে গিয়েছিল এই সেই ছেলে; মেসি ও রোনালদোর সিংহাসন একদিন এই ছেলের হবে। ব্যালন ডি’অর? মেসি আর রোনালদো যুগের অবসান ঘটিয়ে নেইমারই প্রথম সেই ঐ আরাধ্য ট্রফি ঘরে তুলবে। ব্রাজিলের ফুটবল হেরিটেজ হয়তো একেই বলে।
কিন্তু নিখুঁত সবাই হয় না। আর নেইমারের মতো আক্রমণাত্মক ফুটবলার প্রতিপক্ষের কাছে একটু বেশিই ফাউলের শিকার হন। কারণ এমন ফুটবলারের গতি, বল নিয়ে কারিকুরির সাথে না পেরে উঠে তারা শেষমেশ যে শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করেন, তার নাম ফাউল। তাই নেইমারের মতো ফুটবলাররা চোটে পড়েন একটু বেশি। কিন্তু নেইমার যেন জন্মগতভাবেই একটু বেশিই ইনজুরিতে পড়তেন। বার্সায় থাকাকালীন সময়ে প্রথম মৌসুমেই দেখা গেল দলের হয়ে ইনজুরিতে পড়লেন মোট তিনবার; দুইবার গোড়ালির ইনজুরি আর একবার পায়ের ইনজুরি। তাতে প্রায় দুই থেকে তিন মাসের মতো বাইরে থাকলেন। সেবার বিশ্বকাপের বছর ছিল। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপে যথারীতি নেইমার ছিলেন দুর্দান্ত। পাঁচ ম্যাচে করেছিলেন চার গোল এবং এক অ্যাসিস্ট। এরপর কলম্বিয়ার বিপক্ষে নেমে পিঠের ভাটিব্রা ভেঙে স্বপ্নভঙ্গ।
সহজ ভাষায় বলতে, ব্রাজিলিয়ানরা স্থানীয় লিগ থেকে সরাসরি ইউরোপে এসে উচ্ছন্নে যান। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ রোনালদিনহো। পূর্বসূরীদের দেখানো পথে না হেঁটে নেইমার আবার কোথায় যাবেন? তিনি নিজেও পার্টি, আড্ডাবাজি পছন্দ করতেন। কিন্তু বার্সেলোনায় তার সবকিছুই একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে ছিল। বার্সার তখনকার কোচ লুইস এনরিকে ছিলেন কড়া হেডমাস্টার ধরনের। তাই ড্রেসিংরুম খুব ভালোভাবে সামলাতে পারতেন তিনি। এজন্য নেইমারের পারফরম্যান্সে কখনো ভাটা পড়েনি। ‘১৫-‘১৬ মৌসুমে ৪৯ ম্যাচে ৩১ গোল এবং ১৫ অ্যাসিস্ট, ‘১৬-‘১৭ মৌসুমে ২০ গোল এবং ২৬ অ্যাসিস্ট; নেইমারের নিয়মিত আনাগোনা থাকত ব্যালন ডি’অর, ফিফা বেস্ট, উয়েফা বেস্টের নামের তালিকায়। আদতেই তিনি তখন ফুটবলের সুপারস্টার।
পিএসজি ততদিনে নতুনভাবে দল গোছাচ্ছে। দলে একজন সুপারস্টারের অভাব। তাদের চোখ পড়ল এই নেইমারের দিকে। ২২২ মিলিয়ন ইউরোর বিশ্ব রেকর্ড গড়ে নেইমার পাড়ি জমালেন পিএসজিতে। তখন গ্যারি লিনেকার একটা কথা বলেছিলেন,
“হায় নেইমার! বার্সেলোনা ছেড়ে তুমি ক্যারিয়ারের একটা মাত্র দিকেই যেতে পারবে। আর সেটা হল পেছন দিকে।”
কেউ কি ভেবেছিলেন লিনেকারের বলা এই কথা কোনোদিন সত্যি ফলে যাবে?
পিএসজি গিয়ে নেইমারের গোল এবং অ্যাসিস্টের পরিমাণ কমে গিয়েছিল এমন নয়। তার মতো পারফর্মার মাঠে নামলেই গোল করেন। কিন্তু নেইমার পিছিয়ে যাচ্ছিলেন এই মাঠে নামা থেকেই। পিএসজি গিয়েই পায়ের মেটাটারসাল দুইবার ভাঙলেন। ‘১৯-‘২০ মৌসুমে নেইমার প্রায় পুরোটা মৌসুম কাটালেন বিভিন্ন ইনজুরি আর ফিটনেস সমস্যায়। ঐ এক মৌসুমেই ফুটবল থেকে তিনি বেশ খানিকটা পিছিয়ে গেলেন। পরের মৌসুমেও একই গল্পের পুনরাবৃত্তি, অ্যাবডাক্টর আর গোড়ালির ইনজুরি বারবার হানা দিতে লাগল। পিএসজির হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে তিনি থাকলেন মাঠের বাইরে। গত মৌসুমে মাঠে রিদম মাত্র খুঁজে পাওয়া শুরু করেছিলেন, ঠিক তখনই আবার গোড়ালির ইনজুরির হানা। নেইমারের পুরো মৌসুমটাই গেল শেষ হয়ে। হয়তো ইউরোপের অধ্যারের সমাপ্তিও ঠিক তখনই লেখা হয়ে গেছে।
এই ইনজুরিগুলো নেইমারকে ক্রমাগত ফুটবল থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। ফুটবলের বাইরে থেকে নেইমার শুরু দেখেছেন অর্থ আর জীবনের উপভোগ্যতা। নেইমার পা হড়কেছেন, ডুবেছেন অথৈ সাগরে। যে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী তাকে করা হয়েছে, সেই সিংহাসনের দখন নিয়েছে অন্যরা। নেইমার পারেননি। যে মেসি রোনালদোর সাথে তার তুলনা করা শুরু হয়েছিল, সেই মেসি বিশ্বকাপ জিতেছেন, জিতেছেন ক্যারিয়ারের প্রায় সবকিছু। রোনালদো জিতেছেন ইউরো, ক্লাবের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসের অন্যতম সফল খেলোয়াড় তিনি। এই দুই মহারথী হাতভরা সাফল্য নিয়ে ইউরোপের পাঠ চুকিয়ে আজ আমেরিকা আর সৌদি আরবে। সেখানে নেইমার ইউরোপের মায়া ত্যাগ করলেন মাত্র ৩১ বছর বয়সে, প্রায় শূন্য হাতে। পিএসজি থেকে যাচ্ছেন সৌদি আরবে; আর তার পিছুপিছু যাচ্ছে নিজের ব্যর্থতা, দুর্ভাগ্য এবং আক্ষেপগুলো।
অনেকে হয়তো শুনে হাসবেন, কিন্তু গত ২০ বছরে নেইমারের মতো একজন গিফটেড ফুটবল তারকা খুবই কম এসেছে। ইনজুরির প্রকোপ থেকে উঠে এসে বার্সার ক্যাম্প ন্যু থেকে পিএসজির পার্ক দে প্রিন্সেস বা বাংলাদেশের কর্দমাক্ত মাঠ; নেইমার এই পৃথিবীর মাটিতে যেখানে খেলবেন, সেখানেই তার খেলার উপভোগ্যতা টের পাওয়া যাবে। শুধু নেইমার নিজের সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দিতে পারলেন না। রবিনহো, পাতো, আদ্রিয়ানো, গানসো, অস্কার, জোদের মতো ব্রাজিলিয়ানদের দেখানো রাস্তাতেই তিনি হাঁটলেন। রোনালদিনহোর প্রসঙ্গ অনেকেই টানবেন, কিন্তু ক্যারিয়ার সায়াহ্নের আগে তিনি বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন। ব্যালন ডি’অর রয়েছে তার ব্যক্তিগত অর্জনের ঝুলিতে। নেইমার তো এর ধারেকাছেই যেতে পারেননি।
আল-হিলাল বিশাল অঙ্কের বেতনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই ট্রান্সফার থেকে পিএসজিও আয় করবে ১০০ মিলিয়ন ইউরো। চুক্তিতে তিন পক্ষই তাই খুশি। নেইমার এখন দু’হাত ভরে অর্থ কামাবেন। ফুটবলটা তো খেলবেনই। কিন্ত ইউরোপের অমীমাংসিত মিশন ফেলে রেখে সৌদি প্রিমিয়ার লিগের ফুটবলটা কোন কাজে আসবে? আগামী বছর কোপা আমেরিকা এরপর দেখতে দেখতে ২৬’ বিশ্বকাপ চলে আসবে। ভিনিসিয়ুস, অ্যান্থনি, রাফিনহা এবং রদ্রিগোদের মাঝে কবে না আবার ব্রাজিল দলের স্থানটা খুইয়ে বসেন।
ইতিহাস হয়তো তাকে মনে রাখবে ফ্লপ খেলোয়াড় হিসেবেই। অথবা ব্রাজিলের সব থেকে ব্যর্থ তারকা হিসেবে। আসলে নেইমার বিশাল এক আক্ষেপের নাম। একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আক্ষেপ।